আমার বাবা অঙ্কে খুব ভালো ছিল ।প্রতিবছরই
স্কুলে অঙ্কে ফুল নম্বর পেত । সবাই
স্কুলে এখনো গেলে ধ্বনি ধ্বনি করে বাবাকে নিয়ে ।
আমি তার ছেলে হয়ে প্রত্যেক বছর অংকে খারাপ নম্বর আনতাম । আমার বাবাতো মাঝে মাঝে আমাকে বকাঝকা করে বলে তোকে দেখলে মনেই হয় না তুই আমার ছেলে ।
এখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি । আজ আমার ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট । প্রত্যেক বছরের মতো এই বছরও ফেল করে বাড়িতে ফিরলাম । বাবা খুব রাগারাগি করল ।
মা বলল পড়াশোনার বালাই কি একদমই উঠিয়ে দিয়েছিস l
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম না এই বছর
পড়াটা একটু ভালো করে হয়নি l পরের বছর নিশ্চয়ই ভালো রেজাল্ট হবে l বাবা রোজ আমাকে নিয়ে পড়াতে
বসতো , আমাকে অঙ্ক দেখিয়ে দিত । একটুখানি
বই থেকে চোখ সরালেই বাবা চিৎকার
করে বলতো সারাদিন গেম না খেলে । একটু পড়াশোনা কর
তাহলে দেখবি ভবিষ্যতে লাভ হবে ।আমরা
চলে গেলে কি করবি ?কে দেখবে তোকে ?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বলতাম থাক না বাবা ।চলে যাওয়ার কথা উঠছে কেন ?
বাবা খুব রাগী তাই বাবার থেকে মাকেই আমি একটু বেশি ভালোবাসি । বাবা সব সময় সকালে উঠেই
কাগজ মুখে নিয়ে বসে । তারপর রোজ একটা চাবুক নিয়ে
আমাকে অংক করায় । এইতো কিছুদিন আগেই
আমি একটু সকালে খেলতে গেছিলাম । বাবা আমায়
চাবুক মারতে মারতে ঘরে নিয়ে এলো ।
সব কিছু আমার ভালো লাগে কেবলমাত্র পড়াশোনা ছাড়া ।
তারমধ্যে আবার অঙ্কতো আমার একদমই পোষায় না ।
অঙ্ক করতে বসলেই মনে হয় কোন পাগল যে অঙ্ক আবিষ্কার করেছিল কে জানে । যদি জানতে পারতাম না
গিয়ে জিজ্ঞাসা করতাম এতকিছু থাকতে হঠাৎ
মরতে অঙ্ক আবিষ্কার করতে গেলেন কেন ?আপনাদের জন্যই
আমাদের মত ছোট শিশুদের এত কষ্ট ।
অঙ্ক করতে গেলেই ঘুম পেয়ে যায় কিংবা মনে হয়
একটু পাশের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলে আসি
বা একটু আড্ডা মেরে আসি ।যেই অঙ্ক খাতা নিয়ে বসি
হাজার হাজার ক্যালকুলেশন , যোগ -বিয়োগ ,বড় বড়
জিওমেট্রির অঙ্ক দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় ।
যে অঙ্ক আমি করি সে অঙ্ক ভুল হওয়া বাধা ।
আমার টিচার আমাকে পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হয়ে গেছে
তাও আমার দ্বারা অঙ্ক জন্মেও হয়নি ।
