কুসুমকুমারী| পলক ফেলা নিষেধ |রাজর্ষি বর্ধন| Bengali Thriller Story
0 (0)

“তুই রাজবাড়ির ছেলে আগে বলিস নি তো ?”

আমাদের ছুটির তেমন কোন প্ল্যান হয়নি, এমনিতে দোলের ছুটি একদিনের জন্যই জোটে প্রতিবার, এবার বরাত জোরে দুটো দিন পাওয়া গেলো !  এমন বেড়ানোর সুযোগ হেলায় হারাতে চাইলাম না- আমিও না, কুনালও না। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায় ?   শান্তিনিকেতন আমাদের প্রথম থেকেই না-পসন্দ, দোলের দিন ওখানে প্রতিবছর যা ভিড় হয় তাতে দোলের আসল মজাটাই মাটি হয়ে যায়। তাহলে ? এসব যখন চিন্তা করছি তখনই কুণাল বলল, “শক্তিপুর যাবি ?”

আমি বললাম, “তোর দেশের বাড়ি ? কি আছে সেখানে ?”

কুণাল জবাব দেয়,”তেমন দর্শনীয় স্থান হয়ত নেই, কিন্তু আমাদের বাড়িটাই তো দেখার মতো যায়গা ! কোনদিনও জমিদার বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে ?”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “জমিদারবাড়ি? তোরা জমিদার ছিলি বুঝি ?”

কুনাল হেসে বলল, “ন্যাকা, যেন জানো না ! গোটা শক্তিপুর গ্রামটাই আমাদের এস্টেট ছিল জানিস ? এখনও জমিদারবাড়িটা মেন্টেন করা হয় ! আমার ছোটকাকা আর তাঁর পরিবার সেখানে থাকে ! খারাপ লাগবে না কিন্তু !”

“তুই রাজবাড়ির ছেলে আগে বলিস নি তো !” আমি চোখ টিপে বললাম, ”অবশ্য তোর এই ল্যাভিস লাইফস্টাইলের মধ্যে একটা জমিদারি ব্যপার আছে ! কেমন একটা বনেদি-বনেদি ভাব !” বলে আমি চোখ টিপলাম।

আমি আর কুণাল একই কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছি, সেই থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আমরা একই কোম্পানিতে ঢুকেছিলাম ! পরে ও দুবছর এমবিএ পড়তে ব্যাঙ্গালর যায়, ফিরে এসে একই কোম্পানিতে উঁচু পোস্টে জয়েন করে।  অফিসে ও আমার বস হলেও বাইরে আমরা গলাগলি বন্ধু ! ও আমাকে বারবার এমবিএ করে নেওয়ার জন্য জোর দিত,কিন্তু আমার সেই সময় আর সামর্থ্য কোনটাই ছিল না! বরাবরই মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি, কুণালের মতো আর্থিক ভাবে সবচ্ছল নই !

কুণালের ব্যাকগ্রাউন্ডটা এবার জানানো দরকার। ও বড়লোক তা জানতাম, কিন্তু জমিদারবাড়ির ছেলে সেটা জানতাম না ! ছোটবেলাতেই বাবা-মা মারা গেছিল, নিঃসন্তান জ্যেঠার কাছে মানুষ। জ্যাঠার প্রিন্টিঙ্গের ব্যবসা ছিল,কুনালকে কোনদিনও অভাবের মুখ দেখতে হয়নি। কলেজ লাইফে ওর বড়লোকি চাল আমাদের আকৃষ্ট করত ! সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে-না-উঠতেই ওর চার-চারটে বাইক হয়ে গেছিল। আমাদের বন্ধুদের নিয়ে সেই সময় নামি-দামী রেস্তরাঁতে নিয়ে যেতো, যেগুলোতে ঢোকার কথা আমরা চিন্তাও করতে পারতাম না ! এই কারণেই আমরা ওর বশংবদ হয়ে গেছিলাম, ওকে খুশি রাখার  কোন সুযোগই ছাড়তাম না!

ওর একটা বদগুন ছিল, সেটা হল নারী আসক্তি। কলেজে কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলেই ওর পছন্দ হয়ে যেতো, এবং সেই মেয়েকে নিয়েই শুরু  হয়ে যেতো তার যাবতীয় ধ্যান-জ্ঞান ! তবে উল্টোদিক দিয়ে যে একই জিনিষ ঘটত তেমনটা নয়, ও  মেয়েদের প্রেমে পড়লেও মেয়েরাও যে  ওর প্রেমে পড়ত তেমনটা না! কারণ বিধাতা ওকে একটা মোক্ষম যায়গায় মেরে রেখেছিল, সেটা হল ওর রূপ। কারণ কুণালকে দেখতে মোটেই ভালো ছিল না, কুদর্শনই বলা যায় ! তবে কুণালের কাছে আসল অস্ত্রটা ছিল, যা হল অর্থবল- যার কাছে, আমার মনে হয়, সমস্ত গ্ল্যামার, যাবতীয় পুরুষালি শৌর্য-বীর্য সব ফিঁকে পড়ে যায় ! আসলে টাকার একটা সম্মোহনী শক্তি আছে, যেটা আমাদের কলেজের কিছু মেয়ে অস্বীকার করতে পারত না! তাই কুণালের মতো ছেলেরও প্রতিবছর দু-চারটে বান্ধবী জুটেই যেতো !

