Getting your Trinity Audio player ready...
|
সকালের রোদ মেখে বাড়ির উঠোনে দুটো শালিক আপন ছন্দে মাথা দোলাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে বিতান জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কি একটা ভাবছে। বিতান অলৌকিক কোনও বিষয়ের খোঁজ পেলেই সেটা জানার জন্য সাতসমুদ্র পার হতেও পিছপা হয় না। বিজ্ঞান বিশ্বাস করে, তবে পৃথিবীতে যে মাঝে মাঝে অলৌকিক কিছু ঘটতে পারে সেটাও সে মানতে শুরু করেছে। সম্প্রতি পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে একটা বই পড়ে একটু অস্থির হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি রক্ত-চোষা বাদুড়ের একটা খবর হঠাৎ ওকে খুব বিচলিত করে তুলেছে। কয়েকমাস আগে নিয়মিত কাগজে ঐ খবরটা বের হচ্ছিল। জানি না কেন ঐ ব্যাপারটার কোনও সমাধান হয়নি। গবেষক রিচার্ড গোমসের কাছে নিয়মিত যাতায়াতের সূত্রে ভ্যাম্পায়ার নিয়ে বিশদ আলোচনায় অংশগ্রহণ এর সুযোগ হয়েছে বিতানের। ডঃ নিমাই বিশ্বাস এখন ভিয়েনাতে কর্মরত। ডঃ বিশ্বাসের সাথে রিচার্ড গোমসের অফিসে আলাপ হয় তার। বিতানের আগ্রহ দেখে মিঃ গোমস তাকে বেশ পছন্দ করতে থাকেন। মিঃ গোমস কয়েক বছর আগে এই রকম নানা অলৌকিক বিষয় নিয়েই গবেষণা করেছিলেন।
তাই রক্ত-চোষা বাদুড়ের বহু লোকগাথা ওঁর থেকে শুনেছে বিতান। অদ্ভুত সব কান্ড ওর মনকে এক মায়াময় জগতে এনে ফেলেছে। লাইব্রেরিতে গিয়ে পুরানো কাগজ গুলো খুঁজছিলো। সেদিন একটা বই খুঁজে পায়। ভ্যাম্পায়ার নিয়ে নানা রোমাঞ্চকর তথ্য রয়েছে সেই বইতে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের অষ্টাদশ শতকের নানা অলৌকিক ঘটনা বিতানের চিন্তাকে আমূল পরিবর্তন ঘটায়। এখন কলেজের ছুটি, তাই চাপ কম। যখন কলেজ থাকে তখন বঙ্গবাসী কলেজ থেকে ফিরতে গিয়ে মাঝে মাঝে হেঁটে কলেজ স্ট্রিট হয়ে আসে।উদ্দেশ্য কিছু গবেষণা মূলক বই কালেকশন করা। নন্দিনী থাকলে একটু বেশি ভালো লাগে, তবে কিছুদিন সে তার গ্রামের বাড়ি ব্যান্ডেল গেছে। অগত্যা আজ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে ছুটল পাবলিক লাইব্রেরি। যে বইটা কয়েকদিন আগে দেখেছিল, আজ আবার সেটা অতি যত্নে খুঁজে পেয়েছে। সময় দিয়ে পড়ল। একটা লাইব্রেরি কার্ড করে ওটা বাড়ির জন্য নিয়ে এল। আগের সপ্তাহে সারা বইপাড়া ঘুরেও এই বইটি পায়নি। অগত্যা লাইব্রেরি থেকেই তুলে আনতে হল। সারা দুপুর আজ চিন্তা করেছে।আর বই পড়তে পড়তে কোন এক অজানা আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরছিল। বুঝতে পারছিল না। অলৌকিক বিষয়ে পড়তে বসলেই মনে হয় সে গল্পের ঐ সময়ে পৌঁছে গেছে।
যাই হোক কাগজে যে খবরটা ছিল তাতে ব্যান্ডেল চার্চের কাছে রক্ত-চোষা বাদুড় এর উৎপাত এর ব্যাপারে লেখা। এলাকার কয়েকশো নারীর মৃত্যু ঘটেছিল। যেমনটা ঘটেছিল ইউরোপে।একটা সময় প্লেগে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সেরকমই এখানেও কোনও এক অজানা রোগে মহিলা ও শিশুদের রক্তের অভাব শুরু হয়ে গিয়েছিল। দিনের পর দিন রক্তশূন্য হয়ে তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল। কোনও এক কারণে ঐ খবরটা চাপা পড়ে যায়। কেউ কেউ বলতে থাকে ব্যান্ডেলে পর্তুগীজরা শাসন করা কালে ইভান নুরি নামের এক ছোট্ট মেয়ের মৃত্যু ঘটে। আর তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল কিছু এদেশের মহিলা। তার আত্মা পিশাচ হয়েছে, আর তাই প্রতিশোধ নিতেই সে এসব করছে। এমনকি সাংবাদিক এক মহিলাও এই খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ভীষণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার পর থেকে চার্চের পাশে রাতে লোকজন যেতে চায় না। বিতান এই রহস্যের সমাধান করতে চায়, জানতে চায় সত্যিই কি ইভান নুরি এখনও প্রেত হয়ে এমন পৈশাচিক কাজ করে চলেছে।
মিঃ বিশ্বাস এখন ভিয়েনায়। ভিডিও কলে বিতান তাকে বিষয়টা বলল। তিনি আগ্রহ দেখালেন। এটাও জানালেন ইভান নুরির এক বংশধর সালসবার্গে এখনও থাকে। সেন্ট স্টিফেন্স ক্যাথিড্রাল, শনব্রুন প্রাসাদ দেখতে যেদিন উনি গিয়েছিলেন সেদিন জার্মানি থেকে আগত এক নাগরিক ক্রিস্টোফার হেনরির সাথে পরিচয় হয়। হেনরি ভালো ভাবেই চেনে ডঃ বিশ্বাসকে। কয়েকবার ওঁর চেম্বারে এসেছেন। তাই শনব্রুন প্রাসাদ থেকে বের হতেই মুখোমুখি দেখা আর কথার সূত্রে আলাপটা জমে ওঠে। ডঃ বিশ্বাস জার্মান ভাষায় দক্ষ। হেনরির মত বহু ভিয়েনার বাসিন্দা জার্মান ভাষায় কথা বলে। তাই মেলামেশা ও কথা বলতে অসুবিধা হয়নি। বিতানের সাথে কথা হবার একদিন পরই হেনরি এসেছিল ডঃ বিশ্বাসের চেম্বারে কোনও কারণ ছাড়াই। হেনরিকে উনি বলেন, তুমি কি ইভান নুরি নামে কাউকে চেনো?
হেনরি একটু চুপ করে থেকে জবাব দেয়
-নুরি! হুম।
-আপনি কী করে জানলেন এই নাম?