একদিন মা আমাকে বলে সামনেই বাবার জন্মদিন ।
বাবাকে তুই একটা উপহার দে তাহলে তোর বাবা তোর উপর খুশি হবে ।আমি বাবার ঘরে গিয়ে দেখলাম একটা কাগজ রাখা আছে ।আমি সেই কাগজটাকে ছিড়ে
একটা বক্স বানালাম বাবাকে উপহার দেবো বলে l
যেদিন বাবার জন্মদিন বাবা পাগলের মত কি একটা
খুজছিল ?আমি যখন বাবাকে আমার বানানো উপহারটা দেখালাম বাবা খেপে গিয়ে বললো ,এটা তুই কি করেছিস।
তুই আমার ডকুমেন্ট দিয়ে উপহার বানিয়েছিস ।
আমাকে সেদিন আমার বাবা ব্যাপক পিটিয়েছিল ।
আমি ভাবতাম আমার বাবা আমায় একটুও ভালোবাসে না ।
সবসময় বকে ।
আমাকে স্কুলের ছেলেমেয়েরা সবাই বলে আমার বাবা মা নাকি আমাকে ভালোবাসে না ।আমারও মনে হয়
সত্যিই বলে ।আমার বাবা আমায় একটু সময় দেয় না ।
যেটুকু সময় দেয় পড়াশোনার পেছনে যেটা আমি একদম পছন্দ করি না আর সবসময় শাসন করে ।
সবাই স্কুলে প্রত্যেক বছর নতুন ব্যাগ ,জুতো ,জামা
পড়ে আসতো ।আমি যতবারই নতুন জামা ,ব্যাগ ,জুতো
আবদার করেছি সবসময় বলে পরে দেবো আর পরে দেবো ।
মাও বাবার তালে তাল মিলিয়ে বলে বাবাকে এত জ্বালাস নাতো । সবার বাবা মা স্কুলে ছেলে মেয়েদের নিতে আসে
গাড়ি করে কেবল আমাকেই একা একা বাড়ি ফিরতে হয় ।
আমি অনেকবার বাবা -মাকে বলেছি আমাকে স্কুল
থেকে নিয়ে যেতে কিন্তু মা বলে বাবা আমাদের জন্য
অফিসে গিয়ে খেটে মরছে l আর কতদিক সামলাব বাবা lআমিতো রান্নাবান্নার কাজেই ব্যস্ত থাকি । এত বাইনা করিস না । স্কুলের সবার গাড়ি ,ভিডিও গেম আছে l আমার কিছুই নেই l আমি এসব কিছু চাইলেই বাবা বলে
এসব বড়লোকি চাল আমার বাড়িতে করতে আসিস না l
শুধু রাত্রিবেলা টাই বাবা আমায় আদর করে ,গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় l
তার কিছুদিন পর আমি একটু বন্ধুদের সঙ্গে
স্কুল শেষ হওয়ার পর শপিং মলে ঘুরতে গেছিলাম l
ববাড়িতে ফিরে দেখি বাবা-মা খুব চিন্তিত l
বাবাকে যখন বলি আমি শপিং মলে গেছিলাম l
বাবা বলে তোর এত সাহস !আমাদের না বলে একা একা
ঘুরতে চলে গেছিস l মা বলল বড্ড পা বেড়েছে l
একটু মারো না , শুধরে যাবে l
বাবা সেদিন আমায় খুব মারলো l আমি না চাইতেও
বাবাকে বলে ফেলি তুমি তো আমায় একটুও ভালোবাসো না l
কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওনা l কিছু কিনে দাও না তাই
আমি , তোমাদের না জানিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গেছিলাম l