যতদিন যেতে লাগল, কুণালের এই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যেতে লাগল। ফাইনাল ইয়ারে উঠতে-না-উঠতেই দেখতাম ও ওর বান্ধবীদের নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরতে গেছে, দীঘা হোক বা মন্দারমনি-তাজপুর, দুটো দিন কাঁটিয়ে সে ফিরত। তখনও জানতাম না ওর রক্তের মধ্যেই এই প্রবণতা আছে ! শতাব্দী প্রাচীন জমিদারি বহুগামিতা তার মধ্যে লক্ষ্য করা যেতো ! চাকরিতে ঢোকার পরও দেখেছি ওর এই স্বভাবের কোন পরিবর্তন হয়নি। বিভিন্ন বয়সী, বিভিন্ন ক্লাসের মহিলার সঙ্গলাভ ওকে খুশি রাখত। মাঝে-মাঝে ওকে ফাঁকা ফ্ল্যাটে ভাড়া করা কলগার্ল নিয়েও রাত কাটাতে দেখতাম ! বুঝতাম টাকার জোর থাকলে মানুষ হাতে কল্পতরু পেয়ে যায় !

সেই কুণালের গ্রামের বাড়ি শক্তিপুর যেতে হবে শুনেও আমি আপত্তি করতে পারিনি, দু’দিনের জন্য  চেঞ্জ তো হবে !  শক্তিপুর বর্নান মহকুমার মধ্যে পড়ে, মেচেদা হয়ে যেতে হয়। আমরা শনিবারই রওনা দিয়েছিলাম, দুপুরে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে সন্ধ্যের আগেই পৌঁছে গেছিলাম। একেবারে অজ পাড়াগাঁ বলা  যায়না শক্তিপুরকে, রাস্তাঘাট-বাড়িঘর সব উন্নতই দেখলাম, পাশাপাশি খোলা মাঠ-ঘাট পুকুর-বিল ও নজরে এলো। কুণালদের জমিদার বাড়িটাও দেখলাম- পেল্লায় বাড়ি , ঠিক গল্পের বইতে বা সিনেমায় যেমনটা দেখি তেমন ! বুঝলাম, এখানে ছুটিটা মন্দ কাটবে না। কুণালের কাকা ও কাকিমার সঙ্গেও আলাপ হল। কাকার এখানে একটা র‍্যাশনের দোকান আছে। কাকাদের একমাত্র মেয়ে মানে কুণালের খুড়তুতো বোন রসায়নে মাস্টার্স করছে বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে, সে হোস্টেলে থাকে। কুণালের কাছ থেকে জানলাম, তাদের এই বাড়ির পনেরজন শরিক হলেও বর্তমানে তার কাকা ও কাকিমাই থাকেন। সাতমহলা বাড়ি একেবারে ফাঁকা পড়ে থাকবে বলে কাজের লোকেরা তাদের পরিবার নিয়ে এখানে থাকে। আমাদের জন্য সবচেয়ে ওপরতলার ঘর, অর্থাৎ তিনতলার ঘরেরই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমাদের পক্ষে যেটা খুব সুবিধাজনকই হয়েছিল, কারণ আমাদের পাণাহার  পর্বটা সারবার জন্য নিরিবিলি পরিবেশের প্রয়োজন ছিল, তাই সবদিক থেকে তেতলার ঘরটাই ছিল উপযুক্ত!

আমরা হাত-মুখ ধুয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে বসেছিলাম, একটু পরেই আমরা আমাদের পাণাহার  পর্বটা শুরু করব। কুণাল কাকিমাকে বলেছিল একটু পকোড়া ভেজে দিতে, চাট হিসেবে সেটা বলেনি, বলেছিল, “আমার এই বন্ধুটার হঠাৎই পকোড়া খাবার খুব শখ হয়েছে, গ্রামের হাওয়া খেয়ে ওর ক্ষিদেটাও গেছে বেড়ে  !” অর্থাৎ আমার ঘাড়ে বন্দুকটি রেখেই ও কার্যসিদ্ধি করল দেখলাম।

ঘরে বসে আমরা আমাদের ঘোরার প্ল্যানটা করছিলাম। শক্তিপুরে তেমন ঘোরার যায়গা নেই, তবে কুণাল বলছিল কাছাকাছি কয়েকটা পুরনো মন্দির আছে, সেগুলো দেখার কথা ভাবছিলাম। এমন সময় একটা মেয়ে আমাদের ঘরে ঢুকল পকোড়া থালা নিয়ে। যে পকোড়ার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে বসেছিলাম, সেটা থেকে সম্পূর্ণ নজর  গিয়ে সেই মেয়েটার ওপর গিয়ে পড়ল। অমন সুন্দর মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি, বেশ আলাদা চটক আছে, শরীরটাও বেশ আকর্ষণীয় ! কুণালকেও দেখলাম দু’চোখ দিয়ে মেয়েটাকে গিলছে ! ওর দৃষ্টিতে যে মেয়েটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে সেটা ওর চোখে-মুখে ফুটে ওঠা ভয় দেখেই বুঝতে পারলাম ! পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমি বললাম, “ইয়ে-পকোড়াগুলো দিতে এসেছেন বুঝি ?”

