প্রেক্ষাপট – বাংলা হরর
“আজ কোথায় ডিউটি পড়েছে আমার? সেই ঢরঢরে গোবিন্দপুরে নাকি?” স্নিগ্ধ একটু গলা চড়িয়ে বলল। গত রাতের ঘোর এখনও হয়তো কাটেনি, বিপিনবাবুর সুধা পেটে পড়লেই এই স্নিগ্ধ আকার ছাড়িয়ে উড়ে যায়। আর হবে নাই বা কেন, ঘরে তো থাকে একা। তিনকুলে কে আছে জানা নেই, কিন্তু একটা বান্ধবী জুটিয়েছে বছর খানেক হল। যদিও আজ পর্যন্ত তাকে নিজের কাজের ব্যাপারে জানাতে সাহস পায়নি। জানিয়েও কী হবে? বড় জোর ছেড়ে চলে যাবে। তার থেকে আপাতত এই চলুক, সত্য লুকিয়ে।
আধা টাক মাথাওয়ালা বেকুব ভাই মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “ভাই, তুই আমার অনেক উপকার করিস, তাই তোকেই এই কাজের দায়িত্ব দিয়ে একটু শান্তি পাই। তুই না থাকলে আমিও কি করে খেতাম বল তো?”
“থাক থাক, আর মাখন মারতে হবে না। বললাম তো কোথায় যেতে হবে বলে ফেলো?” স্নিগ্ধ বলল।
“বেশী দূর নয়, মধ্যমগ্রাম এর একটা বাগানবাড়িতে। “
“বাগানবাড়িতে কেন? এতদিন লোকের ঘরে যেতাম, কখনও কারোর ফ্ল্যাটে যেতাম, এখন আবার এসব কোথায় যেতে বলছ আমায়? “
“ভয় পাস না বেটা, কিছু হবে না। বাগানবাড়ির একমাত্র মালকিন ছিল সে। ওঁর যে কাজের লোক ছিল, সে ফোন করে আমায় খবর দিল এই একটু আগে। তিনকুলে কেউ নেই।
একটা বিশাল বাগানবাড়ি রয়েছে, সেটায় মালকিন আর ওই চাকরানী থাকত।
কাল ভোর রাতেই উনি… বেশ কিছু দিন ধরে ভুগছিলেন। তুই বেটা আর সময় নষ্ট করিস না, বেড়িয়ে পড় রামরাম বলে।”
“ঠিক আছে, কিছু টাকা ছাড়ো যাতায়াতের, কাল সকালে আসার সময় কোটা ভর্তি করে আনতে হবে বোতল।”
দুটো কড়কড়ে ৫০০ টাকার নোট প্যান্টের পেছনের পকেটে গুঁজে বাইপাস থেকে বাস ধরল, সি–১৪/১, সোজা মধ্যমগ্রামে নামাবে ওটা।
বাসটা ফাঁকা বলা যায়। জানালার কাছে বসে পড়ল স্নিগ্ধ। মনে মনে ভাবল এখন একটা টানা ঘুম দিলে কেমন হয়, যেতে এখনও কম করে মিনিট চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ তো বটেই। সবে বিকেল ৪টে বাজে, অন্ধকার হওয়ার আগেই ও বডি নিজের জিম্মায় নিয়ে নেবে।
পেছন দিকে একটু হেলান দিয়ে চোখটা বুজিয়ে ফেলল।
মনে মনে আবার লড়াই শুরু হল।
কী বলবে বারবার নিজের বান্ধবীকে? প্রথম রেহা যেদিন ওর কাজের কথা জানতে চেয়েছিল, স্নিগ্ধ সেদিন মিথ্যে বলে এড়িয়ে দিয়েছিল। আর প্রতিবার সেটাই কায়দা করে করে, কিন্তু আর কতবার এড়িয়ে যাবে?
কাজের কথা কী করে বলবে?
মৃতদেহ পাহারা দেওয়াটা কোনও সভ্য কাজের মধ্যে পড়ে যে মুখ ভারী করে বলতে হবে? তাও সাধারণ নয়, ছোঁয়াচে রোগীর মৃতদেহ।
করোনা বা এমন কোনও ছোঁয়াচে রোগ হলে, পরিবারের লোক সেই দেহ হাতে নিতে চায় না। সরকার থেকে সেটা পুড়িয়ে ফেলা হয় সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে।
গত কিছু সপ্তাহ ধরে এই ‘করোনা’ এতটাই প্রকোপ ফেলেছে, যে শব্দটা নিজেই ভয়াবহ ভাবে শরীরের আগে ঢুকে গেছে মানুষের মনে, মস্তিষ্কে।
কোনও পরিবার যদি জানতে পারে নিজদের কারোর এই রোগ হয়েছে, তাকে এক ঘরে করে দেয়। আর তারপর যদি সে মারা যায়, তারা সৎকার করতে হিমসিম খেয়ে যায়। সরকারকেও জানাতে ভয় করে, পাড়াতে যদি দুর্নাম ছড়ায়।
এই রকম কিছু পরিবার, নিজের কাছের জনের মৃত্যুর দায়িত্ব যখন নেয় না, তখন ডাক আসে স্নিগ্ধ ও বেকুব ভাই এর মত লোকেদের।
সারারাত শীতল দেহ আগলে বসে থাকে স্নিগ্ধ। ওদিকে বেকুব ভাই সমস্ত জোগাড়যন্ত্র করে ফেলে, কীভাবে সমস্ত কাজটা সবার অগোচরে সারবে, সমস্ত দিক বিচার বিবেচনা করে নেয়।
বডি শ্মশানে নিয়ে যায় নিজের হাতে,আর পোড়ায় নিজের হাতে, খুব সাবধানে, যাতে কোনও রকম সমস্যা না হয়, পরিবেশে এই ভাইরাস যাতে না যায়, তার জন্য যথাযথ ব্যাবস্থা নেয়।
সমস্ত কাজকর্মের জন্য পরিবারের লোক বা কমিটির কাছ থেকে বেশ কিছু পায় বেকুব ভাই, আর তার কিছু অংশ দেয় স্নিগ্ধকে। কাজটা ছোটজাতের কাজ হলেও, পয়সা বেশ ভালই। ছোটজাতের কাজ বলা কি ঠিক হবে? কেউ যেটা করতে পারছে না, সেটা ওরা করে পরিবেশের উপকারই করছে বলা যায়।
পরিবেশের স্বার্থে কাজটা করলেও এই কাজে ভয়ানক ঝুঁকি রয়েছে, সেটাও ভয়ঙ্কর।
মৃতদেহ বা ডেডবডি যেই স্থানে থাকে, সেই স্থানে নজর থাকে তাঁদের।
