১৯১৮। ডিসেম্বর। বেথুয়াডহরী।
এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল সেই রাতে। ঘন কালো মেঘপুঞ্জ তখনও গ্যাঁট হয়ে বসে আছে আকাশের বুকে। ঘন অন্ধকারের এক অদৃশ্য চাদরে যেন ঢেকে গেছে সারা গ্রাম। সেই অন্ধকারের মধ্যে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে বিশাল জমিদারবাড়ি। খানিকক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া এক মহাপ্রলয়ের সাক্ষী হয়ে।
মোমবাতির কম্পিত আলোয় তিনজনে এসে দাঁড়াল দরজার সামনে।
“এই ঘরটা?”
“আ-আজ্ঞে ঠাকুর,” কম্পিত স্বরে বলল মোহনলাল।
“এ-এটাকে কোনোভাবেই ধ্বংস করা যাবে না?” ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করলেন শিবরাম ভট্টাচার্য।
“না হে! এই মুহূর্তে একে ধ্বংস করা অসম্ভব।”
পণ্ডিতাচার্যের নির্দেশে দরজার তালা ভাঙল মোহনলাল। ঘরে ঢুকে চারদিকে চোখ বোলাতে লাগলেন পণ্ডিতাচার্য। না, কোথাও কোনও জানলা, গর্ত এমনকি কোনও ছোট ফাঁকফোকরও নেই। তাঁর নির্দেশে শিবরাম একটা মাঝারি আকারের সিন্দুক ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখলেন। এরপর পণ্ডিতাচার্য চোখ বন্ধ করে সেই সিন্দুকের চারপাশে পরিক্রমণ করতে লাগলেন এবং উচ্চৈঃস্বরে এমন এক ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন যা বাকি দুজনের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা।
মন্ত্রোচ্চারণ শেষ হতেই ইশারায় শিবরামকে সিন্দুক খুলতে বললেন এবং নিজের হাতে ধরে রাখা জিনিসটা অতি সন্তর্পণে সিন্দুকের ভেতরে রেখে দিলেন। সবশেষে ঘরের দরজা বন্ধ করে সেই ভাষায় আরও কিছু মন্ত্র আউরে নিলেন।
“এ-এই রকম ঘ-ঘটনা আর কখনও ঘটবে না তো ঠাকুর?”
“যতদিন এ জিনিস এখানে থাকবে বা এর ধারে-কাছে যদি কেউ না আসে, ততদিন এ কারোর ক্ষতি করতে পারবে না,”
“আ-আর য-যদি এটা এ-এখান থেকে…”
“তাহলে মহাসর্বনাশ নেমে আসবে…”
* * *
২০১৮। ডিসেম্বর। কলকাতা।
সকাল থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে কলকাতার বুকে। একেই ডিসেম্বরের কনকনে শীত। তার ওপর এই অসহ্যকর বৃষ্টি। অবশ্য তাতে বিন্দুমাত্র বিরক্ত হয়নি রোহিত। আজ তার কাজের ছুটি। পুরো দিনটা আজকে সিনেমা দেখে কাটানোর প্ল্যান করেই রেখেছিল সে। তবে প্ল্যান ভেস্তে গেল তার প্রিয় বিশ্বনাথকাকুর হঠাৎ আগমনে। বিশ্বনাথ দত্ত রোহিতের বাবার খুব পুরনো বন্ধু। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর এই চল্লিশোর্ধ বিশ্বনাথকাকু ছাড়া তার আর কেউ নেই। বিশ্বনাথ দত্ত প্রায়ই রোহিতের বাড়িতে আসেন। গল্পগুজব করেন। তবে আজকে বিশ্বনাথকাকুকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে না?
দুকাপ চা বানিয়ে নিয়ে এল রোহিত। একটা কাপ বাড়িয়ে দিল কাকুর দিকে। বিশ্বনাথ অন্যমনস্কভাবে চুমুক দিলেন চায়ে।
“কাকু আজ আপনাকে একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে? সব ঠিক আছে তো?”
চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে মুখ খুললেন বিশ্বনাথ, “হুম সবই ঠিক আছে। কিন্তু…”
“কিন্তু কী কাকু?”
“তুমি তো জানো রোহিত যে ছোটবেলা থেকেই আমার লেখালেখির কত শখ। কিন্তু সংসারের আর্থিক অভাবের জন্য আমাকে সব ছেড়ে দিয়ে কাজ শুরু করতে হয়েছিল। তবে সেই শখ আমার এখনও যায়নি। আসলে কিছুদিন আগে ইন্টারনেটে একটা গল্পের প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন দেখি। অংশগ্রহণ করার খুব ইচ্ছে আছে। তোমার কাকিমা আর রূপসাও আমাকে সাপোর্ট করেছে। কিন্তু…”
রূপসার নাম শুনে ঠোঁটের কোণে একটু হাসি খেলে গেল রোহিতের। তবে সেটা বিশ্বকাকুকে জানতে না দিয়ে সে বলে উঠল, “কিন্তু কী?”
“আসলে ওরা বলেছে একটা ভয়ের গল্প লিখতে। কিন্তু কোনও গল্পই আমার মাথায় আসছে না। আর এদিকে লেখা জমা দেওয়ার শেষদিন এগিয়ে আসছে। ধুর!” বিরক্তি প্রকাশ করলেন বিশ্বনাথ, “তুমি কিছু হেল্প করতে পারবে?”
“আমি আর গল্প!” ম্লান হাসল রোহিত, “তবে যদি কিছু মাথায় আসে অবশ্যই জানাব। কিন্তু রূপসা তো অনেক ভূতের সিনেমা দেখে, সে কিছু হেল্প করতে পারছে না? আর তাছাড়া আপনিও তো আগে টুকিটাকি লিখতেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই…”
“ধুর! রূপসার কথা বোলো না। ওর একটাও গল্প আমার ভালো লাগেনি। আর আমি তো কোনোদিনই ভূতের গল্প লিখিনি, এমনকি পড়তামও না। ওই বিষয়ে আমার ইন্টারেস্টই ছিল না। যদি থাকত তাহলে আজ বেশ সুবিধা হত,” শেষ চুমুক দিলেন বিশ্বনাথ।
কী বলা যায় কিছু ভেবে না পেয়ে রোহিত চুপচাপ বিশ্বকাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ কলিং বেলের অনবরত আওয়াজ তাদের কানে আসে এবং সঙ্গে শোনা যায় এক মহিলা কণ্ঠস্বর। কে যেন রোহিতকে বাইরে থেকে ডাকছে।
রোহিত দ্রুত গিয়ে দরজা খোলে এবং দেখতে পায় তার প্রতিবেশী লীলা কাকিমা দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছেন। বয়স সাতচল্লিশের এই মহিলার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে এক ভীতির ছাপ।
“কী হয়েছে কাকিমা! হাঁপাচ্ছ কেন?”
“এক্ষুনি আমার সঙ্গে চলো বাবা। হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছিল। অশোক আবার কেমন করছে, আমার খুব ভয় লাগছে,”
“আবার! ঠিক আছে আমি রেডি হয়ে আসছি,” বলে ঘরে এল রোহিত, “কাকু তোমাকে বলেছিলাম না পাশের বাড়ির অশোককাকু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আজকে আবার পাগলামি শুরু করেছেন। আমাকে যেতে হবে,”
“আমি গেলে কি অসুবিধা হবে?”
“তুমি যাবে? ঠিক আছে চলো।”
* * *
“ডাক্তারবাবু অশোককাকু মাঝে-মধ্যে এরকম করছেন কেন?”
“আমরাও সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি। বেশ ভালোই থাকেন কিন্তু মাঝে-মধ্যেই চিৎকার করে ওঠেন। একটা ইনজেকশন দেওয়ার পর এখন স্বাভাবিক হয়েছেন,”
“দেখা করা যাবে?”
“হুম, তবে বেশিক্ষণ নয়,”
দরজা ঠেলে তিনজনে ভেতরে ঢুকল। বিশ্বনাথ দেখলেন তাঁর সামনে বেডে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন অশোক সেন। মুখে ফুটে আছে এক রহস্যময় হাসি এবং অনবরত বিড়বিড় করে চলেছেন।
স্বামীর পাশে গিয়ে বসলেন মহিলা, “কেন এমন করছ তুমি?”
“ওখানেই আছে। ওই ঘরেই আছে…” আপনমনে বলতে লাগলেন অশোক।
“কোথায় কী আছে? বলো…” উত্তেজিত হয়ে পড়লেন মহিলা।
হঠাৎ ভোল বদলে গেল অশোকের। মুখের রহস্যময় হাসিটা আরও প্রসারিত হয়ে গেল। এক ঝটকায় স্ত্রীর দুহাত খামচে ধরলেন, “ওখানেই আছে…ওই ঘরেই আছে।“
স্বামীর এই আচরণে বেশ ভয় পেয়ে গেলেন মহিলা। নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। রোহিতও এগিয়ে এল তাঁর সাহায্যার্থে। চিৎকার শুনে ডাক্তারও সেখানে হাজির হলেন এবং সবাইকে বাইরে যেতে অনুরোধ করলেন।
দরজার বাইরে পাশে দুটো চেয়ারে বসেছিলেন লীলা সেন এবং বিশ্বনাথ। রোহিত কিছুটা দূরে কার সঙ্গে ফোনে ব্যস্ত। স্বামীর এই অবস্থা দেখে ভেঙে পড়েছেন মহিলা।
“অশোকবাবুর হঠাৎ কী হয়েছিল? দু মাস আগে যখন দেখা হয়েছিল তখন তো বেশ ভালো ছিলেন,” কথাটা না বলে পারলেন না বিশ্বনাথ।
চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন মহিলা, “জানি না ভাই। বেশ ভালোই ছিল। গত মাসে বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে আসার পর থেকেই কেমন একটা হয়ে গেল অশোক।”
“কোথায় গিয়েছিলেন?”
