অতৃপ্ত আত্মা | পলক ফেলা নিষেধ |সোমালি সরকার| Bengali Thriller Story
0 (0)

কদিন ধরেই রায় বাড়িতে না না রকম উৎপাত শুরু হয়েছে…রাতের বেলা এই বাড়ির ছেলে মৃন্ময় শুতে গেলে বারবার মশারির দড়ি খুলে যায়… বিভিন্ন আওয়াজ.. মাঝে মাঝে খাবারের গন্ধ সবই যেন বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়ায়…. মৃন্ময়ের মায়ের শরীরটা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে… ডাক্তার দেখেও রোগ ধরতেইপারে না…. আনন্দ আর হাসি খুশি পরিবারে কেমন যেন নিস্তব্ধতা ছেয়ে যাচ্ছে ক্রমশ….

বাড়িটা কেমন যেন অদ্ভুত হয়ে উঠছিল মিনতির মৃত্যুর পর…

রায় বাড়িতে সেই ছোট্ট বেলায় কাজ করতে এসেছিল… এখানেই মৃন্ময়ের সাথে আর মৃন্ময়ের দুই বোন শ্রেয়া আর শ্রেষ্ঠার সাথে বেড়ে ওঠা… মিনতি শ্রেয়ার বয়সী… তাই ওদের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব ছিল… কাজের ফাঁকে কত্তা মশাই বিভূতি রায়, মিনতিকে পড়াশুনা শিখিয়েছে… এবাড়ির মেয়ের মতই বড় হয়েছে মিনতি….

কিন্তু এসবের মধ্যে কী থেকে কি যে হয়ে গেল….

সেদিন ছিল রবিবার… মৃন্ময়ের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়েছিল সবাই… মৃন্ময় অফিসের কাজে গিয়েছিল মুম্বাই… একটা সফটওয়ার কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার সে… যাই হোক বাড়িতে একাই ছিল মিনতি…

রায় পরিবারের অন্য সদস্যদের বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়… বাড়ি ফিরে ওরা দেখে গোটা বাড়ি অন্ধকার…

অনেক ডাকাডাকির পরও মিনতির কোনও সারা নেই…

বেশ চিন্তিত রায় বাবু অবশেষে পাড়ার লোক ডেকে তালা ভাঙে

দরজার… ভিতরে ঢুকে দেখে… মিনতি তার ঘরে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে…. আত্মহত্যার কারণ কিছুই লিখে যায়নি মেয়েটা…

রায় বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য মিনতির এভাবে চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না…. সবাই ভেঙে পড়েছিল…

আর তারপর থানা পুলিশ অনেক হাঙ্গামা হয়েছে ওদের ওপর দিয়ে….. সব কাটিয়ে মাত্র মাস দুই… আর এরই মধ্যে এত সব কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে…..

শ্রেয়া আর শ্রেষ্ঠাও বেশ ভয় পাচ্ছে রাতে… ওদের শুধুই মনে হয় মিনতি যেন ওদের চারপাশে ঘোরাফেরা করছে…..

মিনতি মরে যাওয়ার পর ওর ঘর বন্ধ করে রেখেছে ওরা….

কারণ ঘরটা খুললেই ওদের ভীষণ মন খারাপ হয়…..

সেদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা শ্রেষ্ঠার জীবন বদলে দিল যেন…

রাতের খাবারের টেবিলে একটু দেরি করেই গেল শ্রেষ্ঠা… কলেজের কিছু কাজ করছিল ঘরে বসে…. হঠাৎ কারেন্ট চলে যেতেই বুকের ভিতরটা ছাঁৎ করে উঠল… কোনওরকমে হাতড়িয়ে মোমবাতি জ্বালাতেই দেখল পর্দার নিচে দুজোড়া পা… শ্রেষ্ঠা যেন চিৎকার করেও গলা দিয়ে স্বর বার করতে পারলোনা… খাটের থেকে উঠে এগিয়ে গেল ওই দিকে….

পর্দা সরাতেই দেখল কেউ নেই.. মনের ভুল ভেবে ফিরে আসতেই ওর মনে হল একটা অবয়ব করিডোর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে… শ্রেষ্ঠা কিছু না বলেই পিছু নিল অবয়বের… হাতে মোমের আলো…. মিনতির ঘরের সামনে আসতেই অবয়বটা পিছন ফিরে তাকাল… মোমের আলোতে মুখটা দেখতেই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল ওই দিকে… গা দিয়ে ঘাম ঝরছে… পা অচল…. মিনতির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং মিনতি…. তার ফ্যাকাসে মুখে… গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল… একটা অদ্ভুত যন্ত্রনা ওর চোখে মুখে……. কিছু যেন বলতে চায় ও…..

কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল শ্রেষ্ঠা ওর জানা নেই….

তবে সম্বিৎ যখন ফিরল তখন ও বিছানায়… ওর চারপাশে মা বাবা দিদি আর দাদা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে……….

“কি হয়েছিল তোর? “মৃন্ময় গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল শ্রেষ্ঠা কে

জলের গ্লাসের দিকে ইশারা করে শ্রেষ্ঠা বলল “জল !”