তাঁদের বলতে ঠিক যাদের বোঝায়, সেই তাঁদের।
হিংস্র লোলুপ চোখে সেই দেহটার প্রতি তাঁদের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলে। লড়াই চলে নিজেদের মধ্যে, কে ওই দেহটা নেবে, কে ওই দেহে বাস করা আত্মা কে নিজের কব্জায় আনবে। সারারাতের লড়াইতে অংশ নিতে হয় স্নিগ্ধ কে, সব্বার থেকে কেড়ে অক্ষত রাখতে হয় এই দেহ। কিন্তু কীভাবে? সেটা ঈশ্বর জানেন আর স্নিগ্ধ।
একবার খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
কোনও একটা বাঙালি বাড়িতে একজন বয়স্কা মারা গেছেন।
রাত যখন ঠিক ২টো, তখন পাশের রুম থেকে ঠক ঠক ঠক করে আওয়াজ পেয়েছিল, মনে হয়েছিল কেউ যেন ওখানে হাঁটাচলা করছে। এক হাতে লাঠি নিয়ে ভর দিয়ে হাঁটলে যেমন শব্দ হয়, এটাও সেটাই ছিল। খুব নিশ্চিত ছিল যে, এটা কোনও মানুষের কাজ নয়, এই ঘরে কোনও মানুষ নেই আপাতত সে ছাড়া। আর যে আছে, তার দেহ প্রাণ অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধ যে রুমে ছিল, তার ঠিক পাশের রুমেই ছিল দেহটা, আর শব্দটা ওখান থেকেই আসছে।
মনে জোর এনে যখন হাতে টর্চ টা নিয়ে আস্তে আস্তে ওই ঘরের বন্ধ দরজা খট খট করল। োঅমনি ওপার থেকেই সেই খট খট শব্দ ফেরত এল।
সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, বুঝতে পেরেই টর্চ নিয়ে গায়ের জোরে দরজাটা খুলে ফেলতেই দেখল, বডি ঠিক তার জায়গায় শুয়ে আছে, সাদা কাপড় ওপরে মুখ পর্যন্ত মোড়া, আর তার পাশে একটা লাঠি দাড়িয়ে আছে সোজা হয়ে। ঠিক যেন কোনও একজন অদৃশ্য কেউ সেই লাঠি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। টর্চের আলোয় আর কিছু দেখতে পায়নি, মনে মনে কিছু একটা মন্ত্র জপ করতে যাবে, এমন সময় টর্চের আলো বন্ধ হয়ে ঘরটা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তের মধ্যে।
টর্চ হঠাৎ খারাপ হওয়ার কারণ ও জানে না, বাম হাত দিয়ে ডান হাতে ঠুকে ঠুকে আলো জ্বালাতে চেষ্টা করছে এই সময়। আলো জ্বলতে চাইচ্ছে না, বুঝতে পারছে না কী করবে। ঘাম জমে গেছে কপালে। সেই মুহূর্তে “ঠক ঠক ঠক” শব্দটা সামনে এগিয়ে আসছে।
সাঙ্ঘাতিক।
তাড়াতাড়ি করে আলো জালাতেই হবে, এখনই।
ঠিক তখনই টর্চটা জ্বলে উঠল।
সামনে ফেলতেই দেখল, সাদা কাপড় সমেত বডিটা দাড়িয়ে রয়েছে ওর ঠিক সামনে,মুখের সামনে…
ঘুম ভেঙ্গে গেল বাসে, জোরে ব্রেক করেছিল। বাসে এতক্ষণে চোখটা লেগে গেছিল। কন্ডাক্টর কখন ধরে তাকে ঝাঁকিয়ে চলেছে, বুঝতে পারেনি।
বেলা গড়িয়ে পড়েছে। মোবাইলটা বার করে সেভ মেসেজটা চেক করে ঠিকানাটা আর একবার দেখে নিল।
বাগানবাড়ি বলতে যেটা বোঝায়, এটা তেমনই। আলাদা ভাবে চোখে পড়ার মত কিছু নেই। বাউন্ডারিটা বেশ বড়সড়, ঢুকলে চারিদিকে বিভিন্ন গাছ তার ছায়াতে শান্ত ও ঠাণ্ডা করে রেখেছে পরিবেশ। আর তার মাঝে একটা ছোট্ট ঘর, ছোট্ট একটা কটেজ এর মত।
স্নিগ্ধ দরজার কাছে যাওয়া মাত্র কলিং বেলের সুইচ টিপল। মিনিট খানেক অপেক্ষা করার পর, দরজা খুলল কোনও একজন। দরজার পেছনে দাড়িয়ে রইলেন, ওপরে ওঁর ঘোমটা টানা মুখটা দেখা যাছে। মাথা নিচু করে রয়েছেন, মাঝে মধ্যে শাড়ির আঁচলের খুটটা চোখে লাগিয়ে মুছছেন। সর্বসময়ের পরিচারিকা, কষ্ট যে হবে, সেটা স্বাভাবিক। ইনিই তাহলে বেকুব ভাইকে ফোন করেছিলেন।
“আমাকে বেকুব ভাই পাঠালেন, আপনার ম্যাডাম এর জন্য…”
“হ্যাঁ সাহাব, জানি। আমি আর এই ঘরে থাকতে পারবনি। দিদিমণি মারা গেলেন কাল। কতকরে বললাম, টেস্ট করিয়ে নিন, ভ্যাক্সিন নিয়ে নিন, উনি শুনলেন নিকু। শুনলে আজ উনি…”
“কোথায় রেখেছেন ওঁকে?” বললাম।
ন্যাকান্যাকা গলা,বড্ড অসহ্য লাগছিল।
“ওপরতলায় আছেন। আমি আর এই বাড়িতে থাকবনি।”
“তাহলে এই বিকেল সন্ধেতে আপনি যাবেন কোথায়?”
“কাল সকালে আমি আমার গ্রামের বাড়ি, নদীয়া চলে যাবো কুনি। আজ রাতটা স্টেশনে কাটিয়ে দেবো। কিন্তু এই ঘরে আর থাকবনি।”
“কেন? একটা রাতের ব্যাপার তো। থাকুন, কালকে না হয় চলে যাবেন।”
কথা এতক্ষণ উনি মাথা নিচু করে ঘোমটার আড়াল দিয়ে বলছিলেন। এই প্রথম উনি মাথা তুললেন। ঘোমটার পাশ দিয়ে একটা চোখ আর মুখ দেখতে পেলাম। ঘেমে গেছেন হয়তো, নয় এমন ভাবে তাকানোর সময় হাঁপিয়ে ওঠেন কেউ?