হুশে ফিরে মেয়েটা আমতা-আমতা করে বলল, “হ-হ্যাঁ, পি-পিসি এ-এগুলো পাঠালেন আপনাদের জন্য !”

আমি বললাম, “ঠিক আছে, রেখে দিন টেবিলে !”

মেয়েটি টেবিলের ওপর পকোড়ার প্লেটটা রেখে পরনের পোশাকটা সামলে একটা আড়ষ্ট ভাব নিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু যতক্ষণ ছিল, কুণালের চোখ দুটো যেন ওর ওপর সেঁটে ছিল !

“মেয়েটা কে বলত ? তোদের বাড়িতে কাজ করে নাকি ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“ডোন্ট নো, আমিই আজকে ওকে প্রথম দেখলাম,” বলে একটা পকোড়া তুলে নিয়ে বলল, “তবে জিনিষটা ভারি মুচমুচে !”

কুণালের এই ইঙ্গিতটা আমার খারাপ লাগল, বিশেষ করে ‘জিনিষ’ কথাটা ! আমরা মদের বোতল খুললাম, তবে মদ খাওয়াতে আমার তেমন যুত ছিল না, নতুন যায়গায়, বিশেষ করে বন্ধুর বাড়িতে খেতে খারাপ লাগছিল, কিন্তু কুণালকে দেখলাম পেগের পর পেগ ঢেলেই যাচ্ছে ! ওকে আমি বেশি খেতে বারণ করলাম, একটু পরই খেতে ডাকবে, কিন্তু কে কার কথা শোনে !

খাওয়ার সময় কিছুই চাপা থাকল না, কুণালকে ধরে-ধরে নিয়ে যেতে হল ! কাকু-কাকিমার সামনে আমার লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেছিল। খেতে বসার সময় দেখলাম সেই মেয়েটা আমাদের পরিবেশনা করছে, আমাদের ঘর থেকে বেরনর সময় যেই আড়ষ্টভাবটা দেখেছিলাম, সেটা ওর মধ্যে তখনও লক্ষ্য করলাম ! এও দেখলাম, কুণাল সেই নেশাগ্রস্থ অবস্থাতেও মেয়েটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ! কিন্তু আমি তখনও বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে মেয়েটি কে !

এর উত্তর পরক্ষনেই পেলাম, কুণালের কাকিমাই এর জবাব দিলেন। বললেন, “ও হলো রুপালী, আমাদের রান্নার লোক লক্ষীদির ভাইঝি, পাশের গ্রামেই থাকে, আজ তিন মাস হল এখানে এসে থাকছে, লক্ষীদিকে সাহায্য করছে ! খুব ভালো মেয়ে, রান্নার হাতও চমৎকার ! সন্ধেবেলার পকোড়াগুলো তো ওরই বানানো !”

খাওয়ার সময় আর তেমন কথা হয়নি, খাওয়া শেষ করেই আমরা শোয়ার ঘরে চলে গেছিলাম, আমি নিজেও তখন চোখ খোলা রাখতে পারছিলাম না ! কুণালের অবস্থা তো আরো সঙ্গিন, তবে ঘুমের ঘোরে কুণালকে দু’বার ‘রুপালী’ বলতে শুনলাম। ব্যপারটা আমার ঠিক পছন্দ হল না !

পরদিন সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে প্রাতরাশ করতে গেলাম। কুণালকেও দেখলাম গতরাতের খোয়ারি কাঁটিয়ে ফ্রেশ হয়ে গেছে ! কাকিমা আমাদের জন্য লুচি আর আলুর দম বানিয়েছিলেন, সেগুলোরই সদ্ব্যবহার করতে লাগলাম ! খেতে-খেতেই কুণাল কাকাকে জিজ্ঞেস করল, এখানে দেখার কি-কি যায়গা আছে।

কাকা উত্তর দিলেন, “যায়গা তেমন নেই, তবে দেখার একটা জিনিষ আছে বটে !”

বললাম, “কি জিনিষ ?”

কাকা বললেন, “দু’সপ্তাহ আগে এখানকার শ্মশানে এক তান্ত্রিকের আবির্ভাব হয়েছে। তাকে আগে কেউ দেখেনি ! সে আবার নিজেকে বলছে পিশাচসিদ্ধ, রাত্রিবেলা শ্মশানেই বাস করেন, মারন-উচাটন মন্ত্র জানেন,  লোকেদের ভূত-ভবিষ্যৎও বলে দিতে পারেন ! ওকে দেখতেই তো আশেপাশের গাঁ থেকে লোক জড়ো হচ্ছে ! উনিও নির্ভুলভাবে সবার ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিচ্ছেন !”

কুণাল হেসে বলল, “গ্রাম থেকে এখনও কুসংস্কার বিদায় নেয়নি দেখছি !”

