পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনের দিকে তাকাতেই হঠাৎ করে ফোনটা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রীনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে একটু ভয় পেয়ে গিয়ে ফোনটা ধরল সায়ন। ফোনটা ধরতেই অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এল এক নারীকন্ঠ।
“হ্যালো! মিস্টার সায়ন চ্যাটার্জী বলছেন?”
“হ্যাঁ বলছি।”
“আমি মিসেস অনুরিমা চ্যাটার্জী বলছি।”
“আচ্ছা! বলুন।”
আমি আজ সকাল থেকে প্রায় চল্লিশবার ফোন করেছি আপনাকে। আপনি মনে হয় সকাল থেকে ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। তাই আমার ফোন ধরার সময় হয়নি আপনার।
আসলে আজকে কাজের একটু চাপ ছিল।
এইটুকু বলার পরেই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর আসে একটাও কথা বলবে না তুমি। আমি কতবার ফোন করেছি তোমাকে। একবার দেখারও সময় হয়নি তোমার। এত ব্যস্ত তুমি। এটুকু বলেই ফোনটা কেটে দিল অনুরিমা।
ফোনটা কেটে যেতেই সায়ন মনে মনে ভাবতে লাগল সকাল থেকে আজকে কাজের খুব চাপ ছিল। তাই আজকে একবারও রিমাকে ফোন করতে পারিনি। রিমা অনেকবার ফোন করেছে, আমাকে না পেয়ে আমার উপর আবার রাগ করেছে। সত্যি রিমা আর বড় হবে না। সেই বাচ্চাই রয়ে গেল। কতদিনের সম্পর্ক আমাদের। কিন্তু একদিনও যদি আমার সাথে ঝগড়া করতে না পারে তাহলে ওঁর না কী দিন ভাল যায় না।
আমাকে তো এমনটাই বলেছে। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হত আমার। কিন্তু আস্তে আস্তে এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এখন রিমা ঝগড়া না করলে আমার ভাল লাগে না। সত্যিই আমি ওই মেয়েটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি।
এইসব ভাবতে ভাবতেই সায়ন ঘড়ির দিকে তাকাল। দুপুর দুটো লাঞ্চ টাইম। এবার অন্তত অনুরিমাকে ফোন করতেই হবে একবার। অনুরিমাকে ফোন করল সায়ন। একবার ফোন বাজতেই রিমা ফোন ধরল।
“হ্যালো! বল কি বলবে?”
বিশ্বাস কর আজ কাজের খুব চাপ ছিল। পরপর দুটো মিটিং এটেন্ড করতে হয়েছে। তাই ফোন করতে পারিনি।
“ঠিক আছে। অসুবিধা নেই।”
এই জন্যই তো আমি আমার পাগলিটাকে এত ভালোবাসি।
শোন না সায়ন আজকে আমার একটু দেরি হবে। আমি নার্সিংহোম থেকে একটু স্যারের বাড়িতে যাব, দরকার আছে। তুমি আমাকে আটটা নাগাদ নিতে এস। আমি তোমাকে স্যারের বাড়ি ঠিকানা মেসেজ করে দিচ্ছি।
ঠিক আছে!!