“থাকবনি সাহাব, আপনি থাকেন। কাল দাহ করে দিবেন। আমি আর এই বাড়িতে একটুকও থাকবনি কো। বড্ড ভয় করছে।” কথা শেষ হতে না হতেই পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে এসে চোখের সামনে থেকে মুহূর্তের মধ্যে বেড়িয়ে গেল।
কিছু বলতে সাহস বা ইচ্ছে হল না। কাজের লোকটি কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেল? মনে মনে একটা কালো ছায়া তৈরি করে ফেললাম। বাইরের আলো প্রায় শেষ হতে চলেছে।
* * *
একটা মাত্র আলো নিচে জ্বালিয়ে মেইন দরজা বন্ধ করে ওপর উঠে এলাম বাগানবাড়ির। না, সত্যি সাজানো গোছানো বেশ অপূর্ব। দুটো মেয়েমানুষের হাত যে এই ঘরে আছে, আসবাবপত্র পরিছন্নতা, তাদের গোছানোর ধরন থেকে আন্দাজ করাই যায়।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পর, দুই দিকে দুটো রুম রয়েছে। মাঝে ডাইনিং হল। ওপরে ফলস সিলিং এর কাজ, ছোট্ট ছোট্ট ডিম আলো। মাঝখানে প্লাস্টার অফ প্যারিসের বানানো সুন্দর রঙিন নকসা কাজে গোল চাকতি, দেখলে মন ভরে যায়। তার ঠিক নিচেই, মাঝখানে রাখা বড় সাদা প্লাস্টিকে প্যাকিং করা একটা ডেডবডি।
স্নিগ্ধ এই দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত, কিন্তু এমন সুন্দরের মাঝে বীণার কেটে যাওয়া সুর, একটু বেগ পেতে হয়েছে মেনে নিতে।
সাদা পরিষ্কার ত্রিপল প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো একটা বডি। গলার কাছে একটা বড় দড়ির ফাঁস আটকানো, টাইট করে, দড়ির মত কিছু একটা। কোমর এর কার্ভের কাছ দিয়ে আর, উরুর নিচ অংশ দিয়ে আটকানো দড়ি, এককথায় দমবন্ধ পারসেল।
ঘণ্টাখানেক দেহটা রয়েছে এখানে, এক প্রকার গন্ধ নাকে আসছে স্নিগ্ধর। পকেট থেকে ধুপ কাঠির প্যাকেট বার করে, কটা জ্বালিয়ে রেখে দিল সামনে।
বিচিত্র এই মনুষ্য জীবন। বেঁচে থাকতে এত বড় ঘরেও কুলয় না, আর মরার পর দুই বাই চার জায়গা ছাড়া আর কিছু লাগে না। প্রাণহীন দেহটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এমনটাই ভাবছিল স্নিগ্ধ। মুখে একপ্রকার ভাবলেশহীন হাসি টেনে ঘড়ির দিকে তাকালও। সবে আটটা বাজে।
বেকুব ভাই আসতে এখনও অনেক দেরি আছে। সেই ভোর ছাড়া ওঁর আবার সব জোগাড় করা হয়ে ওঠে না। এতক্ষণ কী করবে, সেটা নিয়েই একটু চিন্তা। কী আর করবে, যেটা অন্য সময় করে সেটাই করবে।
মোবাইলের গ্যালারী খুলে বান্ধবীর ছবি দেখতে থাকল। নিজের বলতে এই একটাই মানুষ রয়েছে তার জীবনে। তার সাথে দেখা হয়েছিল গত বছরে, একটি পার্কে। প্রথম দেখা, প্রথম প্রেম, প্রথম ছোঁয়া সমস্তটা আজও মনে আছে স্নিগ্ধর।
বান্ধবীর নামটা দারুণ, রেহা। বাঙালি, কলেজে জেনারেল গ্র্যাজুয়েশনে অন্তিম পর্ব চলতে চলতেই বিদেশের একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি তে চাকরি পেয়ে যায়। রেহার কাজের শিফট শুরু হয়, রাত ১০ টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত। এখন যদিও ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে, তাই রুটিনটা একটু হচপচ হয় আর ্কী।
রেহার এই রুটিনটা সম্পর্কে আগাগোড়াই জানে। স্নিগ্ধও যে এই এসময়ে কাজে ব্যস্ত থাকে, রেহা সেটা জানতেও পারে না। আর দিনেরবেলা রেহা বেশিরভাগ সময় নিজেই ঘুমিয়ে পড়ে, তাই আপাতত মিথ্যে সত্যে টিকিয়ে চলেছে স্নিগ্ধর প্রেম জীবন।
হুম, এখন একটা ফোন করাই যায়। কললিস্ট থেকে নাম্বার সিলেক্ট করে ডায়াল, তারপরই স্নিগ্ধ কানে রাখল মোবাইলটা।
ওপার থেকে ভেসে আসবে, “আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে, শুধু তোমায় ভালোবেসে…”
গানটা বেশ লাগে, চোখ বন্ধ করে মৃদু মাথা নাড়বে বলে তৈরি হল বরাবরের মত।
ছ্যাঁত করে উঠল বুকটা।
একটা রিংটোন বাজছে কানের সামনে। শব্দটা আসছে পড়ে থাকা ডেডবডির পেছন থেকে। ধড়াস ধড়াস করছে বুকের ভেতর, এটা কী শুনছে স্নিগ্ধ।
সাদা প্লাস্টিকে মোড়া বডিটার পেছনে একটা আলোর আভা, বিনা সময় নষ্ট না করে ওদিকে গিয়ে দেখল একটা মোবাইল ফোন, আলো জ্বলছে নিভছে।
* * *
নিজের মোবাইল দেখে নিল স্নিগ্ধ, ওদিকে কলটা তখনও রেহা তোলেনি। এই মুহূর্তে কি করণীয়? কথা ভাবতে ভাবতেই দেখল রেহার ফোনটা কেটে গেছে, কেউ তোলেনি।
অথচ ডেড বডির কাছে মোবাইলটা তখনও চিৎকার করে চলেছে, কোনও নাম্বার ওঠেনি।
কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করছে এখন। ফোনটা তুলে রিসিভ করল। থরথরে গলায় এই প্রথম কেঁপে উঠল, “হ্যালো!”