-আপার অস্ট্রিয়াতে আছে সুন্দর গ্রাম হালস্টাট। সালসবার্গের কাছেই অবস্থিত। তবে ভিয়েনা হালস্টাট থেকে যেতে গেলে ট্রেনে করে প্রায় ৩ঘন্টা ৪০ মিনিট লাগবে।সেই ছোট গ্রাম হালস্টাট এ বাড়ি এই নুরি পরিবারের। এখন থাকে এক ৫০ বছর বয়সী আইভান নুরি। তার একটা মেয়ে আছে গ্লোরী। চাষবাস করে দিন কাটায়। শোনা যায় প্রায় ২০০ বছর আগে ওদের পরিবারের ইভান নুরি নামের একটি মেয়ে প্রণয় ঘটিত কারণে ভারতে গিয়ে মারা যায়। একটি ছেলের সাথে সম্পর্ক তৈরী হয়। এলাকার মেয়েরা ছোট মেয়েটিকে মেরে দেয়।গলায় কিছুর আঘাত ছিল। সুইসাইড বলে চালানোর চেষ্টা করলেও তার পরিবার তা মেনে নেয়নি। এদিকে ইভানের মৃতদেহ ভিয়েনাতে তারা আনেনি।ইভানের কফিন সমাধিতে রাখার পরদিনই পরিবারের সবার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। অনেকে বলে বংশের উত্তরসুরি হিসাবে আইভান এত বছর পরে সেই প্রতিশোধ নিতে রাতে কি সব করে, কেউ কেউ গ্লোরীকে মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতেও দেখেছে। অলৌকিক কান্ড হালস্টাট জুড়ে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছে”।
‘আপনি কি ডাক্তারি ছেড়ে এদের নিয়ে গবেষণা করছেন’?
-না না।
‘আমার দেশের একটি ছেলে ভ্যাম্পায়ার নিয়ে কি সব তথ্য পেয়েছে, আর তার সূত্রে ইভানের নামটা আসে বললেন ডঃ বিশ্বাস’।
-আপনি কি জানেন ডাক্তার বাবু ইদানিং আইভানকে এখানে দেখা যায় না?
-বলো কি?
-সেটাই তো বলছি।
-কোনও এক কারণে গ্লোরী ও আইভান হালস্টাটে নেই। রহস্য তো সেখানেই, বলল হেনরি। দানিউব নদীর আসে পাশেও মাঝে মাঝে দেখা গেছে আইভানকে। কিন্তু সন্দেহ এখানেই যে আপার অস্ট্রিয়া থেকে হালস্টাট যখন তখন কিভাবে আইভান তার ১৮ বছরের মেয়েকে নিয়ে চলে আসে।
এদিকে হেনরির থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে ডঃ বিশ্বাস ডিটেলস আলোচনা করলেন বিতানের সাথে। বিতান জানাল তার বান্ধবী নন্দিনী জানিয়েছে ওদের গ্রামে কিছু ছেলে নিখোঁজ। সন্ধ্যার সময় ব্যান্ডেল রেল স্টেশনের কাছ থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। নন্দিনীর কথা অনুযায়ী দুজনকে পাওয়া গেলেও তাঁদের শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে। ডঃ বিশ্বাস এতটা শুনেই বিতানকে বলেন গবেষক গোমসের সাথে যোগাযোগ করতে। কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে। দানিউব নদীর তীরে কয়েকদিন আগে এমনই কিছু শিশুর মৃতদেহ পাওয়া যায়। স্থানীয় পুলিশ কিছুই পায়নি। গলার কাছে ইঁদুর বা বাদুড় জাতীয় কিছুর কামড়ে মৃত্যু বলে ধরা হয়।
বিতান এসব জানতে পেরেই বাইক নিয়ে ছুটলেন মিঃ গোমসের বাড়ি। গবেষক বিতানকে দেখেই বললেন ‘রক্তচোষা বাদুড়ের গবেষণা পত্রটি চাই’। বিতান ভাবল কি করে জানলেন উনি। আসলে ডঃ বিশ্বাস আগেই বিতানের আগ্রহের বিষয়টা কিছুটা জানিয়েছে। এর ফলে আগে থেকেই মিঃ গোমস ১০ বছর আগেকার গবেষণা পত্র বিতানের জন্য বের করে রেখেছেন। ব্যান্ডেল চার্চের কাছে ঘটা অলৌকিক কান্ড ওঁকেও বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। সেটা বিতান কথার মধ্যে বুঝতে পারে। মিঃ গোমস বিতানকে খুব সাবধানে এগোতে বললেন। খুব সাবধান করে বললেন,
-রাতের দিকে ভ্যাম্পায়াররা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। দিনের বেলা সূর্যের আলোতে এদের দেখা যায় না। কোনও ট্রাঙ্ক বা বাক্সের মধ্যে এরা লুকিয়ে থাকে। রাত হলেই এদের উৎপাত বাড়ে। সুদূর থেকে এক নিমেষে এরা এসে যায়। চারিদিকে তখন প্রলয় নাচন শুরু হয়। আকাশে কালো মেঘ কোথা থেকে এসে পড়ে। আর তখন অলৌকিক ও পৈশাচিক কান্ড শুরু হয়। সুস্থ মানুষকে এরা নিজেদের বশে এনে ফেলে, আর তার পর তার নিজের কোনও ক্ষমতা থাকেনা। একটা মানুষকে এরা দিনের পর দিন রক্ত চুষে ক্রমশ দুর্বল করে প্রায় মৃত করে দেয়। তারা মৃত্যুর আগে অবধি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। এই অ-মৃত মানুষের থেকে রক্ত পান করে করে এরা অসম্ভব শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে।
এতটা শুনে বিতানের প্রশ্ন – আমরা কি এদের কিছু করতে পারি না?
