৭২০ এর নৈহাটী লোকাল | পলক ফেলা নিষেধ |দেবশ্রী ঘোষ| Bengali Thriller Story
0 (0)

৭:২০ এর নৈহাটী লোকাল

“খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে,কাল হল তার এঁড়ে গরু কিনে।”

কথাটা একেবারে প্রযোজ্য আমার নিজের জন্য। আমি রুমেলা বোস, বেঙ্গল ব্যাঙ্ক এর কর্মচারী। ২০১৪ সালে পরীক্ষা দিয়ে কেরানি হয়ে জয়েন করেছিলাম। আমাদের বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার চকখালি গ্রামে, ট্রেনিং এর পর নিজের গ্রামেই ব্যাংকের একমাত্র ব্রাঞ্চে পোস্টিংও পেয়ে যাই ভাগ্যক্রমে। দিব্বি ছিলাম খোশমেজাজে চেয়ারখানি চেপে, হঠাৎ যে কী মাথার ব্যামো হলহল প্রমোশন এর পরীক্ষা দিয়ে বসলাম বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, আর বিনা প্রস্তুতির পরীক্ষাতেও দুর্দান্ত রেজাল্ট করে প্রমোশন পেয়ে অফিসার হয়ে গেলাম। মাইনে বাড়ার আনন্দে ভুলেই গেছিলাম যে, প্রমোশন হলেই ব্যাংকের পলিসি অনুযায়ী দূরে ট্রান্সফার করে দেবে। তাই ডিসেম্বরের ৪ তারিখ হঠাৎ নিজের নাম মেইলে দেখে একটু হলেও চমকে গেছিলাম! সোদপুরে পোস্টিং। হে ভগবান! এত্ত দূরে রোজ আসা যাওয়া করব কী করে? প্রোমোশনের রেজাল্ট বেরোবার পর ৬ মাস কেটে গেছে, তাই আর রিফিউসাল লেটারও জমা দিতে পারব না। অগত্যা বেজার মুখে একগাদা ফেয়ারওয়েল গিফট নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। মা বাবাও যারপরনাই চিন্তিত। সারা জীবন বাড়ির কাছে স্কুল, কলেজ এমনকি চাকরি জীবনের প্রথম ৫টা বছরও এইখানেই কেটে গেছে। বাড়ির লোক, আত্মীয়স্বজন, পাশের বাড়ির কাকু কাকিমা সবার চিন্তার মাঝেই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সময়িতা হোয়াটস্যাপে একটা মেসেজ পাঠাল “বেস্ট অফ লাক” লিখে আর সঙ্গে একটা খুব সুন্দর প্রজাপতির ছবি। এতক্ষণ পরে আমার মুখে একটু হাসি ফুটল। সত্যি তো, গুটিপোকার এবার সত্যি সময় হয়েছে কোকুন ছিঁড়ে ডানা মেলে উড়ে যাবার। আর বেশি কিছু না ভেবে মাকে বললাম ডিনার দিয়ে দিতে, কালকে সকাল সকাল উঠতে হবে। জীবনের নতুন একটা অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছি। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে তাই।

প্রজাপতির ডানা একদিনেই প্যারালাইসড হয়ে বাড়ি ফিরল। প্রথমত দৌড়ে দৌড়ে স্টেশন পৌঁছানো, তারপর ২০ জনের পিছনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটে অফিসটাইমের চূড়ান্ত ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে অনভ্যাসের দেড় ঘন্টার জার্নি পেরিয়ে শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছনো, তারপর দৌড়ে সাউথ সেকশন থেকে মেইন সেক্শনে পৌঁছে অন্য ট্রেনে ওঠা। ফেরার সময় একই অবস্থা। দুই সপ্তাহ পার হবার ভাবলাম রিসাইন করে দিই, এভাবে আর সম্ভব নয়। সারাদিন শুধু ট্রেন এর পিছনে ছুটে্ ট্রেনের ভিতরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কেটে যাচ্ছে। মুশকিল আসান করলেন আমার মেজ মামা। বললেন, “রুমি তুই ফেরার সময় ডাইরেক্ট নৈহাটী লোকালটা ধরছিস না কেন, ওটা তো সোদপুরের ওপর দিয়ে ৭:২০ তে পাস হয়, তুইও মোটামুটি ওই সময়েই ট্রেন ধরিস শিয়ালদহ থেকে। হয়তো কিছুক্ষণ দেরি হবে, কিন্তু ট্রেন বদলের ধকল থেকে বাঁচবি।” আমার এই বিকল্প ব্যবস্থাটি বেশ মনে ধরল।পরদিন আর শিয়ালদহ গেলাম না, সোদপুর স্টেশনে বসে রইলাম। ঠিক ৭:২০ তে ডাইরেক্ট নৈহাটী–চকখালী লোকাল এল স্টেশনে, ট্রেনটা বেশ ফাঁকা, উঠেই সিট্ পেয়ে গেলাম। এই অফিসটাইমে এত্ত ফাঁকা ট্রেন ভাবাই যায় না, যাই হোক আরাম করে জানলার ধারে একটা সিটে গিয়ে বসলাম। বেলঘরিয়া, দমদম্বিধাননগর পেরিয়ে ট্রেনটি পথ পরিবর্তন করল। কারণ এই ডাইরেক্ট ট্রেনগুলো শিয়ালদহ যায়না, গুরুদাস হল্ট স্টেশনের ওপর দিয়ে গিয়ে সোজা পার্কসার্কাস স্টেশনে যায়। স্যার গুরুদাস ব্যানার্জীর নামাঙ্কিত এই স্টেশনটিতে সারাদিনে খুব কম ট্রেনই থামে, সত্যি কথা বলতে আমি এই স্টেশনটি প্রথমবার দেখলাম। হাতে গোনা দু চারজন প্যাসেঞ্জার ওঠানামা করার পর ট্রেনটা ছেড়ে দিল। পার্কসার্কাস স্টেশনের দিকে গতিপথ বদল করার পর ট্রেনটি চলতে চলতে হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গেল। ট্রেনের সব আলোগুলোও নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিকে। জানলা দিয়েও বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, খুব বেশি আলো চোখে পড়ল না। মিনিট তিনেক এই অবস্থাতেই থাকার পর আমার পাশের সিটের যাত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম যে ট্রেনটা এভাবে থেমে আছে কেন? তিনি এই ট্রেনের নিত্যযাত্রী, জানালেন যে রোজই ট্রেনটা এই জায়গায় কিছুক্ষণ থামে, হয়তো সিগনালের অপেক্ষায়। লাইন ক্লিয়ারেন্স পেলে তারপর আবার যাত্রা শুরু করে। ওঁর কথাই সত্যি হল, আরও মিনিট দুয়েক থেমে থাকার পর হুইসল বাজিয়ে আমার ট্রেন আবার চলতে শুরু করল, আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