ওপার থেকে নিস্তব্ধতা কথা বলছে, এছাড়া আর কোনও শব্দ আলাদা ভাবে শোনা যায় না।
কানে ফোন, আর মুখের সামনে ওই সাদা পার্সেল এর বন্ধ মুখমণ্ডল।
কেমন একটা ভয়াবহ ব্যাপার। ঠিক ভাল লাগলো না, “হ্যালো হ্যালো” করতে করতে ওপরে উঠে দাঁড়ালো। ভয় আর বিরক্তি ওর মধ্যে মিশে গেছে, ফোনটা এবার রেখে দেওয়াই ভাল।
“আপনার সাথে কিছু কথা ছিল আমার,” কোনও রকম ভণিতা ছাড়া স্পষ্ট কথা শুনতে পেল একটা কম বয়সী মেয়ে গলা, ফোনটা রেখে দিতে যাবে ঠিক এমন সময়।
কিছুটা অপ্রস্তুত তো হয়েই ছিল, ভয় তেমন লাগেনি। মরার পাশে পড়ে থাকা ফোন, কী আছে তাতে। ভূত কি ফোনে কথা বলবে নাকি? সামনে পড়ে আছে যখন, উঠেই কথা বলতে পারে।
স্নিগ্ধর সাহস এই কথাগুলো বলছে ভেতর থেকে। এটুকু ভরসা যে একটু আগে ও যে কারণে ভয় পেয়েছিল, সেটা অন্তত মিথ্যে। যাক, তাহলে আর ভয় কী!
“আপনি কে বলছেন বলুন?” স্নিগ্ধ এবার জোরের সাথেই বলল।
“আমাকে আপনি চেনেন!”
“আমি? না, ভুল করছেন কোথাও।”
“এতক্ষণ ধরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও চিনতে পারছেন না?”
“কী? কে বলছেন আপনি?” গলায় স্বরে একটু ভাঁজ পড়েছে স্নিগ্ধর। যে কথাটা শুনল সেটা কি ঠিক? কেউ মশকরা করছে না তো?
মুহূর্তের নিস্তব্ধতা বিরাজমান। ফোনের কোনও প্রান্তেই কোনও কথা নেই, এদিকে টানা একপ্রকার দীর্ঘশ্বাস।
নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ওপার থেকে আবার ভেসে এল, মহিলা কণ্ঠস্বর
“আমায় একটু সাহায্য করবেন? এভাবে শুয়ে দমটা আঁটকে গেছে, প্লাস্টিকটা খুলে দেবেন? প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতাম।”
বাক্যহারা স্নিগ্ধ এর মাথা এবার ঘুরছে। এমন অভিজ্ঞতা ওর প্রথম বইকি, যেখানে মড়া নিজের কষ্টের কথা বলছে।
গলা শুকিয়ে গিয়েছে ওর। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিল।
“আপনি কি … … আপনি কি… …” কথা আটকে যাচ্ছে।
“হ্যাঁ, আমি গৌরি সেন।”
মনে পড়ে গেল বেকুব ভাই এর কথা, বাগানবাড়ির মালকিনের নাম জিজ্ঞেস করতে এই নামটাই বলেছিল।
ছিটকে কিছুটা পিছনে পিছিয়ে গেল, হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল সামনেই, ফোনটা তখনও অন কল রয়েছে।
* * *
রাতে মড়া পাহারা দিতে গিয়ে অনেক ধরণের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফেলেছে স্নিগ্ধ। ভগবানে বিশ্বাস না করা এই ছেলে কিন্তু শয়তানে প্রবল বিশ্বাসী।
যমে মানুষের লড়াই শেষ এ যম জিতে গেলেও, তারপর তারই অগোচরে খেলা শুরু করে অতৃপ্ত, অশুভ কিছু প্রেতাত্মা। ওরা মরার দেহ পেলে আগলে রাখতে চায়, বশে নিয়ে তাদের অতৃপ্ত বাসনা পূর্ণ করতে চায়। মৃতদেহ এর আশেপাশে যখন কেউ থাকে না, সেই মুহূর্তের জন্য ওরা ওত পেতে বসে থাকে, অপেক্ষা করে কখন খালি খোলসটা ওরা টেনে নিয়ে চলে যাবে।
কিন্তু আজ সেই অশুভ শক্তি নয়, মৃত খোলসের ওপর নজর পড়ছে তারই প্রাক্তনের।
জানি না, এটা হয়তো কোনও প্রকারের ছল বা কোনও ফাঁদ। কোনও কিছুতেই পা দিলে চলবে না স্নিগ্ধর।
ফোনটা হাতে যতক্ষণে নিয়েছে, স্নিগ্ধ ততক্ষণে অনেকটাই ঘেমে গেছে।
নিজের স্নায়ুর প্রতি জোর রেখে মনে মনে এটুকু প্রতিজ্ঞা করেছে, আর যাইহোক মরার খোলস ভুল করেও হাত দেবে না। কানে ফোনটা রেখে দিল, কিছু কথা বলার ইচ্ছে করছিল না। মনে মনে একটু ভিত স্নিগ্ধ বলল, “তুমি কি চাও?” মনের ভয়ে কখন আপনিটা তুমিতে এসে গেছে, বুঝতে পারেনি।
ক্ষিপ্ত একটা স্বর ওপার থেকে স্নিগ্ধর বুকের পাঁজর নাড়িয়ে দিল।
“কতবার বলব শুনতে পাস না? খুলে দে আমার প্লাস্টিক। বড্ড কষ্ট হচ্ছে বললাম তো!” শেষের কথাগুলো চাঁচাছোলা নির্দেশ সূচক। ভাবনাকে লাগাম দিয়ে স্নিগ্ধ ঘরের এক কোনে বসে পড়েছে।
কী করবে কী বলবে বুঝতে না পারা এই ছেলেটা এখন মোবাইল এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কথা বলবে কি? নাকি ফোনটা কেটে দেবে?