শ্রেয়া জল এগিয়ে দিল শ্রেষ্ঠার দিকে…. এক নিঃশ্বাসে জলটা খেয়ে শ্রেষ্ঠা দাদার দিকে চেয়ে বলল “মিনতি ওর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল… ওর চোখে জল… খুব কষ্ট হচ্ছিল ওর… ” কথাটা বলতে বলতে শ্রেষ্ঠারও যেন বুক ফেটে যাচ্ছিল.. ভয় আর যন্ত্রনা চোখের কোল ঘেঁষে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল….

কথাটা শুনে মৃন্ময় বলল “হোয়াট রাবিশ ! কি সব বলছিস ভুল ভাল… এই যুগে ভূত… তাও আবার মিনতি? অন্ধকারে ভুল দেখেছিস…. “

“তু্ই বিশ্বাস কর দাদাভাই… আমি সত্যি ওকে দেখেছি… “ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল শ্রেষ্ঠা….

“আহঃ ! তুই বা বোনের কথা বিশ্বাস করছিস না কেন? আমারও মনে হয় মিনতি এখানেই যেন আছে…” রাশভারী রায় কত্তা বললেন

“তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে বাবা? এই কদিন ধরে এই বাড়িতে কত নাটক চলছে…” মৃন্ময় বলল

“কেন তোর ও তো মশারির দড়ি সেদিন খুলে গিয়েছিল….”শ্রেয়া বলল

“হা হা হা হা… আরে ওটা ইঁদুরের কাজ.. ভুতে আবার মশারি…. হো হো হো…” মৃন্ময় হাসতে হাসতে বলল

“তোর হাসি পাওয়ার কারণ? আমরা মিথ্যে কথা বলছি…” শ্রেয়া

বলল

“তোরা মিথ্যে বলছিস…. সেটা আমি বলছি না.. কিন্তু এগুলো সত্যি! আমি মানি না… তোদের মনে মিনতির জন্য একটু বেশি দরদ আর তার জন্য এসব হ্যালুসিনেট হচ্ছে….” মৃন্ময় বলল

“কেন হবে না ও তো আমাদের বাড়ির একজন… তোর কি মনে পরে না? কিন্তু আমি সত্যি দেখেছি ওকে… ও কিছু বলতে চাইছে… ” শ্রেষ্ঠা বলল

“একদম চুপ… এরপর থেকে এ বাড়িতে ওর নাম কেউ নিবি না… আর এসব ঝেড়ে ফেলে পড়াশুনাতে মন দে….. নতুবা এ বাড়ি বিক্রি করে দেবো…. “মৃন্ময় বলল (রেগে)।

“ভুলে যাস না আমি এখনও বেঁচে আছি… এসব কি বলছিস তু্ই? তোর মা ও এখানে আছে…. ওর শ্বশুরের ভিটে…..” রায় কত্তা বললেন

“কি করব বাবা… ভূত ভূত করে বাড়ির সব আনন্দ নষ্ট করে দিচ্ছে… এরা…. মিনতি আমাদের পাস্ট…. ওর প্রতি আমাদের ভালোবাসা আছে… সব মানলাম কিন্তু তাই বলে… ওকে নিয়ে পরে থাকলে আমাদের জীবন চলবে?” মৃন্ময়ের কথাটাও ফেলে দেওয়ার নয়… সত্যি কথাটা ঠিক….

যাই হোক রাতের খাবারের পাট শেষ করে যে যার নিজের ঘরে শুতে গেল….

মৃন্ময় অনেক রাত করে ফেসবুক করে… কিছুদিন হল তারই অফিস কলিগ নবনীতার সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে… শুধু বন্ধুত্ব বললে ভুল হবে… মনের আদান প্রদানও হয়েছে… তাই অফিস শেষে বাড়িতে রাতে ওর সাথেই জমিয়ে প্ৰেম চলে অনেক রাত অবধি…..

আজও (এত ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ) এর অন্যথা হয়নি… রাত বাড়ছে আর প্রেমের গভীরতা বাড়ছে…. ঘড়িতে রাত (১টা )

খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে ল্যাপটপে চ্যাট করছিল মৃন্ময়…

মাজা পর্যন্ত চাদর দিয়ে ঢাকা ওর… বালিশের ওপর বুক আর সামনে ল্যাপটপ…

ঠিক সেই সময়, যখন প্ৰেম শরীর ছুঁই ছুঁই… তখন হঠাৎ করে মাজা থেকে নেমে গেল চাদর…. মৃন্ময় চমকে উঠে আবার চাদর টেনে নিল… কিন্তু না… যতবার নবনীতার কাছে আসার একটা সুযোগ করছে ততবারই… একই ঘটনা… বাধ্য হয়েই

নবনীতাকে গুড নাইট বলতে হল….

রাগ করে বাথরুমে ঢুকল মৃন্ময়…. তারপর এসে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়ল… কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না…. ভালো মুহূর্তটা আজ ফসকে গেল হাত থেকে…. কথাটা ভাবতে ভাবতেই দুটো ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠল শরীর… গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসলো মৃন্ময়ের… ভয়ে ভয়ে পায়ের দিকে চাইতেই একটা শীতল রক্তের স্রোত উষ্ণ শরীরকে নিমেষেই যেন হিম করে দিল..

রাস্তার ল্যাম্পোস্টের আলোতে.. দেখতে পেল দুটো চোখ….

মৃন্ময়ের গলায় কাঁপা সুর “কে?”