নতুন ব্রাঞ্চে আমার একমাস পূর্ণ হল আজ। এই ডাইরেক্ট নৈহাটী লোকালটা পেয়ে আমার যে কী উপকার হয়েছে তা বলে বোঝাতে পারবনা। এই দীর্ঘ ট্রেন জার্নির পথটা আমি মোবাইলে সিনেমা দেখতে দেখতে অথবা গান শুনতে শুনতে আসি। আজ গুরুদাস হল্ট পেরোনোর পর ঠিক সেই একই যায়গায় ট্রেনটি থামল। সেই আলোগুলো সব নিভে গেল। আজ পূর্ণিমা হওয়ায় জানলা দিয়ে বাইরেটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। রেললাইনের পাশে কালো পাথরের স্তুপ যেমনটা সব জায়গায় হয় আর কি। তারপাশে একটা ছোট নোংরা ড্রেন মত। সাধারণত রেললাইনের পাশে মানুষের বসতি থাকে, কিন্তু এখানে কিছু নেই। একদম নির্জন। ড্রেনের পাশে অনেক ঝোপ ঝাড় ছোটোখাটো জঙ্গল তৈরী করেছে। আরও বেশ কিছুটা দূরে একটা বাড়ি দেখতে পেলাম, তবে বাড়ি বললে ভুল হবে,পরিত্যক্ত পোড়োবাড়ি বলা চলে। ভাঙা এবড়ো খেবড়ো দেয়াল, দেয়ালের গায়ে সবুজ শেওলার পুরু আস্তরণ, সামনে একটু ছোট একটা লন মত যেটা পুরোটাই আগাছায় ভর্তি, একটা ভ্যান মত ভাঙা গাড়িও চোখে পড়ল। আর বাড়িটিকে ঘিরে অনেক বড় বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটার পাশে একটা বড় মাঠ চোখে পড়ল,তাতে উঁচু উঁচু ঢিবি মত, তবে মাঠে বড় গাছ কিছু নেই। ওই মাঠে একটা ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে, পূর্ণিমার আলো আর ল্যাম্পপোস্টের আলোয় অনেক পরিষ্কার ভাবে সবটা আজ দেখলাম। আর খুব অবাক হলাম,কলকাতার ক্রমবর্ধমান জনস্ফীতিকে সামাল দিতে যেভাবে খাল পুকুর ডোবা বুজিয়ে শহরতলিতে ব্যাঙের ছাতার মত ফ্ল্যাট বা রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স তৈরী হচ্ছে সেখানে শহরের বুকে রেললাইনের ধারে এত্ত ভালো, এত্ত বড় একটা জায়গা এখনো খালি পরে আছে? প্রোমোটারদের নজরে এখনো এত্ত লোভনীয় জায়গাটা চোখে পড়েনি দেখে সত্যি খুব অবাক হলাম।

কোনও অজানা জায়গা সম্পর্কে একবার একটু সামান্য ধারণা হলেই আমাদের মনে ওই জায়গাটা সম্পর্কে কৌতুহল খুব বেড়ে যায়, আমারও তাই হল। রোজ ফেরার পথে ওই জায়গাটায় ট্রেন থামলেই আমি উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করতাম যে, আরও নতুন কিছু দেখা যায় কিনা? এভাবেই আমি উদ্ধার করলাম বাড়ির এই পাশটা পিছনদিক। কারণ কোনও বড়ো দরজা নেই। কিন্তু অনেকগুলো জানলা আছে। বাড়িটা দোতলা, প্রতিটা ঘরে দুটি করে জানলা। জানলার পাল্লা অধিকাংশ ঘরেই নেই, তবে গ্রিলের কাঠামোটা রয়ে গেছে। হালকা আলোতেও পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে জং ধরে গেছে গ্রিলগুলোতে। গাড়িটার আসল রং ও উদ্ধার করতে পেরেছি, সাদা। আরও একটা অ্যাম্বাসেডর গোত্রের গাড়িও আছে বাড়ির এই পাশটায়, যা দেখে বুঝতে পারলাম যে বাড়ির মালিক বেশ বড়লোক ছিলেন। যাই হোক, সেদিনও এভাবেই খুব করে চেষ্টা করছিলাম নতুন কিছু উদ্ধার করার, হঠাৎ দোতলার বাঁদিক থেকে ৩ নম্বর ঘরটার জানলায় মনে হলহল কেউ দাঁড়িয়ে আছে, আর আমাদের ট্রেনের দিকেই দেখছে। চমকে উঠলাম গাড়ির হুইসেলের আওয়াজে, গাড়িটা ছেড়ে দিল কিন্তু ফিরতি তাকাতেই দেখলাম না্কিছু নেই। জানলাটা একদম ফাঁকা। মনে খটকা লাগল, এতটা ভুল দেখলাম?