বেশ করেছি আমি l তোমাদের বললে তোমরা তো যেতেই দিতে না । বাবার ওই কথাটা শুনে হৃদয় খুব আঘাত লাগে ।
বাবা মাকে বলে হ্যাঁ সত্যিই তো আমিতো ওকে কিছুই কিনে দিতে পারি না ।শুধু মারি আর বকি । তখন মা বলে
আমি তো জানি তুমি কতটা ওকে ভালোবাসো
কিন্তু প্রকাশ করো না । তারপরে আমার বাবা আমাকে
ঘুম পাড়িয়ে ,দিতে চাইলেও আমি হাত সরিয়ে দিই ।
আমি ভেবে নিয়েছিলাম , যারা আমাকে ভালোবাসে না তাদের সঙ্গে আমি আর কথা বলবোনা । কিছুদিন পর
আমার বাবার হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেল । বাবার
মৃতদেহটা দেখে আমার খুব কষ্ট হল । আমার মনে হল
হয়তো আমার জন্যই আমার বাবার মৃত্যু হলো ।
আমি বাবাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি সেটা হয়তো বাবা
মেনে নিতে পারেনি । তারপর থেকেই
মাঝে মাঝে আমি আমার স্বপ্নে বাবাকে দেখতাম ।
আমার বাবার স্বপ্নে বলতো সোনা তুই কিছু চিন্তা করিস না ।
আমি তোর সঙ্গে সব সময় আছি । তোকে কিন্তু
এইবারে অঙ্ক পরীক্ষা ভালো করতেই হবে । তুই
উঠ ,জাগ ।কিছুদিন পরেই তো তোর পরীক্ষা ।দেখিস
এবার অন্তত ফাস্ক্লাস পেতেই হবে তোকে ।কোন অঙ্কে
অসুবিধা হলে তুই আমাকে সবসময় পাশে পাবি ।
এরাম ভাবেই স্বপ্নে রোজ আমার বাবা আমার
মনে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট পাওয়ার জন্য জোর
দিয়ে যেত ।আমি তৎক্ষণাৎ উঠে অঙ্ক করা শুরু করে দিতাম l
সত্যিই আমার যেন মনে হতো কোন অঙ্কে অসুবিধে হলে
আমার ,বাবা আমায় সেই অঙ্কটা দেখিয়ে দিচ্ছি l
আমাকে মেরে বলছে তোর দ্বারা আর হলো না l
এরাম করে পড়লেতো এই বছরটাতেও ফেল বাধা ।
আমি এইসব শুনে ,মনে আরো জোর পেতাম ।
আমি ভেবেই নিয়েছিলামআমি ভেবেই নিয়েছিলাম
আমি কোনদিন বাবাকে খুশি করতে পারিনি
কিন্তু আমি বাবার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করবোই ।
আমি ভালো করে অঙ্ক শিখে ফার্স্ট ক্লাস
নম্বরটা এই বছর আনবোই আনব । আমার মা তো
মাঝে মাঝে আমাকে দেখলে অবাকই হয়ে যায় ।
এইটা ভাবলেই আমার মায়ের খুব অবাক লাগে,
যে ছেলে পড়াশোনা থেকে এক হাতে দূরে থাকতো ।
বিশেষ করে অঙ্ক থেকে সেই ছেলে আজ
সারা দিন রাত অঙ্ক করেই যাচ্ছে । খাওয়া-ঘুম কিচ্ছু নেই ।
ওর জীবনে শুধু এখন অঙ্ক আর অঙ্ক ।আমার মা তো ভেবে নিয়েছে আমার মাথায় বোধায় অঙ্ক ভূত চেপেছে ।
একদিন মা খাবার দিতে এসে দেখে আমি কোন এক
অদৃশ্য ছায়ার সঙ্গে বকবক করছি ?