হঠাৎ করে অবয়ব মুখের সামনে চলে এল… মুখে পরা চুল সড়িয়ে বলল “চিনতে কি পারছো? “

“তুমি….. মি… ” তোতলাতে লাগল মৃন্ময়

“আমি…. ঠিক ধরেছ… ” মিনতির আত্মা বলল

“কি চাও? তুমি তো মরে গেছো…চ” মৃন্ময় ক্ষীণ কন্ঠে বলল

“তুমি সবার সামনে সত্যিটা বল…. তুমি তো সব জানো….” মিনতি বলল

“আমি কিছুই জানি না….. আমাকে ছেড়ে দাও… আমাকে ছেড়ে দাও….” মৃন্ময়ের চিৎকারে সবাই জেগে গেল…. দৌড়ে এল ওর ঘরে….

দরজায় ধাক্কার আওয়াজে চমকে উঠল মৃন্ময়….

ততক্ষণে সব শান্ত…

“কী রে কি হয়েছে…?”শ্রেয়া আর শ্রেষ্ঠা বলে উঠল।

“কই কিছু হয়নি তো….” ঢোক গিলে বলল মৃন্ময়।

“হয়নি তো চেঁচামেচি করছিলি কেন?”শ্রেয়া বলল।

“ও কিছু না… তোরা যা…” এক প্রকার মুখের ওপর দরজা দিয়ে দিল মৃন্ময়…

কালই এর বিহিত করতে হবে…. প্রফেসার রুদ্র বসুকে সব জানাতে হবে…

সবার সামনে ভূতের ব্যাপারটা নাটক বললেও… ইদানিং মৃন্ময় অনেক বার এই উপলব্ধি করেছে… আর সেই কারণে প্রফেসার বসুর কাছে গিয়েছিল গত শনিবার……

কাল আবার যাবে….

পরদিন অফিসের নাম করে বেড়িয়ে গেল মৃন্ময়…

“আমাকে বাঁচান প্রফেসার….” মৃন্ময় হাত জোড় করে বলল।

প্রফেসার বসু বললেন,  “ঠিক আছে কাল তোমাদের বাড়ি আমি যাব…. ওখানে গিয়ে তারপর কি করা যায় সেটার বিষয়ে ভাববো…. “

রুদ্রবাবুর বাড়ির থেকে বেড়িয়ে মৃন্ময় বাড়িতে এসে বলে “শ্রেয়া আর শ্রেষ্ঠা এভাবে ভয় পাচ্ছে… তাই প্যারানরমাল রিসার্চার প্রফেসার রুদ্র বসুকে ডেকেছি।.. কাল আমাদের বাড়ি আসবেন উনি…. “

শ্রেয়া আর শ্রেষ্ঠা বলল, “সেই বিখ্যাত মানুষ… ওঁর কত অভিজ্ঞতা পড়েছি… ভালোই হবে উনি এলে….”

সেদিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল শ্রেয়ার… একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে করিডোর থেকে…. শ্রেয়া দরজা খুলে বেড়িয়ে এল…. রাত তখন অনেক… সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন….

করিডোরে খুবই কম আলো… তাও আবার দপদপ করছে…. কান্নার আওয়াজ ধরে এগিয়ে গেল শ্রেয়া… মিনতির ঘরের ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজটা আসছে…. দরজায় কান পাতল শ্রেয়া….

বুকের ভিতর ধকধক করছে… শীতের রাতেও ঘেমে জল… তবুও বুকে সাহস জুগিয়ে ঘরের দরজা খুলল শ্রেয়া…. ঘরের ভিতরে গুমোট অন্ধকার…. আসবাব বলতে একটা খাট আর আলমারি….

বদ্ধ ঘরের স্যাতস্যাতে গন্ধটা প্রবল ভাবে নাকে ঠেকছে…. শ্রেয়ার পা দুটো হালকা কাঁপছে… গলাটা শুকিয়ে যেন কাঠ…. তবুও চিৎকার করে বলল, “কি চাই তোর মিনতি… কেন এরকম ভাবে ভয় দেখাচ্ছিস…. আমাকে বল… আমি জানতে চাই…..”

শ্রেয়ার চিৎকার সারা ঘরময় যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে…. দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছে ও….

ঠিক সে সময় হঠাৎ করে ঘরের আবহাওয়া পরিবর্তন হতে থাকল…. মনে হল যেন বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে….

মুখ থেকে হাত সড়িয়ে পিছন ফিরল শ্রেয়া…

মিনতি…. !

হাত দুটো এগিয়ে শ্রেয়ার হাত ধরল শক্ত করে….

তারপর জ্ঞান হারাল শ্রেয়া….

সবাই একটা আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে এল করিডোরে… তারপর দেখল মিনতির ঘর খোলা….

রায় কত্তা আর মৃন্ময় এগিয়ে গেল ওই দিকে….

পিছনে শ্রেষ্ঠা আর ওর মা ললিতা দেবী…

ঘরের ভিতরে অন্ধকার… খোলা দরজার দিয়ে ভিতরে ঢুকল ওরা….

ঘরের লাইটটা জ্বলছে না… মোমবাতি জ্বালিয়ে দেখল আলমারির পাশে বসে আছে শ্রেয়া….

হাঁটুতে মুখটা ঢোকানো…….

মৃন্ময় এগিয়ে গিয়ে বলল, “শ্রেয়া তুই এখানে?”