পরদিন ছিল রবিবার। সময়িতার কথা আগেও লিখেছি, সেই স্কুলজীবনের বন্ধু ও আমার, নার্সারি থেকে একসঙ্গে পথ চলা শুরু, সত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আজও বেস্ট ফ্রেন্ড আমরা। ইংরেজিতে এম এ পাশ করে এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে এখন বারুইপুরের একটা স্কুলের শিক্ষিকা ও, ডাকনাম সমু। রোজ ফোন আর হোয়াটস্যাপে কথা হলেও রবিবারগুলোয় আমরা চেষ্টা করি একবার এর ওর বাড়িতে ঢুঁ মেরে আসার, কারণ আমরা এক পাড়াতেই থাকি। প্রায় ২০ বছরের অভ্যেস, কোনও কোনও দিন কাকিমা আটকে দেন, বলেন “রুমি আজ এখানেই লাঞ্চ করে যা, সারা সপ্তাহ গল্প করার সময় পাস না, আজ মন খুলে দুই বন্ধু মিলে গল্প কর।” এমনই গাঢ় সম্পর্ক আমাদের দুজনের, নিমন্ত্রণ লাগে না দুপুরের খাবার খেতে। আজ সমু আমাদের বাড়িতে এসেছে, ও ওর স্কুলের হেডমিস্ট্রেসের কড়া শাসনের গল্প করছিল আর আমি আমার নতুন ব্রাঞ্চের কড়া ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের। শুয়ে শুয়ে দুজনেই ভাবছিলাম যে আমাদের স্কুলজীবনটা মনে হয় কোনোদিন শেষ হবে না, সেই হেডদের বকাঝকা খেতে খেতে আর নির্দেশ পালন করতে করতেই কেটে যাচ্ছে। মন ভালো করতে ভূতের সিনেমা আই টি চ্যাপ্টার টু দেখলাম দুজনে মিলে। সিনেমা দেখতে দেখতে সমুকে আমি আমার ট্রেন জার্নির পথের অদ্ভুত ঘটনাটা বললাম। সমু তো শুনে খুব অবাক হলহল, জিজ্ঞেস করল “তুই নিশ্চিত যে তুই সত্যি সত্যি কাউকে জানলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিস?” আমি বললাম যে মনে তো তাইই হচ্ছে কিন্তু চোখের ভুলও হতে পারে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে আমি আর সমু আমরা দুজনেই ভীষণ অকুতোভয় ছোটবেলা থেকে, ডাকাবুকো প্রকৃতির। আমরা ছোটবেলায় তাইকোন্ডো শিখেছি, ভূতের ভয় দুজনের কারুরই নেই,তাই নতুন ভূতের সিনেমা রিলিজ করলেই গোগ্রাসে গিলি। ভয় তো একফোঁটাও পাই না,উল্টে হেসে কুটিপাটি যাই রং মাখা ভূত আর টমেটো কেচাপ ফ্লেভার্ড রক্ত দেখে। সমু যেন আমার মনের কথা ধরে ফেলল “যাবি একবার? সত্যিটা নিজের চোখে দেখে আসতে?” “চল তাহলে, নেক্সট রবিবার।”

মাঝের এক সপ্তাহ ব্যাংকের স্বাভাবিক ব্যস্ততাতেই কাটল। রবিবার সকালবেলা আমি আর সমু একটা করে ছোট ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে সন্ধের ডাইরেক্ট ট্রেনটার মতই সকালবেলাতেও একটা ডাইরেক্ট ট্রেন আছে ভোর ৭:১৪ তে, আমরা তাই ৭টার মধ্যে স্টেশন পৌঁছে টিকেট কেটে রাখলাম। অফিসের দিন না হওয়ায় ট্রেনটা ভীষণ ফাঁকা আজ, লেডিস কামরায় আমি আর সমু ছাড়া হাতেগোনা ৪-৫ জন। গল্প করতে করতেই কখন গুরুদাস স্টেশনে পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। জায়গাটার নাম না জানায় আমি গুগল ম্যাপে লোকেশনটা মার্ক করে রেখেছিলাম, ট্রেন থেকে নেমে আমরা একটা ওলা ট্যাক্সিতে চড়লাম ওই নির্দিষ্ট জায়গাটায় পৌঁছাতে। ট্যাক্সি থেকে নেমে রাস্তার ধারের একটা চায়ের দোকানে জায়গাটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। চা-ওয়ালা অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, “ওখানে কেন যাবেন আপনারা? একদমই সুরক্ষিত নয় মেয়েদের জন্য!” আমার আর সমু দুজনের মুখেই তাইকোন্ডো জানা কনফিডেন্ট হাসি ফুটে উঠল। আমরা বললাম, “না না,আপনি শুধু রাস্তাটা বলে দিন কিভাবে যাব? আমরা বেশিক্ষণ থাকব না। শুধু একটা প্রজেক্ট এর জন্য কয়েকটা ছবি তুলেই চলে যাব।” এটা  শুনেও লোকটার মুখের ভঙ্গিতে বিশেষ কোনো পরিবর্তন হলহল না। তবুও নিমরাজি হয়ে উনি আমাদের পথনির্দেশ দিয়ে দিলেন। আমরা ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলাম।