মা আমায় ধাক্কা দিয়ে বলল কিরে পাগল হলি নাকি । কার সঙ্গে
বকবক করছিস ?আমি চিৎকার করে বললাম
কোথায় গেলো বাবা ?এই যে দেখলাম বাবাকে
আমার মা বলে তুই বাবাকে দেখলি ।আমি বললাম
আমি রোজ বাবাকে দেখি । বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় , আমাকে আদর করে ,নতুন নতুন অঙ্ক শেখায় । আমার মা বলে তুই নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছিস ।
আমি বললাম স্বপ্ন না , সত্যি । আমার এখন অনুতাপ হয়
যে কেন ,ষসেদিন বাবাকে নিজের অজান্তেই অত বাজে করে
অপমান করলাম , মনে আঘাত দিলাম ।যদি সেদিন
অপমান না করতাম ,মনে আঘাত না দিতাম
তাহলে হয়তো বাবা আজ থাকতো ।ওই কোথায়
বলেনা কিছু একটা না হারালে তার মর্ম বোঝা যায় না ।
আমি শুধু আমার বাবার রাগটাই দেখেছিলাম
কিন্তু সে যে আমাকে কত ভালোবাসতো
সেটা দেখিনি । ভালোবাসা হয়তো দেখানো যায় না ।
নিজেকেই বুঝে নিতে হয় । স্কুলের ছেলে মেয়েরা
সবাই বলা বলি করে যে আমি নাকি কিরাম
পাগলের মত ব্যবহার করি ? সব সময় বাবা বাবা করে
ডাকি কোন এক অদৃশ্য ছায়াকে ।
কোন ছেলে মেয়েরা যদি বলে আমার বাবা-মা আমাকে ভালোবাসে না আমি তখন প্রতিবাদ করি ।
কেউ আমার কথা বিশ্বাস করত না এমনকি আমার মাও
না যে আমি আমার বাবাকে রোজ দেখতে পাই ।
কোন টিচার যদি আমায় বকাবকি করে ,মারধর করে
পড়াশোনা না পারলে বাবা রেগে যায় ।
তারপর বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ,আমাকে আদর করে ।কোন অঙ্ক যখনই টিচার বোঝায় আমার বাবা
আমায় জিজ্ঞাসা করে কিরে অঙ্কটা ভালো করে বুঝলি তো ?
আবার বাড়ি গিয়ে যে অঙ্কগুলো ক্লাসে করায় সব বাবা আমায় করিয়ে আমায় করিয়ে দেয় ।যেহেতু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করলো না তাই আমি বললাম ঠিক আছে তাহলে
প্লানচেট করেই প্রমাণ করিয়ে দিই আমার বাবার আত্মা আছে কি নেই । আমার ক্লাসের বেশ কিছু ছেলে
খুব গর্ভের সাথে বলে তারা নাকি ভূতকে ভয় পায় না , ভূত নাকি তাদের ভয় পায় ।
তারা নাকি প্ল্যানচেট করে অনেক মৃত মানুষের
আক্তা দেখেছে । এমনকি একটা ভূত বাংলোতে গিয়ে
স্বচক্ষে ভুত দেখেছে । এদিকে প্ল্যানচেটের কথা শুনে
তারা খুব সাহসের সাথে হ্যাঁ বললেও মনে মনে ভয় পেয়ে যায় ।
আমি আমার বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম বাবা
তুমি কিন্তু প্রমাণ করে দিও যে তুমি আছো যাতে আমার বন্ধুরা আর আমাকে পাগল বলতে না পারে । বাবা হাসতে হাসতে বলল ঠিক আছে সোনা ।আমি তোমার বন্ধুদের প্রমাণ করে দেবো আমি আছি ।
কেউই ভয়ে প্ল্যানচেটে আমার বাবার আত্মার মিডিয়াম
হতে চাইছে না । অবশেষে আমার মাই , মিডিয়াম হতে রাজি হয়ে যায় । আমরা পরের বৃহস্পতিবার প্ল্যানচেটের প্ল্যান করি ।
সবাই প্ল্যানচেটে বসার আগে খুব ভয়ে পেয়েছিল , ভাবছিল
কি না কি হয়ে যায় আবার । যখন মোমবাতি জ্বালিয়ে প্লানচেট করতে বসলাম । কিছুক্ষণ পর মনে হল মায়ের শরীরের মধ্যে দিয়ে দিয়ে আমার বাবার আত্মা কথা বলছে ।
আমার বাবা বলছে আমাকে এত জনের মাঝে জাগালী কেন ?