মৃন্ময়ের প্রশ্নের কোনও উত্তর দিলনা শ্রেয়া। মৃন্ময় আরও একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে শ্রেয়ার সামনে বসল।

তারপর শ্রেয়ার গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠল। শ্রেয়ার শরীরটা বরফের মতই ঠান্ডা।

হাতটা সরিয়ে মৃন্ময় ভয়ার্ত মুখে পিছিয়ে আসতেই হাতটা চেপে ধরল শ্রেয়া।

চুলগুলো তখন বাতাসে উড়ছে শ্রেয়ার। বাইরে মেঘের চমক।

মোমবাতির আলোতে সবাই দেখছে শ্রেয়ার দিকে।

কিন্তু কোথায় শ্রেয়া এত মিনতি…

চোখ দুটো রক্তবর্ণ, মুখটা ফ্যাকাসে। ঠোঁট দুটো ঈষৎ নড়ছে। সারা মুখময় ছড়িয়ে আছে যন্ত্রনা মিশ্রিত হাসি।

মৃন্ময়ের হাত ধরেই ধীরে ধীরে হালকা শরীরটা ভাসছে।

মৃন্ময় প্রা্ণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে।

কিন্তু প্রত্যেক বার ব্যর্থ হচ্ছে।

মৃন্ময় ঘেমে উঠছে। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে।

আর ঠিক সেই সময় একটা জোর ঝাঁপটা অনুভব করল মৃন্ময়।

এবং ছিটকে গিয়ে ঘরের কোনায় পড়ে জ্ঞান হারাল।

এদিকে শ্রেয়াও অজ্ঞান হয়ে গেছে।

এসব দেখে ভয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে মাটিতে বসে পড়ল বিভূতি রায়।

এসবই ললিতা দেবীর জন্য সম্ভব হয়েছে। এত কিছু ঘটনার মধ্যে উনি দৌড়ে ঠাকুর ঘর থেকে নিয়ে এসেছিলেন হনুমান চল্লিশা। কারণ উনি জানতেন এই একজন ভূত প্রেত দূর করতে সক্ষম।

শ্রেয়ার জ্ঞান ফিরলেও বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে মেয়েটা। বাকি রাত

টুকু ললিতা দেবী তার ঘরেই নিয়ে গেল শ্রেয়কে।

মৃন্ময় নিজের ঘরে গেলেও সেদিন সারা রাত আলো জ্বালিয়ে রাখল। কেমন একটা আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাকে।

মিনতি কি তবে প্রতিশোধ নিতে চাই? মনের ভিতরে একটা অজানা আশঙ্কা। এই মুহূর্তে সবটা বলা ঠিক হবে না!

যদি সবাই ভুল বোঝে।

ঘরের আলো জ্বালা থাকলেও বাইরে অন্ধকার।

মিনতির কথা ভাবতে ভাবতেই চোখটা লেগে এল মৃন্ময়ের।

হালকা ঘুমে মৃন্ময় অনুভব করল ঘরের মধ্যে কেউ যেন ওকে এক নজরে দেখছে।

কথাটা মনে হতেই ঘুম ভেঙে খাটের ওপর উঠে বস্ল মৃন্ময়।

কিন্তু কোথাও কেউ নেই। দরজায় ঝোলানো পর্দার নিচে চোখ যেতেই আঁতকে উঠল। মনে হল ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

মৃন্ময় বালিটা বুকের কাছে চেপে ধরে। হনুমানজির নাম নিতে থাকল…

এভাবে কতক্ষণ ছিল জানা নেই। ভোরের আলো ফুটতেই মৃন্ময় বেড়িয়ে গেল প্রফেসর রুদ্র বসুর বাড়ির  উদ্দেশে।

বিশাল গেট পেড়িয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই। একজন মাঝ বয়সী লোক মৃন্ময়কে মিস্টার বসুর চেম্বারে বসাল। এর আগেও রুদ্র বসুর বাড়িতে এসেছে মৃন্ময়। এক বন্ধুর বিয়ে বাড়িতে আলাপ হয়েছিল রুদ্রর সাথে এবং সেখানেই ওর বাড়ি সম্পর্কে জানিয়ে ছিল মৃন্ময়। তখন কার্ড দিয়েছিল রুদ্র। তবে সেদিন উনি বলেছিল আজ যাবেন মৃন্ময়দের বাড়ি। কিন্তু গত রাতের পর মৃন্ময় আর ওঁর অপেক্ষা করতে পারেনি তাই বাড়িতে চলে এসেছে আবার।

প্রায় দশ মিনিট পর প্রফেসর বসুর দেখা মিলল।

সব শুনে কিছুক্ষণ ভেব, আলমারিতে রাখা অজস্র বই থেকে একটা বই নিয়ে রুদ্র মৃন্ময়কে ব,লেন “চলুন যাওয়া যাক।”

পথে রুদ্র বসু একটিও কথা বলেননি মৃন্ময়ের সাথে।

কিছু একটা চিন্তা করছিলেন। মৃন্ময়দের বাড়ির সামনে আসতেই

মৃন্ময় বলল,”এখানেই রাখুন।”

বাড়িতে ঢুকে একে একে পরিচয় পর্ব সারা হলে মৃন্ময় আর বিভূতিবাবু প্রফেসর বসুকে নিয়ে গেলেন মিনতির ঘরে।

ঘরের দরজা খুলতেই একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে ঠেকল রুদ্রর।