বেশ কিছুটা হাঁটার পর একটা পাঁচিল ঘেরা পরিত্যক্ত বাড়ি চোখে পড়ল। সামনে একটা বড় লোহার গেট, বছরের পর বছর ধরে জং এর প্রলেপ পড়ে যার আসল রং উদ্ধার করা আর সম্ভব নয় বলেই মনে হলহল। সমু অলরেডি মোবাইলে ছবি তোলা শুরু করে দিয়েছে। আমাদের চকখালীতেও এরকম একটা পরিত্যক্ত কারখানা আছে যেখানে আমরা অনেকবার গেছি, সেখানেও এরকম জং ধরা গেট, মেশিনপত্র দেখেছি,কিন্তু এই বাড়িটার অবস্থাটা একটু অন্যরকম। দুজনেই উপলব্ধি করলাম। বাড়িটা ঘিরে আগাছার জঙ্গল, বুঝতে পারলাম অনেক বছর এখানে কেউ আসেনি। দুটো বড় গাছ দেখতে পেলাম যেগুলো আমি ট্রেন থেকে রোজই দেখি। হেঁটে হেঁটে আমরা বাড়িটার মূল প্রবেশদ্বারে পৌছালাম। বাড়িটাকে ঠিক কারুর বসতবাড়ি বলে মনে হলহল না, কারণ কে এরকম একগাদা ছোট ছোট ঘর বানিয়ে ভরিয়ে রাখে নিজের বাড়িকে? নিচের তলায় প্রথম ঘরটাতে ঢুকে মনে হল এটা কোনো অফিস ছিল বোধ হয়, কারণ একটা ভাঙা টেবিল আর কয়েকটা ভাঙা চেয়ার দেখতে পেলাম। কাঠগুলো খুব জীর্ণ আর পোড়া পোড়া বলে মনে হল। বাকি সবকটা ঘর একইরকম পায়রার খোপের মত। কী একতলা কী দোতলা! আমরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গেলাম। সব দেয়াল, সব অবশিষ্ট আসবাবপত্র, তা সে যতই যৎসামান্য হোক না কেন, পুরু ধুলোর আস্তরণ, মাকড়শার জালে বন্দি, আর কেমন পোড়া পোড়া। আমার যাওয়ার মূল কারণ সেই ৩নম্বর ঘরটাতে গেলাম। বাকি ঘরগুলোর তুলনায় ওই ঘরটা একটু বেশিই ঠান্ডা মনে হলহল। জানুয়ারির সকাল, আমরা দুজনেই ভালো রকম শীতপোশাক পড়েছিলাম তবুও একটা ভীষণ রকম ঠান্ডা বাতাসের ঝলক আমাদের দুজনকেই এক মুহূর্তের জন্য শিহরিত করে গেল মনে হল। যেন আমরা ঢোকায় কেউ একজন দুম করে ঘর ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল,শুধু তাকে আমরা চোখে দেখতে পেলাম না, অনুভব করলাম। আমরা দুজনেই ভূতে বিশ্বাস করিনা, তবুও এক মুহূর্তের জন্য আমাদের চেহারাটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল। সাময়িক ভয় কাটিয়ে সমু বীর গলায় বলল, “ভয় পেলি নাকি?” আমি চোখের ভাষায় অস্বীকার করলাম। এই ঘরটা যেন একটু বেশি পোড়া বলে মনে হল। কিন্তু পোড়া দেয়ালেও অনেক আঁচড়ের মত দাগ দেখতে পেলাম। একটা লোহার খাটও ছিল ঘরটায়, পোড়া কাগজের টুকরো, পোড়া তুলোর টুকরো আর একটা পোড়া পেন্সিল এর টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখলাম। যেই পেন্সিলটা হাতে তুলতে গেল সমু তক্ষুনি হঠাৎ একটা কাক বেশ জোরে পাখা ঝাপ্টে জানলার পাশ দিয়ে উড়ে গেল। এতটাই হঠাৎ হল ঘটনাটা যে সমু আর আমি দুজনেই চমকে উঠলাম। পিছন থেকে কেউ ঠিক তক্ষুনি জিজ্ঞেস করল “কি করছ তোমরা এখানে?” দুটো ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা দুজনেই এতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম যে পিছনে ফিরে দেখার সাহস হচ্ছিল না। তবুও চোখ বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ালাম, অনুমান করেছিলাম যে চোখ খুলে ভয়ংকর কিছু দেখব, কিন্তু চোখ খুলে সামান্য আশাহত হলাম, দেখলাম একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, সাদা পাজামা আর মোটা একটা পশমের চাদর মুড়ি দিয়ে,হাতে একটা লাঠি। “তোমরা এখানে এসেছ কেন? এখানে ঢোকার সাহস তোমাদের হল কী করে? এক্ষুনি চলে যাও তোমরা। আর কিছু জিনিসে হাত দেবে না। এক্ষুনি বেরিয়ে যাও।” বেশ বিরক্ত এবং রাগি গলায় বললেন তিনি।