কাকা ভেবে বলেন, “কুসংস্কার কিনা বলতে পারব না, তবে কাল যখন আমাদের পাশের বাড়ির গাঙ্গুলিমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তান্ত্রিকের কথা তুলতেই উনি কেঁদে ফেললেন ! পাঁচ বছর আগে ওনার  একমাত্র মেয়ে বুলা নিজের শ্বশুরবাড়িতে গায়ে আগুন লাগিয়ে মারা যায়, সেটা নাকি নির্ভুলভাবে বলে দিয়েছিলেন তান্ত্রিক !”

আমি অবাক হতেই কাকা বললেন, “শুধু এই নয়, উনি নাকি আবার আত্মা-টাত্মাও নামান, তবে সেটা মৃত্যুদিনে, অর্থাৎ যেই দিন সেই ব্যাক্তি মারা গেছে, সেইদিন তার আত্মার সঙ্গে তিনি সংযোগ স্থাপন করেন। তিনি গাঙ্গুলিমশাইকে এও বলেন, যদি এখন পঁচিশে কার্ত্তিক হত, তাহলে তিনি বুলার আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন, কারণ সেই দিনই বুলা মারা যায়, কিন্তু এখন তো ফালগুণ মাস চলছে, তাই অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই !”

শুনে কুণাল বলল, “বাবা, সাথে প্ল্যানচেটও  জুড়েছে দেখছি ! তা তুমি দেখেছ তাঁকে ? কেমন দেখতে- সেই রক্তাম্বর কাপড়, ইয়া বড় চোখ জবাফুলের মতো লাল, মুখভর্তি দাঁড়ি, হাতে নরকরোটি !”

কাকা বললেন, “ধুত, ও তো কাপালিক, ইনি তো তান্ত্রিক ! হ্যাঁ, ওই লাল কাপড়টা ঠিক আছে, বাকি সব আলাদা, মুখভর্তি দাড়ি-ফাঁড়ি কিসু নেই ! নিপাট ভদ্রমনুষের মতো চেহারা, দেখে মনেই হবে না যে উনি এসব ভয়ঙ্কর জিনিষ নিয়ে ঘাটাঘাটি করেন ! আমার তো মনে হয় তোরা একবার ওনার কাছ থেকে ঘুরে আয় !”

কুণাল হাল্কা ভাবে বলল, “হ্যাঁ, একটা টাইমপাস তো হবে ! দেখে আসি, একটা ফ্রড লোক কি করে এতোগুলো মানুষের বিশ্বাস অর্জন করছে ! কি বলিস ?”

বললাম, “আমার আপত্তি নেই। তবে ভূত নামানোর ব্যপারটা যদি সত্যি হয়, তাহলে কিন্তু জমে যাবে !”

ঠিক করলাম, আজকে বিকেলেই সেই তান্ত্রিকের কাছে যাবো। কাল দোল, আজ রাতে তাই নেড়াপোড়া, কয়েকটা ছেলেছোকরাকে দেখলাম কুণালদের বাগানে নেমে শুকনো ডাল-পালা সংগ্রহ করছে। ওদের মধ্যে একটা মেয়েকে দেখে অবাক হলাম, ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখলাম, মেয়েটা রুপালী ! দেখলাম কুণালের দৃষ্টিও ওর দিকে আটকে গেলো। ব্যপারটা ভালো ঠেকল না, একটা সতেরো-আঠেরো বছরের মেয়ের প্রতি কুণালের কিসের এতো মনোযোগ তা বুঝতে পারলাম না ! কুণালকে জিজ্ঞেস করাতে ও বলল, “দিস ইজ আ পিস অব বিউটি ! ওর ফিগারটা দেখেছিস ?”

আমি ওর কথা শুনে চমকে উঠে বলি, “কি বলছিস তুই ?”

“ঠিকই বলছি, কাল আমি নিজের হাতে ওকে রঙ মাখাবো, দেন আই উইল হ্যাভ হার !”

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম,”হ্যাভ হার মানে ?”

কুণাল হেসে বলল, “ওরে গান্ডু, হ্যাভ হার মানে জানিস না- আমি ওকে ভোগ করতে চাই !”

আমি আবার চমকে উঠি ! এই কুণালকে আমি যেন চিনতে পারি না ! জানি ওর চরিত্রের দোষ আছে, কিন্তু ও এরকম পাশবিক হয়ে উঠবে তা ভাবিনি ! আমার মনে হল, ওর মধ্যে উনবিংশ শতাব্দীর ভোগবাদী, অত্যাচারী, জমিদারের আত্মা ঢুকে গেছে !

আমাকে থতমত খেতে দেখে কুণাল ‘ফ্যাক’ ‘ফ্যাক’ করে হেসে বলল, “আরে চিল ম্যান, আমি তো মজা  করছিলাম ! তুই খেপেছিস নাকি, আমি ওসব কাজ করব, তাও আমার কাকার বাড়িতে? আমার মান-সম্মানের ব্যপার নেই !”