চোখটা বন্ধ করে সবাইকে ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে বললেন।

দরজা জানলা বন্ধ থাকায় ঘরে অন্ধকার আস্তরণের প্রলেপ ছিল। আর তারই মাঝে প্রফেসার অনুভব করছিল কারোর উপস্থিতি। কেউ যেন গোপন কিছু বলার জন্য চেষ্টা করছে।

কিছুক্ষণ এভাবে থেকে প্রফেসর চোখ খুলল।

রুদ্র বসু মৃন্ময়কে বললেন “এ বাড়িতে অতৃপ্ত আত্মা আছে। যার সাথে অন্যায় হয়েছে। আর সে অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে চায়।”

কিন্তু মিনু মানে মিনতিকে আমরা খুব ভালোবাসতাম তাহলে ও কেন… কথাটা বলতে বলতে ললিতা দেবী আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন।

দেখুন এই বাড়ির কেউ না কেউ আছে যে ওর ক্ষতি করেছে।

আর ও এর প্রতিশোধ নেবেই। আর যতক্ষণ না প্রতিশোধ নিতে পারছে ওকে এখান থেকে তাড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু সত্যিটা সামনে আসলে একটা উপায় বের করা সম্ভব হবে।

কথাগুলো এক মনে শুনছিল মৃন্ময়। বাড়ির সবার কাছে মুখ দেখানোর ভয় যেমন ছিল তেমনই মিনতির প্রতিশোধ নেওয়ার

ভয় তাড়া করছিল মৃন্ময়কে। আর সব মিলিয়ে মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠল মৃন্ময়ের। কোনও কিছু না ভেবেই

হঠাৎ কেঁদে উঠে প্রফেসর বসুর পায়ে ধরে বলল আমি সব খুলে বলছি। আপনি আমাকে বাঁচান।

ঘরের আর বাদবাকি লোক অবাক হয়ে মৃন্ময়ের দিকে তাকাল।

মৃন্ময় চোখ মুছে বলতে শুরু করল…

ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে যখন বাড়ি ফিরি। মাস খানিক বাকি ছিল চাকরিতে জয়েন করতে। সে সময় মিনতির প্রতি একটা আকর্ষণ হয়ে ছিল আমার। ওর সাথে কথা বলা, সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া। আর মাঝে মাঝে ঘরে চা জল খাবার নিয়ে আসলে একটা চোখের ভাষার আদান প্রদান হত বার বার।

আর এভাবেই আমাদের ভালোলাগা একদিন ভালোবাসা হয়ে উঠেছিল।

একদিন ঝড় জলের রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি মিনুর ঘরে যাই। আর সেদিন একটা মস্ত ভুল…

কথাটা শেষ না করতে দিয়ে মিসেস রায় সপাটে চড় মারল মৃন্ময়ের গালে।

কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ছিঃ। তুই আমাদের পিছনে এত কিছু করেছিস আর আমরা…”

মৃন্ময় কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমায় ক্ষমা করে দাও। আমি বুঝতে পারিনি মিনতি আত্মহত্যা করবে। আমি ওকে বুঝিয়ে ছিলাম আমরা ভুল করেছি। আমি ওকে বিয়ে করতে পারব না।

এ বাড়িতে কেউ মেনে নেবে না… কিন্তু ও।”

রুদ্র বসু কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “আপাতত এই লাল সুতোটা হাতে বেঁধে দিলাম। দুদিন পর অমাবস্যা। আর সেদিন এই ঘরে বাস্তু

পুজোর আয়োজন করতে হবে। এক মাত্র সেই পুজো আপনাদের রক্ষা করবে। তবে এই দুদিন সাবধান। মিনতি চেষ্টা করবে মৃন্ময়কে মেরে প্রতিশোধ নিতে। ও শুধু মৃন্ময়ের ক্ষতি করতেই এখানে আছে তবে ওর কাজে বাধা দিলে ও কিন্তু আপনাদের ও ছাড়বে না।

এই দুদিন মৃন্ময়কে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে নতুবা…”

প্রফেসর বসু চলে গেলে ললিতা দেবী কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

বিভূতি রায় মৃন্ময়কে বললেন, “আমি আশা করিনি তুমি এভাবে আমাদের সব কিছু শেষ করে দেবে।”

শ্রেয়া আর শ্রেষ্ঠা ও দাদার দিকে কটু দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

মৃন্ময় হাত জোর করে ক্ষমা চাইল আর তারপর বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে।

রায় বাড়িতে আরও একবার নেমে এল শোক। সত্যি এত বড় অন্যায় ঘটে গেছে অথচ তারা কিছুই টের পাননি।

সারাদিন মৃন্ময় নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে রাখলেও বাড়ির কাছে আসতেই বুকটা কেমন যেন ধড়াস করে উঠল।

বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের স্বল্প আলোতে বাড়িটা কেমন যেন থমথমে মনে হল।

দরজায় এসে বেল বাজাতেই ললিতা দেবী দরজা খুলে দিলেন।

আগে দরজা খোলার সময় ললিতা হাসি মুখে স্বাগত জানাতেন ছেলেকে কিন্তু আজ তার মুখ ভার। হয়তো ভীষণ লজ্জায় আর মিনতির প্রতি হওয়া অন্যায়ের যন্ত্রনায়।