সন্ধে তখন ঠিক ছ’টা অনুপ্রিয়া তাঁর সমস্ত কাজ তাঁর বন্ধু তথা সহকর্মী পুষ্পিতাকে বুঝিয়ে দিল। ওঁরা দুজনেই মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেছে। এখন কলকাতার নামকরা একটা নার্সিংহোম নিউ লাইফে কর্মরতা।
পুষ্পিতা জানতে চাইল, “কি ব্যাপার রে! কোথাও কি ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান আছে নাকি তোদের। তাই আমাকে এত জরুরী তলব।”
নাহ্ রে! সেই রকম কিছু নয়। কাল রাতে স্যার মেসেজ করেছিল আমাকে। কি দরকার আছে আলোচনা করতে হবে। তাই ওঁর বাড়িতে যাওয়ার জন্য বলেছেন।
“ঠিক আছে! তাহলে আর দেরি করিস না।”
“হ্যালো! পুলিশ স্টেশন আমি ডাঃ দিবাকর কুমার গাঙ্গুলীর বাড়ি থেকে বলছি।”
গতকাল বিকেল থেকে ডাঃ গাঙ্গুলী বাড়ি ফেরেননি। আপনারা দয়া করে তাড়াতাড়ি আসুন। আধঘণ্টার মধ্যে থানা থেকে দুজন অফিসার এসেছেন। যেহেতু একজন নামকরা ডাক্তার তথা বিশিষ্ট সমাজসেবীর নিখোঁজের ব্যাপার। তাই উপরমহল থেকে এই কেসের দায়িত্ব এসে পড়েছে এসিপি মিঃ অর্ণব রায় চৌধুরীর উপর। ওঁকে খুঁজে বের করতে না পারলে অনেক মানুষের ক্ষতি হয়ে যাবে।
মিঃ অর্ণব রায় চৌধুরীর গাড়ী কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাঃ গাঙ্গুলীর বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায়। বাড়িতে ছিলেন ডাঃ গাঙ্গুলীর স্ত্রী সুমনা গাঙ্গুলী, মেয়ে ঈশাশ গাঙ্গুলী আর ডাঃ গাঙ্গুলীর শ্যালক সুশোভন সেন। বাড়িতে ঢুকেই মিঃ রায় চৌধুরী পুরো বাড়িটা ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর ওঁর সহকর্মী ওসি মিঃ রজত সেনকে দায়িত্ব দেন সারা বাড়ি ভাল করে খুঁজে দেখতে। প্রত্যেকটা ঘর প্রত্যেকটা কোনাও যেন বাদ না পড়ে। মিঃ সেন ওঁর সাথে দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে যান।
এরপর মিঃ রায় চৌধুরী ডাঃ গাঙ্গুলীর বাড়ির লোকজনকে একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করেন।
প্রথমেই ডাঃ গাঙ্গুলীর স্ত্রীর কাছে জানতে চান-
“কখন থেকে নিখোঁজ ডাঃ গাঙ্গুলী?”
ডাঃ গাঙ্গুলীর স্ত্রী জানান- “গতকাল বিকেল থেকে।”
বিকেল বলা ভুল হবে কারণ উনি গতকাল বিকেলে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন তখন বলেছিলেন গতকাল রাতে উনি ফিরবেননা। দুটো ক্রিটিক্যাল অপারেশন ছিল। স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন উনি। কিন্তু গতকাল রাতে যখন ওঁকে ফোন করেছিলাম তখন ওঁর ফোন সুইচড্ অফ পেয়েছিলাম। তখনও সেরকম সন্দেহ হয়নি। ভেবেছিলাম হয়ত অপারেশনের জন্যই ফোন বন্ধ আছে। গতকাল রাতে আর ফোন করিনি কিন্তু আজ সকালেও যখন ফোন করলাম তখনও দেখি ফোন সুইচড্ অফ। তখন সন্দেহ হয়। কিন্তু এর আগেও উনি এমন করেছেন। কাজের জন্য উনি দেরি করে বাড়িতে এসেছেন। তাই ভেবেছিলাম উনি বাড়ি ফিরে আসবেন। কিন্তু সকাল গড়িয়ে যখন দুপুর হয়ে গেল তখন চিন্তা বাড়তে লাগল। ওঁর হসপিটালে ফোন করি। কিন্তু ওখান থেকে জানায় গতকাল ডাঃ গাঙ্গুলী হসপিটালে যায়নি। সমস্ত আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের কাছে খবর নিয়ে জানতে পারি উনি কোথাও যায়নি। তাই আপনাদের ফোন করলাম।
মিঃ রায়চৌধুরী জানতে চান- “ডাঃ গাঙ্গুলী কেমন মানুষ ছিলেন?”
“খুব ভাল!” সাংসারিক মানুষ ছিলেন। কাজের জগতের বাইরে পুরো সময়টা বাড়িতে দিতেন। তবে উনি কাজ-পাগল মানুষ ছিলেন। ওঁর ডাক্তারীর পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজও থাকত।
ডাঃ গাঙ্গুলীর বিবাহ বর্হিভূত কোন সম্পর্ক ছিল?
নাহ্। এমন মানুষ নন উনি।
ওঁর হসপিটালে এমন কি কোন ঘটনা ঘটেছিল যার কারণে উনি নিখোঁজ হতে পারেন?
তেমন তো কিছু জানা নেই।
কোন রোগীর মৃত্যু অস্বাভাবিক ছিল। রোগীর বাড়ির লোকেরা ওঁকে ভয় দেখিয়েছিল?