“নবদ্বীপ। সেখানে ওর এক বন্ধু থাকে। তার বাড়িতেই গিয়েছিল তিন-চার দিনের জন্য। সেখানে বিভিন্ন মঠ এবং মন্দিরে ঘুরে ও যে কত খুশি হয়েছিল সেটা আমাকে পরে বলেছিল। শেষদিন গিয়েছিল বেথুয়াডহরী নামক এক জায়গায় ওখানকার বিখ্যাত অভয়ারণ্য দেখার জন্য। তবে ওর নাকি সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল ওখানকার বিভিন্ন পুরনো জমিদার বাড়িগুলো। হিস্ট্রির স্টুডেন্ট হওয়ায় এসব দিকে ওর খুব ঝোঁক।
সেগুলোর মধ্যে নাকি একটা বাড়ির বেশ ভেতরে চলে গিয়েছিল অশোক। সেখানে সে একটা ভাঙা দেওয়ালের ওপারে নাকি একটা তালাবন্ধ ঘর দেখতে পেয়েছিল। কোনোমতে সেই ঘরের সামনে পৌঁছতে পারলেও সন্ধের অন্ধকারে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল। এই কথাটা ও কাউকে বলেনি। কলকাতায় ফিরে আসার কয়েকদিন পরেই অশোক আবার সেখানে যাওয়ার প্ল্যান করে কিন্তু যেদিন যাওয়ার কথা তার আগের দিন থেকেই ওর শরীর খারাপ হয়। ধুম জ্বর আসে আর তখন থেকেই শুরু হয় প্রলাপ বকা। আর আজকে…” ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন মহিলা।
কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন বিশ্বনাথ। তারপর বললেন, “জায়গাটার নাম কী বললেন?”
“বেথুয়াডহরী।”
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ি যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন বিশ্বনাথ। তার ঠোঁটে এক ঝলমলে হাসি ফুটে উঠেছে। হাসিটা নজর এড়াল না রোহিতের।
“কী ব্যাপার কাকু? হাসছ যে বড়?”
“একটা গল্প মাথায় এসেছে।”
“বাহ! কিন্তু এল কীভাবে?”
“অশোককে দেখে। অশোকের এই ঘটনাটাই হবে আমার গল্পের মূল উপজীব্য।”
* * *
বিকেলের পড়ন্ত রোদে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালেন বিশ্বনাথ। দুদিন আগেই বেথুয়াডহরীতে এসে উপস্থিত হয়েছেন ‘ওই ঘর’-এ কী আছে জানার জন্য। জানতে না পারলে যে ওঁর গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। গত দুদিন ধরে এখানকার পুরনো জমিদারবাড়িগুলো তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন। কিন্তু ‘ওই ঘর’-এর সন্ধান পাননি। আজ অনুসন্ধান করবেন বিখ্যাত সিংহ বাড়িতে।
বিশাল এক দোতলা বাড়ি। আশেপাশে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে অজানা সব বড়বড় ঘাস এবং আগাছা। একসময় সম্ভবত এখানে বাগান ছিল। বাড়িটাকে ভালোভাবে দেখতে লাগলেন বিশ্বনাথ। বাকিগুলোর থেকে এর অবস্থা আরও সঙ্গন। ভগ্নপ্রায় বাড়িটা যেন কোনোমতে টিকে আছে। খুব সন্তর্পণে পা বাড়ালেন বিশ্বনাথ। তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগলেন চারদিক।
মিনিট পঁচিশ পরে গিয়ে পৌঁছলেন বাড়ির পেছনের অংশে। বাড়ির অন্য অংশের তুলনায় এখানে লম্বা বারান্দা ছাড়া আর কিছুই নেই। তাহলে কি এটাও সেই বাড়ি নয়? এমন সময় তার চোখ গেল কিছুটা দূরে এক ঘন অন্ধকারে। টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল এক ভগ্নপ্রায় দেওয়াল। জায়গাটা এতটাই গভীরে যে সেখানে হয়তো সূর্যের আলো এসেও পৌঁছয় না। এগিয়ে গেলেন বিশ্বনাথ। টর্চের আলোয় দেখতে পেলেন দেওয়ালের গায়ে বিভিন্ন ফাঁক-ফোঁকর। হঠাৎ তাঁর চোখ গেল দেওয়ালের ডানদিকে বেশ বড় একটা গর্তের ওপর। সেটা একটা মানুষ ঢোকার জন্য যথেষ্ট। সেই গর্তে আলো ফেলতেই চমকে উঠলেন তিনি। এটাই কী সেই ঘর?
বহুকষ্টে সেই ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন বিশ্বনাথ। দরজায় মৃদু ধাক্কা দিতেই একটা বিশ্রী শব্দ করে সেটা খুলে গেল। ঘরে আলো ফেললেন তিনি। কিন্তু হায়! পুরো ঘরই তো ফাঁকা। হতাশ হয়ে পড়লেন তিনি। সত্যিই কি অশোক প্রলাপ বকছে! হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল মেঝের এককোণে থাকা কাঠের এক পাটাতনের ওপর। তাতে ছোট একটা হাতল লাগানো। গুপ্তপথ? এক ঝটকায় বিশ্বনাথ সেই পাটাতনটা টেনে খুলে দিলেন। দেখলেন, একটা সিঁড়ি নেমে গেছে ভূগর্ভস্থে। আর সিঁড়ির শেষপ্রান্তে রয়েছে তালাবন্ধ এক দরজা। তাহলে এটাই কি! সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে গেলেন বিশ্বনাথ। ব্যাগ থেকে একটা পাথর বের করে সজোরে আঘাত করলেন জং-ধরা তালার ওপর। তালা ভেঙে দরজা খুলতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এল তাঁর। সেই সঙ্গে টর্চের আলোয় দেখা গেল এক কাঠের সিন্দুক। আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়লেন তিনি। দ্রুত সিন্দুকটা খুললেন। সোনাদানা কিছু তো হবেই! কিন্তু পরক্ষণেই এক হতাশা নেমে এল তাঁর মুখে। এটা কী! শুধু একটা বই! আর কিছুই নেই!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতে তুলে নিলেন বইটা। মাঝারি আকারের একটা বই। তবে সেটা বেশ ভালো অবস্থাতেই আছে। পাতা ওলটাতে লাগলেন। কিন্তু সেই বইয়ের একটা বর্ণও বুঝতে পারলেন না। কী ভাষা এটা! বেশ খানিকক্ষণ বইটা দেখতে লাগলেন। এমন সময় হঠাৎ তাঁর মনে হল মাথাটা কেমন যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না। বইটা নিয়েই বেরিয়ে গেলেন তিনি।
পরেরদিনই কলকাতায় ফিরে এলেন। নিজের ঘরে বসে মনে মনে গল্পটা সাজানোর চেষ্টা করছিলেন বিশ্বনাথ। রাত তখন প্রায় বারোটা। তাঁর স্ত্রী পাশে ঘুমিয়ে কাতর। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল সেই বইটার কথা। দেরাজ থেকে বইটা বের করতেই এক অদ্ভুত গন্ধ এল তাঁর নাকে। বইটা দেখতে লাগলেন। অজানা বর্ণগুলো গাঢ় লাল কালি দিয়ে হাতে লেখা হয়েছে। কিন্তু এ কী! লেখাগুলো এখন পড়া যাচ্ছে মনে হল!
অবাক হয়ে গেলেন বিশ্বনাথ। ঠিকই তো! স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে! কী একটা নাম লেখা! কী নাম? জমিদার কেদারনারায়ণ সিংহ!
* * *
১৮১৮। অক্টোবর। বেথুয়াডহরী।
কালীপুজোর মহোৎসবে এই প্রথমবার সারা গ্রাম ছেয়ে আছে এক চাপা দুঃখে। গ্রামবাসীর মনে জমেছে এক অজানা ভয়। একমাত্র প্রদীপ এবং মোমবাতির আলোয় সেজে উঠেছে সিংহ বাড়ি। বহুদূর থেকে আত্মীয়রা এসে ভিড় করেছে জমিদারবাড়িতে। বেশ রাত হয়ে গেলেও তখনও গমগম করছে বাড়ির প্রাঙ্গণ। কিন্তু সেই আনন্দে যোগ দেননি জমিদার প্রতাপনারায়ণ সিংহ। তাঁর মনে বাসা বেঁধেছে এক দুশ্চিন্তা। গ্রামবাসীরা তাঁকে খুব মানে। তাদের কাছে জমিদার প্রতাপনারায়ণ ভগবানতুল্য। হবে নাই বা কেন! গ্রামবাসীদের সব দুঃখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন জমিদারমশাই। সব অনুষ্ঠানে বাড়ির প্রাঙ্গণে গ্রামবাসীদের জন্য ভোজনের ব্যবস্থা করেন। গ্রামের ছেলেপুলেদের নিজের সন্তানের চোখে দেখেন তিনি।
বাগানের এককোণে দাঁড়িয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন প্রতাপনারায়ণ। গত একমাস ধরে গ্রামে যে কার কুনজর পড়েছে কে জানে! একমাসের মধ্যে তিন-তিনটে বাচ্চা নিখোঁজ। তন্নতন্ন করে খুঁজেও বাচ্চাগুলোর কোনও হদিশ মেলেনি। আকাশের দিকে তাকিয়ে সেই সবই ভাবছিলেন তিনি। এমন সময় কে যেন ডাকল তাঁকে।
“হ্যাঁ বলো সুদীপ্ত?”