আমার মাথায় আসছিল না যে কি বলব? সমুই সাহস করে বলল, “এটা কি আপনার বাড়ি? আমরা অনধিকার প্রবেশ করে কোনো নিয়ম ভাঙতে চাইনি, বিশ্বাস করুন। কিন্তু রোজ ট্রেন থেকে এই বাড়িটা চোখে পরে, ইনস্টাগ্রামে ছবি আপলোড করব বলে শুধু কয়েকটা ছবি তুলতে এসেছি। আপনার অনুমতি নিতে হবে জানলে নিশ্চয়ই আপনাকে জিজ্ঞেস করতাম। আমাদের ক্ষমা করে দিন প্লিজ কাকু। আমরা ভেবেছিলাম যে এই বাড়িতে কেউ থাকে না। তাই ঢুকে পড়েছি। সরি।”

সমুর সরিতে চিঁড়ে ভিজল বলে মনে হল না। আমরা ওঁর আদেশ মত নিচে নেমে এলাম। মনে হল এই বাড়ি সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন উনি। আমরা বেরোবার পথে ছোট ছোট প্রশ্ন করতে লাগলাম যেমন ওঁর নাম কি? উনি কোথায় থাকেন? এই বাড়িটা কার? বাড়ির মেইন গেট দিয়ে বেরিয়ে উনি আমাদের পাশের মাঠে নিয়ে গেলেন ওঁর বাড়িতে। ট্রেন থেকে যে বড় মাঠটা দেখি সেটা আসলে একটা পুরনো কবরস্থান। আর ওই উঁচু ঢিবিগুলো আসলে যে কী তা বুঝতে আমার খুব একটা অসুবিধা হল না। আমি আর সমু এর আগে বেশ কয়েকবার পার্কস্ট্রিট এর বিখ্যাত সেমেটারিতে গেছি,ভয় লাগেনি, কিন্তু আজ এখানে এসে কেমন একটা বুক দুরুদুরু করতে লাগল। আসলে অস্বস্তি আমরা সব সময় ভাষায় প্রকাশ করতে পারিনা, কারণও অনুধাবন করতে পারি না, শুধু আমাদের হৃদয় সেটা অনুভব করতে পারে। বৃদ্ধ আমাদের চা বিস্কুট খাওয়াতে খাওয়াতে অনেক গল্প করতে লাগলেন। উনি এখানে একাই থাকেন। প্রথমে আমাদের অনধিকার প্রবেশ দেখে একটু রেগে গেলেও আমাদের যে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই তা জানতে পেরে একটু নরম হলেন। মনে হল যে উনি গল্প করার বেশি সুযোগ পান না, তাই আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরে ওঁর ভালোই লাগছিল। আর ওঁর কাছ থেকেই আমরা জানলাম যে এই বাড়িতে আসলে একটা অনাথ আশ্রম ছিল। ব্রিটিশ আমলে তৈরী হওয়া “টিউলিপ অরফানেজ” মূলতঃ  অনাথ মেয়েদের দেখাশোনা করা হত এই আশ্রমে। তাদের লেখাপড়া শেখানো, সেলাই গান নাচ সবকিছুই সেখানে শেখানো হত। বিদেশ থেকে অনেক অনুদানও আসত। একটা সময় শিশু কিশোরী মেয়েদের কলতানে ভরে থাকত এই বাড়িটা। দুটো গাড়ি ছিল, মাঝে মাঝে তাদের এক্সকারশন এও নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু কালের নিয়মে বিষ জল এখানেও ঢুকে পড়েছিল। মূলতঃ সিস্টাররা দেখাশোনা করতেন মেয়েদের, পুরুষদের কোনো প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু যে বিদেশী বোর্ড এর মূল তত্ত্বাবধানে এই আশ্রম চলছিল, তার নতুন বোর্ড নতুন কিছু নিয়ম কানুন আনেন, এত বছরের পুরোনো নিয়মের রদবদল করে একজন পুরুষ রক্ষী নিয়োগ করা হয়। সিস্টাররা অনেক বাধা দিলেও তাদের আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। শম্ভুনাথ রায় নামের একজন রক্ষীকে বোর্ড নিয়োগ করে মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য। মুখে অমায়িক শম্ভু আসলে ভালো লোক মোটেই ছিল না। তখন মূল শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এই আশ্রমের খবর খুব বেশি লোক জানতো না। তার ওপর মেয়েগুলো ছিল অনাথ,তিনকূলে তাদের কেউ নেই। কুৎসিত মতলবের অধিকারী শম্ভু এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে এখানে চাকরি নেয়। মেয়েরা অনাথ হলেও এখানে খুব যত্নে ছিল, কিন্তু রক্ষকই যখন ভক্ষক হয়ে ওঠে তখন মেয়েদের জীবনে চরম অভিশাপ নেমে আসে। অকৃতদার শম্ভুর খারাপ দৃষ্টি গিয়ে পরে ফুলের মত নিষ্পাপ কিশোরীদের ওপর। বাড়িতে অবাধ প্রবেশাধিকার থাকায় শম্ভু মেয়েদের ওপর নির্যাতন শুরু করে, ১৫-১৬ বছর বয়েসী মেয়েগুলি তার পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে থাকে দিনের পর দিন। ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে মেয়েদের মুখ বন্ধ করে রাখে শম্ভু। ওপর মহলে ভালো যোগাযোগ থাকায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস জুটিয়ে উঠতে পারেনি অসহায় মেয়েগুলি, কারণ অনাথ এই মেয়েগুলোর কাছে এই আশ্রমই ছিল তাদের একমাত্র আশ্রয়। সিস্টাররা বেশিরভাগই ছিলেন প্রৌঢ়া বা বৃদ্ধা, তাই লজ্জায় ও ভয়ে মেয়েরা কিছু জানাতে সাহস পায়নি। খুব ছোটবেলায় তারা এই আশ্রমে এসে উঠেছিল, তাই বাইরের জগৎ সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণা ছিল না, অসৎ শম্ভু তারই সুযোগ নিতে থাকে।