-পারি, তবে সেটা খুব ধৈর্যের ব্যাপার, খুব সাধনার ব্যাপার। আমি কিছুটা জানি। তবে সাকসেসফুল হব কিনা এক্ষুনি বলতে পারব না।
– বলুন আমি পারব যদি আপনি সাথে থাকেন।
-আমার কাজের একটু চাপ কম।
-দেখছি…
বিতান আপাতত পরিকল্পনা নিল খুব তাড়াতাড়ি যাবে ব্যান্ডেল চার্চ। কী আছে ওখানের সমাধিক্ষেত্রে সেটা জানার প্রবল আগ্রহ বিতানের। মিঃ গোমস তার সাথে যোগ দেবে এটা ভেবে সে উল্লসিত।
নন্দিনীর বাড়ি ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে ২.৫ কিমি দূরে হংসেশ্বরী দেবীর মন্দিরের কাছে। বিতান আজ রওঁ দিল ব্যান্ডেলের উদ্দেশ্যে। হাওড়া থেকে সকাল ৭.১৫ মিনিটের লোকাল ট্রেন ধরল। স্টেশনে আজ ভিড় সেরকম নেই। রবিবার বলে অফিস যাত্রী নেই। দু একজন হকার বাদাম ভাজা বিক্রি করতে উঠেছে। বিতান জানলার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, আর মাঝে মাঝে ফোনে সময় দেখছিল। খেয়াল করেনি তার পাশে একজন এসে অনেকক্ষণ বসেছে। লোকটার অদ্ভুত চোখ দেখে প্রথমে কুঁকড়ে যায় বিতান। চোখের মধ্যে ঘৃণা ও ক্রোধের আগুন জ্বলছিল।
পরক্ষনেই নিজেকে সামলে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। লোকটি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে।
একটু পরে বিতান লক্ষ্য করে লোকটির চোখ স্বাভাবিক, কোনও অস্বাভাবিক কিছু নেই। তাহলে তখন কী দেখে অমন মনে হল এটা চিন্তা করতে লাগল। একজন ব্যাক্তি লিলুয়া থেকে উঠলেন। যাত্রীর আগমনে তাদের আনমনা ভাব চলে গেল। ট্রেন এগিয়ে চলল। পাশে বসা ভদ্রলোক বিতানের সাথে গল্প করতে শুরু করলেন।
-কোথায় যাবেন?
-এই ব্যান্ডেল।
-কেউ আছে নাকি।
-না না ঐ আর কি।
বিতান এবার কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে বলল – আপনি কোথায় যাবেন?
উনি বললেন – আপাতত শ্রীরামপুর।
-কেন অন্য কোথায় যেতেন?
-সেটা এখন নয়। ওবেলা যাব।
-আচ্ছা।
বিতান মিঃ গোমসের রিসার্চ পেপারটা ট্রেনেই পড়তে লাগল যাতে সময়টা কেটে যায়।
কী পড়ছেন? – বলল ঐ ব্যাক্তি।
-কিছু না, একটা গবেষণা পত্র।
-তা কী লেখা আছে শুনি।
বিতান বিশ্বাস করে তাকে কিছুটা বলল।
তিনি শুনে একটা গল্প শুরু করলেন।বললেন – আমি এমন গল্প আগে শুনেছি। কোনও এক পর্তুগীজ মেয়েকে ব্যান্ডেলের স্থানীয় মেয়েরা মেরে ফেলে। তার অতৃপ্ত আত্মা প্রতিশোধ নিতে রাতের দিকে ব্যান্ডেল চার্চের ভিতরে তান্ডব শুরু করে। ভয়ঙ্কর সব বাদুড়, ইঁদুর, হায়না ঘিরে ধরে। হঠাৎ আলো নিভে যায়। পিশাচের আবির্ভাব ঘটে তখন। কোনও মানুষের নিস্তার নেই তখন। এখনও তার প্রতিশোধ শেষ হয়নি। এখনও সে অনেক রক্ত নেবে। যে আসবে তাকেই শেষ করে দেবে। সুদূর অস্ট্রিয়া থেকে তার আত্মা এখানে এসে পড়েছে।
কথাগুলো বলার সময় লোকটির চোখ কেমন অদ্ভুত এক রহস্যময় হয়ে উঠেছিল, যেন সে এই প্রতিশোধ নেওয়াটা বেশ ভালো মনে করে।
শ্রীরামপুর এসে যেতে উনি নেমে গেলেন। বিতান মিঃ গোমসের কথাগুলো চিন্তা করতে থাকল। এটা ভেবে সে আশ্চর্য হল যে ওঁর গবেষণা ও ভাবনার সাথে এই লোকটির কথার অদ্ভুত মিল আছে। ভ্যাম্পায়ার নিয়ে যে কথা আগে শোনা গিয়েছিল সেটার সাথে এই কথার কোনও তফাৎ নেই। ভাবতে ভাবতেই হুগলী স্টেশন এসে পড়ল ট্রেন। তৈরি হতে লাগল নামার জন্য। ঠিক ৮টা ২০ মিনিটে ব্যান্ডেল স্টেশনে নেমে পড়লো বিতান। আসে পাশে লোকজন দেখতে পেল না। আতঙ্ক থাকলেও এখন তো দিন, এখনই লোক ভয়ে বের হয়নি এটা ভাবতে থাকল। তখনই দূরে এক রিক্সাওয়ালা দেখতে পেল। এগিয়ে গিয়ে ব্যান্ডেল চার্চ যাব বলতে রিক্সাওয়ালা একটু ভয় পেল। হংসেশ্বরী দেবীর মন্দির বলতে রিক্সাওয়ালা সন্তুষ্ট হয়ে এগিয়ে চলল। ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল নন্দিনীর বাড়ি। নন্দিনী তাকে দেখে খুব খুশি হল। বিতান কিছুক্ষন কথা বলেই নন্দিনীর সাথে চার্চের উদ্দেশ্যে রওঁ দিল। যেতে যেতে এখানের অলৌকিক নানা ঘটনার কথা শুনতে থাকল। চার্চে এসে ভিতরে প্রবেশ করল। নন্দিনী সমাধির কাছে নিয়ে গেল বিতানকে। কয়েকটা সমাধি খুব যত্নকরে সাজানো। এখানে এমন অদ্ভুত কিছু তাদেরকে চোখে পড়ল না। ভিতরের থাকা ফাদার এর সাথে ভ্যাম্পায়ার এর বিষয়ে জানার চেষ্টা করল।
বিতান বলল – এখানে রাতে কি অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে আপনাদের।
ফাদার সেরকম কিছু দেখলেও বলতে চাইলেন না। অজানা কোনও আতঙ্কে বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন। বিতান পুরো চার্চ, পাশের মাঠ ও এলাকার চারিদিকে খুব নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকল। নন্দিনী তার সাথে যথাসাধ্য সাহায্য করে চলল। কী একটা ডাল নিয়ে অনেকক্ষণ বিতান কোথাও ঠেকিয়ে দেখছিল, সেটা নন্দিনী বুঝতে পারেনি। জিজ্ঞাসা করতে বিতান জানায় এটা বুনো গোলাপের ডাল। সাথে আছে আরও অনেক কিছু। সবকিছু মিঃ গোমস দিয়েছেন। এখানের তথ্য ওঁকে গিয়ে দিলে, উনি তারপর আসবেন একদিন। আসলে আজ আমি এসেছি পুরোটা বুঝে যাব বলে। সন্ধ্যা হওয়া অবধি থাকতে হবে।