মৃন্ময় ভিতরে ঢোকার আগেই ললিতা দেবী ওখান থেকে চলে গেলেন। মৃন্ময় পিছন ফিরে তাকিয়ে মাকে চলে যেতে দেখল

তারপর দরজা বন্ধ করতে সামনে ঘুরতেই চমকে উঠল।

দরজার বাইরে উঠোনে মিনতি দাঁড়িয়ে হাসছে। তার হাসির মধ্যে তীব্র প্রতিশোধের রেশ।

এক নিমেষেই দরজা বন্ধ করল মৃন্ময়। তারপর দ্রুত ঘরে ঢুকল।

হাত মুখ ধুয়ে খাটে এসে বসতেই। ঘরের লাইটগুলো আপন ইচ্ছায় দপদপ করতে লাগল। মিনতির উপস্থিতি টের পেয়ে চিৎকার করে ঘর থেকে বেরোতে গেলে ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

বিভূতিবাবু, ললিতা শ্রেয়া আর শ্রেষ্ঠা ছুটে গেল মৃন্ময়ের ঘরের দিকে। জোরে জোরে দরজা ধাক্কা্ল।

কিন্তু না কোনও সাড়া শব্দ নেই ভিতর থেকে।

মৃন্মকে সাবধানে রাখতে বলেছিল প্রফেসর রুদ্র। অথচ

মৃন্ময় এর অন্যায়কে না মানতে পেড়ে সবাই ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল এক নিমেষে।

ললিতা দেবী কাঁদতে কাঁদতে বিভূতিবাবুকে বললেন, “এখনই প্রফেসর বসুকে ফোন করো। ছেলেটার কিছু হয়ে গেলে…”

বিভূতিবাবু সময় অপচয় না করে ফোন করল মিস্টার বসুকে।

প্রফেসর বসুকে ফোন করার ঠিক ১০ মিনিট বাদে আপনা আপনি খুলে গেল মৃন্ময় এর ঘর। মেঝেতে পড়ে আছে মৃন্ময়। তার সারা শরীরে আঁচড়ের দাগ। মুখ দিয়ে একটা গোঙানির আওয়াজ আসছে। ঘরের জিনিসপত্র উলটপালট।

ললিতা দেবী তাড়াতাড়ি জল নিয়ে এসে মৃন্ময়ের চোখে মুখে ছিটিয়ে দিল।

ততক্ষণে রুদ্র বসু চলে এসেছেন। ঘরে ঢুকে মৃন্ময়কে বিছানায়

শোয়ানো দেখে প্রফেসর বসুর বুঝতে বাকি রইল না কি ঘটত চলেছে।

একটু বিরক্ত হয়েই বিভুতি রায়ের দিকে কথাটা ছুঁড়ে দিলেন রুদ্র।

“আপনাদের আমি বারবার বলেছিলাম এই দুদিন মৃন্ময়কে খেয়াল রাখতে। কিন্তু আপনারা ছেলের উপর রাগ করে বিপদ ডেকে এনেছেন। আজ ও ভাগ্যের জোরে বাঁচলেও মিনতির আত্মা রাতের মধ্যেই ওকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।

যে মরে যায় সে কোনদিন আর আপন থাকে না। আপনার ছেলে ভুল করেছে। কিন্তু তাই বলে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক নয়। অন্তত মানবিকতার খাতিরে এই ছেলেটির প্রাণ বাঁচানো আপনাদের দায়িত্ব। আমি ওর হাতে এই লাল সুতোটা বেঁধে দিয়ে যাচ্ছি। মিনতি কিন্তু যে কোনও প্রকারে এই লাল সুতোটা ওর হাত থেকে খোলার চেষ্টা করবে।

আমি আগামী পরশু আসব। ঠিক রাত সাড়ে এগারোটায়।

রাত্রি বারোটায় আমরা পুজো করব। দুটো লাল রঙের মোমবাতি, দুটো ধূপকাঠি, একটা লাল জবা ফুলের মালা, লাল সুতো গামছা, দুটো ১ টাকার কয়েন এবং একটু মিষ্টি আর জল। এই সামগ্রীগুলো জোগাড় রাখবেন। সুষ্ঠুভাবে যদি এই পুজোটা করতে পারেন তাহলে মিনতির আত্মা মুক্তি পেয়ে যাবে।

আর হ্যাঁ সেদিন বাড়িতে কোন রকম আমিষ রান্না করবেন না। সেদিন সকাল থেকেই নিরামিষ খাবার খাবেন।”

এতদুর একটানা বলে এবার মিস্টার বসু থামলেন। তারপর ঘরের চারদিকে তাকিয়ে আবার বিভুতিরায়ের উদ্দেশ্যে বললেন মাঝে আর একদিন। আজ রাত থেকে আগামীকাল রাত পর্যন্ত মৃন্ময়কে নিজেদের কাছে রাখুন। মিনতি কিন্তু নিজের রূপ বদলেও মৃন্ময়কে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।”

কথাগুলো বলেই বেরিয়ে গেলেন রুদ্র বসু। ললিতা দেবী মৃন্ময়ের মাথার কাছে গিয়ে বসলেন। বিভূতিবাবু বাইরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে  এলেন রুদ্র বাবুকে।

রাত এগারোটা…

বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। কুকুরগুলো কাঁদছে। রায় বাড়িতে নিস্তব্ধতা আর ভয়ের আবহাওয়া গুটিয়ে রেখেছে সকলকে।