দিনের পর দিন নারকীয় অত্যাচারের শিকার হতে হতে একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে মেয়েদের, তারা তুলনায় কমবয়েসী সিস্টার রোসিকে সব জানায়। রোসি বুঝতে পারেন মেয়েদের যন্ত্রনা, কিন্তু বোর্ডের নিয়মের কাছে তিনি ছিলেন অসহায়। বেশি কিছু বললে যদি অনুদান বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এতগুলো মানুষ অনাহারে মরবে এই ভেবে তিনিও কিছু করে উঠতে পারলেন না। এখনকার  মত আইন তখন মেয়েদের জন্য উপলব্ধ ছিল না। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় তারা। সিস্টাররা যখন ছোট বাচ্ছাদের নিয়ে এক্সকারশনে বেরিয়ে যান,তারা জোটবদ্ধ হয়ে ওই ঘরটায় লুকিয়ে থাকে। লুকিয়ে রাখে রান্নাঘর থেকে লুকিয়ে আনা ছুরি, বঁটি ইত্যাদি। আজই শম্ভু রায়কে খুন করে ফেলবে তারা, তারপর পাশের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসবে এই মানুষরূপী দৈত্যটার দেহ,সবাইকে বলবে যে কাজ ছেড়ে চলে গেছে শম্ভু। সিস্টাররা কেউই শম্ভুকে বিশেষ পছন্দ করেন না,তাই তাঁরাও খুব বেশি খোঁজ করবেন না। কিন্তু কিভাবে জানি শম্ভু রায় তাদের এই প্ল্যানটা জেনে ফেলে। মিটার ঘরের সুইচ অফ করে দেয়্সব আলো নিভে যায়। মেয়েরা কেরোসিনের ল্যাম্প, হারিকেন ইত্যাদি জ্বালিয়ে অপেক্ষা করে। সিস্টার রোসিও তাদের সাথে ওই ঘরটায় থেকে যান। শম্ভু রায় দোতলায় প্রবেশ করে, আজ আর পাশবিক অত্যাচার করার মতলবে নয়, অন্য আরও একটি ঘৃণ্য মতলবে। একটি বড় জেরিক্যান ভর্তি কেরোসিন এনে সে ঢেলে দেয় দোতলার সব ঘরে কারণ বড় মেয়েরা সব দোতলায় থাকতো।শম্ভু রায় বুঝতে পারে যে মেয়েরা সবাই ওই ৩ নম্বর ঘরটায় লুকিয়ে আছে আর তাই একটা জ্বলন্ত দেশলাই ঘরের ভিতর ছুড়ে ফেলে দিয়ে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে পালিয়ে যায়। দোতলার ঘরে মেয়েগুলো পাগলের মত চিৎকার করতে থাকে, আগুনের লেলিহান শিখা বাড়িটাকে গিলে ফেলে। সাহায্যের জন্য কাতর আর্জি করতে থাকে তারা কিন্তু সেই আর্জিতে সাড়া দেয়ার জন্য কেউ ছিলেন না। কবরস্থানের তৎকালীন কেয়ারটেকার অনেক পরে আগুনের শিখা দেখতে পান বাড়িটায়, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যান সাহায্য করতে। সাদ্ধমত চেষ্টা করেন,কিন্তু সব চেষ্টা বিফল হয়। বাকি সিস্টার এবং বাকি মেয়েরা ফিরে এসে দেখে যে সিস্টার রোসিসহ ৬টি তাজা প্রাণ পুড়ে খাক হয়ে গেছে। আপৎকালীন ব্যবস্থা স্বরূপ উত্তর ২৪ পরগনার অন্য একটি আশ্রমে শিশুদের আশ্রয় দেওয়া হয়। সিস্টাররা আর কোনোদিন ফিরে আসেননি এখানে,আসবেনই বা কোথায়? সব যে ধ্বংসস্তূপ। এতগুলো প্রাণ অকালে অকস্মাৎ চলে যাওয়ায় এই বাড়িটা একটা পোড়োবাড়িতে পরিণত হয়, মানুষ এড়িয়ে যেতে থাকেন। কারণ অনেক রাতে এখানে জানলায় মেয়েদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া পিয়ানোটায় টুং টাং সুর বাজতে শোনা যায়। দেয়ালে পেন্সিলের আঁচড় দেখতে পাওয়া যায়। একবার একজন প্রোমোটার এসেছিলেন বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট বাড়ি বানানোর মতলবে, কিন্তু ফেরত আর আসেননি। কারণ একটা কার অ্যাকসিডেন্টে তার মৃত্যু হয়। পাড়ার ডাকাবুকো কিছু ছেলে এই বাড়িতে রাত কাটানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছিল,কিন্তু আধ ঘন্টার বেশি টিকতে পারেনি। “আজ আমি সময়ে না পৌঁছালে তোমাদের দুজনের কী অবস্থা হত তোমরা অনুমানও করতে পারছ না।”