তারপর আমার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলছে
তোতোরাই তো বিশ্বাস করছিলি না যে আমি আছি
তাহলে দেখ । এইতো আমি এখনো বেঁচে আছি কিন্তু
আমার ছেলেকে পাগল বলবার জন্য ও মিথ্যে ভূত দেখার কথা বলার জন্য তোদেরতো একটা শাস্তি পেতেই হবে ।
আমি মিথ্যা বলা একদম পছন্দ করি না ।তোরা তো
এক কথায় ভূতদের অপমান করেছিস । তোরা বলেছিস
ভূত নাকি তোদেরকে ভয় পায় । আমি বললাম না বাবা
তুমিও দায় কিছু করোনা । ওরা আমার বন্ধু ।
আমার বন্ধুরাও কাঁদতে কাঁদতে বলল কাকু আমাদের ছেড়ে দিন । আমরা আর জন্মেও মিথ্যে কথা বলবো না ।এই নাক
মূলছি , কান মূলছি। আমার বাবা বললো ঠিক আছে
তোদের শাস্তিটা একটু কমিয়ে দিলাম যেহেতু তোরা আমার ছেলের বন্ধু তবে শাস্তি কমিয়ে দিলাম বলে ভাবিস না
ক্ষমা করে দিলাম । তোদের শাস্তি এই হবে যে
তোদের সারাজীবন আমার ছেলের পাশে থাকতে হবে বন্ধুর মত । ওরা হাসতে হাসতে বলল হ্যাঁ তা তো থাকবোই কাকু ।
আজ থেকে ও আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড । আমার বাবা বলল
ঠিক আছে আমি কিন্তু তোদের উপর সব সময় নজর রাখব
তাই একটুখানি এদিক ওদিক হলেই কিন্তু শাস্তি পারবে ।
আমার বন্ধুরা বলল না না কাকু । কোন এদিক-ওদিক হবে না ।
চলে যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেল
সোনা অঙ্কটা ভাল করে করিস । এবার কিন্তু ফাস্ক্লাস পেতেই হবে । আমার শেষ ইচ্ছাটা রাখিস প্লিজ । আমি বললাম হ্যাঁ বাবা নিশ্চয়ই । তার কিছুক্ষণ পরই মা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল ।
মায়ের জ্ঞান ফেরার পর মা জিজ্ঞাসা করল কি
হয়েছিল আমার ?আমরা সবাই বললাম যে আমরা
বাবার আত্মাকে দেখেছি ।মা এটা শুনে খুব খুশি হয়েছিল
যে বাবার আত্মা এখনো বেঁচে আছে ।এই বছর
ক্লাস ইলেভেনের ফাইনাল পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট ক্লাস নম্বর পেয়ে পাশ করলাম ।আমি পরীক্ষা দিয়ে আসার পর
আমার মা খুব খুশি হয়েছিল ।আমার মা খুশি হয়ে
আমাকে সেদিন বিরিয়ানি , মাংস নিজের হাতে বানিয়ে
খাইয়েছিল । আমার সবচেয়ে আনন্দ হচ্ছিল এই ভেবে যে
আমি আমার বাবার শেষ ইচ্ছাটা রাখতে পেরেছি।
আমি যখন খাবার খাচ্ছিলাম আমার মনে হচ্ছিল
আমি ছাড়াও যেন কেউ খাবারটা খাচ্ছে । পরে বুঝলাম
আমার বাবাই আনন্দে অনেকদিন পর মায়ের রান্না খাবার খাচ্ছে । আমার বাবা এতদিন পর মা রান্না খাবার
খেয়ে খুব তৃপ্তি পেয়েছে । সবচেয়ে খুশি হয়েছে এইটা ভেবে যে
আমি আমার বাবার মতই এই বছরের অঙ্ক পরীক্ষায়
ফার্স্ট ডিভিসন মার্কস পেয়ে পাস করেছি । সেদিন রাত্রে
আমার বাবার আত্মা স্বপ্নে এসে আমায় বলেছে
আমি আসছিরে । আমি যে জন্যে এতদিন বেঁচে ছিলাম