“দাদা নিতাই আর রামু এসেছে। আপনাকে কী একটা বলতে চায়,”
“ঠিক আছে চলো,”
লোহার গেটের একপাশে দাঁড়িয়েছিল দুজনে। জমিদার কাছে আসতেই তারা করজোড়ে প্রণাম করল।
“হ্যাঁ বল, কী বলতে চাস?”
“বাবু রামু বলছে যেদিন কানু নিখোঁজ হল সেদিন নাকি রামু কানুকে দেখেছিল,”
উত্তেজিত হয়ে পড়লেন জমিদারমশাই, “কোথায় দেখেছিলি তাকে?”
“আজ্ঞে বাবু আমি এখানে ছিলাম না। আজকে এসে জানতে পারলাম যে গত পরশু থেকে খোকা নিখোঁজ, এমনকি সাতদিন ধরে কানুকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবু গত সপ্তাহে আমি যখন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলাম তখন কানুকে মাধবীর সাথে দেখেছিলাম। আর বাবু সত্যি বলতে মাধবীকে আমার মোটেই সুবিধার মনে হয় না। ওই কিছু করেছে…”
“কী যা-তা বলছিস!” গর্জে উঠলেন জমিদার, “আড়াই মাসও হয়নি ওর ছেলে মারা গেছে। আর তুই একটা পুত্রহারা বিধবাকে দোষারোপ করছিস,”
“কিন্তু বাবু…”
“আর নিতাই তুইও একে সঙ্গ দিয়েছিস। শুধুমাত্র জঙ্গলে ঘর বেঁধে একা থাকে বলে তোরা ওকে সন্দেহ করছিস। নিতাই তুই তো সেদিন গিয়েছিলি কানুকে খুঁজতে। পেয়েছিলি ওর বাড়িতে বা জঙ্গলের কোথাও?”
“আপনার কথা একদম ঠিক বাবু। কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
“সেদিন যখন মাধবীকে কানুর কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তখন সে বলেছিল কানুর সাথে তার নাকি দেখাই হয়নি। কিন্তু রামু বলছে…”
“হতে পারে রামু ভুল দেখেছে,”
“না বাবু, আমি আমার মেয়ের দিব্যি করে বলছি সেদিন কানুর সাথে মাধবীকেই দেখেছিলাম,”
এবার একটু চিন্তায় পড়লেন প্রতাপনারায়ণ। যাই হোক রামু নিজের মেয়ের দিব্যি করে মিথ্যে বলবে না।
“এটা যদি মিথ্যে হয় তাহলে তোদের দুজনকেই গ্রামছাড়া করাব কিন্তু মনে রাখিস!”
“আজ্ঞে বাবু। তবে ওর বাড়িতে আমাদের আরেকবার যাওয়া উচিত।”
“হুম,” বেশ চিন্তিত দেখাল প্রতাপনারায়ণকে।
“তাহলে বাবু কাল সকালে যাবেন কি?”
“না, আজ রাতেই যাব।”
* * *
২০১৮। ডিসেম্বর। কলকাতা।
“এই রূপসা, আরে বলো না কী হয়েছে?” শেষে বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞাসা করল রোহিত।
কফির কাপ থেকে ঠোঁটটা সরিয়ে রূপসা একটা কড়া নজরে তাকাল রোহিতের দিকে। সকালে একসাথে বেরোনোর পর থেকেই রোহিতের সাথে একটাও কথা বলেনি সে। বহু চেষ্টা করেও তার মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারেনি রোহিত। সকাল থেকেই রূপসার মুড যে ভয়ানক বিগড়ে আছে সেটা বুঝতে পেরে ইতিমধ্যেই রোহিত কতবার যে ভগবানকে ডেকে নিয়েছে তার ঠিক নেই।
“আরে না বললে বুঝব কীভাবে!”
কাপটা টেবিলের ওপর রেখে এবার মুখ খুলল রূপসা, “কী হয়েছে জানো না তুমি? বেশি ন্যাকামো কোরো না। পাঁচদিন ধরে টানা ফোন করছি, টেক্সট করছি কিন্তু বাবুর কোনও পাত্তাই নেই। কেন একবার ঘুরিয়ে ফোন করা যায় না, টেক্সটের রিপ্লাই করা যায় না!”
“আজকে দেখা করলাম তো! আসলে কয়েকদিন কাজের যা চাপ ছিল…”
“সেই তো, আমার জন্য তো তোমার কাছে সময়ই নেই। আমার সাথে যে কী হচ্ছে সেটা তোমার শোনার তো দরকারই নেই, তাই না?” অন্যদিকে তাকাল রূপসা।
“কী হচ্ছে মানে! কী হয়েছে?” এবার একটু সিরিয়াস হয়ে পড়ল রোহিত।
“কিছু না।”
রূপসার হাতের ওপর নিজের হাত রাখল রোহিত, “বলো কী হয়েছে?”
রোহিতের চোখে তার জন্য ভালোবাসা দেখে মনে মনে বেশ খুশি হল রূপসা, বলল, “তেমন কিছু না কিন্তু কয়েকদিন ধরেই বেশ অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখছি। এই ব্যাপারে তোমার সাথে কথা বলব ভেবেছিলাম কিন্তু তুমি তো…”
বাধা দিয়েই বলল রোহিত, “সরি, ভেরি সরি। কিন্তু এখন বলো প্লিজ।”
“আসলে বেশ কয়েকদিন ধরে একটা বাজে স্বপ্ন দেখছি। দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি আর আমার পায়ের সামনে কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে মুখ দেখা না গেলেও সে যে বেশ লম্বা একজন সেটা বোঝা যায়। দূর থেকে শুধু তার দুটো লাল চোখ জ্বলজ্বল করে। আস্তে আস্তে সে আমার দিকে এগিয়ে আসে…” বলে একটু থেমে গেল রূপসা।
“তারপর?”
“তারপর সে তার কালো শরীরটা নিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে আসে। তার লোমশ হাত দিয়ে আমার হাত দুটো চেপে ধরে। আর তারপর শুরু হয় আমার শরীর নিয়ে তার জঘন্য খেলা। তখন আমি টুঁ শব্দ পর্যন্ত করতে পারি না। আমার শরীর যেন তখন পাথর হয়ে যায়। শুধু চোখ মেলে দেখি আমার চোখের ঠিক সামনে জ্বলতে থাকা তার লাল দুটো চোখ,”
“তারপর,”
“তারপর ঘুম থেকে উঠে দেখি কোথাও কেউ নেই। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম।”
“হুম…বুঝলাম।”
“কী?”
“এই ভূতের সিনেমাগুলো দেখা বন্ধ করো আর ওইগুলোও বুঝলে?” মুচকি হাসল রোহিত।
“যাঃ, তুমিও না।”
“আরে সত্যি বলছি। ভূতের সিনেমা দেখা কমাও দেখবে ভূতও আর স্বপ্নে আসবে না।”
কিছুক্ষণ দুজনে পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। যেন চোখের ইশারায় দুজনের মধ্যে কথা হচ্ছে। হঠাৎ রূপসা চোখ সরিয়ে নিল।
“কী হল?”
“তুমি আমাদের ব্যাপারটা আমার বাবাকে কবে জানাবে?”
“জানাব জানাব। আচ্ছা কাকুর গল্পের কী খবর?”
“কথা ঘুরিয়ে দিলে তো!”
“বলো না,” ম্লান হাসল রোহিত।
“আর বোলো না সে কথা,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রূপসা।
“কেন?”
“গল্পে পুরো ডুবে গেছে বাবা। গল্প লিখবে বলে অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে। খাওয়া-দাওয়া প্রায় লাটে তুলেছে। দোতলায় আমার বেডরুমের পাশে দিদার ফাঁকা রুমটা দখল করেছে। ওটাই এখন বাবার স্টাডি-কাম-বেডরুম। কাউকে ঢুকতে পর্যন্ত দেয় না ঘরে। তার ওপর আবার কী একটা বই নিয়ে এসেছে। সারাক্ষণ ওই নিয়েই পড়ে থাকে।”
“বই?”
“হ্যাঁ, ওই অশোককাকু কোথায় একটা ঘুরতে গিয়েছিল না, কী নাম যেন…বে-বেথু…”
“বেথুয়াডহরী।”
“হ্যাঁ ওই। ওখানকার কোন এক জমিদার বাড়ি থেকে নাকি বইটা নিয়ে এসেছে। কী যে ছাতার মাথা ভূতের গল্প লিখছে কে জানে!”
“তাহলে মনে হচ্ছে প্রাইজটা কাকুই মারবে।”
“হুম মনে হচ্ছে,” মুচকি হাসল রূপসা, “এই ভালো কথা, অশোককাকুর কী খবর? এখন কেমন আছেন?”
“অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেদিন তো নাকি কাকিমাকেই মারতে গিয়েছিল। তারপর থেকে কাকিমা দরজার বাইরে থেকেই দেখা করে। জানো তো ডাক্তারও ঠিক বুঝতে পারছে না।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল দুজনে। বাইরে মেঘ কালো করে এসেছে। দু-একবার মেঘের গর্জনও শোনা গেছে। বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায় আর দেরি না করে সেখান থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল তারা।
* * *
১৮১৮। অক্টোবর। বেথুয়াডহরী।
সদলবলে জঙ্গলের সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রতাপনারায়ণ সিংহ। সবারই এক হাতে একটা বড় লাঠি এবং অপর হাতে মশাল। অমাবস্যার সেই রাতে যেন কেউ পুরো গ্রামকে ঢেকে রেখেছে ঘন অন্ধকারের চাদরে। সেই অন্ধকারের মধ্যে শুধু আলোকিত হয়ে আছে জঙ্গলের একদিক।
“দাদা, আমরা ঠিক করছি তো?” পাশ থেকে বলে উঠলেন প্রতাপনারায়ণের ভাই।
জমিদার একবার রামুর দিকে তাকালেন। তারপর এগিয়ে গেলেন জঙ্গলের মধ্যে মাধবীর বাড়ির দিকে। বাকিরা তাকে অনুসরণ করল। অতি সন্তর্পণে মশাল হাতে এগিয়ে চলল সবাই। আগুনের আলোয় জঙ্গলের গাছগুলোকে ভূতের মতোই দেখতে লাগল। এই যেন লম্বা লম্বা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল! জঙ্গলে বাঘ-নেকড়ে নেই ঠিকই তবে বিষাক্ত সাপ আছে যাদের এক কামড়ে মৃত্যু অনিবার্য। বেশ খানিকটা এগোনোর পর কিছুটা দূরে কুঁড়েঘরের মতো কিছু একটার সিলুয়েট চোখে পড়ল। ধীর গতিতে সেখানে গিয়ে থামলেন প্রতাপনারায়ণ। অন্ধকারে ডুবে থাকা কুঁড়েঘরটা মশালের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে।
“কেউ কথা বলবে না,” দরজার সামনে এগিয়ে গেলেন জমিদার এবং অতি শান্তস্বরে ডাকলেন, “মাধবী। মাধবী, আমি জমিদার প্রতাপনারায়ণ সিংহ। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে বলেই এত রাতে বিরক্ত করলাম। মাধবী, মাধবী…”
অনেক ডাকাডাকির পরেও দরজা খুলল না মাধবী। কী ঘুম রে বাবা! প্রতাপনারায়ণ কিছুটা পিছিয়ে এলে বাকিরা একসাথে মাধবীর নাম ধরে ডাকতে লাগল। তখনও মাধবীর খুম ভাঙল না দেখে মাথা গরম হয়ে গেল রামুর। সে এগিয়ে গিয়ে লাথি মারতে লাগল দরজায়। রামুর এই কাণ্ড দেখে বেজায় রেগে গেলেন জমিদারমশাই। রামুকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই লাথির ধাক্কায় খুলে গেল ঘরের পুরনো দরজা। কিন্তু এ কী! কোথায় মাধবী! ঘরে তো মানুষই নেই! কিন্তু এত রাতে ও গেল কোথায়?
“দেখলেন তো বাবু, আমি বলেছিলাম না মাধবীকে সুবিধার মনে হয় না।”
এবার সত্যিই সন্দেহ হতে লাগল প্রতাপনারায়ণের। তৎক্ষণাৎ তিনি মাধবীকে খোঁজার আদেশ দিলেন। আদেশ পাওয়ামাত্রই সবাই মাধবীকে খুঁজতে আরও গভীর জঙ্গলের দিকে এগোল।
রাত ক্রমশ বেড়ে চলেছে। সেই সঙ্গে নিভে আসছে মশালের আগুন। কিন্তু মাধবীকে খোঁজার এক জেদ ধরে বসেছেন প্রতাপনারায়ণ। সেই জেদের বশে সদলবলে তিনি এগিয়ে যেতে লাগলেন জঙ্গলের ওপারের ছোট পাহাড়টার দিকে। সেই পাহাড়ের একপাশে একটা ছোট গুহার মতো জায়গা আছে কিন্তু সেখানেও কানুদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে আজ প্রতাপনারায়াণের মন বলছে যে ওখানেই মাধবীর খোঁজ পাওয়া যাবে।
* * *
২০১৮। ডিসেম্বর। কলকাতা।
সেদিনের পর থেকে রূপসার সাথে আর কোনও কথা হয়নি রোহিতের। রোহিতের কাজের চাপ দিনদিন বেড়েই চলেছে। তবে এইবারে রোহিতের কোনও দোষ নেই। অফিস থেকে বেরিয়ে প্রতিদিনই রূপসাকে ফোন করত রোহিত। কিন্তু এবারে রূপসাকে ফোনে পাওয়া যেত না। ফোন করলেই সেই একই কথা- ‘আপনি যে নম্বরে ফোন করেছেন সেটি এখন বন্ধ আছে’। বিশ্বকাকুকে ফোন করলে উনিও এখন ফোন ধরেন না। এতটাই গল্পে ডুবে গেছেন। তাই এক ছুটির দিন বিকেলের দিকে রোহিত রূপসার সাথে দেখা করতে তার বাড়িতে আসে। যদিও তার আসার অপর এক কারণও ছিল বটে।
বেল বাজার অনেকক্ষণ পরেই দরজা খোলেন বিশ্বনাথ। দরজার বাইরে রোহিতকে দেখে বেশ বিস্মিত হলেন।
“কেমন আছেন কাকু? এখন আর আমার বাড়িতে যানই না,” একগাল হেসে বলল রোহিত।
নিজেকে গোছাতে একটু সময় নিলেন বিশ্বনাথ, “আরে রোহিত যে! আসলে গল্পটা এমনভাবেই মাথায় গেঁথে গেছে যে সেটা ছাড়া আর কিছুর খেয়ালই নেই।”
“ভেতরে আসতে পারি?”
“ভে-ভেতরে? হুমম…এ-এসো।”
বাড়ির ভেতরে ঢোকামাত্র একটা কটু গন্ধ নাকে এল রোহিতের। পচা বিশ্রী এক গন্ধ। বাড়ির ভেতরের পরিবেশটাও বেশ অবাক করে দিল তাকে। বাড়ির জানলা-দরজা সব বন্ধ। বন্ধ জানলাগুলো আবার কালো পর্দা দিয়ে ঢাকা। বাড়ির ভেতরে আলোর চিহ্নমাত্র নেই। সেই অন্ধকারের মধ্যেই বিশ্বনাথ একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন রোহিতের দিকে।
“চারদিকে অন্ধকার করে রেখেছেন কেন কাকু? জানলা-দরজাও সব বন্ধ!”
“না আসলে ভয়ের গল্প তো, তাই পরিবেশটাকেও একটু ভয়ের করে রেখেছি যাতে লেখার সময় ভয়টা অনুভব করতে পারি,” একটা অদ্ভুত হাসি হাসল বিশ্বনাথ।
“কাকিমা আর রূপসা কোথায়? একটা কাজের জন্য রূপসাকে ফোন করেছিলাম কিন্তু ওর ফোন অফ বলছিল,”
“তি-তিন চারদিন হল রূপসা আর রত্না দুজনে রূপসার মামার বাড়িতে গেছে। আর ওখানে খুব নেটওয়ার্ক প্রবলেম,” এবার কেমন যেন উশখুশ করতে লাগলেন বিশ্বনাথ, “আ-আর কিছু?”
“হ্যাঁ, আসলে আমি একটা দুঃসংবাদ দিতে এসেছিলাম কাকু। কাল মাঝরাতে অশোককাকু সুইসাইড করেছেন।”
“কি?” রোহিতের নজর এড়িয়ে একটা চাপা হাসি খেলে গেল বিশ্বনাথের মুখে।
“হুম। তবে এত নৃশংস সে আত্মহত্যা যে বলতে গিয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে,”
“কে-কেন?”
“কাল মাঝরাতে এক নার্স কাকুকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়েছিল। দরজার সামনে এসেই চিৎকার করে ওঠে সে। তার চিৎকারে বাকি সবাই ছুটে আসে এবং দেখে এক ভয়াবহ দৃশ্য।”
“কী?” হাসিটা আরেকটু প্রসারিত হল বিশ্বনাথের।
“অশোককাকু নিজের বেডের ওপর বসে এক অস্বাভাবিক চাহনিতে তাকিয়ে ছিলেন সেই দরজার দিকে। আর একটা হাত দিয়ে নিজের গলা চেপে ধরেছিলেন। এতটাই চাপ দিচ্ছিলেন যে তাঁর হাতের আঙুলগুলো ধীরে ধীরে চামড়া ভেদ করে গলার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসছিল রক্তের ধারা। তাঁর মুখে ছিল রহস্যময় এক হাসি। মুহূর্তের মধ্যে সেই হাতটা নিজের গলার ভেতরে ঢুকিয়ে টেনে বের করে নিয়ে আসেন নিজের শ্বাসনালি। তাঁর রক্তে ভরে যায় পুরো বেড।”
“তারপর?”