এমন সময় নিজের পকেট থেকে সুরেলা আওয়াজ শুনতে পেল, আর একটা মহিলা কণ্ঠস্বর। হ্যাঁ, স্নিগ্ধর পকেট থেকেই তো আসছে কথাটা।
বাম হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে আস্তে করে ফোনটা যখন বার করল, স্নিগ্ধ অবাক।
রেহা এর কলটা কাটাই হয়নি, প্রায় দশ মিনিট হতে চলেছে রেহা ফোনটা ধরেই আছে সেই তখন থেকে। সেটা বুঝতে পারেনি। মনে ভয় ঢুকে গেলে চারপাশে কী হচ্ছে সেটা কারোর ভ্রূক্ষেপ থাকে না।
“হ্যালো, স্নিগ্ধ, তখন থেকে তোমায় ডাকছি। তোমার গলার শব্দ পাছি, কিন্তু তুমি সাড়াও দিচ্ছ না। চিন্তা হয় না আমার?” ফোন তুলে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো রেহা বলে গেল।
“না আমি ঠিক আছি, তুমি হঠাৎ ফোন করলে?” নিজের চাপা উত্তেজনা ছাপতে গিয়ে স্নিগ্ধ ভুলেই গেছে যে ফোনটা ওই আগে করেছিল।
“আমি? তুমিও তো ফোন করলে। আমি সবে কাজ সেরে উঠেছিলাম তোমার মিসড কল দেখে নাম্বারে কল দিলাম।”
নিজের ভুল আপাতত বুঝতে পেরেও কোনও চিন্তা নেই এদিকে। সাদা প্লাস্টিকের দিকে তাকিয়ে নিজের ওই হাতের ফোনটা দেখলও, ওদিকের ফোনটাও কাটা হয়নি, তখনও অন কল।
“রেহা, আমি তোমায় পড়ে কল করব? কাল? আজ একটু টায়ার্ড হয়ে পড়েছি। কাল কথা হবে।”
“স্নিগ্ধ শোনো…” কথাটা শুনতে শুনতে ফোনটা কেটে দিল।
ওই ফোনটা কানে দেওয়া মাত্র ওপার থেকে কানে ছ্যাকা খাওয়ার মত শব্দ এল, বিকট অট্টহাসি। ফোনের স্পিকার মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে স্পিকারের কাছ থেকে একটা মুখ বেড়িয়ে এসেছে কানের কাছে, খুব কাছে…
“আমার মুখ থেকে প্লাস্টিকটা খোলো একটি বার, তোমাকে দুচোখ ভরে দেখতে চাই, একটিবারের জন্য!” হঠাৎ এমন কী হল যে, রুক্ষ গলার স্বর কোমল হয়ে গেছে।
আগের তুইতোকারি হঠাৎ করে কী করে এমন কোমল আবেদনমূলক স্বরে পরিণত হল, স্নিগ্ধ কিছু বুঝতে পারছে না। এতক্ষণে বুঝে গেছে, এই নারীর সূক্ষ্ম শরীর সাধারণ নয়। যারা মরার পরও নিজের পুরনো বস্তুর লোভ সামলাতে পারে না, তারা ইহজগতে সারাজীবনের জন্য বন্দি হয়ে যেতে পারে, যদি না সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে সৎকার না করা হয়। বেকুব ভাইকে ব্যাপারটা বলে রাখতে হবে, সে বেটার আসতে তো সেই ভোর হয়ে যাবে।
“আমি কিছুতেই প্লাস্টিক খুলব না, আপনার আর কিছু আবদার থাকলে বলতে পারেন,” রুক্ষ ও শক্ত স্বরে বলল স্নিগ্ধ, মনে শক্তি যতটা হয় সঞ্চয় করে ফেলেছে।
“এত করে বলছি, খুলবে না যখন আমার কথা শুনবে? শুনবে আমার জীবনের গল্প?”
একেই মাথা ঠাণ্ডা নেই, তারপর অশরীরীর কাছ থেকে তারই গল্প শুনব? আছা নাছোড়বান্দা জিনিস তো, মরার পরেও জ্বালায় বেশ।
মনে মনে ভাবলও, না এটা অনেক ভাল, একবার মিত্তির বাড়ির মেজ বৌ এর বেলায় তো মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে পড়েছিল দেহ, অবশ্য রাইগরমরটিস এর জন্য এটা ঘটে থাকে। কিন্তু তখন তো সবে এক দুই ঘণ্টা কেটেছে, এত তাড়াতাড়ি দেহে খিঁচ তো ধরার কথা নয়। এরও কিছু দিন আগেই, আর একটা বউমনির দেহ আগলাতে গিয়ে বিপদে পড়েছিল। মড়া শুয়ে আছে, কিন্তু তার চারপাশ থেকে মনে হচ্ছে কেউ বা কারা যেন ঘিরে বশে আছে, অথচ তাদের চোখে দেখতে পারছে না স্নিগ্ধ। অদৃশ্য এক ধরণের আস্তরণ বৌমনিকে যেন আলাদা করে রাখতে চায়, দেহটা যেন নিজের কাছে রাখতে চায়, আগলাতে চায়।
এইবারে তেমন কিছু ঘটছে না, অশরীরী একটা গল্প শোনাতে চায়। এটা ওর কাছে প্রথম ঠিকই, সঙ্গে সঙ্গে বেশ ইন্টারেস্টিং। মনে মনে একটু ভয় তো করছেই, কিন্তু ভয় পেলে তো আর স্নিগ্ধর কাজ করা চলে না, তাই না?
কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবেই বলল স্নিগ্ধ, “হ্যাঁ, বলুন।”
“আমাকে আপনি নয়, তুমি বোলো। এই শেষ বেলায় কাউকে নিজের কাছের মানুষ ভাবতে আমার ভালই লাগবে।”
“বেশ, বলো তোমার কথা।”
“ ক্রিং রিং রিং, ক্রিং রিং রিং ”
স্নিগ্ধর ফোনটা বেজে উঠল, রেহার ফোন নাম্বারটা ফুটে উঠল আবারও। জলে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘ। কী করবে বুঝতে পারছে না। এদিকে অশরীরীকে শান্ত না রাখলে হবে না, ওদিকে নিজের প্রেমিকার সাথে কথা বললে সেও শান্ত থাকবে না।
“হ্যালো, রেহা, আমি কি তোমায়…” কথাটা বলতে বলতেই ওদিক থেকে
“স্নিগ্ধ, আমি জানি তুমি কী কাজ করো, আর কেন আমায় লুকিয়ে বেরিয়েছ?”
ভাদ্র মাসে কালবৈশাখী এর মত ধেয়ে এল কথাগুলো, স্নিগ্ধর কানে। এতদিন ধরে যেটা লুকিয়ে রেখেছিল, সেটা আজই ফাঁস হয়ে গেছে, কিন্তু কী করে?
কিন্তু সেটা আজই হতে হল? এখন কি করবে স্নিগ্ধ, বুঝতে পারছে না।
দুই হাতে দুটো ফোন নিয়ে এখন বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে।
“আমি, আমি আমি… তোমায় আগেই বলতে ছেয়েছিলাম, কিন্তু ভয়ে…”
“কিসের ভয় তোমার? আমাকে মিথ্যে বলতে তোমার ভয় লাগেনি? এতটুকু চিন্তা করোনি যে তোমায় নিজের বাবা মা এর থেকেও বেশী ভালবাসে, তাকে ঠকাতে তোমার লজ্জা করেনি?”
কী উত্তর দেবে বুঝতে পারেনি। খুব কষ্ট অনুভব করছে ছেলেটা এখন। সত্যের মুখোমুখি হওয়া সব্বার বশে নেই। ফোনে বলল, “রেহা, আমি তোমায় সব গুছিয়ে বলব, আজকের দিনটা দাও শুধু, আমি কাল সব বলব, এখন রাখছি।”
রেহাকে আর কোনও রকম বলার সুযোগ দিল না স্নিগ্ধ।
এদিকে তুলে রাখা ফোনটা আবার বলে উঠল,
“কে ফোন করেছিল? গার্ল ফ্রেন্ড?”