নন্দিনী আপত্তি করল না, এটা ভেবে আনন্দিত হল যে বিতানের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটানো যাবে। কলেজের দিনে হোস্টেলে থাকার সুবাদে মাঝে মাঝে দেখা হত। কিন্তু এখন ছুটি আছে তাই সেই ভাবে দেখা হবার সুযোগ ছিল না। যে কোনও কারণেই হোক আজ বিতানকে পেয়ে নন্দিনী স্বপ্নে বিভোর। রিক্সা দিনের বেলা পাওয়া গেল কিন্তু ওবেলা পাব তো এমন এক আশঙ্কা মনে হল বিতানের। জুন মাসের রবিবার। আকাশে অল্প মেঘের আনাগোনা মনে কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করল। সন্ধ্যা হবার কিছুক্ষন আগে বিতান ও নন্দিনী পৌঁছে গেল চার্চে।সন্ধ্যা বেলা এদিকে লোকজনের আনাগোনা নেই। সমাধির দিকে কেউ থাকেও না। ইভান নুরির আত্মার দ্বারা মৃত্যু হওয়া এক বছর কুড়ির সুন্দরী মেয়ের সমাধির কাছে পৌঁছল। ফাদার বা সিকিউরিটির চোখের আড়ালে পাঁচিল টপকে সেখানে যায়। ফলে কেউ বারণ করার ছিল না। সমাধির কাছে আসতেই নন্দিনী কেমন একটু ভয় পেল। বারণ করতে যাচ্ছিল বিতানকে। কিন্তু কোনও এক অজানা শক্তি তাকে আটকে দিল। গলা বুজে এল তার। বিতান সাহসী ছেলে। অলৌকিক কিছু জানার অসীম আগ্রহ তার। চারিদিকে আলোর অল্প ছটা ছিল তখন। চার্চের ঘড়ির কাটায় তখন সন্ধ্যা সাতটা। সমাধির সামনে আসতেই চারিদিকটা কেমন গুমোট হয়ে উঠল। তার পর একটা পূতিগন্ধ ভরে উঠল। হঠাৎ করে একাধিক ইঁদুরের শব্দ ও উপর থেকে বাদুড়ের ঝটপটানি শুনতে পেল। গা গুলিয়ে ওঠা গন্ধে শ্বাস বন্ধ হবার জোগাড় হল ওদের। এমন অবস্থায় কোনও রকমে ওরা দুজনে সমাধির ওখান থেকে পালিয়ে একটা গাছের তলায় আশ্রয় নিল। নজর রাখতে থাকল ঠিক কী ঘটে এই সমাধি ক্ষেত্রে। এর পর আকাশ বাতাস গর্জন করে বাজ পড়তে থাকল। গুমোট ভাব থেকে প্রচন্ড ঝড় উঠল। ধুলোয় চারিদিক ভরে উঠল, অন্ধকার নেমে এল সমাধির ওখানে। মনে হতে থাকল পৃথিবী থেকে এই জায়গাটা আলাদা। উপরে বাদুড়ের প্রলয় নাচন আর তার সঙ্গে সঙ্গে কোনও এক অলৌকিক শক্তি সমাধির তলা থেকে এক একটা কফিনকে উপরে তুলে আনছে। কফিনগুলোর সামনে দূর থেকে কালো চাদর চাপানো এক পৈশাচিক ছায়ামূর্তি এসে হাজির হল। মুখে অদ্ভুত এক বিকৃত হাসি আর তার ফাঁক দিয়ে শ্ব-দন্ত বেরিয়ে আসছে। হালকা মায়াময় আলোর রেশ রয়ে গেছে সেখানে। ফলে সেই ছায়ামূর্তির অলৌকিক কান্ড অল্প হলেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। বীভৎসতা ও ভয় তখন ওদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। পৈশাচিক হাসির ওই ছায়ামূর্তি কফিন থেকে একটা মৃত দেহকে তুলে তার সামনে শুয়ে কী একটা করল, আর তার পরই এক একটা কফিন থেকে এক একটা মৃতদেহ উঠে তার দেখানো পথে চলে যেতে থাকল। শূন্যে ভেসে প্রতিটা সাদা চাদরে মোড়া মূর্তি ক্রমশ আরও উপরের দিকে উঠতে থাকল। বড় বড় মৃতদেহগুলো আস্তে আস্তে ক্রমশ ছোট হতে থাকল,আর ঝড়ের সাথে মিলিয়ে যেতে থাকল। আকাশ জুড়ে তখন কালো মেঘের আনাগোনা। ঘন ঘন বাজ পড়তে থাকল। এলাকাটা হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময়।
বিকট গন্ধটা এবার আস্তে আস্তে হালকা হতে থাকল। চারিদিকের ঝড় ও মেঘের প্রলয় নাচন ক্রমশ শান্ত হতে থাকল। কতক্ষন এই অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল বলতে পারেনি বিতান। তখন চার্চের কোন শব্দ কানে আসেনি। সমস্ত পৃথিবী থেকে এই জায়গাটা আলাদা হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য।
ঘটনার আকস্মিকতায় নন্দিনী চুপচাপ হয়ে গেল। বাইরে বেড়িয়ে ওরা দেখল আকাশ পরিষ্কার, মেঘ সেই ভাবে নেই। রাস্তায় আলো জ্বলছে। কোথায় কোনও অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না।বিতান ধীরে সুস্থে তাকে কোনও রকমে সেখান থেকে বের করে এনেছিল। রাতের ট্রেন ধরে যাবার ঠিক করলেও সেদিন ফিরতে পারল না। মোবাইল নেটওয়ার্ক খারাপ থাকায় গোমসের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনাও করতে পারেনি।
নন্দিনী দের বাড়ি আসতে বাড়ির লোক কিছু জানতে চাইল। কোনও রকমে ওরা ম্যানেজ করল। রাতে ছাদের ঘরে একা শুয়ে ঘটনাটা চিন্তা করতে থাকল। ভাবতে থাকল এমন আধুনিক সময়ে এই ধরণের অলৌকিক ঘটনার বিষয়ে। হঠাৎ করে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। যেন মনে হল এখানে কিছু খারাপ ঘটতে চলেছে। হঠাৎ করে একাধিক বাদুড়ের ডানার শব্দ মনে কু ডেকে উঠল বিতানের। পৈশাচিক কোনও ঘটনা ঘটবে এই মনে করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখল সিঁড়ি শেষ হচ্ছে না। ও নেমেই যাচ্ছে, আর কোনও এক অলৌকিক শক্তি নন্দিনীদের দিকে আসতে দিচ্ছে না। একটা বীভৎস ছায়ামূর্তি জানলা দিয়ে ঢুকে নন্দিনীর ঘরের দিকে গেল। তারপরই নন্দিনীর গলার শব্দ পেল বিতান। দুরন্ত এক ঝড়ে সারা বাড়ি যেন শুন্যে উঠে গেল। আকাশে প্রলয় নাচন শুরু হল। হায়না আর শিয়ালের ডাকে সারা বাড়ি ভয়ঙ্কর এক বিভীষিকাময় হয়ে