“শম্ভু রায় এর কি হয়েছিল? সে কি শাস্তি পেয়েছিল?” আমার মনের প্রশ্নটাই সমু জিজ্ঞেস করে বৃদ্ধকে। বৃদ্ধ বলেন, “এই ঘটনার এক বছর পর একদিন বাগানের আমগাছের ডালে শম্ভু রায়ের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এত বড় অন্যায় করে আবার সে যে কেন ওই অভিশপ্ত বাড়িতে ফিরেছিল কে জানে? অনুতাপে? না কোনও ভৌতিক যোগাযোগে তা আজও অজানা!”

আমরা কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিল অসহায় মেয়েগুলোর কথা ভেবে। তারপর আমরা ওঁর কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসি। রাস্তায় সমু বলে “গল্পটা খুবই দুঃখের,কিন্তু এই ভূতের যোগাযোগ আমি মানতে পারছি না। তুই তো সায়েন্সের স্টুডেন্ট, তুই পারছিস মানতে?” সত্যি কথা বলতে ঝট করে ভূতের অস্তিত্ব কোনও নাস্তিককে বিশ্বাস করানো খুব কঠিন। বললাম, “সাহস আছে আবার ওই বাড়িতে যাওয়ার?” “কেন নয়? এক্ষুনি চল। আরেকবার যাই। পোড়া পিয়ানোর একটা ছবি তুলেই বেরিয়ে আসব। ইন্সটাতে ছবিটা দেব। #antique ”

আজকে ট্রেনে একজন টেরাকোটার গয়নাওলা উঠেছিলেন,আমি আর সমু তাঁর কাছ থেকে বেশ কয়েকটা সুন্দর ডিজাইনের নেকপিস আর কানের দুল কিনেছিলাম, আমি কিনেছিলাম সঙ্গে একটা টেরাকোটার ঠাকুরমূর্তি। সেটা হাতে নিয়ে ঢুকলাম বাড়িটায়। সমুর সাহস বজায় থাকলেও আমার ভেতর ভেতর হালকা একটা ভয় লাগছিল। বাড়িতে ঢুকেই সোজা দোতলায় উঠলাম। একটা একটা ঘর পেরিয়ে শেষ ঘরটায় গিয়ে দেখলাম একটা বড় পুরনো কিন্তু পোড়া পিয়ানো। পিয়ানোর কী-গুলোতে পুরু ধুলোর আস্তরণ। সমু ছবি তুলছিল। আর বলছিল “দেখলি তো ভূত টুট যত বাজে কথা!” যেইনা বলা অমনি আমাদের চমকে দিয়ে পিয়ানোটা বাজতে শুরু করল। আপনা আপনি কী-গুলো উঠছে নামছে, ওয়েস্টার্ন একটা মিউজিক বাজছে। আমরা স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বোধগম্য হচ্ছিল না যে কী হচ্ছে। হঠাৎ সমু আমার হাত ধরে এক টান দিয়ে দিল ছুট। আমরা বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে আর ছুটতে লাগলাম। মেইন রাস্তায় পৌঁছে দুজনেই যখন হাঁপাচ্ছি তখন মনে পড়ল যে আমার টেরাকোটার ঠাকুরের মূর্তিটা আমার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেছে ওখানে, ওই ঘরটায় যতদূর সম্ভব। কিন্তু আর ফিরে গিয়ে মূর্তি ফেরত নেবার সাহস আমাদের হয়নি। আমরা ট্যাক্সি ধরলাম বাড়ি ফেরার জন্য।

পরদিন অফিসে কাজ করছি। হঠাৎ দেখি সমুর মা ছন্দা কাকিমা ফোন করেছেন। আমি একটু অবাক হলাম। এখন? এই সময়? কি হলহল হঠাৎ? বললাম “হ্যালো!” ওপারে কান্নাভেজা গলা সমুর। জিজ্ঞেস করলাম “কি হয়েছে সমু? কাঁদছিস কেন?” সমু বলল যে তার ফোনটা চার্জে ছিল, হঠাৎ ফোনটা দপ করে জ্বলে উঠে পুড়ে গেছে। “মানে?” আঁতকে  উঠলাম। চার্জ দেবার সময় ফোন পুড়ে যাওয়ার ঘটনা খবরে অনেক শুনেছি, কিন্তু নিজের কারুর প্রথম হয়েছে শুনলাম। বললাম আন্ড্রয়েড ফোন যখন, তখন নিশ্চয়ই ব্যাক আপ নেওয়া আছে সব ফটো আর ডেটার। সেটা শুনেই সমু খুব ধীর গলায় বলল “আছে, আমি বাবার পুরনো ফোনে চেক করেছি। শুধু কালকের কোনও ফটো নেই। মানে ট্রেনে আমাদের তোলা ফটোগুলো আছে, কিন্তু বাড়িটায় তোলা একটা ফোটোও নেই আর।” আর কোনও কথা বলতে পারলাম না, কাজেও খুব বেশি মন বসল না সেদিন।