একটা প্রলয়ের আগে যেমন নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরে ঠিক তেমনই যেন একটা নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে বাড়িটাকে।

নাম না জানা পাখির একটা আওয়াজ আসছে কানে।

সেই আওয়াজের মধ্যে রয়েছে melancholy সুর।

মৃন্ময়ের গায়ে জ্বর। মাথায় জল পট্টি দিচ্ছিলেন ললিতা।

হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা তীব্র আওয়াজ রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। চমকে গিয়ে মৃন্ময়ের পাশ থেকে উঠে পড়ল ললিতা। তারপর রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াতেই একটা বিদ্যুতের ঝলক গোটা ঘরটাকে আলোকিত করল। আর সাথে সাথে তীব্র কান ফাটা আওয়াজ ভেঙে খান খান করল সবটা।

মৃন্ময়ের তন্দ্রা ভাঙল বাজের আওয়াজে আর সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলতেই দেখল ওর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে মিনতি।

চোখ দুটো সাদা, চুল এলোমেলো। ফুফিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলছে এক নাগাড়ে।

বিছানায় শুয়ে এই দৃশ্যে হতবাক মৃন্ময় ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে আছে। গলার কাছে শব্দগুলো জমাট বাঁধছে। ঠোঁট দুটো নড়লেও কোন কথা বাইরে প্রকাশ পাচ্ছে না। সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। এক দৃষ্টে পায়ের দিকে চেয়ে থর থর করে কাঁপছে শুধু।

ঠিক সে সময় ললিতা ঘরে ফিরে এসে হতবাক। মৃন্ময়ের চোখ দুটো খোলা বিস্ফোরিত।

ললিতা ছুটে এসে ছেলের মাথায় হাত রাখে আর তারপর ধীরে

ধীরে সব কিছু যেন নরমাল হয়।

সে রাতে ললিতা দু চোখের পাতা এক করতে পারেন ন। চোখ বন্ধ করলেই অদ্ভুত একটা অস্বস্তি আর বিভিন্ন আওয়াজ কানে এসে বাজে।

পরদিন ভোরের আলো ফুটতেই একটা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে ললিতা। মৃন্ময়ের জ্বর নেই।

মৃন্ময় কে ঘুমোতে দেখে রান্না ঘরের দিকে যায়।

যাওয়ার পথে মিনতির ঘরের দিকে চোখ পড়ে। ঘরের পাল্লা সামান্য নড়ছে।

ঘরের দরজাটা ভালো করে আটকাতে এগিয়ে যায় ললিতা।

দরজার ফাঁকাতে চোখ রাখতেই ললিতার মনে হয় অন্ধকার ঘর থেকে কেউ যেন তাকে দেখছে। মহূর্তে একটা অস্বস্তি অনুভব হয় ললিতার। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ফিরে আসে নিজের ঘরে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় আর বাড়ির সকলের যেন শুরু হয় একটা অজানা ভয়। রাত নামলেই সে আসে তার প্রতিশোধ নিতে।

আজ রাতটা রায় বাড়িতে বিভীষিকার মতই।

সবাই তাই আজ এক ঘরে রয়েছে। আজও হয়তো চেষ্টা করবে মিনতি মৃন্ময়ের ক্ষতি করতে।

সন্ধ্যা নামতেই একটা থমথমে পরিবেশ ঘিরে ধরল গোটা বাড়ি।

রান্নাঘরে কাজ করতে করতেই ললিতার মনে হল ঠিক পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই মনে হল যেন কিছু একটা দরজার পাশে সরে গেল। খাবারটা তাড়াতাড়ি করে তৈরি করে নিয়ে ঘরে ঢুকল ললিতা।

কোনরকমে খাওয়ার পাঠ শেষ করল ওরা।

রাত এগারোটা। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দাটায় কারোর হেঁটে যাওয়ার আওয়াজ কানে ভেসে এল। তার সাথে ক্রমাগত একটা কান্নার আওয়াজ। শ্রেষ্ঠা মুখটা ভয়ে আতঙ্কে কেমন যেন অদ্ভুত হয়ে উঠল। পেটের মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল।

শ্রেষ্ঠা ললিতা দেবী কে বলল বাথরুম যাওয়ার কথা।

ললিতা তখন শ্রেষ্ঠাকে সঙ্গে নিয়ে বাথরুমে গেল। বারান্দার লাইটগুলো আজ জ্বলছে না। অন্ধকারের মধ্যেই একটা হারিকেন নিয়ে বারান্দা ধরে গুটি গুটি এগোতে লাগল ওরা।

বাথরুমের কাছে পৌঁছাতে হঠাৎই আলোটা নিভে গেল।

শ্রেষ্ঠা ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল। একটা একটা ঠান্ডা শীতল অনুভূতি ঘিরে ধরল ওদের।

শ্রেষ্ঠা র চিৎকারে তখন শ্রেয়া আর রায় বাবু বেরিয়ে এসেছেন ঘর থেকে। মৃন্ময়কে একা ফেলে। সবাই ঘর থেকে বের হতেই মৃন্ময় ঘরের আলোগুলো দপ দপ করতে লাগল। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিভে গেল। মৃন্ময় বুঝল তার খাটের পায়া দুটো আপনাআপনি যেন শুন্যে উঠছে। কেউ যেন তার খাটটাকে ধরে জোরে জোরে নাড়াচ্ছে মৃন্ময় চিৎকার করে উঠল।