উঠল। খানিক বাদে কোনও রকমে নিচে এসে নন্দিনীর ঘরে ঢুকল, আর দেখল নন্দিনী বিছানায় এলিয়ে পড়ে আছে। আলো জ্বলার অপেক্ষায় না থেকে বাতি নিয়ে নন্দিনীর বিছানার কাছে দৌড়ে গেল। যা দেখলো তাতে রক্ত হিম হয়ে যাবে। নন্দিনীর গলার কাছে দুটো ছোট দাগ। ইঁদুরের দাঁতের দাগ বা বাদুড় জাতীয় কোনও প্রাণীর দাঁতের দাগের মত। যা ভেবেছিল তাই হল। নন্দিনীর উপরে ভয়ঙ্কর পিশাচের আক্রমণ হয়েছিল আজ। এক্ষুনি না ডাক্তার দেখালে তাকে বাঁচানো যাবে না। কোনও রকমে তার বাড়ির লোকের সৌজন্যে ডাক্তার এলেন। তিনি নন্দিনীকে দেখে বললেন রক্ত দিতে হবে। নন্দিনীর শরীরে রক্তশুন্যতা দেখা দিয়েছে। বিতান কী করবে বুঝতে পারল না। সকাল হওয়া অবধি অপেক্ষা করল। সকাল হতেই মিঃ গোমসের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাল রাতের পুরো ঘটনা ব্যাখ্যা করল। মিঃ গোমস সবটা শুনে এক্ষুনি নন্দিনীকে নিয়ে কলকাতায় আসতে বললেন। বিতান গাড়ি ভাড়া করে কলকাতার পথে রওনা দিল। এন আর এস হাসপাতালে এমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে গেল।
মিঃ গোমস আগেই সেখানে হাজির হয়েছেন। ডাক্তার দেখে বললেন এক্ষুনি রক্ত দিতে হবে। শরীর ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। দু দিন হাসপাতালে রাখার পর একটু সুস্থ বোধ করায় তাকে বাড়ি নিয়ে গেল বিতান। ব্যান্ডেলের বাড়িতে গিয়ে নন্দিনী খুব একটা হাঁটাচলা করতে পারল না। বিতান ওখানেই থাকবার ইচ্ছা প্রকাশ করল। মিঃ গোমস তার যাবতীয় গবেষণার সরঞ্জাম নিয়ে ব্যান্ডেলে পাকাপাকিভাবে চলে এলেন। নন্দিনীদের বাড়িতেই থাকবার ব্যবস্থা হল। বাড়ির লোকের সম্মতিতে তাদের থাকার খুব একটা অসুবিধা হয়নি। দিনের বেলা ভ্যাম্পায়ারদের আক্রমণ ঘটল না। যা কিছু আক্রমণ বা খারাপ কিছু হতে লাগল সেটা রাতের বেলা।
আজ বৃহস্পতিবার। পাড়ায় একটা অনুষ্ঠানে প্রচুর মানুষের সমাগম হল। সন্ধ্যা হতেই হৈ হৈ পড়ে গেল কিছু বাচ্চাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেদিন রাতে মিঃ গোমস নজর রাখলেন নন্দিনীর ঘরের দিকে। কলকাতায় তিনি একা তাঁর স্ত্রীকে রেখে এসেছেন। আজ রাতে নন্দিনীর ওপর কিছু হয়েছিল কি না বুঝতে পারেননি মিঃ গোমস , অথচ সকালে খবর পান যে তার স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ভ্যাম্পায়ার এর রহস্যের সমাধান না করেই ওঁকে সকাল সকাল বেরিয়ে আসতে হল ব্যান্ডেল থেকে। রাস্তায় আসতে আসতে জটিল নানা কিছু মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল। হংসেশ্বরী দেবীর মন্দিরের কাছে একজন লোককে দেখে তিনি আঁতকে উঠলেন। হুবহু এমনই একজনের ছবি উনি দেখেছিলেন ভ্যাম্পায়ার নিয়ে গবেষণা করার সময়। আজ থেকে দশ বছর আগের ব্যাপার, অথচ সেই একই মুখ এত অল্পবয়সী লোকের মধ্যে দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তার চোখের চাহনি তার দিকে। কোনও রকমে উনি ওখান থেকে বেড়িয়ে কলকাতা পৌঁছালেন। ওঁর স্ত্রীর একই সমস্যা দেখা গেল। গলার কাছে দুটো ছোট দাঁতের দাগ। ডাক্তার এসে বললেন রক্তশূন্যতা। গবেষক নিজে জানেন রক্ত শূন্যতার আসল কারণ। তিনি সব ব্যবস্থা করলেন বাড়িতেই। রক্ত দেওয়া সত্বেও ধীরে ধীরে ওঁর স্ত্রী দুর্বল হয়ে পড়লেন।উনি বুঝতেই পারছিলাম যে স্ত্রীকে বাঁচানো সম্ভব নয়,তবু চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। একমাত্র পথ যদি সেই রক্ত-চোষাকে মুক্ত করতে পারা যায়।
নিজের স্ত্রী আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকলেন। যে কটা দিন ছিলেন একটা অ-মৃত মানুষের মতো বেঁচে ছিলেন। ধীরে শান্ত হয়ে দু-একটা কথা বলতেন, আর বেশিরভাগ সময়টাই ঘুমের ঘোরের মধ্যেই থাকতেন। মিঃ গোমস সকাল বেলা উঠে দেখলেন শরীর একদম ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। শরীরে প্রাণ আছে বলে মনে হয় না। অবশেষে খ্রিস্টীয় মতে ওঁর স্ত্রীকে কফিনবন্দি করে সমাধিস্থ করা হল। মিঃ গোমস এবার একরোখা হয়ে রক্ত-চোষা বাদুড়ের পৈশাচিক আক্রমণের অবসান ঘটাবেন বলে ঠিক করলেন। ব্যান্ডেলের আশেপাশে যে কটা বাচ্চা ছেলে হারিয়েছিল প্রতিটা বাচ্চা ছেলেকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল এবং তাদের গলার কাছে ছোট্ট দাঁতের দাগ দেখতে পাওয়া গেল। মিস্টার গোমস এবার বিতানকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন চার্চের কাছাকাছি জায়গায়। এদিকে নন্দিনীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকল, পাশাপাশি এলাকার এক একজন মহিলার আস্তে আস্তে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে শুরু করল। কোন এক অদৃশ্য শক্তির বলে এলাকায় মানুষের মধ্যে ভয়াবহ এক আতঙ্কের সৃষ্টি হল। চারিদিকে মড়ক লেগে গেল। কী কারণে ঘটছে তা কোনোভাবেই কেউ বুঝতে পারল না।