তা আজ আমি পেয়ে গেছি তাই আর বাঁচতে চাই না , বেঁচে থেকে বেচে থেকে মানুষদের ভয় বাড়াতে চাইনা ।
যাওয়ার আগে একটা সত্যি কথা বলে যাই । হয়তো আমাদের আমাদের আর কোনদিন দেখা হবে না । তুই আমাদের নিজের ছেলে নস । আমরা তোকে
কুড়িয়ে পেয়েছিলাম । জন্মানোর পর তোকে কেউ রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে গেছিল । তোর মায়ের
প্রেগনেন্সির একটু প্রবলেম ছিল
তাই তোর মা কোনদিন মা হতে পারত না কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা করেছিল সে মা হবেই ।
রোজ রাত্রে কোন এক বাচ্চার স্বপ্ন দেখতো । কোন একটা অদৃশ্য ছায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো ,সকালে স্কুলের জন্য তৈরি করে দিত ,খাওয়াতো ,সাজিয়ে দিতে ,ঘুরতে নিয়ে যেত ।
বাচ্চার না পাওয়ার দুঃখে ,তোমার মা প্রায় পাগলি হয়ে গেছিল ।
আমি তাই
তোকে যেদিন কুড়িয়ে পেয়েছিলাম আমি তোকে
আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেছিলাম
নিজেদের ছেলের মতো আগলে
রাখবো বলে ।একটা সত্যি কথা এই যে আমরা কিন্তু তোকে
আমাদের নিজের ছেলের মতই ভালবাসি ।আমিও বললাম
না বাবা ঠিক আছে ।এসব বলতে হবে না ।আমি জানি তোমরা আমায় কত ভালোবাসো ,আগলে রাখো ।যারা আমায় জন্মানোর পর ফেলে চলে গেছে তাদের পাপ হবে ।বাবা বলল কারোর পাপের কথা চিন্তা করিস না ।
তোর বাবা মা নয় একটা ভুল করে ফেলেছে ।মানুষ মাত্রই তো ভুল হয় ।তোর বাবা মাকে ক্ষমা করে দিস ।শেষে একটাই কথা বলব যে ভালো অঙ্ক
প্র্যাকটিস করে যা ।দেখবি
তোর আরো আরো উন্নতি হবে । কোন অংক না পারলে
আকাশের তারার দিকে চেয়ে
অংক গুলো করবি । দেখবি
সব অঙ্কে পারছিস । ভাববি না আমি নেই । আমি তোর সঙ্গে
সব সময় থাকবো । আরো এগিয়ে যাও ।সবাইকে দেখিয়ে দেয়
তোর কি ক্ষমতা ।
কোনদিন আমাকে দেখতে ইচ্ছে হলে আকাশের দিকে তাকাবি ।
আমাকে দেখতে পাবি ।
আমি তোকে ভাল করে অঙ্ক
শেখাতে চেয়েছিলাম এই কারণেই
যাতে আমি মরে যাওয়ার পরও
তুই তোর মাকে দেখতে পারিস
ও তোর মা মরে যাওয়ার পর
তুই একটা চাকরি বাকরি পেতে পারিস ।আমি জানতাম আমি আর বেশিদিন বাঁচতে পারব না ।
আমার হার্টে একটা বড় ফুটো ছিল । কাজের চাপে
শরীর আরও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল ।কাউকে ববলতে পারিনি আমার রোগের কথা । এক কথায় বলতে চাইনি । আমাদের এমনিতেই সংসার চলে না তার ওপর এক গাদা ওষুধ কিনে , অপারেশন করে টাকা নষ্ট করতে চাইনি ।
আমি মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম
জন্মালেতো কোন না কোন দিন মরতেই হবে । আজ নয় কাল ।
তাহলে আর কিছুদিনের জন্য মায়া না বাড়িয়ে এখনই মরে গেলে কি আর হবে ?