“ হুম।”
“আচ্ছা, আজ একরাতের গার্লফ্রেন্ড না হয় আমি হলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড হবে তুমি?”
“আপনি কি বলবেন বলছিলেন না, বলুন,” চতুরতার সাথে কথাটা এড়িয়ে গেল।
“বেশ, শুনবেন আমার কষ্টের কথা, তাহলে বলি শুনুন।”
* * *
“এই বাগান বাড়িতে আগে থাকতাম আমি আর মা। মা বলব না মাসি বলব জানি না।
মা বলে ডাকি মানে এই না যে সে আমায় পেটে ধরেছে। কুড়িটা বছর হল, পুষেছে সে আমায়। যেমন করেছে, মরার আগের দিন পর্যন্ত তেমনই শুষেছে।”
“মানে? বুঝলাম না।”
“ওটা মা ছিল না, ওটা ছিল মাসি, এই বাগানবাড়ির মাসি। সব্বাই যে বয়সে কলেজ এ পড়তে যায়, আমি সেই বয়সে অন্যের হাতে পড়েছি। দিনে রাতে কাস্টমার ঢুকিয়ে টাকা রোজগার করত ওই মহিলা। আমার শরীরে অন্যরা উঠে মজা করত, ঘোড়া চালিয়ে।”
“ক্রিং রিং রিং, ক্রিং রিং রিং…”
“রেহা আমি তোমায় পরে বুঝিয়ে বলছি, একটু আমায় সময় দাও…”
“গৌরি সেন গ্রেপ্তার হয়েছে স্নিগ্ধ, তুমি ওই ঘর থেকে বেড়িয়ে এসো।”
আগামী শঙ্কার কথা না জানিয়ে যেন একটা বাজ পড়ল স্নিগ্ধর মাথায়, এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে, গৌরি সেন এর নাম কথা রেহা জানল কী করে? আর ওকে গ্রেপ্তার কে করবে? কেন করবে? তাছাড়া উনি তো মারা গেছেন! মাথায় কিছু ঢুকছে না ওর।
“রেহা তুমি একি বলছ? আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না!”
“অত বলার সময় নেই স্নিগ্ধ, এটুকু বলছি আমার সাথে এখন তোমার বেকুব ভাইয়া আছেন, ধরে নাও আমি সমস্তটাই জানি। কিন্তু তুমি অনেক কিছু জানো না। যেটা বলছি মন দিয়ে শোনো। ভদ্রমহিলার মুখোশ পড়া গৌরি সেন বেঁচে আছেন। নিজের লুকানো ফ্ল্যাটে উনি ছিলেন, এখন আপাতত পুলিশের জিম্মায়।”
কিছু না বুঝতে পারা ছেলেটা প্রচণ্ড ভাবে ভয় পেয়েছে।
“গৌরি সেন যদি মারা না যায়, তাহলে এটা কার লাশ?” মুখ থেকে বেড়িয়ে গেল কথাটা।
হাতে অন্য ফোনটা তখনও ধরা…
ভূমিকম্প এখন হওয়ার কথা নয়, অন্তত সেটাই অনুমান। তাহলে বাগানবাড়িটা দুলতে শুরু করেছে কেন? স্নিগ্ধর মনে হল, বাড়ির ফ্লোর, সিলিং যেন দুলছে না ভাসছে, ঠাহর করতে পারছে না। পাখা লাইট পেন্ডুলামের মত এপাশ ওপাশ করছে। এরই মধ্যে স্নিগ্ধর ঠাণ্ডা লাগছে। এটা ঠিক সেই ঠাণ্ডা না যেটা শীতকালে পেয়ে থাকে, এই ঠাণ্ডা হঠাৎ জন্ম নিয়েছে, কাঁপুনি আসছে ভেতরের হাড় থেকে, শিরায় ধমনি ব্লক করে দিতে চাইছে, পা হাত নড়তে দিতে চায় না। বুকের ধুকপুকানি যেন আর একটু পড়ে বন্ধ হয়ে যাবে, সময় মত গরম কিছু না পেলে।
এমন অনুভুতি এর আগে হয়নি। একটু আগেও খিদে পায়নি, এখন পেটটা কিল মারছে পাঁজরের দেওয়ালে, কনকন করছে। ব্যাথায় ফেটে যাবে মনে হয়, স্নিগ্ধর মধ্যভাগ। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেছে, শুয়ে কুঁকড়ে পড়েছে, পা দুটো বুকের মাঝে চলে এসেছে নিজের অজান্তেই।
এমনটা এর আগে ঘটেনি কখনও, এমন বিপদে এর আগে কখনও পড়তে হয়নি। আজ নিজেকেই হয়তো হারিয়ে ফেলতে পারে।
চোখটা আস্তে আস্তে মুদে আসছে, ক্লান্তি আর কষ্টে স্নিগ্ধর প্রাণ বায়ু বোধহয় আর নেই। নিঃশ্বাসের হার কমতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে, বুঝতে পারছে শেষ ভ্রমর পথ গুনতে এসেছে।
আস্তে আস্তে চোখটা একটু ওপর দিক করতে, দেখল সাদা প্লাস্টিকে মোড়া দেহটা উঠে বসে আছে সোজা হয়ে, মাথাটা এদিকে ঘোরানো।
ভয়ের থেকে হয়তো এখন বাঁচাটাই দায় হয়ে পড়েছে। এবারটা বোধহয় স্নিগ্ধ নিজেকে প্রাণে বাঁচাতে পারবে না। শরীরের খোলসটা মনে হয় অন্য কিছুর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। সেই কালো দেবতা, সেই কালো অভিশাপ…
চোখটা বুঝে এসেছে আস্তে আস্তে, অসুস্থ লাগছে স্নিগ্ধর… কতটা সময় ওইভাবে আছে আর জানে না।
* * *
“হ্যালো, হ্যাঁ আমি বলছি। কেমন আছো?”
“আছি, অপেক্ষায় আছি কখন তোমার বাগানবাড়ি যাবো আর…”
একটু হেসে মহিলা বলল, “চলে এসো, সমস্ত কিছু তৈরি আছে।”
“সাথে কি নিয়ে আসব, হুইস্কি না রাম?”