“ভেতর থেকে লক থাকা দরজাটা যেভাবে হোক খুলে যখন ডাক্তাররা ভেতরে গেল তার আগেই সব শেষ হয়ে যায়।”
“বাহ! ইন্টারেস্টিং!” হাসিটা ছড়িয়ে যায় বিশ্বনাথের সারা মুখে।
এবার সেটা নজর এড়াল না রোহিতের। সে একটু রেগেই বলল, “এখানে এত বড় একটা কাণ্ড ঘটে গেল আর আপনি হাসছেন কাকু। এটা আপনাকে শোভা দেয় না।”
“আ-আমাকে ভুল ভেব না রোহিত। আসলে গল্পের এন্ডিং-টা যে এমন হবে সেটা আশা করিনি।”
রোহিতের রাগ ক্রমশ বাড়তে লাগল। এখানে একটা মানুষ চলে গেলেন আর বিশ্বকাকু সারাক্ষণ শুধু গল্প গল্প করে যাচ্ছেন। আর থাকতে পারল না রোহিত।
“একটা কথা বলব কাকু। এটা যদি আপনার পরিবারের কারোর সাথে হয় তখনও কি আপনি এভাবেই রিয়্যাক্ট করবেন? তখন থেকে শুধু একটাই কথা- গল্প আর গল্প। কী আছে আপনার ওই গল্পে?”
হঠাৎ ভোল পাল্টে গেল বিশ্বনাথের। তাঁর মুখের হাসিটা মুহূর্তের মধ্যে পরিণত হল এক প্রচণ্ড ক্রোধে। তাঁর বড় চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে রক্তবর্ণ চোখে রোহিতের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বিশ্বনাথের এই হিংস্র চাহনি দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল রোহিত।
রোহিতের খুব কাছে এসে এক ভৌতিক গলায় বললেন বিশ্বনাথ, “কী বললি তুই! কী আছে আমার গল্পে? জানতে চাস কী আছে? আমার গল্পে ভয় আছে…ভয়…আর এক অদ্ভুত আনন্দ…”
* * *
১৮১৮। অক্টোবর। বেথুয়াডহরী।
মশালের আগুন এখন অনেকটাই নিভে এসেছে। সেই ক্ষীণ আলোয় গভীর জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকতেও কয়েকজনের সাহসে কুলোচ্ছে না। কিন্তু জমিদারের কথা অমান্য করার সাহস তাদের নেই। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজ তারা বাধ্য।
বেশ খানিকটা এগোনোর পর তাদের চোখ পড়ল অন্ধকারে ডুবে থাকা পাহাড়টার ওপর। এই অন্ধকারে সেটাকে দেখে মনে হল যেন এক দানব নিজের হাত মেলে তাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছে। তবে যে জিনিসটা তাদের সবথেকে বেশি অবাক করল তা হল সেই গুহার ভেতরেছড়িয়ে থাকা এক রহস্যময় আলো। এত রাতে সেখানে কীসের আলো? তাহলে কি!
একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল প্রতাপনারায়ণের ঠোঁটের কোণে। নিঃশব্দে গুহার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। এগোনোর সঙ্গে সেই আলোটাও বেশ উজ্জ্বল হতে লাগল। ধীর পায়ে গুহার সামনে এসে দাঁড়াল তারা এবং মুহূর্তের মধ্যে তাদের সবার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। তারা দেখল গুহার মাঝখানে জ্বলছে এক যজ্ঞের আগুন। তার একপাশে লাল বস্ত্রধারণ করে অদ্ভুত এক ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছে মাধবী। আর অপরপাশে মাটিতে পড়ে আছে পচাগলা এক মৃতদেহ। সেটা যে মাধবীর ছেলে লালুর মৃতদেহ তা বুঝতে কারোর অসুবিধা হল না। সেই মৃতদেহের ঠিক ওপরে উল্টোভাবে ঝুলছে অপর এক দেহ, খোকার দেহ। খোকার গলায় বড়সড় একটা কাটা দাগ। সেখান থেকে গলগল করে বেরোচ্ছে তাজা লাল রক্ত আর সেই রক্ত গিয়ে পড়ছে লালুর মুখের ওপর। লালুর দেহ রক্তে লাল উঠেছে। ঝুলন্ত দেহটা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে আর মাটিতে পড়ে থাকা দেহটা যেন থেকে থেকে নড়ে উঠছে। সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে বিস্ময় আর ক্রোধে ফেটে পড়লেন প্রতাপনারায়ণ।
“মাধবীঈঈঈ…” চিৎকার করে উঠলেন জমিদার।
চিৎকার শুনে মন্ত্রোচ্চারণ না থামিয়েই সেদিকে ঘুরে তাকাল মাধবী। এক ভয়ানক ক্রোধে জ্বলে উঠেছে তার লাল চোখদুটো। কী ভয়ানক সেই চাহনি!
“আমি কোনোদিন ভাবতেও পারিনি যে তুই এত জঘন্য একটা কাজ করতে পারিস। তুই মানুষ না, তুই ডাইনি!” বলেই আদেশ দিলেন সবাইকে, “এক্ষুনি এই ডাইনিকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেল। আর এর চোখের সামনেই জ্বালিয়ে দে এর ছেলের মৃতদেহ। তারপর একেও জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিবি। এইরকম ডাইনির শাস্তি আর কিছু হতে পারে না,” রাগে ফোঁসফোঁস করছিলেন প্রতাপনারায়ণ।
আদেশ পাওয়ামাত্রই গ্রামবাসীরা মাধবীকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেল সামনের এক বটগাছের কাছে এবং শক্ত করে বেঁধে দিল তাকে। তখনও মাধবীর মন্ত্রোচ্চারণ থামেনি। একইভাবে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে সেই অজানা ভাষা। এবার প্রতাপনারায়ণ নিজের হাতে তুলে নিলেন জ্বলন্ত এক কাঠ এবং আগুন ধরিয়ে দিলেন মাটিতে পড়ে থাকা সেই মৃতদেহে। একটা গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে আসতে লাগল সেই দেহ থেকে। এইবার থেমে গেল মাধবীর মন্ত্রোচ্চারণ। করুণ নয়নে তাকিয়ে থাকল ছেলের জ্বলন্ত দেহটার দিকে। পরক্ষণেই তীব্র জিঘাংসায় তাকাল প্রতাপনারায়ণের দিকে।
“প্রতাপনারায়ণ, শয়তান। তুই আমার ছেলেকে নতুন করে আমার কাছে ফিরতে দিলি না। আমার অমঙ্গল করে বাকিদের মঙ্গল করছিস তুই! কিন্তু আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি, তোর ঘরে এমন একজনের জন্ম হবে যে হবে সাক্ষাৎ শয়তানের রূপ। তুই যে গ্রামবাসীদের রক্ষা করছিস তাদের সবার সর্বনাশ হবে তোর সেই উত্তরসূরির হাতেই। তোর উত্তরসূরিই নিজের হাতে শেষ করবে তোর বংশ। মনে রাখিস শয়তান, মনে রাখিস…”
* * *
২০১৮। ডিসেম্বর। কলকাতা।
সেদিনের ঘটনায় রোহিত এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে সেটার ব্যাপারে তার বন্ধু অনিরুদ্ধকে জানাতে বাধ্য হয় সে। বিশ্বকাকু যে এমন একটা আচরণ করবেন সেটা ভাবতেই পারেনি রোহিত। সেদিন রাতেও রূপসাকে ফোন করে কোনও লাভ হয়নি। তখনও তার ফোন অফ ছিল। বাধ্য হয়ে সে যোগাযোগ করেছিল রূপসার মামাতো দাদা রুপমের সঙ্গে। রুপম রোহিতের ফেসবুক ফ্রেন্ডও বটে। কিন্তু রুপম যখন জানায় যে রূপসা ও তার মা তাদের বাড়িতে যায়নি তখনই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল রোহিতের। তাহলে তারা গেল কোথায়?
পুরো ঘটনাটা শোনার পর অনিরুদ্ধ যে কথাগুলো বলেছিল সেটা রোহিতের কাছে একইসঙ্গে অবিশ্বাসের এবং বিস্ময়ের। কিন্তু রূপসার প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা তাকে সেটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে। তাই অনিরুদ্ধের কথামতো তার সঙ্গে কোন এক ঠাকুরমশাইয়ের কাছে যেতে রাজি হয়েছে সে। তিনি নাকি তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। গাড়িতে বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে শুধু একটাই কথা তার মাথায় ঘুরছে- রূপসা এখন কোথায়?