সেইরকম কিছু জানি না।
কোন রুগীর ব্যাপারে ওঁকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল?
নাহ্! তেমন কিছু শুনিনি কখনও।
এরপর ডাঃ গাঙ্গুলীর মেয়ের কাছে জানতে চান- “বাবার সাথে সম্পর্ক কেমন ছিল?”
“খুব ভাল!” আমরা প্রত্যেকদিন রাতে একসাথে খাবার খেতাম। তখন সারা দিনের জমানো গল্পগুলো ভাগ করে নিতাম।
আচ্ছা ডাঃ গাঙ্গুলী বাড়িতে কতটা সময় দিত?
যেদিন ছুটি থাকত সেদিন আমরা সবাই মিলে বাইরে ঘুরতে যেতাম। আর ছুটি না থাকলে বাড়ি ফিরে এসে।
আচ্ছা তোমার বাবা তোমাকে কখনও কোন কাজের জন্য বকেছেন?
নাহ্! জামাইবাবু এমন মানুষই নন।
আপনি কে?
আমি ডাঃ গাঙ্গুলীর শ্যালক।
আপনি এখানে কি করছেন?
আমি এখানেই থাকি। বাবা মা মারা যাবার পর থেকে আমি দিদি জামাইবাবুর সাথে থাকি।
আপনি কি বিবাহিত?
নাহ্!
আপনি কী করেন?
ব্যবসা।
কিসের ব্যবসা?
ইলেকট্রিক্যাল গুডসের।
ওহ্! আচ্ছা!
ইতিমধ্যেই পুরো বাড়িটা ভাল করে খোঁজার পর মিঃ সেন নীচের ড্রইং রুমে এসে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছে মিঃ রায়চৌধুরীকে জানান, স্যার! তেমন কিছু সন্দেহজনক পেলাম না।
এর মধ্যে কি আপনাদের কাছে কোন ফোন এসেছে টাকা চেয়ে পাঠিয়ে?
নাহ্! এখনও তেমন কোন ফোন আসেনি আমাদের কাছে।
মিসেস গাঙ্গুলী আপনি ডাঃ গাঙ্গুলীর একটা ছবি দেবেন।
মিঃ সেন আপনি এক কাজ করুন শহরের প্রত্যেকটি জায়গায় ডাঃ গাঙ্গুলীর ছবিটি পাঠিয়ে দিন। সমস্ত পুলিশ স্টেশন, হসপিটাল, মর্গ সব জায়গায়। এখনও তো কোন ফোন আসেনি তাই মৃত্যুর সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এটাও খবর নিন এর মধ্যে শহরে কোন অ্যাক্সিডেন্ট ঘটেছে কিনা?
ওকে স্যার! আমি এখনই করছি সবটা।
এইসব শুনে মিসেস গাঙ্গুলী খুব কান্নাকাটি করছেন। বারবার বলছেন ওঁর স্বামীর কিছু হয়নি তো। উনি বেঁচে আছেন তো?
দেখুন মিসেস গাঙ্গুলী চব্বিশ ঘন্টা কেটে গেছে ডাঃ গাঙ্গুলী নিখোঁজ। তাই কোন সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। চিন্তা করবেন না সব ঠিক হবে। মিঃ রায় চৌধুরী জানায় এখনকার মত তাঁরা চলে যাচ্ছেন। কিন্তু দরকার পড়লে আবারও আসতে হতে পারে কিংবা তাদেরকেও থানায় যেতে হতে পারে।
মিঃ রায় চৌধুরী বেরতে যাবেন এমন সময় হঠাৎ করেই ডাঃ গাঙ্গুলীর বাড়ির দরজার সামনে একজন অল্প বয়সী মহিলা এসে দাঁড়ায়। কিন্তু বাড়ির ভিতরে এত পুলিশ দেখে বাড়ির ভিতরে যাবে কিনা ভাবছিল। এমন সময় মিঃ রায় চৌধুরী মেয়েটিকে বাড়ির ভিতরে আসতে বলে। মেয়েটি বাড়ির ভিতরে এলে মেয়েটিকে বসতে দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন।
প্রথমে মিঃ রায় চৌধুরী জানতে চান-
আপনার নাম কী?
মিসেস অনুরিমা চ্যাটার্জী।
কী করা হয়?
আমি একজন ডাক্তার। নিউ লাইফ নার্সিংহোমের সাথে যুক্ত আছি।
এখন এখানে কী জন্য এসেছেন?