কথাগুলো ও বলল বটে, কিন্তু আমি নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা শ্মশানের উদ্দেশ্যে বেরলাম। শ্মশান খুব দূরে নয়, সেখানে মানুষের জটলা দেখেই বুঝলাম তান্ত্রিক মহাশয় উপস্থিত আছেন ! সবাই জমায়েত হয়েছে নিজেদের ভূত-ভবিষ্যৎ জানার জন্য ! এরই ফাঁকে তান্ত্রিকমশাইকে এক ঝলকের জন্য দেখতে পেলাম, কুণালের কাকার বর্ণনার সঙ্গে মিলে গেলো ! দেখলাম, যারাই  ওনার কাছে যাচ্ছে, উনি প্রথমে তার কপালে লাল রঙের একটা টিকা পড়াচ্ছেন, তারপর কপালে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছেন, তারপর ওনার পাশে রাখা চিরকুটে কি যেন লিখে সেই ব্যাক্তির হাতে  ধরিয়ে দিচ্ছেন, সেই চিরকূটটা দেখে কেউ আবার আনন্দে নেচে উঠছে, কেউ আবার কান্নায় লুটিয়ে পড়ছে, অর্থাৎ তিনি ভালো-মন্দ দু’রকম খবরই দিচ্ছেন !

“চিটিংবাজির বহরটা একবার দেখলি ?” কুণাল আমার পাশ থেকে বলল।

“সবাই তো দেখছি অন্ধভাবে বিশ্বাস করে নিচ্ছে, কাউকেই তো কোন প্রতিবাদ করতে দেখলাম না !” আমি বললাম।

আমরা একপাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলাম। ভক্তদের সমাগম তখনও কমেনি, একদল গেলে অন্যদল আসছে। এ জিনিষ চলবে গোধূলি বেলা অব্ধি, অর্থাৎ সূর্য ডুবে গেলে বাবাজি ধ্যানমগ্ন হবেন !

ভক্তদের মধ্যে হঠাৎই একজনকে বলতে শুনলাম, “বাবা, আত্মা নামানোর ব্যপারটা কবে হবে ?”

প্রশ্নটা শুনে আমি নড়ে-চড়ে বসলাম, তান্ত্রিক বললেন, “কাল পূর্ণিমা লাগছে রাত্রি আট ঘটিকায়, তারপরই হবে !”

“এবার কাকে ডাকবেন বাবা ?”

একটা রহস্যময় হাসি হেসে তান্ত্রিক বললেন, “কুসুমকুমারী !”

“কুসুমকুমারী ?” কুণালের মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে এলো !

আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কে এই কুসুমকুমারী? যার নাম শুনে কুণাল পর্যন্ত বিচলিত হয়ে গেলো! তান্ত্রিককে আবার বলতে শুনলাম, “কাল দোল পূর্ণিমায় কুসুমকুমারীর মৃত্যুদিন, ওই দিনই তাঁকে ডাকব !”

সবাই হইহই করে উঠল। আমি আর থাকতে পারলাম না, জিজ্ঞেস করলাম কুসুমকুমারীর ব্যপারে। কুণাল বলল, “এক সময় কুসুমকুমারী নামে এক মহিলা আমাদের ভৃত্যা ছিলেন, আমার প্রপিতামহ শম্ভুনাথ মুখারজির আমলে ! তার অসাধারণ রূপ আর যৌবনের আগুনে পুড়ে খাক হয়েছিলেন শম্ভুনাথ, চেয়েছিলেন কুসুমকুমারীকে নিজের অঙ্কশায়িনী করতে ! বিয়ের কথা চিন্তা করেন নি, কারণ একটা সামাজিক ব্যপার ছিল, তাই তিনি চেয়েছিলেন কুসুমকুমারীকে নিজের রক্ষিতা বানাতে ! তিনি তাঁকে সে প্রস্তাবও দেন, কিন্তু কুসুমকুমারী রাজি হয় নি ! শম্ভুনাথ তাঁকে অনেক প্রলোভন দেখান, বলেন-  শম্ভুনাথের  রক্ষিতা হলে কুসুমকুমারী রাজরানী হয়ে থাকবে, এই জমিদারবাড়িও  তিনি তাঁর নামে লিখিয়ে দেবেন, কিন্তু কিছুতেই তিনি কুসুমকুমারীকে টলাতে পারেননি ! কারণ, না খেতে পেয়ে মরলেও কুসুমকুমারী  নিজের সম্মান কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না! নিরুপায় হয়ে শম্ভুনাথ তখন চরম পন্থা নেন, বলেন, কুসুমকুমারী যদি তাঁর প্রস্তাবে রাজি না হয় তাহলে গ্রামে তাঁর বিধবা মা আর ভাইয়ের জীবনের নিশ্চয়তা তিনি দিতে পারবেন না! তিনি কুসুমকুমারীকে চব্বিশ ঘণ্টার সময় দিয়েছিলেন, তাঁর সামনে তখন দুটো রাস্তা খোলা- হয় শম্ভুনাথের কথায় রাজি হওয়া নয় নিজের মা-বোনকে চিরতরে হারানো ! পরদিন ছিল দোল, শম্ভুনাথ কুসুমকুমারীকে রঙ মাখাতে তাঁর ঘরে গিয়ে দেখলেন, কড়িকাঠে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়েছে কুসুমকুমারী ! তাঁর আত্মহত্যায় প্রচুর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু শম্ভুনাথ নিজের প্রভাব খাটিয়ে সব চুপ করিয়ে দেন !”