রূপসার চিন্তায় রোহিত এতটাই মগ্ন যে সে কোথায় যাচ্ছে সেদিকে কোনও খেয়ালই নেই। গাড়ি থামতে হুঁশ ফিরল। কোনও এক গ্রামের পাশে ছোট রাস্তার ধারে এসে দাঁড়িয়েছে গাড়িটা।
“এখান থেকে হেঁটেই যেতে হবে। বেশি না, মিনিট কুড়ির পথ,” বলেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল অনিরুদ্ধ।
রোহিতও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নামল। গ্রামের পরিবেশ সেজে উঠেছে গোধূলিবেলার এক অপরূপ সৌন্দর্যে। রাঙা আকাশের দিগন্তে সূর্যের অস্তিত্বটুকু তখনও চোখে পড়ছে। কানে ভেসে আসছে পাখিদের ঘরের ফেরার গান। তবে সেই সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করে রোহিত এগিয়ে চলেছে গ্রামের এক অজানা পথে।
মিনিট কুড়ি পর একটা পুরনো মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে। সূর্যের শেষ আভাটুকুও তখন বিলীন হয়ে গেছে সন্ধের অন্ধকারে। মন্দিরটার জাঁকজমক দেখে বোঝাই যায় না সেটা প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো। ভক্তদের ভিড়ে গমগম করছে মন্দির। সেই দিকে এগিয়ে গেল অনিরুদ্ধ। রোহিত তাকে অনুসরণ করল।
মন্দিরের ভেতরে ঠাকুরমশাই তখন পুজোয় ব্যস্ত। বাধ্য হয়ে রোহিতকে অপেক্ষা করতে হল। পনেরো মিনিট পর পুজো শেষ হতে ঠাকুরমশাই এগিয়ে এলেন তাদের কাছে।
“আরে অনিরুদ্ধ যে! ভালো আছ?”
‘আজ্ঞে ঠাকুরমশাই,” প্রণাম করল অনিরুদ্ধ।
“এই সুবীর, এদিকে এসো,” ঠাকুরমশাইয়ের এই ডাক শুনে প্রসাদের থালা হাতে বছর কুড়ির এক যুবক এসে হাজির হল।
প্রসাদ খেয়েই বলতে শুরু করল অনিরুদ্ধ, “ঠাকুরমশাই বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। এই যে আমার বন্ধু রোহিত…রোহিত ঠাকুরমশাইকে যা যা ঘটেছে সবটা খুলে বল। একমাত্র ইনিই আমাদের হেল্প করতে পারবেন।”
“অবশ্যই, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। বলো,” আশ্বাস দিলেন ঠাকুরমশাই।
সবটা বলতে লাগল রোহিত। এমনকি অশোককাকুর কথাটাও জানাল সে। পুরো ঘটনা শুনে আতঙ্কে আঁতকে উঠল সুবীর।
“তা-তার মানে সব স-সত্যি!” কাঁপতে লাগল সুবীর।
“কী সত্যি! কীসের কথা বলছ তুমি?” সুবীরের কাছে এগিয়ে এল রোহিত, “কী জানো তুমি? বলো বলো…”
এক অদ্ভুত ভয় নেমে এসেছে সুবীরের চোখে-মুখে। ভয়ে ভয়ে সে বলল, “সে এক ভয়ানক ঘটনা এবং আমাদের পরিবার ছাড়া তার ব্যাপারে হয়তো আর কেউ জানে না। সাত-আট বছর বয়স থেকে আমি সে গল্প আমার বাবার কাছ থেকে শুনে আসছি,” একটু থামল সুবীর।
“কী সেই ঘটনা। বলো…প্লিজ…”
বলতে শুরু করল সুবীর।
“ঘটনাটা ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে। কেশবনারায়ণ সিংহ ছিলেন তখন বেথুয়াডহরীর শ্রেষ্ঠ জমিদার। নিজের পূর্বপুরুষদের মতো ইনিও গ্রামবাসীদের খুব ভালোবাসতেন। তাদের সব বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। গ্রামবাসীরাও তাঁকে ভগবানের মতো শ্রদ্ধা করত। বিপত্নীক জমিদার মশাইয়ের সংসার বলতে ছিল তাঁর একমাত্র সন্তান কেদারনারায়ণ, পুত্রবধূ সরলা এবং সাত বছরের নাতনি সুমি। সবার চোখেই তিনি ছিলেন এক আদর্শ পুরুষ।
তবে তাঁর মনে জমেছিল এক চাপা দুঃখ। বেশ কয়েকবছর ধরে গ্রামের মেয়েগুলো রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যেতে লাগল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও তাদের খোঁজ মিলত না। সবারই বয়স ছিল পনেরো থেকে পঁচিশের মধ্যে এবং সবাই ছিল অবিবাহিতা। প্রতিদিনই নিখোঁজ মেয়েগুলোর বাড়ির লোক জমিদারের সামনে করুণ নয়নে তাকিয়ে থাকত কিন্তু সেই চোখের দিকে তাকানোর ক্ষমতা ছিল না কেশবনারায়ণের।
বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে শেষে এই দায়িত্বের ভার নেয় কেদারনারায়ণ। কেদারনারায়ণ খুব মেধাবী ছিল এবং সেই জন্যই হয়তো কেশবনারায়ণ তাঁর ছেলের প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন। কিন্তু তারপর…”
“তারপর কী?” অধৈর্য হয়ে পড়ল রোহিত।
“তারপর একদিন মোহনলাল নামে গ্রামের একজন জমিদারের সঙ্গে দেখা করতে আসে এবং কেশবনারায়ণকে জানায় গত রাতে তার দেখা এক ভয়াবহ ঘটনার কথা,”
“কী ঘটনা?”
“মোহনলাল জানতে পেরেছিল যে এই ঘটনার পেছনে কে ছিল। কিন্তু সেটা যখন ও জানায় তখন জমিদার রেগে গিয়ে মোহনলালের গালে এক চড় কষিয়ে দেয়…”
“কেন?” বাধা দিয়ে বলল অনিরুদ্ধ।
“কারণ এই ঘটনার পেছনে ছিল জমিদারের একমাত্র ছেলে কেদারনারায়ণ। সে-ই এত বছর ধরে মেয়েগুলোকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যেত এবং তাদের সর্বনাশ করে জ্যান্ত পুঁতে দিত গভীর জঙ্গলে।”
“কি! কেদারনারায়ণ?”
“আমার বাবা বলেছিল সিংহ বাড়িতে নাকি একমাত্র কেদারনারায়ণই ছিল সাক্ষাৎ শয়তানের রূপ। তবে এর পরের ঘটনা আরও ভয়াবহ,” আবার বলতে শুরু করল সুবীর।
“মোহনলাল কথাগুলো এতটাই জোর দিয়ে বলেছিল যে জমিদারের মনে একটা খুঁত থেকে গেল। এটা যদি সত্যি হয় আর গ্রামবাসীরা জানতে পারে তাহলে তারা কেশবনারায়ণকে ঘৃণার চোখে দেখবে। আর সেটা তিনি কখনই চাননি। তাই তিনি তাঁর ছেলের ওপর নজর রাখতে শুরু করেন। এটা সত্যি হলে তিনি নিজেই কেদারনারায়ণকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন কিন্তু সেটা সবার চোখের আড়ালে।
বেশিদিন নজর রাখতে হয়নি কেশবনারায়ণকে। একদিন হাতে-নাতে ধরা পড়ে যায় তাঁর ছেলে। তবে সেইদিনের পর থেকে ছেলের প্রতি রাগের চেয়েও নিজের ওপর বেশি ঘৃণা হতে লাগল জমিদারের।”
“কেন?” আবার প্রশ্ন করে অনিরুদ্ধ।
“কারণ ছেলের প্রতি অগাধ ভালোবাসার দরুণ তিনি কেদারনারায়ণকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেননি। এমনকি ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কোনোভাবে ঘটনাটা কেদারনারায়ণের স্ত্রী সরলাদেবীর কানে পৌঁছয়। সরলাদেবী ছিলেন সাহসী, জেদি এবং সত্যের পূজারী। সত্যিটা জানার পরেই তাঁর শ্বশুরের আপত্তি সত্ত্বেও গ্রামবাসীদের জানিয়ে দেন তাঁর স্বামীর কুকর্মের কথা। ব্যস, তারপর গ্রামবাসীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে মারতে আসে কেদারনারায়ণকে কিন্তু সেই শয়তান কোনোভাবে গ্রাম থেকে পালাতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে কেশবনারায়ণ যার ভয় করেছিলেন ঠিক সেটাই হয়। গ্রামবাসীরা এমনকি তাঁর পুত্রবধূও তাঁকে ঘৃণার চোখে দেখা শুরু করে। সেই লজ্জায় এবং অপমানে একদিন কেশবনারায়ণ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন,” এতটা বলে একটু থামে সুবীর।
“তারপর কী হল?” এবার প্রশ্ন রোহিতের।
“তারপর থেকে আবার খুশির জোয়ার আসে গ্রামে। গ্রামবাসীর কাছে সরলাদেবী হয়ে ওঠেন মা দুর্গার প্রতিরূপ। ভালোই চলছিল সব কিছু। কিন্তু প্রায় দুবছর পর আবার গ্রামে ফিরে আসে কেদারনারায়ণ। এই দুবছরে সে বিভিন্ন তান্ত্রিকদের থেকে শিখে নিয়েছিল বিভিন্ন তন্ত্রবিদ্যা। সেদিনের অপমান সে ভুলতে পারেনি এবং তার প্রতিশোধ নিতেই সে ফিরে এসেছিল গ্রামে। এক রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে সে সিংহ বাড়িতে আসে এবং সরলাদেবীর ঘরে ঢোকে। সরলাদেবী তখন মেয়ে সুমির সঙ্গে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কেদারনারায়ণ কোমর থেকে একটা ধারালো অস্ত্র বের করে এবং ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে তার ঘুমন্ত স্ত্রীর পেটে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠেন সরলাদেবী এবং চোখ খুলে দেখতে পান তাঁর স্বামীকে। তার সারা মুখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল সরলাদেবীর রক্ত। তার চোখে জ্বলছিল প্রতিহিংসার আগুন আর মুখে ছিল এক জঘন্য হাসি।
মায়ের চিৎকার শুনে সুমীর ঘুম ভেঙে যায় আর এই বীভৎস দৃশ্য দেখে এককোণে ভয়ে কাঁদতে থাকে। পরে সেই শয়তান নিজের মেয়ের গলা কেটে দেয় আর একটা বই বের করে তাতে কীসব লিখতে থাকে নিজের মেয়ের রক্ত দিয়ে।”
এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে ওঠে রোহিতের সর্বাঙ্গ। ভয়ার্ত গলায় সে বলল, “কী লিখেছিল?”