মৃত্যুটাতো সব মানুষেরই ভবিতব্য । আমি রোজ রাতে
মৃত্যুর সঙ্গে কথা বলতাম , মৃত্যুর সঙ্গেই নিঃশ্বাস নিতাম । মনে হতো
এই বুঝি নিশ্বাস চলে গেল , আমার মৃত্যু ঘটলো ।
অঙ্ক আমার সবচেয়ে প্রিয় সাবজেক্ট তাই আমি আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলে যেন অঙ্কতে ভালো হয় । আমি চললাম রে সোনা । আমি অনেকবার ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে বললাম প্লিজ যেওনা বাবা । বাবার হাতটা শক্ত করে চিপে ধরে রাখলাম কিন্তু তাও হাত ছাড়িয়ে বাবা চলে গেল ।আমি পরের দিন মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম মা সত্যি কথা বলতো
আমি তোমার নিজের ছেলে নয় ।
তুমি আমাকে কোত্থেকে পেয়েছো ?
মা বলল আজ আবার এইসব কথা কেন ?
আমি বললাম না মা একবার হলেও আমাকে সত্যিটা শুনতে হবে ।
মা বলল ঠিক আছে বলতে পারি কিন্তু কথা দেয় তুই শুনলে ছেড়ে চলে যাবি না । আমি মাকে কথা দিলাম ।
হ্যাঁ তোকে আমরা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম
কিন্তু আমরা তোকে নিজেদের ছেলের মতই ভালবাসি ।
তারপর থেকে আমি আর আমার বাবাকে দেখতে পেতাম না । আমার বাবা আর ঘুমানোর সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত না । আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার বাবার আত্মা হয়তো শান্তি পেয়েছে । আমার বাবা শুধু এটা দেখার জন্যই বেঁচে ছিল যে আমি একবার অন্তত অঙ্ক পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস
পাই । আমিও সবাইকে দেখিয়ে দি আমি অঙ্ক পারি ।
আমার মনে হয় আমার টিউশন স্যার এই যে সব সময় বলতো
আমার দ্বারা অঙ্ক হবে না । সেটা আমার বাবার ভালো লাগতো না । আমি যাতে আমার টিউশনের স্যারের কথা ভুল প্রমাণিত করতে পারি তাই হয়তো মরে যাওয়ার পরেও আমার মনে
জীবিত থেকে গেছিল আমার বাবার কঙ্কাল ।
আমার বন্ধুরাও আমার হাত কখনো ছাড়েনি । সবসময়
আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত ধরে রেখেছিল আমার বন্ধুরা ।মাঝে মাঝে অন্ধকার আকাশে তারা গুনতে গুনতে মনে হয় একটা তারা আমার বাবা
আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে
আর বলছে সোনা অঙ্ক কিন্তু চালিয়ে যেতে হবে । আমার মুখটা রাখিস সোনা ।
মাঝে মাঝে আবার বৃষ্টির মধ্যে
স্বপ্নের ঘোরে খুঁজে পাই আমার বাবাকে । আজও আমার
মনে হয় আমার বাবা এখনো বেঁচে আছে ।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ।চাবুক নিয়ে অঙ্ক করাতে
বসছে ।খালি খালি বলছে
সোনা আমার সম্মানটা রাখিস ।অঙ্ক তোকে পারতেই হবে সোনা ।
আমি এরপর থেকে প্রত্যেক বছর