ব্যান্ডেল থেকে ফেরার পথে যে লোকটিকে দেখে মিস্টার গোমস স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন, সেই লোকটির খোঁজ উনি শুরু করলেন। ভিয়েনায় ডঃ বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগ করে উনি জানতে পারেন আইভান নুরি সে দেশ থেকে উধাও। আইভান এর ছবির সাথে মিঃ গোমসের দেখা লোকটির অদ্ভুত মিল আছে। শুধু বয়সটা একটু কমে গেছে। মিঃ গোমসের বুঝতে অসুবিধা হল না যে কী জন্য এসব ঘটছে। যতদিন নন্দিনী শয্যাশায়ী ছিল ততদিন এলাকায় এক একটা মানুষের এইরকম অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে শুরু করল। আর নন্দিনী ও সেই মানুষগুলোর মৃত্যুর পর থেকে ক্রমশ আরও দুর্বল এবং আরও শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। শুধুমাত্র তার সাদা দাঁত গুলো ক্রমশ বড় হতে থাকল। বিতানকে বলতে সে বিশ্বাস করল না যে এলাকায় যে সমস্ত মানুষের মধ্যে রক্তশূন্যতা দেখা দিচ্ছে তার একমাত্র কারণ হচ্ছে নন্দিনী। নন্দিনীর এই শয্যাশায়ী অবস্থা হওয়ার আগে অবধি তাঁদের এলাকায় পাশাপাশি কোনও ছোট বাচ্ছা বা মহিলার উপর এমন বীভৎসতা নেমে আসেনি। যেদিন থেকে নন্দিনীর ওপর বাদুড় জাতীয় কোনও প্রাণীর আক্রমণ হয় তার পর থেকে এগুলো ঘটতে থাকল। বিতান বুঝতে পারল নন্দিনী মৃত্যুর পথে এগিয়ে চলেছে। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে নন্দিনী চলে গেল।
মন খুব ভেঙে পড়ল বিতানের। খ্রিস্টান মতে চার্চের কাছেই থাকে সমাধিস্থ করা হল। কফিন বন্দী নন্দিনীর দেহ শেষ বার দেখে চোখের জলে বিদায় জানালো বিতান।
সেদিনই মিস্টার গোমসের গাড়িতে ব্যান্ডেল থেকে নিজের শহরে ফিরে পড়ল। মনে ভীষণ এক কষ্ট তাকে শান্তি দিচ্ছিল না। বার বার সেই পিশাচ রুপী ছায়া মূর্তিটার কথা ভাবতে শুরু করল। মিস্টার গোমস তাকে সান্তনা দিতে থাকল।
আজ শনিবার। জুলাই মাসের শুরু। আকাশে মেঘ বৃষ্টির খেলা শুরু হয়েছে। বিতানের মনেও বৃষ্টির ধারা বইছে। নন্দিনীর কথা ভুলতে পারছে না। আরও বেশি খারাপ লাগছে নন্দিনীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে না পারার জন্য। রাতে শুয়ে ছিল বিতান। হঠাৎ মিঃ গোমসের ফোন পেয়ে উঠে পড়ল। উনি বিতানকে নিয়ে চার্চে যাবেন বলে তার বাড়ির কাছে এসে গেছেন। রাত ১১টা।
এত রাতে চার্চে যাওয়াটা খুব একটা ঠিক হবে বলে মনে করল না। কিন্তু গোমস তাকে একটা সত্যি জিনিস দেখানোর জন্য নিয়ে গেলেন। অগত্যা তার সাথে চলল চার্চে। নন্দিনীর সমাধির কাছে গিয়ে স্কু দিয়ে কফিন খুলল মিঃ গোমস। বিতান এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেদিকে। কফিন খুলতে গিয়ে প্রবল এক ঝড় তাঁদেরকে ঘিরে ধরল। পূতিগন্ধে চারিদিক ভরে উঠল। কোনরকমে ওরা ওই কফিন ছেড়ে গাছের আড়ালে আশ্রয় নিল। পৈশাচিক আনন্দে কারা উল্লাস করে উঠল। চারিদিকের ধুলো এক হয়ে ঘূর্ণিঝড়ের সাথে শুন্যে উঠতে থাকল। অন্ধকার ঘনিয়ে এল।
দূর থেকে ভেসে ভেসে কালো ছায়ামূর্তি উড়ে এল কফিনের সামনে। দুই হাত সামনে এগিয়ে দিয়ে বীভৎস এক হাসির উল্লাস করে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে অলৌকিক সেই ঘটনা ঘটল। নন্দিনীর কফিন থেকে পুরো শরীরটা উঠে এল। এর পর এক ছায়ামূর্তির আদেশ অনুযায়ী নন্দিনীর দেহটা আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠতে থাকল এবং হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে কোথাও একটা অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণ বাদেই আবার ওই চার্চের অংশটা ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে গেল। কোথাও কোন ঝড় বা পূতিগন্ধ আর পাওয়া গেল না। গাছের আড়াল থেকে এতক্ষণ মিস্টার গোমস ও বিতান দেখছিল। ভয়াবহ এই ঘটনাটা ঘটার কিছুক্ষণ পরে ওরা দৌড়ে কফিনের সামনে এল। কফিনটা খোলা হল। দেখল তার মধ্যে নন্দিনীর দেহটা নেই। মাত্র তিনদিন হয়েছে নন্দিনী মারা গেছে। নিয়ম অনুযায়ী এখনও কফিনের ভেতর তার দেহটা থাকার কথা। কিন্তু একি আশ্চর্য ব্যাপার যা বিতান নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। মিঃ গোমস তৎক্ষণাৎ ওখান থেকে চলে গেলেন। পরদিন সকালে শুনলেন যে আরও কিছু মেয়ের শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে। মিস্টার গোমসের কথা অনুযায়ী এগুলো সবই নন্দিনীর কাজ। কোন এক অলৌকিক শক্তি তাকে দিয়ে ওগুলো করাচ্ছে। নন্দিনীর দেহটাকে মুক্ত করতে গেলে এক্ষুনি কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। দিনের বেলা ভ্যাম্পায়ারদের কোন ক্ষমতা থাকেনা। তাই যা কিছু দেখার বোঝার সব দিনের বেলায় করতে হবে। রাত হলেই ওই অতৃপ্ত আত্মা ভ্যাম্পায়ারের বশে চলে যায়, আর তখন কিছুই করার থাকেনা।