শুনে আমি একরকম স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পুরনো জমিদারদের বর্বরোচিত আচরণের কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু আমার বন্ধুর পূর্বপুরুষও যে এমন সেটা ভাবতেই সর্বাঙ্গে বেদনা হতে লাগল ! দেখলাম, সন্ধ্যে হয়ে গেছে, সব ভক্তরা একে-একে ফিরে যাচ্ছে, এবার তান্ত্রিকের ধ্যানের পালা। ফেরার পথে দূরে একটা মড়া পুড়ছে দেখে বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠল, কাছে গিয়ে দেখলাম ওটা একটা নেড়াপোড়া, তার চারপাশে ছেলে-ছোকরার দল খুব হল্লা করছে ! আকাশে দেখলাম চতুর্দশীর চাঁদটা থালার মতো প্রকট হয়েছে।

“কাল রাতে এখানে আসবি নাকি ?” আমি কুণালকে প্রশ্ন করলাম।

“ভূত নামানোর লাইভ শো দেখতে ?” কুণাল হেসে বলল, “তা মন্দ হয়না !”

ব্যপারটায় আমারও খুব কৌতূহল হচ্ছিল। সাধারণত প্ল্যানচেটের সময় দেখা যায়, একজনকে মিডিয়াম করে আত্মার সাথে কথোপোকথনটা হয়, কিন্তু এখানে কি জিনিষ হবে সেটা জানার জন্য কাল রাত অব্ধি অপেক্ষা করতে হবে !

হঠাৎই কুণাল বলল, “তুই একা চিনে যেতে পারবি তো? আমি বাজার হয়ে একটু আসছি !”

আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই দেখলাম কুণাল হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো ! হঠাৎ ওর বাজারে যাওয়ার কি দরকার থাকতে পারে, যে আমাকে ফেলেই যেতে হল !

যাই হোক, একা-একাই জমিদারবাড়িতে ফিরে আসলাম। তান্ত্রিকের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যপারটা কুণালের কাকাকে জানালাম, এও বললাম কুণালের আচমকা বাজারে যাওয়ার কথা, শুনে কাকা হেসে বললেন, “ও ওইরকমই, হয়ত রঙ-টঙ্গ কিনতে গেছে, ওর ছেলেমানুষি এখনও গেলো না !”

দশমিনিট পর কুণাল এলো, সত্যিই ও একটা ছেলেমানুষই বটে ! রঙ-আবীর কিনতে যাচ্ছিস সেটা বললেই তো পারতিস ! জবাবে সে হেসে বলল, “তুই বুঝবি না, আয় তোকে বাড়িটা দেখাই !”

তখনই কুণালদের গোটা বাড়িটা দেখতে পেলাম। পেল্লায় সব ঘর!  পুরনো আসবাবপ্ত্রগুলো দেখলাম ভালো করে দেখভাল করা হয়। পুরনো দিনের লম্ফ, ঝাড়লন্ঠন, টানাপাঙ্খা, গড়গড়া সবই রয়েছে, এ যেন একটা আস্ত মিউজিয়াম ! দু’জন লোক মাইনে করে রাখা হয় এইসব দেখাশুনো করার জন্য। হঠাৎই দেওয়ালের দিকে চোখ পরে গেলো, একটা ছবি- ওয়েল পেইন্টিং,  একজন রাশভারী জমিদারের প্রোউড় বয়সের ছবি। চোখের চাহুনি বুকের মধ্যে কম্পন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ! কুণালকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইনিই কি শম্ভুনাথ মুখারজি ?”

কুণাল উত্তর দিলো, “ঠিকই ধরেছিস, ইনিই আমার প্রপিতামহ !”

ছবিটায় আর একটা জিনিষ দেখে আমার বুকের কম্পনটা দ্বিগুণ হয়ে উঠল, সেটা হল একটা সাদৃশ্য- কুণালের মুখের সাথে অদ্ভুতরকমের সাদৃশ্য খুজে পেলাম শম্ভুনাথের মুখের ! মনে হচ্ছিল, কুণালকে মেক-আপ করে দিলে অবিকল শম্ভুনাথের মতো লাগবে ! একটা অজানা অস্বস্তি আমায় চেপে ধরেছিল, আমি সে ঘর থেকে তক্ষুনি বেরিয়ে গেছিলাম।  রাত্তির হয়ে গেছিলাম, আমি আর আমার ঘরে গেলাম না, বাকিটা সময় ছাতে একা কাটালাম, নামলাম সেই খাওয়ার সময়। সেদিনও আমাদের পরিবেশনা করছিল রুপালী, আশ্চর্যভাবে কুণালকে গতরাতের মতো এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম ! আমার সেই অস্বস্তিটা ফিরে এলো, মনে হল, কুণাল নয়, আমার সামনে বসে আছেন স্বয়ং শম্ভুনাথ ! রাতে কাকিমা চমৎকার মাংসের পদ বানিয়েছিলান, কিন্তু ভালো করে খেতে পারলাম না!