“শয়তানটা জানতে পেরেছিল মৃত্যুর পরেও কীভাবে নিজেকে ফিরিয়ে আনা যায়। তাই মৃত্যুর পর নিজেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সে নিজের মেয়ের রক্ত দিয়ে লিখেছিল এক মন্ত্র। শুধু তাই নয়, এই মন্ত্র পড়ে যদি কেউ নিজের মেয়ের রক্ত দিয়ে ওই মন্ত্রটা লেখে তাহলে ধীরে ধীরে শয়তানটার শক্তি বাড়তে থাকবে এবং একশটা যুবতীর রক্তে যেদিন মন্ত্র লেখা শেষ হবে সেদিন আবার হবে তার নতুন রূপে আবির্ভাব, পরিণত হবে এক সর্বশক্তিশালী দানবে।
নিজের স্ত্রী-মেয়েকে হত্যা করার পর সে গ্রামের সব পুরুষদের নিজের বশে করে নিয়েছিল। তারা কেদারনারায়ণকে প্রভু বলে মানতে লাগল এবং সেই সুযোগে তাদের যুবতী মেয়েদের শরীর নিয়ে শুরু হয় শয়তানটার পাশবিক যৌন খেলা। তার কাছে সেটাই ছিল শিষ্যদের থেকে পাওয়া শ্রেষ্ঠতম ভোগ। শুধু তাই নয়, শয়তানটার জন্মদিনে সবাই তাকে উপহার দিত। সেই উপহার ছিল সেই হতভাগ্য মেয়েগুলোর রক্তে তাদের বাবাদের দ্বারাই লেখা সেই মন্ত্র।”
আঁতকে উঠল রোহিত। তার মানে সেদিন রূপসা যা বলছিল সব সত্যি!
“ওদের মা-রা কিছু করতে পারত না?” বলে উঠল অনিরুদ্ধ।
“না! গ্রামের পুরুষেরা তাদের স্ত্রীদেরকে তার আগেই মেরে ফেলত। কিন্তু সব বিপদ থেকে বেরোনোর একটা উপায় সবসময় থাকে। মহাদেবের অশেষ কৃপায় একমাত্র মোহনলাল গ্রাম থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিল। সেখান থেকে পালিয়ে মোহনলাল চলে যায় মেদিনীপুরে আমার গ্রামে। সেখানে তার দেখা হয় আমার পূর্বপুরুষ শ্রীমান শিবরাম ভট্টাচার্যের সঙ্গে। শিবরাম ভট্টাচার্য ছিলেন তখনকার এক মহান পণ্ডিতাচার্য রামানন্দের প্রিয় শিষ্য। পণ্ডিতাচার্য সব কথা শুনে তখনই রওনা দেন বেথুয়াডহরীর উদ্দেশ্যে।
সেদিন ছিল ঘোর অমাবস্যা, সঙ্গে সেই শয়তানের জন্মদিনও। সারা গ্রাম অন্ধকারে ডুবে ছিল। একমাত্র গমগম করছিল সিংহ বাড়ি। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকে তিনজন এবং তাদের চোখের সামনে চলতে থাকে বীভৎস দৃশ্য। একটা সিংহাসনে বসেছিল কেদারনারায়ণ। আর তার পায়ের সামনে ছিল কতকগুলো মেয়ের কাটা মুণ্ডু। তার কিছুটা দূরে তার শিষ্যরা নিজেদের মেয়ের মুণ্ডুহীন রক্তাক্ত দেহ থেকে রক্ত নিয়ে মহানন্দে লিখে চলেছিল সেই মন্ত্র।”
“তারপর?”
“তারপর শুরু হয় এক মহাযুদ্ধ। আলোর সঙ্গে অন্ধকারের। ভালোর সঙ্গে মন্দের। কেদারনারায়ণ শক্তিশালী ছিল বটে কিন্তু পণ্ডিতাচার্য রামানন্দের কাছে পেরে উঠতে পারেনি। তখন ক্ষোভে-লজ্জায় শয়তানটা নিজের মুণ্ডু কেটে ফেলে এবং তার সঙ্গেই আত্মহত্যা করে তার শিষ্যরা। তখনই সেখানে আছড়ে পড়ে এক ঘূর্ণিঝড়। সেই ঘূর্ণিঝড়ে তার কাটা মুণ্ডুটা হাওয়ায় ভাসতে থাকে আর তার শিষ্যদের লেখা মন্ত্রের কাগজগুলো ঘুরতে থাকে মুণ্ডুটার চারপাশে এবং ধীরে ধীরে সেগুলো মিশে যেতে থাকে কেদারনারায়ণের সেই বইটার সঙ্গে। সবশেষে এক বিকট অট্টহাসি শোনা যায়, সঙ্গে কিছু কথাও।”
“কী কথা?”
“কী ভেবেছিস, এখানেই সব শেষ! এটা তো সবে শুরু রে। আমি আবার ফিরে আসব…আবার ফিরে আসব…”
“তার মানে?”
“তার মানে আপনার কাকু সেই বইটা পেয়েছেন এবং সেই শয়তানকে নিজের ঘরে ডেকে এনেছেন। হয়তো এতদিনে সে তার ভোগও গ্রহণ করেছে। এবার কেদারনারায়ণ অপেক্ষায় আছে তার জন্মদিনের উপহারের জন্য। আমার ধারণা আপনার কাকু তার স্ত্রী আর মেয়েকে নিজের ঘরেই বন্দি করে রেখেছেন,” মনে মনে ভগবানকে ডেকে নিল সুবীর।
“কিন্তু তাহলে অশোককাকু?”
“তিনি সেই ঘরের সামনে গিয়েও বইটা বের করেননি। তাই সেই শয়তানের অভিশাপ লেগেছিল আপনার কাকুর ওপর।”
“তার জন্মদিন কবে?”
“ক্ষমা করবেন সেটা মনে নেই। আসলে আমি এটা একটা গল্পের মতোই শুনেছিলাম। একদমই বিশ্বাস করিনি সেই গল্পে। তবে আজ…”
“আচ্ছা এর কি কোনও প্রতিকার নেই?” প্রশ্ন করল অনিরুদ্ধ।
“একটাই প্রতিকার আছে। পণ্ডিতাচার্য আমার পূর্বপুরুষকে বলেছিলেন যে এর বিনাশ একমাত্র আমাদের বংশের হাত ধরেই হবে। আমাদের বংশের একজনের সঙ্গে নাকি এক সিদ্ধ পুরুষের সাক্ষাৎ হবে যার জন্ম নবদ্বীপের পুণ্যভূমিতে। তিনি হবেন যেমন দয়ালু, পরোপকারী তেমনই হবেন তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। একমাত্র সেই মহান পুরুষই পারবেন এটি ধ্বংস করতে।”
মুহূর্তের মধ্যে একটা নীরবতা নেমে এল। সেই নীরবতা ভঙ্গ করল অনিরুদ্ধ।
“আচ্ছা ঠাকুরমশাই, আপনার জন্ম নবদ্বীপে না?”