ডাঃ গাঙ্গুলী গতকাল রাতে আমাকে মেসেজ করেছিল। কী দরকার আছে তাই আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন ওঁর বাড়িতে।
কতদিন ধরে চেনেন ওঁকে?
প্রায় আট নয় বছর হবে। ওঁর স্টুডেন্ট ছিলাম মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু মেসেজ আসার পর স্যারকে অনেকবার ফোন করেছিলাম। ওঁর ফোন বন্ধ ছিল তাই এখানে আসা।
আচ্ছা আপনি কী জানেন গতকাল বিকেল থেকে ডাঃ গাঙ্গুলীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
নাহ্! কী বলছেন। তাহলে গতকাল রাতে যে আমাকে মেসেজ করেছিল স্যার।
সেটাই তো ভাবার বিষয়। মেসেজটা দেখান তো একবার।
দেখাচ্ছি স্যার!!
আচ্ছা মেসেজটা এসেছে গতকাল রাত সাড়ে নটায়। তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
বাড়িতে স্যার।
বাড়ি কোথায়?
এখানে গড়িয়াতে থাকি। তবে আমাদের আদি বাড়ি বর্ধমানে। এখানে কাজের সূত্রে আছি। আমি আর আমার স্বামী।
এখানে কে কে থাকেন?
আমি আর আমার স্বামী।
আচ্ছা বাড়িতে কে কে আছেন?
বাড়ি বলতে শ্বশুরবাড়িতে শ্বশুর আর শ্বাশুড়ি। আর আমার বাপের বাড়িতে মা বাবা আর ছোট বোন।
কতদিন আগে ডাক্তারী পাশ করেছেন?
পাঁচ বছর আগে।
আচ্ছা মিসেস গাঙ্গুলী আপনি কাল রাতে কখন ফোন করেছিলেন ডাঃ গাঙ্গুলীকে?
ওই রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টার ভিতর।
তখনও ফোন বন্ধ ছিল তাই তো?
হ্যাঁ।
আচ্ছা ডাঃ চ্যাটার্জী আপনি মেসেজ পাওয়ার কতক্ষণ পর ফোন করেছিলেন ডাঃ গাঙ্গুলীকে।
দুই – তিন মিনিটের মধ্যেই।
আচ্ছা তখনও ফোন বন্ধ ছিল তাই তো?
হ্যাঁ।
আচ্ছা ডাঃ চ্যাটার্জী ডাঃ গাঙ্গুলী মানুষটা কেমন ছিলেন?
খুব ভাল স্যার! আমাদের সব বন্ধুরাই ওঁর প্রিয় ছিল। আসলে ওঁর পড়ানোর ধরনটাই আলাদা ছিল। সবাই পছন্দ করত স্যারকে।
মিসেস গাঙ্গুলী আপনি কী ডাঃ চ্যাটার্জীকে চেনেন বা কখনও ওঁর নাম শুনেছেন?
নাহ্!!
ডাঃ চ্যাটার্জী আপনার সাথে কি মিসেস গাঙ্গুলীর পরিচয় আছে আগে থেকে?
নাহ্!! স্যারের কাছে ম্যাডামের নাম শুনেছিলাম কিন্তু সামনে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
এইসব কথা বলতে বলতেই ফোন বেজে ওঠে অনুরিমার। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে জানতে চায়, “কোথায় তুমি?”
আমি স্যারের বাড়িতেই আছি। আমি তো তোমার দেওয়া ঠিকানায় এসে দাঁড়িয়ে আছি। কখন আসবে? একটু দাঁড়াও আমি আসছি।
ফোনটা কেটে যেতেই এসিপি জানতে চায়- “কে ফোন করেছিল?”