মৃন্ময়ের চিৎকারে ললিতা দেবী আর সকলে দৌড়ালো মৃন্ময়ের ঘরের দিকে।

ওরা ঘরে ঢুকতেই আলো জ্বলে উঠল। মৃন্ময় তখনও ভয়ে কাঁপছে।

এই রাত্তিরে ওদের কারোর ঘুম হল না। ছাদের ওপর পায়ের শব্দ। সিঁড়ি দিয়ে কারোর হাঁটাচলা।

আর একটানা কুকুরের কান্না সব মিলিয়ে ওদের চোখের পাতাগুলো যেন স্থির হয়ে রইল।

রাত্রি শেষে ভোরের আলো ফুটতেই বিভূতি রায় সমস্ত সামগ্রীর যোগাড় করে রাখল।

শআজ আমাবস্যা। অন্যদিনের তুলনায় আজ যেন অন্ধকারে গোটা পাড়া ঢেকে গেছে। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আস্লেন রুদ্র বসু।

আজ একেবারেই অন্যরকম বসনে। লাল কাপড়ের ধুতি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর কপালে লাল সিঁদুরের তিলক।

মিনতির ঘর খুলে গঙ্গা ছিটিয়ে। দেওয়ালের কোল ঘেঁষে একটা ঘট পাতলেন রুদ্র। গামছা দিয়ে ঘরটাকে বউয়ের মত করে সাজালেন। আর তার ওপর জবা ফুলের মালা দিলেন।

সামনে জ্বালালেন দুটো মোমবাতি একটা প্রদীপ। গোটা ঘরটাকে মন্ত্রপূতঃ জল দিয়ে বাঁধলেন।

রায় পরিবারের সকলেই আজকের সকাল থেকে নিরামিষ খেয়ে ছিলেন রুদ্রর নির্দেশে।

তারা নতুন বস্ত্র পরিধান করে এক এক করে বসলেন রুদ্রর পাশে।

রাত বারোটা…

বাইরের মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি পড়ছে। ঝড়ের দাপটে মোমবাতিগুলো প্রায় নিভে যাচ্ছে। বাজ পড়ার কানফাটা আওয়াজে কেঁপে উঠছে ঘরটা। রুদ্র একমনে মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছে।

রান্নাঘরে বাসন পড়ার আওয়াজ, সব ঘরের দরজা-জানালাগুলো আপনা আপনি খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। এসব দেখার জন্য ললিতা আসন ছেড়ে উঠতে গেলে রুদ্র বাধা দিলেন।

ললিতাকে উদ্দেশ করে বলন, “এগুলো সবই মিনতির কাজ। আসন ছেড়ে যে উঠবে তারই ক্ষতি হবে।”

রুদ্রর কথাই পুজোয় মন দিলেন ললিতা। সারারাত ধরে চল পুজো।

গোটা বাড়িটাকে বেঁধে ফেলেন রুদ্র তার মন্ত্র বলে।

রায় বাড়ির পিছনে বড় কাঁঠাল গাছটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে।

তখন ও ভোরের আলো ফুটতে দেরি আছে।

সমস্তপূজা শেষ করে রুদ্র ললিতা দেবীকে বলেন, “এই ঘটটা

আজীবন সিংহাসনে রেখে দেবেন। বাড়ি আমি বেঁধে দিয়েছি।

মিনতি আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। শুধু এক মাস বাদে ওর নামে গয়ায় পিণ্ডদান করবেন, এবং তারপরেই মৃন্ময়ের বিয়ে দেবেন।

সকালের এক উজ্জ্বল রোদ্দুর এসে ঢুকল। রায়বাড়ির সমস্ত বিপদ কেটে গিয়ে এক নতুন সকাল এল।

কিছু আবার আগের মতন হয়ে উঠল নিমেষে।

এক মাস বাদে মিনতির নামে গয়ায় পিন্ডদান করলেন বিভূতি রায়।

ইতিমধ্যে মৃন্ময় মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে মিনতির কাছে।

একটা ভুল সে যে করেছে তা সত্যি ক্ষমা করা যায় না।হয়তো মিনতি এতদিনে ওকে ক্ষমা করেছে।

সামনের মাসেই মৃন্ময় এর বিয়ে ঠিক হয়েছে। এই নিয়েই ব্যস্ত রায় বাড়ি। সানাইয়ের সুর শোনা যাচ্ছে আকাশে বাতাসে।

(সমাপ্ত )

সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা এই গল্পটির চরিত্র এবং নামগুলো কাল্পনিক। কিছুটা কল্পনা মিশ্রিত হলেও এ ঘটনা আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় সাথে ঘটে ছিল। এবং ওদের পরিচারিকা মারা যাওয়ার পর বাড়িতে টিকতে পারছিলনা। বিভিন্ন ভাবে ভয় পাচ্ছিল। শেষে একজন সাধু এসে বাড়িটাতে পুজো করে এবং বাড়ি বেঁধে দেন। আর তারপর থেকে সব কিছু স্বাভাবিক হয়।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post ভালোবাসার মর্ম | পলক ফেলা নিষেধ |প্রতিম ভট্টাচার্য| Bengali Thriller Story
Next post প্রতিশোধ | পলক ফেলা নিষেধ |চৈতি চ্যাটার্জি| Bengali Thriller Story