“হ্যাঁ কিন্তু তুমি কি আমাকে সেই সিদ্ধ পুরুষ ভাবছ?” ম্লান হাসলেন ঠাকুরমশাই।
“আজ্ঞে। আপনার জন্ম নবদ্বীপে, আপনি দয়ালু, পরোপকারী, তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আপনার সঙ্গে সুবীরের দেখা হওয়া। হিসেব পুরো মিলে যাচ্ছে।”
ঠাকুরমশাই এবং সুবীর একে ওপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। সুবীর কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না। এদিকে রোহিত এবার উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
ঠাকুরমশাইয়ের দিকে করজোড়ে তাকাল সে। তার চোখ ছলছল করে উঠল, বলল, “দয়া করে আমার রূপসাকে আপনি বাঁচান ঠাকুরমশাই। ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই। দয়া করে ওকে বাঁচান।”
এবার সুবীরও মুখ খুলল, “আমারও তাই মনে হচ্ছে ঠাকুরমশাই। আপনিই সেই পুরুষ। চলুন আর দেরি করা ঠিক হবে না। আমাদের এখনই বেরোতে হবে।”
* * *
রাত ক্রমশ বেড়ে চলেছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে মুশলধারে বৃষ্টি এবং চোখ ধাঁধানো বিদ্যুতের ঝলকানি। তীব্রবেগে গাড়ি ছুটে চলেছে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। গাড়ির ভেতরে বসে নানারকম দুশ্চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে রোহিত। কিন্তু তার মনের এককোণে ফুটে আছে আনন্দের হাসি। তার দৃঢ় বিশ্বাস রূপসা এখনও বেঁচে আছে এবং সে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করবেই।
বিশ্বনাথ দত্তের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি থামাল অনিরুদ্ধ। বৃষ্টির দাপট তখনও কমেনি। সেই বৃষ্টির মধ্যেই তিনজনে গাড়ি থেকে নামল। ঠাকুরমশাইয়ের কথামত অনিরুদ্ধ গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল থানার উদ্দেশ্যে। অতি সন্তর্পণে তিনজনে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। সেই আলো-আঁধারির রাতে বাড়িটা যেন এক ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
কয়েকবার জোরে ধাক্কা দিতেই সদর দরজা খুলে গেল এবং তাদের নাকে এল এক কটু গন্ধ। বিশ্রী মরা পচা এক গন্ধ। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে তিনজনে ঘরে ঢুকল। পুরো বাড়ি যেন এক গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছে। শুধুমাত্র ওপরের একটা ঘর আলোকিত হয়ে আছে। ধীরে ধীরে তারা ওপরে উঠল এবং সেই ঘরের সামনে আসতেই সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল তিনজনের। ঘরে জ্বলতে থাকা মোমবাতির কম্পিত আলোয় তারা স্পষ্ট দেখল ঘরের এক কোনে পড়ে আছে বিশ্বনাথ দত্তের স্ত্রীর মৃতদেহ এবং সেই দেহটাকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে কতকগুলো কালো কালো মূর্তি। তাদের হাতে-মুখে লেগে আছে তাজা রক্ত। মহানন্দে তারা সেই মহাভোজ উপভোগ করছে। আর ঠিক তার পাশে পড়ে আছে রূপসা। তার সারা দেহজুড়ে রয়েছে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন এবং গলায় একটা বড় কাটা দাগ। সেখান থেকে গলগল করে বেরোচ্ছে তাজা লাল রক্ত এবং সেই রক্ত দিয়ে পাশে বসে রূপসার বাবা একটা কাগজে কীসব লিখে চলেছে। রূপসার দেহটা কাঁপতে কাঁপতে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।
আর থাকতে পারল না রোহিত। একটা জোরে চিৎকার করে উঠল। সেই চিৎকার শুনে লেখা থেমে গেল বিশ্বনাথের। ঘুরে তাকালেন রোহিতের দিকে। রাগে চিৎকার করতে লাগলেন বিশ্বনাথ। তার চোখে জ্বলে উঠেছে জিঘাংসার আগুন। রাগে তার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে।
“কেন এসেছিস তোরা এখানে? কেন এসেছিস?” হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন বিশ্বনাথ, “আজ মহানন্দের দিন। আজ আমার প্রভুর জন্মদিন। আমার উপহার গ্রহণ করে তিনি আজ আমাকে ধন্য করবেন। হে প্রভু…” এক বিকট অট্টহাসি দিলেন এবং আবার লেখা শুরু করলেন।
এই দৃশ্য দেখে ঠাকুরমশাইও একটু ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সাহস জুগিয়ে মনে মনে একবার নিজের আরাধ্য দেবতাকে ডেকে নিলেন এবং উচ্চৈঃস্বরে এমন এক ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন যা ছিল রোহিতের কাছে সম্পূর্ণ অজানা। তবে রোহিতের সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। পাথরের মতো এককোণে দাঁড়িয়ে সে করুণ নয়নে তাকিয়ে থাকল রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা রূপসার দিকে। তখনও তার গলা থেকে রক্ত ঝরছে। তার খেয়ালই নেই যে ঠাকুরমশাইয়ের মন্ত্র এবার বিশ্বনাথের গায়ে কাঁটার মতো বিঁধতে শুরু করেছে।
“চুপ কর পাপী! তুই আমার কাজে বাধা দিস না। আমার প্রভু কিন্তু তোকে ছাড়বে না। চুপ কর শয়তান,” দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে শাসাতে লাগলেন বিশ্বনাথ।
ঠাকুরমশাই অনবরত মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন। হঠাৎ বিশ্বনাথের লেখা থেমে গেল এবং মুহূর্তের মধ্যে তাঁর হাত-পা বেঁকে যেতে লাগল। এক তীব্র যন্ত্রণায় তিনি ছটপট করতে লাগলেন। তাঁর চোখের লাল মণিদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল। প্রচণ্ড ব্যথায় আর্তনাদ করতে লাগলেন।
সুবীরের চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ ফুটে উঠল, “হচ্ছে, কাজ হচ্ছে ঠাকুরমশাই। আপনিই সেই সিদ্ধ পুরুষ! আমি আপনার সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। আজ আমি ধন্য।”
এমন সময় অন্ধকার থেকে উঠে এল এক দীর্ঘ কালো মূর্তি। মূর্তিটার লাল চোখদুটো জ্বলছে এক জিঘাংসার আগুনে। কী ভয়ানক সেই চোখ! বিকট এক চিৎকার করে সেই কালো মূর্তি তার দুটো হাত বাড়িয়ে দিল এবং বিশ্বনাথের কাঁধ চেপে ধরল। কালো লোমশ দুটো হাত, ঠিক যেমন রূপসা স্বপ্নে দেখেছিল। সেই হাতের স্পর্শ পেয়ে স্বাভাবিক হতে লাগলেন বিশ্বনাথ। ঘরের মধ্যে একটা ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল এবং নিমেষের মধ্যে সেই হাত দুটো ঠাকুরমশাইয়ের গলা চেপে ধরে তাঁকে শূন্যে ঘোরাতে লাগল। সেই সঙ্গে শোনা গেল এক ভৌতিক কণ্ঠস্বর।
“তোর এত সাহস! তুই আমার কাজে বাধা দিবি!” বলতে বলতে সেই কালো মূর্তি ঠাকুরমশাইয়ের গলা টেনে ছিঁড়ে ফেলল।
ঠাকুরমশাইয়ের মুণ্ডুহীন দেহটা মাটিতে পড়ে ছটপট করতে লাগল। সেটা দেখে বিশ্বনাথ আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন এবং মুহূর্তের মধ্যে রূপসার মুণ্ডুটা তার দেহ থেকে আলাদা করে দিলেন। ঘরের মধ্যে বইতে লাগল রক্তের স্রোত। সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে আর থাকতে পারল না রোহিত। সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। সুবীর এককোণে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল এবং ভয়ার্ত চোখে দেখতে লাগল সব কিছু।
বিশ্বনাথ রূপসার শরীর থেকে শেষবারের মতো রক্ত নিয়ে নিজের লেখা শেষ করলেন এবং মহানন্দে নিজের প্রভুর দিকে তাকালেন।
“হে প্রভু, আজ আপনার জন্মদিন। এই আনন্দের দিনে এই সামান্য উপহারটুকু গ্রহণ করে এই অধমকে ধন্য করুন।”
বিশ্বনাথের হাতের কাগজটা শূন্যে উড়তে উড়তে শেষে বইটার সঙ্গে এসে মিলিত হল। সেই সঙ্গে বিশ্বনাথও নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে দিলেন নিজের প্রভুর কাছে।
এবার সেই কালো মূর্তি নিজের হাত বাড়িয়ে দিল সুবীরের দিকে। এমন সময় হঠাৎ যে কী হল সেটা সুবীর বুঝতে পারল না। সে দেখল হাত দুটো ঠিক তার সামনে এসে থমকে গেছে, আর এগোতে পারছে না। কোনও এক অদৃশ্য শক্তি যেন হাত দুটোকে তার কাছে আসতে দিচ্ছে না। ঘরে হাওয়ার বেগ আরও জোরালো হতে লাগল। সঙ্গে শোনা গেল একটা তীব্র আর্তনাদ, শয়তানটার আর্তনাদ।
এবার সব কিছু পরিষ্কার হতে লাগল সুবীরের কাছে। তার হাত ধরেই হবে এই শয়তানটার বিনাশ। তবে সে সময় এখনও আসেনি। তাদের এক মস্ত বড় ভুল হয়েছে এবং সেই ভুলের জন্যই প্রাণ গেল এক ব্রাহ্মণের। ঠাকুরমশাই সেই সিদ্ধ পুরুষ নন। সুবীরের সঙ্গে তাঁর দেখা হতে এখনও সময় আছে। তবে এখন এই মরণখেলা দেখা ছাড়া সুবীরের আর কোনও পথ নেই।
ক্ষোভে-লজ্জায় আর্তনাদ করতে লাগল সেই শয়তান। তবে সেই আর্তনাদে মিশে আছে এক ইচ্ছাশক্তি। সর্বশক্তিশালীরূপে ফিরে আসার ইচ্ছা। ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এল সেই আর্তনাদ এবং সেই কালো মূর্তিগুলোর সঙ্গে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল বইটা। একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল ঘরে।
বিশ্বনাথের মৃতদেহের দিকে তাকাল সুবীর। একটা জয়ের হাসি লেগে আছে তাঁর মুখে। তবে আজ সুবীর যা উপলব্ধি করল সেটা একইসঙ্গে তার কাছে আনন্দের এবং দুশ্চিন্তার। আনন্দ এটাই যে শয়তানটার বিনাশ নিশ্চিত এবং দুশ্চিন্তা এটা যে এই খেলা এখনও কয়েকবছর ধরে চলবে। কত মানুষের জীবন ধ্বংস করে শক্তিশালী হয়ে উঠবে শয়তানটা। তার শোনা গল্পটা এখানে শেষ হল না, এখান থেকে শুরু হল সেই গল্পের এক নতুন অধ্যায়।