পরদিন  ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেলো। সেদিন দোল, তাড়াতাড়ি স্নান করে নিয়ে হাতে আবীর নিয়ে কাকু-কাকিমাকে প্রনাম করলাম, ওনারাও আমায় আশীর্বাদ করলেন ! কুণালকে কোথাও না দেখে জিজ্ঞেস করাতে জানলাম ও একতলার ঘরে বসে আছে। আমি একতলার ঘরে গিয়ে দেখলাম, কুণাল রাগে ফুঁসছে, আমাকে দেখেই বলল, ‘সি রিফিউজড মি !”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কার কথা বলছিস ?”

“দ্যাট ড্যাম বিচ রুপালী ! আমি ওকে রঙ মাখাতে ওর ঘরে গেলাম, ও মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো ! আমি ছাড়ব না ওকে !” রাগে ফুঁসতে-ফুঁসতে কুণাল বলল।

আমি ওকে বললাম, “পাগলামো করিস না কুণাল, তুই কেন রুপালির পেছনে পড়েছিস? ওর সঙ্গে যদি কিছু উল্টোপালটা করিস তাহলে তোর, তোর কাকু-কাকিমার আর এই বাড়ির মান-সম্মান জড়িয়ে যাবে !”

“ডু হেল উইথ ইওর মান-সম্মান !” কুণাল ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো বলল, “আই ওয়ান্ট হার ব্যাডলি ! ভাবিস না, ওকে এখানে কিছু করব না, এখান থেকে খানিকটা দূরে আমাদের একটা কাছারি বাড়ি আছে, ওকে সেখানে নিয়ে যাবো ! কিভাবে নিয়ে যাবো সে প্ল্যানও করা আছে, ওর খাবারের সাথে কালকের আনা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ওকে অচেতন করে দেবো, সবাই ভাববে ওর শরীর খারাপ হয়ে গেছে, তারপর হাস্পাতালে যাওয়ার নাম করে ওকে সেখানে নিয়ে যাবো, তারপর আর আমায় পায় কে!”

আমার পা কেঁপে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল- কুণাল নয়, কুণালের খোলস ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসছে একটা দৈত্য! আমি আবারও বললাম, “ডোন্ট বি সিলি-“

“বেটার ইউ ডোন্ট স্পিক আ ওয়ার্ড !” ও ধ্মকের সুরে বলল, “ভুলে যাস না, বাইরে আমরা বন্ধু হলেও আমি তোর ইমিডিয়ট বস ! সুতরাং, চাকরি যদি বাঁচাতে হয় দেন ডোন্ট হোল্ড মি !”

আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। কুণালকে এতদিন চিনতে পারিনি, তার জন্য অনুশোচনা হতে লাগল ! ও যে এতো বড় পাষণ্ড হতে পারে তার ধারণা ছিল না ! সেই মুহুরতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। সারাদিন নিজের ঘরের মধ্যে বন্দি রাখলাম নিজেকে। চারিপাশে রঙের উৎসবে নিজেকে মেলাতে পারছিলাম না! দুপুরে খাওয়ার টেবিলে কুণালের মুখোমুখি হতেই গা-টা ঘুলিয়ে উঠল ! রুপালী মেয়েটার জন্য মায়া হতে লাগল, অমন ফুলের মতো মেয়েটার কি পরিণতি হতে চলেছে ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠছিল !

আঁচানোর সময় কুণাল আমার কানে-কানে বলল, “আজ রাতের ব্যপারটা ভুলে যাস না যেন !”

আত্মা নামানোর ব্যপারটা আমার মনে ছিল, কিন্তু আমার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না ! এদিকে কুণালকে ঘাটাতেও সাহস পাচ্ছিলাম না, ওর যে কি অভিসন্ধি তা বোঝা দায় !

শ্মশানে গিয়ে দেখলাম লোকে লোকারণ্য, সবাই তান্ত্রিকের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ দেখতে এসছে! আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, ব্যপারটা যদি বুজরুকিই হবে তাহলে এতোগুলো মানুষের সামনে দেখানোটা চাড্ডিখানি কথা নয়, তান্ত্রিকবাবার এলেম আছে বলতে হবে!

আটটা বাজতেই তান্ত্রিক সবাইকে একজোট হতে বললেন। অশ্বত্থ গাছটার সামনে দেখলাম হোমের আগুন জ্বালানো হয়েছে। সবার উদ্দ্যেশ্যে তিনি বললেন, “সবাই একাগ্র  চিত্তে কুসুমকুমারীকে স্মরণ ক্রুন!  ওর চেহারা মনে করার চেষ্টা ক্রুন, উনি স্বরূপে প্রকট হবেন !”

ব্যপারটা আমার বোধগম্য হল না। আমি তো জানিই না কুসুমকুমারী কেমন দেখতে, তার ছবিও দেখিনি ! বাকি যারা আছে, তাড়া কুসুমকুমারীকে দেখেছে বলে মনে হয়না কারণ কুসুমকুমারী মারা গেছে আশি বছর আগে !