তাই পরদিন সকাল বেলা আসবে বলে বের হল। কিন্ত সেই লোকটিকে রাস্তায় দেখে তার পিছু করতে ছুটলেন ওরা দুজনে। বিতান জানালো ‘এই লোকটিকে যেদিন নন্দিনীদের বাড়ি প্রথম আসি সেদিন ট্রেনে দেখেছিলাম ‘। কিন্তু আজ অনেক কম বয়স্ক লাগছে। এর মধ্যে গাড়িতে বিতানকে বসিয়ে কিছুক্ষনের জন্য মিঃ গোমস কোথায় চলে গেলেন। কিছু দূর গিয়ে তার দেখা আর পাওয়া গেল না। তাও মিঃ গোমস অনেকটা সময় কিছু একটা সূত্র পেয়ে গিয়েছিলেন। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল। দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে বিতান অস্থির হয়ে পড়ল। হঠাৎ মিঃ গোমস এসে বিতানকে সঙ্গে নিয়ে তাড়াতাড়ি চললেন। ক্রুস, পেরেক, হাতুড়ি, ছুরি, বাতি, আগুন সব সঙ্গে নিয়েছিল।সমাধির কাছে গিয়ে কফিন খোলার প্রস্তুতি নিল ওরা। মিঃ গোমস নানা জাদুবিদ্যা দিয়ে কফিনের চারিদিকে ঘিরে দিলেন। বিতান কফিন খুলতেই যা দেখল তা অবিশ্বাস্য। নন্দিনীর মৃতদেহ কফিনে সুন্দরভাবে শায়িত আছে। যেন মৃত্যুর আগের থেকে এখন অনেক বেশি জীবন্ত মনে হচ্ছে। মুখটা অনেক বেশি উজ্জ্বল, শুধু দাঁতগুলো ক্রমশ বড় হয়েছে। দাঁতের ফাঁক থেকে টকটকে টাটকা লাল রক্ত বেরিয়ে আসছে। যা দেখে বিতান ছিটকে পড়ে গেল। এও সম্ভব। হয়তো তার মনের কথা মিঃ গোমস বুঝতে পেরে বললেন -আর সময় নেই ভাববার, যা করার এখনই কর।
বিতানের হাত কাঁপতে থাকল। সন্ধ্যা হয়ে আসতে থাকল। নন্দিনীর এমন অপূর্ব রূপ দেখে তার মুন্ডচ্ছেদ করতে ঠিক মন চাইলো না বিতানের। তাও মিঃ গোমসের আদেশে নন্দিনীর আত্মাকে মুক্তি দিতে তার মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দিল বিতান। সঙ্গে সঙ্গে প্রবল ঝড় চারিদিকে প্রলয় নাচন শুরু করে দিল। নন্দিনীর মুখে ইভান নুরির ছায়া দেখা গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় বিতান চমকে উঠলেও, মিঃ গোমস একটুও সাহস হারালেন না। তিনি তৎক্ষণাৎ বুনো গোলাপের ডাল ও ক্রুস দিয়ে নন্দিনীর দেহটা বেঁধে দিলেন,আর বড় পেরেক দিয়ে দেহের বামদিকে হৃৎপিণ্ডতে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন। আকাশে বাদুড়ের মেলা বসে গেল। প্রবল এক পৈশাচিক হাসি ও রাগ ঝরে পড়তে লাগল।কিন্তু ক্রুস ও তন্ত্রবিদ্যার বলে তাঁদের কাছে আসতে পারল না কোনও শক্তি। মিঃ গোমস জানতেন যে নন্দিনীর মত মেয়েদের মুক্তি না দিলে ভ্যাম্পায়ার এর শক্তি কমান যাবে না। প্রায় ১৫ মিনিট এক অদৃশ্য শক্তির তান্ডব সহ্য করতে হল।অবশেষে কফিনের চারিদিকে প্রলয় নাচন থেমে গেল।
ঐ মুহূর্তে ব্যান্ডেল চার্চের কাছে কোনও পৈশাচিক বা বীভৎস ঘটনা ঘটল না। বোঝা গেল তাঁদের তন্ত্রবিদ্যায় কাজ হয়েছে। কিছুক্ষন আটকানো গেলেও পিশাচের আক্রমণ থেকে বাঁচা খুব মুশকিল।
এবার শেষ শক্তি দিয়ে আইভান তাদেরকে আক্রমণ করবে। ইভান নুরির কফিন আগে থেকেই মিঃ গোমস তুলে এনেছিলেন। সেদিনই রাতের ট্রেনে হাওড়া আসার পরিকল্পনা করে ফেললেন।
৮টা ২০ মিনিটে ব্যান্ডেল থেকে কফিন নিয়ে ট্রেনে উঠলেন মিঃ গোমস ও বিতান। ট্রেনে উঠতেই এক প্রলয় ঝড় উঠল। ট্রেনের কামরা দুলতে শুরু করল। বাকি যাত্রীদের কি হয়েছিল জানিনা।মিঃ গোমস তন্ত্র বিদ্যার বলে সাহায্যে কফিনকে বেঁধে ফেললেন। ঐ কফিনেই আইভান ও তার শক্তি নিহিত আছে। কোনও ভাবে ঐ কফিনকে সঙ্গে নিয়ে আইভানের মেয়ে গ্লোরীকে অমাবস্যার রাতে তন্ত্রবিদ্যার বলে বন্দী করে যদি কালীমন্দিরের সামনে জ্বালিয়ে দেওয়া যায় তবেই আত্মার মুক্তি ঘটবে। তাই যেভাবেই হোক চন্দননগরের কাছে পৌঁছাতেই হবে। ওখানেই বাসা বেঁধেছিল আইভান ও তার মেয়ে গ্লোরী। আসলে গ্লোরী জীবিত নয়, সেও মৃত। আইভান তার শক্তির বলে নিজের মেয়েকেই অ-মৃত অবস্থায় রেখে এই পৈশাচিক কান্ড ঘটিয়েছে। ফলে তার দেহ খুঁজে এই ইভান নুরির কফিনের সাথে আগুন দিতে হবে, তবেই ভ্যাম্পায়ার এর অবসান ঘটবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। আইভান নামের ঐ রক্তচোষা ট্রেনের উপরে তার প্রভাব বিস্তার করতে থাকল। বিতান ও মিঃ গোমস ভীষণ বড় রিস্ক নিয়ে ফেলেছেন। আজ অমাবস্যার রাতে যদি পুরো কাজটা না করতে পারে তবে ভ্যাম্পায়ার আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। মিঃ গোমস কফিন আগলে বসে রইলেন।আর বিতান স্টেশন কটা আসলো দেখতে থাকল। ট্রেনের বাইরে তখন প্রচন্ড বাদুড়ের নৃত্য ও শিয়ালের ভয়ার্ত কণ্ঠের চিৎকার শুরু হয়েছে, মনে হচ্ছে এক অন্ধকার পাতালে প্রবেশ করছে এই ট্রেন। বাইরে কালো মেঘ ছেয়ে গেল। আসতে আসতে ট্রেনের ভিতরে মেঘ ঢুকতে শুরু করল। ট্রেনের আলো নিভে গেল। শ্রীরামপুর আসতে কীভাবে জানি না মিঃ গোমস ও বিতান কফিন নিয়ে কালীমন্দিরে উপস্থিত হল। গ্লোরীর দেহ আগে থেকেই উনি মন্দিরের নিচে রেখে এসেছিলেন। কোদাল দিয়ে খুঁড়ে গ্লোরীর দেহ তুলে কফিনের উপরে শুইয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন আর চিৎকার করে তন্ত্র বিদ্যা আওড়াতে থাকলেন। পৈশাচিক হাসি আরও বীভৎস হয়ে উঠল। আইভান এর শরীর এবার পরিষ্কার দেখা গেল। আকাশে, বাতাসে পূতিগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। কফিন থেকে এক সুন্দরী মেয়ের কামনা মিশ্রিত ডাক বিতানের দিকে ধেয়ে এল। বিতান ইভান নুরি না গ্লোরী কার মুখ দেখছে জানে না, কিন্তু এক অদ্ভুত মায়া জড়ানো ডাক তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকল। ওদিকে ধুলো বালির মাঝ থেকে খিলখিল করে ভয়ার্ত গলা হাড়হিম করে দিল। চিৎকার করে বলতে থাকল – ছাড়ব না তোদের, রক্ত খাব.. রক্ত চাই, বাঁচবি না কেউ….তোরা কেউ বাঁচবি না।