“উহু, কথা মত দশহাজার টাকা, তারপর সারারাত যা ইচ্ছে করো আমি দেখতেও আসব না।”
“ওকে ম্যাডাম, অ্যাজ ইউ উইশ।”
এই মহিলার পড়নে একটা লাল শাড়ি, টকটকে, স্লিভলেস ব্লাউজ। পেছন থেকে কোমরের ভাঁজ দেখলে যে কেউ হামাগুড়ি খেয়ে লেজ নাড়াবে। শরীরের বাঁধন যথেষ্ট টাইট। সামনে থেকে দেখলে মন ভরে যাবে অপ্রাকৃত নেশায়। উহু, কপাল পরিষ্কার, মানে এখনও কোথাও মাথা নোয়ায়নি এই মহিলা, কিন্তু বয়স আন্দাজ ৩৫ ছুঁই ছুঁই।
একে দেখতে অনেকটা সেই কাজের লোকটার মত, যে বিকেল বেলা ঘর আগলে ছিল ঘোমটা দিয়ে। স্নিগ্ধ যাকে কাজের লোক বলে ভুল করেছে, ইনিই কি আসল গৌরি সেন?
এতক্ষণ ধরে এই সমস্ত বার্তালাপ, ফোনে কথা, সমস্ত কিছুই শুনতে পাছিল স্নিগ্ধ। ও জানে না এখন ঠিক কোনও জগতে আছে, তবে দেখতে আর বুঝতে পারছে, কিছু বলতে পারছে না।
“এই শোন, ফ্যাচফ্যাচ করে কী সকাল থেকে কেঁদে চলেছিস রে মুখপুরি?
বাগানে জলটা কে দেবে? আর শোন, সন্ধেতে তৈরি থাকিস, সেই গত রোববারের বাবু আসবে। যা যা, লেট করিস না।”
ঝাঁঝাঁ করে এক টানে বলে গেল গৌরি।
যাকে বলল, সে ঘরের এক কোনে বসে আছে, পড়নে একটা রোজের ধোয়া সবুজ চুড়িদার, ছেঁড়া ওড়না। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া মেয়েটা মুখ তুলে প্রতিবাদ করতে পারেনি। দিনের পর দিন ওর ওপর হয়তো শোষণ চলছে।
“কী রে মুখপুরি, আমার মুখের দিকে কী তাকাছিস?”
“মা, আজকের দিনটা ছেড়ে দাও। আমার শরীর ভাল নেই। সকাল থেকে শরীরটা বড্ড দুর্বল হয়ে আছে,” মেয়েটি প্রতিবাদ না করলেও নিজের ভালটা বলতে পেরেছিল কান্না গলায়।
“দুব্বল? সকাল থেকে পাউরুটি জেলি দিয়েছি। তাতেও মন ভরেনি না?”
“মা, পেট ভরেছে মা। কিন্তু ওই ব্যথাটা পেটের ভেতর থেকে আসছে। বুঝতে পারছি না, তুমি আজকের দিনটা আমাকে ছেড়ে দাও।”
“ছেড়ে দেবো? ছেড়ে দিলে আমার টাকা কে তুলবে?
জাল টাকা গুলো ট্যাঁকশাল থেকে আলাদা করে পেলাম, বাজারে ফেলার আগেই এলাকাতে নতুন ডি এস পি হানা দিল। যাদের পুষলাম এতদিন ধরে, সেই মরদের দল আজ বেইমানির পথে নেমেছে। আর তুই কিনা ওদের একটু সুখ দিতে পারবি না? হারামজাদি, শরীরটা তো ডাগর করে বানালাম আমি রে, তারপরও মুখে মুখে কথা?
পথে বসাতে চাস?
ছোটবেলায় রাস্তায় খেতে পেতি? আমি খাওয়ালাম।
আর আজ ওই রুস্তপুস্ত শরীর খেলাতে পারবি না? আজ তার ফসল দিবি না?
ওদের তোকে মনে ধরেছে।
যতক্ষণ যৌবন, ততক্ষণ পাবি মন, তারপর মৌ এর মধু খেতে কাক পক্ষীরাও আসবে না। এতদিনে আমি খিদে মিটিয়ে মিটিয়ে ক্লান্তও, পুরনো ছিবড়া ওদের আর মনে ধরছে না। যা যা, ফ্যাচফ্যাচ করিস না।”
কথাগুলো কানে এক একটা অগ্নিবাণের মত ঠেকছিল স্নিগ্ধর।
এই বাগানবাড়ি, ফুর্তি করার জায়গা, যারা ঘরের খাবার না খেয়ে মুখ মারতে চলে আসে এখানে। যে গৌরি সেন এত দান ধ্যান করে নাম কামাল, সে আসলে কিনা চোর বাজারের সাথে যুক্ত?
সত্যি, আজকের শহরেও এমন নৃশংস মানুষ রয়েছে যারা শরীরের খিদেকে টাকায় পরিণত করতে কী না করছে। ছোট্ট মেয়েটার বয়স কত হবে? বাইশ পেরিয়েছে কিনা সন্দেহ, তার মধ্যেই এমন ধকল। হয়তো কাজ করতে নিয়ে আসে কোনও গরিব বাড়ি থেকে, সেই ছোটবেলায়, এই অনাথকে। আর আজ কাজে লাগায় নিজের টাকার মেশিন ভেবে।
এই সমস্ত কিছুর পেছনে গৌরি সেন। স্নিগ্ধ নিজেও অনাথ, কষ্টটা বুঝতে পারছে।
* * *
সন্ধে কেটে গেছে।
“ও ম্যাডাম, আজ মনে হয় তোমার মেয়ে তৈরি হয়নি ঠিক করে,” ফোন করা বাবু ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে গৌরিকে বলল।
“কেন? ওত সকাল থেকেই গোলাপ পাতা মেলে বসে আছে তোমার জন্য।”
“তাই? সেই গোলাপ এত তাড়াতাড়ি নেতিয়ে পড়েছে কেন? সারারাতের টাকা দিয়ে এই পেলাম?”
গৌরি হয়তো সমস্যাটা বুঝতে পেরেছিল, কোনও রকমে নিজে সামাল দিয়ে বলল, “ওই গোলাপ মুছরে পড়লেও এই স্থলপদ্ম তোমায় পাতায় ভাসিয়ে রাখবে, চলো ওই ঘরে দেখি তোমার কত রস জমেছে …”
“থাক, আটি যতই রসে ডোবাও, সেটা শুকনোই থাকে। চললাম, এই মুখো আর হব না।” বেড়িয়ে গেলেন ওই বাবু গটগট করে।
রাগে গা কষকষ করছে গৌরির। এমন অপমান এর আগে কখনও হয়নি। এতদিন ধরে দুধ কলা দিয়ে যাকে পুষলও, কালসাপের ছোবল খাওয়ার জন্য?