যাই হোক, যথারীতি সন্ধে ৭:২০ এর ডাইরেক্ট ট্রেনে উঠলাম। আজ আর লাইনের যে ধারে বাড়িটা আছে, সেই সাইডে বসলাম না ভয়ে, জানলার ধরে সিট্ থাকা সত্ত্বেও। উল্টোদিকে বসলাম। বুকের ভেতর কেমন একটা ভয় ভয় করছে। মোবাইলে গান শুনতে শুরু করলাম। চোখ বন্ধ করে রাখলাম,কিছুটা ভয়ে,কিছুটা একটা চাপা অস্বস্তিতে। নির্দিষ্ট জায়গাটায় ট্রেনটা যথারীতি থামল। যথারীতি ট্রেনের আলোগুলোও নিভে গেল। আমি মোবাইলের লাইট জ্বালাবার চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু কিছুতেই আলো জ্বলছে না। চার্জ তো অনেক ছিল, তবে? সমুর মত আমার ফোনটাও খারাপ হয়ে গেল না তো? কিন্তু আমি তো কোনও ছবি তুলিনি। হঠাৎ মোবাইলের আলোটা নিজের থেকে জ্বলে উঠল। দেখলাম আমার পাশের সিটে কেউ নেই। সে কি? এক্ষুনি তো ছিল! উল্টোদিকের সিটটা বরং ফাঁকা ছিল। এখন ওখানে একজন বসে আছেন চাদর মুড়ি দিয়ে। কেমন একটা আঁশটে গন্ধ পাচ্ছি। কই অন্যদিন তো এটা পাই না! উল্টোদিকের মানুষটা এগিয়ে আসছেন আমার দিকে,কিন্তু কেন? আমি কি চিনি ওঁকে? উনি কি কিছু বলবেন আমাকে? চাদর সরাচ্ছেন কেন উনি? চোখগুলো এরকম ভাবে জ্বলছে কেন ওঁর? গালগুলো এরকম পোড়া কেন? উনি হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরতে কেন চাইছেন? আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি সিট্ ছেড়ে উঠে পড়ার কিন্তু আমায় যেন সীটের সঙ্গে কেউ চুম্বকের মত বেঁধে রেখেচে! ওঁর কঙ্কালসার হাতটা দিয়ে উনি আমার গলাটা টিপে ধরলেন। বরফ ঠান্ডা সেই ছোঁয়ায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমি চিৎকার করতে চাইছি, কিন্তু মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। আমি আস্তে আস্তে নিথর হয়ে যাচ্ছি, আমার শরীরের সব রক্ত,সব প্রাণ,সব শক্তি কেউ যেন টেনে নিচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে জ্ঞান হারালাম।

আমার জ্ঞান ফিরেছিল ৩ দিন পর। আই সি ইউ তে কাটাবার পর। ট্রেনের হকার দাদা এবং বাকিরা আমায় অজ্ঞান অবস্থায় ট্রেনের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। ওঁরাই রেল পুলিশের সাহায্যে হসপিটালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন। আমার হিমোগ্লোবিন ৫এ নেমে গিয়েছিল। যাই হোক, এই ঘটনার পর বাবা ব্যাংকের হেড অফিসে যোগাযোগ করেন কাছাকাছি পোস্টিং দেওয়ার জন্য। সবার ধারণা রোজ এতটা জার্নি করে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষও আমার শারীরিক অবস্থার বিবরণ জেনে সহানুভূতির কারণে কাছাকাছি একটা ব্রাঞ্চে ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে পাঠায়। আজ আমার জয়েনিং। এই সবকিছু একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে আমি ভোলার চেষ্টা করেছি এই কদিন। না,আর ভূতের সিনেমা দেখবনা। ওসব কথা আর ভাববও না। মা ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছেন। আমি অটো করে নতুন ব্রাঞ্চের উদ্দেশ্যে রওঁ দিলাম। স্টপে পৌঁছে ভাড়া দেওয়ার জন্য ব্যাগের খুচরোর পকেটে হাত ঢুকিয়েছি,কিছু একটা শক্ত জিনিসে হাতটা আটকাল। পয়সার সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটিও বের করে আনলাম, আর দিনের আলোতেও সেদিনের রাতের অন্ধকার আমার চোখের সামনে স্পষ্ট নেমে এল। আমার হাতে ধরা বস্তুটি আর কিছুই নয়,আমার হাত থেকে পোড়োবাড়িতে পড়ে যাওয়া সেই টেরাকোটার ঠাকুরের মূর্তি, শুধু সেটি ভয়ঙ্করভাবে পুড়ে কালো হয়ে গেছে।

লেখিকা পরিচিতি: নমস্কার। আমি দেবশ্রী ঘোষ। পেশায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আধিকারিক। বাস্তব জীবনের কিছু টুকরো ঘটনার সাথে কল্পনার রং মিশিয়ে আমি এই ভূতের গল্পটি লিখেছি। আশা করি সবার ভালো লাগবে।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post কুসুমকুমারী| পলক ফেলা নিষেধ |রাজর্ষি বর্ধন| Bengali Thriller Story
Next post রহস্যময় আংটি | পলক ফেলা নিষেধ |মুতাসিম বিল্লাহ| Bengali Thriller Story