কণ্ঠস্বর ক্রমশ আরও ভয়ার্ত হয়ে উঠল, আর মুখ দিয়ে টপটপ করে লাল রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকল। তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধ মিঃ গোমস আগে থেকেই বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। ফলে ঘৃণা, ক্রোধ ভরা ভয়ার্ত আইভান এর শ্ব-দন্ত স্পষ্ট দেখতে পেলেন।দাঁত আসতে আসতে বড় হতে শুরু করেছে। অমাবস্যার কালো আঁধার তো ছিলই, তারই মধ্যে মিঃ গোমসের বাতির আলোয় যা দেখা গেল সেই বীভৎস মুখ দেখলে রক্ত জল হয়ে যাবে। রক্তের বন্যা বইতে থাকল আকাশ থেকে। ভয়ঙ্কর দানব তার সব শক্তি দিয়ে মিঃ গোমসের কাজকে পন্ড করে দিতে চাইছে। অশরীরী আত্মারা কালো জটার মত করে কফিনের চারিদিকে ঘুরতে থাকল। একটা নয়, একাধিক প্রেত যেন প্রেতভূমি থেকে নেমে গ্লোরীর দেহের সামনে আসার চেষ্টা করছিল। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত মিঃ গোমসের চারিদিকে পড়তে থাকল। এমন বীভৎস পরিস্থিতিতেও একদিকে মিঃ গোমস মন্ত্র পড়ে চলেছেন, অন্যদিকে বাতাসে তান্ডব চলছে। বিদ্যুতের ঝলক ও বজ্রপাতের শব্দে কান ফেটে যাবার উপক্রম হল। মনে হল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু বৃষ্টির উদয় হল না।বাদুড়গুলো বড় থেকে ক্রমশ ছোট হতে শুরু করল। ইঁদুরগুলো মাটি থেকে উপরে উঠতে শুরু করল। সে এক অলৌকিক দৃশ্য। বিতান স্থির থাকতে পারছিল না। এরই মধ্যে কফিনের আগুন আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকল। পিশাচ রুপী ঐ মোহময়ীর আকর্ষণে বিতান কফিনের দিকে এগোতে থাকল। মিঃ গোমস তাকে আটকানোর চেষ্টা করতে থাকলেন। কিন্তু বিতান ক্রমশ সে দিকে ঝুঁকে পড়ল। আইভান তার গলায় দুটো দাঁতের দাগ বসিয়ে দিল। বিতান কফিনের উপর পড়ে গেল আর তৎক্ষণাৎ এক পৈশাচিক হাসির রোল উঠল। গাছের পাতা উদ্দাম নৃত্যে নড়তে শুরু করল, আর মন্দির চত্বরে এক প্রলয় তান্ডব শুরু হল। ঘোর অন্ধকার নেমে এল। তার পরই কফিনের আগুন ক্রমশ নিভতে শুরু করল। এরই মধ্যে প্রচন্ড বিস্ফোরণে চারিদিক কেঁপে উঠল, তখন আসতে আসতে চারিদিক শান্ত হতে শুরু করল। মিঃ গোমসের আফসোস যে তিনি বিতানকে বাঁচাতে পারলেন না। অমাবস্যার রাত কেটে তখন ভোর হতে শুরু করেছে। মিঃ গোমস ক্লান্তিভরা শরীরে ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোতে থাকলেন।
প্লাটফর্ম দেখে একটু মনে শান্তি ফিরে পেলেন গোমস। প্লাটফর্মে এসে বেঞ্চে বসে উনি একটু জল খেতে গেলেন। দূরে এক ছায়ামূর্তি দেখে উনি খুব ভয় পেয়ে গেলেন। বিতানের মত কেউ দাঁড়িয়ে আছে আর হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে মিঃ গোমসকে। মনের ভুল কিনা জানি না। মিঃ গোমস বেঞ্চে বসেই ঘুমিয়ে পড়লেন। ভোর ৫টা ৩০ মিনিটের ট্রেনের শব্দে ঘুম থেকে উঠে তাকালেন আর দেখলেন ট্রেনটা ক্রমশ প্লাটফর্মে উঠে তার দিকে আসছে। উনি ভয়ে আতঙ্কে দৌড়াতে শুরু করলেন। অন্ধকারে কোনও এক জলাশয়ে পড়ে গেলেন। মনে হল ভ্যাম্পায়াররা আবার জীবিত হয়ে তার পিছনে আসছে।
-কি মশাই, কোথায় যাবেন?
একটু জলের ছিটে দিতেই কী এক চিৎকারে উঠে পড়লেন গোমস। তাকিয়ে দেখলেন এক রেলের গার্ড তাকে ডাকছে। তাকিয়ে উনি বুঝলেন সারা রাতের বীভৎসতার পর উনি ঘুমিয়ে পড়ে এরকম এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিলেন।
তাকে কিছু না বলেই সামনে দাঁড়ানো ট্রেনে উনি উঠে পড়লেন। আর দ্রুত সেই ট্রেনে করে বাড়ি ফিরতে লাগলেন। মনের মধ্যে স্ত্রীর মৃত্যু, বিতানের মৃত্যু তাকে খুব দুর্বল করে দিল। বারবার তাদের কথা চিন্তা করতে থাকলেন, আর চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকল। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে থাকলেন।
তবুও রাতের ঐ ভয়াবহতা তাকে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল। ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা এ জীবনে দেখতে পাবেন তা হয়তো উনি ভাবেননি। মনে এলোমেলো সব ভাবনা পাহাড় হয়ে জমা হচ্ছিল। চাইলেও উনি তা ভুলতে পারছিলেন না। ট্রেন তার আপন ছন্দে এগিয়ে চলতে থাকল।
আকাশে তখন ভোরের সূর্যের মলিন আলো ফুঁটেছে, গায়ে এসে লেগেছে মিঠে রোদের আলোর বন্যা। এমন সুন্দর পৃথিবী কখনও কখনও কোনও দানবীয় শক্তির জন্য ভৌতিক হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানে তার ব্যাখ্যা হয় না। তাও মাঝে মাঝে তা মেনে নিতে হয়। অবশেষে হাওড়া ঢোকার আগে লোকজনের কোলাহল শুনে মিঃ গোমস একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
~ সমাপ্ত ~