আমার বাবার মতই ফাস্ট ক্লাস
পেতাম অঙ্কতে ।আমার টিচারও
আমার দ্বারা কিছু হবে না
ওই কথাটা তুলে নিয়েছে ।
আমার স্কুলের টিচার ও বাড়ির টিচার প্রত্যেক বছর
ভালো রেজাল্ট করলেই কিছু-না-কিছু খাওয়াতো ।
এইটা হয়তো বাবার আত্মা , ছায়া, কঙ্কাল আমার মনে না থাকলে হতো না । আজ এই দিনটা দেখতে পাচ্ছি শুধুমাত্র আমার বাবার জন্য । আমি মাঝে মাঝে মুখে পেন দিয়ে ভাবি
বাবা না থাকলে তো এই দিনটা আসবেই না । তাহলে এত সম্মান, উপহার আমার প্রাপ্য নয় । আমি তখনই , আকাশের যে তারা টার মধ্যে দিয়ে বাবাকে দেখতে পেতাম ।সেই তারাটার দিকে আমি সব উপহার ,সার্টিফিকেট ছুঁড়ে দিতাম ।আমার মনে হতো বাবা আমায় অভিনন্দন জানালো ।হাসতে হাসতে বলল এইসব সম্মান তোরই প্রাপ্যরে ।আমিতো শুধু তোকে উৎসাহ দিয়েছি যেটা বাবা হিসেবে প্রত্যেক বাবার কর্তব্য ।
আজি এই দিনটা আসতো না
যদি তুই ভালো করে পড়াশোনা না করতিস ।আবার তারপর
বাবা আকাশ থেকে সার্টিফিকেট উপহারগুলো ,ছুঁড়ে আমার দিকে
ফেলে দিচ্ছে ।আমার মনে হত
বাবা এই যে সব সময় আমার পাশে আছে ,আমার উন্নতি দেখছে সেই জন্যেই আমি
হয়তো অঙ্ক করার জোর পাচ্ছি
নচেৎ পেতাম না । এখনো অব্দি
কোন অঙ্কে অসুবিধা হলে বাবা আমায় দেখে যায় । আমায় একটু চাবুক মেরে বলে সোনা ভালো করে পড় । তর মধ্যে প্রতিভা আছে । তুই পারবি । প্র্যাকটিস ছাড়িস না । সবসময় ভাবছি আমি তোর পাশে আছি , তোদের সবাইকে দেখতে পাচ্ছি ।
তোদের আনন্দে আমার আনন্দ ,
তোদের দুঃখে আমার দুঃখ ।
সবসময় ভাববি তোর অঙ্কে
উন্নতি হলে আমি সবচেয়ে খুশি হব ।ভালো এগোছিস সোনা ।
প্রাক্টিস কিন্তু চালিয়ে যাবি
নাহলে কিন্তু আবার আগের জায়গায় পৌঁছে যাবি ।
এই ভাবেই আমার সবচেয়ে অপছন্দের সাবজেক্ট আমার সবচেয়ে প্রিয় সাবজেক্টে পরিবর্তন হয় ।
আমার বন্ধুরাও আজ আমাকে দেখলে অবাক হয় ।তারা
এইটাই ভাবে যে ছেলে অঙ্ক করতে ভালোইবাসতো না সেই ছেলে এখন নিজের মনে বক বক
করতে করতে সারা দিন অঙ্ক করছে ।
আমাকে দেখে আমার
বন্ধুদেরও অঙ্ক কোরার নেশা
অনেকটা বেড়ে গেছিলো ।
আমাকে এখন স্কুলে টিচার যে
অঙ্ক দিক , আমি সেই অঙ্ক
পারবোই পারবো । আমি এখন চান ,নাওয়া , খাওয়া
ভুলে সব সময় পাগলের মতো অঙ্ক
করি ।অঙ্কই আমার ধ্যান-জ্ঞান ,জীবন ।রাতে ঘুম আসতে চায় না ।ঘুমাতে গিয়ে মাঝখানে উঠে পড়ে
খাতা পেন নিয়ে অঙ্ক করতে বসে
যাই । অনেকেতো ভাবে আমার মাথায় অঙ্কের
ভূত চেপেছে ।
এইভাবেই হয়তো মানুষরা জীবনের শিক্ষা পায় ।ভালোবাসা কি জিনিস সেটা বোঝো ।ভালোবাসা কি জিনিস সেটা বাইরে থেকে বিচার করলে হয়না ।সেটাকে অন্তর দিয়েই বিচার করতে
হয় ।