তান্ত্রিক কি মন্ত্র পড়তে লাগলেন, ওঁর গমগমে কণ্ঠস্বর আমার মধ্যে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দিচ্ছিল ! হঠাৎই দেখলাম, শ্মশানের পেছনে খালের ওপর একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে, কিন্তু এই ধোঁয়ার উৎস কি ? ধোঁয়াটা দেখেই তান্ত্রিক মন্ত্র পড়ার জোর বাড়িয়ে দিলেন!  দেখতে পেলাম, ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা আস্তে-আস্তে একটা নারীর  অবয়ব ধারন করছে, খুব স্পষ্ট নয়, তার হাত-পা পরনের শাড়ি সব প্রকট হচ্ছিল, কিন্তু মুখটা তখনও ফুঁটে ওঠেনি ! তান্ত্রিক চেঁচিয়ে বললেন, “ওই- ওই যে প্রকট হচ্ছেন কুসুমকুমারী, আমাদের আহ্বানে উনি সারা দিয়েছেন !”

এবার ধীরে-ধীরে কুসুমকুমারীর মুখটা ফুঁটে উঠল, এবং সে মুখ দেখে আপনা-আপনি আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো , “রূপালী !”

তান্ত্রিক বলল, “কুসুমকুমারী এসেছে- ওই দেখো সবাই ! বল মা, তোর কি বাসনা ?”

কুসুমকুমারীর ভূত সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, “কোথায়- কোথায় সেই নরপিশাচ !”

কথাগুলো যেন মৃত্যুর গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসছিল, সেই মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল আমি হার্টফেল করে যাবো! হঠাৎ খেয়াল হল, আমার পাশে কুণাল নেই। দেখলাম, সে দৌড়ে পালাচ্ছে ! আমি ওকে ডাকার আগেই দেখলাম, ধোঁয়ার মতো কুসুমকুমারী উড়ে কুণালের কাছে গিয়ে, কোন এক অতিলৌকিক ক্ষমতায় তাকে মাটি থেকে শূন্যে তুলে সেই হাড়হিম গলায় বলছে, “আমার সর্বনাশ করে, আমাকে মৃতুর মুখে ঠেলে দিয়ে তুই নিশ্চিন্তে পালিয়ে যাবি ভাবছিস ? আমিই আজকে চিরতরে শেষ করে দেবো শয়তান !”

সবাই তাঃস্বরে চেঁচাতে আরম্ভ করল। এ কি দৃশ্য, কিভাবে এর বর্ণনা করা যায় ! এমন অপার্থিব দৃশ্য কি আগে কেউ দেখেছে ? ওদিকে কুণাল প্রাণপণে “বাঁচাও-বাঁচাও” করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে ! তান্ত্রিক জোর গলায় বললেন, “ওকে ছেড়ে দে !”

কুসুমকুমারীর প্রেতাত্মা মরিয়া হয়ে বলল, “ছাড়ব না, এই শয়তান শম্ভুনাথকে আমি ছাড়ব না ! আমাকে ও শেষ করেছে, আমি ওর বুকের রক্ত খাব !”

প্রেতাত্মা কুণালকে শম্ভুনাথ ভেবেছে, তাই তাঁর মধ্যে জেগে উঠেছে প্রতিশোধ স্পৃহা ! কিন্তু এই বিপদ থেকে কুণালকে উদ্ধার করি কি করে?

আমাদের পরিত্রাতা  হয়ে এলেন স্বয়ং তান্ত্রিক। তিনি জোর গলায় কি মন্ত্র পড়তেই মুহূর্তের মধ্যে কুসুমকুমারীর অবয়ব হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো ! কুণালকে দেখলাম মাটিতে  লুটিয়ে পড়তে, সঙ্গে-সঙ্গে ওঁর কাছে ছুটে গেলাম ! দেখলাম, বেঁচে আছে- কিন্তু অজ্ঞান। তাড়াতাড়ি ওকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। 

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে, এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে সেটা আবার জানতে পারলাম ! কুসুমকুমারীর ভাইয়ের বংশধর হচ্ছে এই রূপালী, তাই তার পূর্বসুরীর মতো তাকে দেখতে হয়েছিল, ঠিক যেমন কুণালের মধ্যে এসেছিল তার প্রপিতামহ শম্ভুনাথ মুখারজির স্বভাব ! কুসুমকুমারী কুণালকে প্রাণে মারতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু আশি বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা অন্যায়ের প্রতিকার যেন দেখতে পেয়েছিলাম……

……কুণাল এখন সম্পূর্ণভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন, ঠিকানা তার অ্যাসাইলামে, অবস্থার কবে উন্নতই হবে কেউ বলতে পারে না ! তবে একটা নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে এরই মাঝে, কোন মেয়েকে দেখলেই সে “কুসুমকুমারী” “কুসুমকুমারী” বলে চেঁচিয়ে ওঠে !

( কাহিনীটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। লেখক কোন রকম কুসংস্কারে বিশ্বাসী নয়। )

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post জ্যাঠা মশাইয়ের ভুতুড়ে বাড়ি | পলক ফেলা নিষেধ |সমীর মন্ডল| Bengali Thriller Story
Next post ৭২০ এর নৈহাটী লোকাল | পলক ফেলা নিষেধ |দেবশ্রী ঘোষ| Bengali Thriller Story