দড়াম করে দরজা খুলে ঢুকল ঘরে।
অর্ধচৈতন্য নিয়ে ওই মেয়েটি তাকাল ওপর দিকে কোনও রকমে। সমস্ত বিছানা রক্তে ভিজে জ্যাবজ্যাব করছে। টাটকা রক্ত এখনও বেরোনো থামেনি।
মাথায় কী চলছিল জানা নেই, গৌরি এগিয়ে গেল মেয়েটির দিকে।
“হারামজাদি, আজ পর্যন্ত কেউ মুখের ওপর টাকা ছুড়ে মারেনি। এই জন্য তোকে আমি রেখেছি? শালি, আজ তোকে শেষ করে দেবো। শেষ করে দেবো, তোর জন্য আমার সব শেষ হয়ে যাবে। একজন মুখ ফিরিয়ে গেছে যখন, বাকিরা খবর পাবেই।
তাহলে? আমার টাকা গুলো সামলাব কি করে?
হারামি মেয়েছেলে, আজ তুই মরবি আমার হাতে।”
কথাগুলো বলার অনেক আগে থেকেই মেয়েটির গলাতে গৌরির দুই হাত জাঁকিয়ে বসে পড়েছে। দম আটকে আসছে মেয়েটির, এমনিতেই দুর্বল শরীর নিয়ে নিজেকে সামলাতে পারছিল না, তারপর গলায় এমন চাপ আর নিতে পারছে না। ওক ওক করে গলায় অদ্ভুত কণ্ঠস্বর, কষ্ট হচ্ছে। শরীর ছেড়ে দিয়েছে একদম, দম যতক্ষণ আছে, পা দুটো ছটপট করছে।
ওপরে বসে আছে গৌরি সেন, সাথে চোখে আগুন দৃষ্টি।
আর কিছুক্ষণ… আর কিছুক্ষণ…
পা দুটো থেমে গেল আস্তে আস্তে…
সহ্য করতে পারছে না আর স্নিগ্ধ এই দৃশ্যটা। দমবন্ধ হয়ে আসছে নিজের, চোখে মুখে অন্ধকারের চাপ আবার লেগে গেছে। গাটা গুলিয়ে উঠেছে।
ধপাস করে পড়ে গেল মেঝেতে সাথেসাথে…
* * *
চোখ খুলল যখন, রেহা আর বেকুব ভাই বসে ছিল। স্নিগ্ধ আস্তে আস্তে চোখ ঘষছে, এটা কী সত্যি না স্বপ্ন। ও কি ঠিক দেখছে? এতক্ষণ ও কোন জগতে ছিল…
সমস্তটা বুঝতে মুহূর্ত খানেক সময় নিয়েছে, তারপর বেকুব ভাই যখন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “তুমি ঠিক আছ ভাই?”
“হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। কিন্তু এটা কী দেখলাম? বেকুব ভাই, ওই মেয়েটাকে গৌরি সেন মেরে ফেলেছে। মেয়েটাকে বাঁচতে দিল না। নিষ্পাপ ফুলের কুড়িকে নষ্ট করে ফেলল গৌরি সেন আমার চোখের সামনে…” হাউমাউ করে কাঁদছে।
বেকুব ভাই বলল, “প্লাস্টিকে মোড়ানো বডিটা ওই ছোট্ট মেয়েটার। গৌরি সেন ফোনে আসলে ভয় দেখাতে চাইছিল। কি বলছিল তোমাকে?”
নিজেকে সামলে স্নিগ্ধ বলল, “প্লাস্টিকে ওর কষ্ট হচ্ছে। মুখটা যেন খুলে দিই আমি।”
“ওটা ওর চালাকি ছিল বুঝলে ভাই। তুমি যাতে ভয় পাও, তুমি যাতে মুখটা না খোলো সেটাই ওর আসল উদ্দেশ্য ছিল। খুলে ফেললে তো সব ফাঁস হয়ে যেত। ফোনটাও ওই জন্য রেখে গেছিল ফেলে ইচ্ছে করে,” বেকুব ভাই বলল।
রেহা, “পুলিশ একটু পরেই চলে আসবে। এখানের লোকেশন আমি দিয়ে দিয়েছি।”
খুব খারাপ লাগছে। একজন অনাথকে ঘরে এনে কত মানুষ স্বার্থের জন্য ঘরের কাজ করায়, কাজের লোক বানায়। এটাও ঠিক ছিল, কিন্তু বেশ্যাবৃত্তি করতেও আনে? হায় ঈশ্বর, এ কোন পৃথিবীতে আমায় আনলে তুমি। আমার মা বাবা আমাকে কেন ছেড়ে চলে গেল। আজ আমার যদি কোনও বোন থাকত? তাহলে আমি কি তাকে বাঁচাতে পারতাম না?
এই প্রথমবার চোখে জল এসেছে। বুকটা ভার হয়ে গেছে।
আসতে আসতে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “গৌরি সেন কখন ধরা পড়েন?”
বেকুব ভাই, “এই বাগানবাড়ি থেকে যাওয়ার এক ঘণ্টা পরেই। তা প্রায় ৮টা নাগাদ, পুলিশ তো তাই বলছে। তবে হ্যাঁ, সমস্ত জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। উনি কোনও কিছুই স্বীকার করছেন না।”
“স্বীকার তো ওঁকে করতেই হবে, এই চক্রের একমাত্র মালকিন,” রেহার গলার স্বর শক্ত।
স্নিগ্ধ কিছু একটা হিসেব মেলাতে পারছে না।
“মোবাইল ফোনটা কোথায়, দাও তো দেখি,” বেকুব ভাই বলল।
“তুমি ঠিক বলছ? রাত্রি ৮টাতেই ধরা পড়েছে?” স্নিগ্ধ কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই।
“হ্যাঁ, একদম ঠিক বলছি ভাই।”
“কেন, কী হয়েছে?” রেহা বলল।
“প্রথম কলটা ওই রাত ৮টাতেই এসেছিল, যখন আমি রেহাকে কল করতে চাইছিলাম। গৌরি সেন যদি তখনই ধরা পরে যায়, তাহলে… তাহলে এতক্ষণ ধরে কলে কে ছিল?”
“ফোনটা কোথায়?” একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বেকুব ভাই জিজ্ঞেস করল।
আঙ্গুল তুলে প্লাস্টিক বডিটার দিকে দেখাল স্নিগ্ধ।
বডিটার সামনে পরে রয়েছে ফোনটা, কল তক্ষণই কাটেনি, কাউন্টিং চলছে…
প্লাস্টিকের ভেতরটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল, তিননজনের চোখের সামনে…
ঠিক তখনই বাগানবাড়ির সব আলো নিভে গেল…
* * *
সমাপ্ত