অনুরিমা জানায় তার স্বামী ফোন করেছিল।
এসিপি তাকেও ভিতরে আসতে বলে। ভিতরে এলে এসিপি প্রথমে তাঁর পরিচয় জানতে চায়।
সায়ন জানায় তাঁর নাম সায়ন চ্যাটার্জী। SGC কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর আর ডাঃ অনুরিমা চ্যাটার্জীর স্বামী। এসিপি তাকে পুরো ঘটনা খুলে বলে। তার সাথে ডাঃ চ্যাটার্জীকে একটু সাবধানে থাকতে বলে। বলা হয় প্রয়োজনে ডাঃ চ্যাটার্জীকে থানায় আসতে হতে পারে।
এই ঘটনায় রিমা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও ভয় পেয়ে গিয়েছিল খুব। তাই ওঁর মনটা ভাল করার জন্য সায়ন ওঁকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যায়। সায়ন ওঁকে অনেক রকম ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। বোঝানোর পর কিছুটা স্বাভাবিক হলে খাওয়া দাওয়া করে ওঁরা বাড়ি ফিরে আসে।
রাত তখন এগারোটা। দুজনে বাড়ি ফিরে আসার পর প্রথমে সায়ন চেঞ্জ করতে যায় ওয়াশরুমে। সায়ন ওয়াশরুমে ঢুকতেই অন্ধকার হয়ে যায় সারা বাড়ি। আর ঠিক তখনই রিমা অন্ধকারে কোন মানুষের স্পর্শ অনুভব করে তাঁর পাশে। প্রথমে ভেবেছিল সায়ন ফিরে এসেছে। কিন্তু সায়নের নাম ধরে ডাকতেও কোন সাড়া যখন পেল না তখন রিমার ভয় শুরু হতে লাগল। তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘরে গিয়ে মোমবাতি জ্বালাতে গেলে কোন ছায়া তাঁর পিছন দিয়ে সরে যেতে দেখল। রিমা ভয় পেয়ে গিয়ে হাত থেকে মোমবাতিটা মাটিতে ফেলে দেয়। ঠিক যখন রিমা মোমবাতিটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে জ্বালাতে যাবে তার আগেই পিছন থেকে কে যেন রিমার গলাটা চেপে ধরে। রিমা তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু কোন লাভ হয় না গলায় চাপ আরও বাড়তে থাকে। তাই বাধ্য হয়ে রিমা হাতের সামনে থাকা ফুলদানি দিয়ে তাকে মাথায় আঘাত করে। তাতে সামান্য কিছুটা বাঁধন আলগা হয় ঠিকই। কিন্তু যখন রিমা নিজেকে ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে সেই মুহূর্তে আরও শক্ত করে গলা চেপে ধরে। এর সাথে সাথেই অনুরিমার মৃত্যু হয়। এই ঘটনা ঘটার কিছুক্ষণের মধ্যেই সায়ন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। অনেকক্ষণ ধরে রিমাকে ডাকার পর কোন সাড়া না পেয়ে একতলায় নেমে আসে। ততক্ষণে আলো চলে এসেছে। এসে দেখতে পায় রিমার নিথর দেহটি মাটিতে পড়ে আছে। এটা দেখে আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে সায়ন থানায় ফোন করে। যেহেতু এই কেসের দায়িত্ব ছিল এসিপি মিঃ রায় চৌধুরীর ওপর। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই সায়নের বাড়িতে এসে পৌঁছায় মিঃ রায় চৌধুরী ও তার সহকর্মীরা।
এসিপি দেখে তো খুব অবাক হয়। কিছুক্ষণ আগেই তো অনুরিমার সাথে কথা হল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল। এটা কি করে সম্ভব? এটা কী তাহলে পরিকল্পিত খুন না কী আত্মহত্যা? যদি খুন করে থাকে তাহলে কে করেছে? ডাঃ গাঙ্গুলী না কী অন্য কেউ? কী শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল রিমার সাথে? এসিপি সবটা খুব ভাল করে লক্ষ্য করল। অনুরিমার মৃতদেহ দেখে বুঝতে পারল গলায় ফাঁস লাগিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।
তবে তাদের সাথে ফরেনসিক টিমও এসেছে। যেহেতু এটা খুন তাই ভাল করে পরীক্ষা করতে হবে। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখল রিমার হাতের নখে কিছু রক্ত লেগে ছিল। এছাড়া ফুলদানিতে রক্তের দাগ পাওয়া গেছে। সম্ভবত যে রিমাকে খুন করতে এসেছিল এটা তাঁর দাগ। এটা জানার সাথে সাথেই এসিপি মিঃ সেনকে বলে ফুলদানিটা ল্যাব টেস্টের জন্য পাঠাতে। এছাড়া অনুরিমার নখে যে রক্ত লেগে ছিল সেটাও পরীক্ষা করতে বলল। কিছুক্ষনের মধ্যেই অনুরিমার মৃতদেহও ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। হঠাৎ করেই এসিপি লক্ষ্য করে সায়নের মাথায় একটা কাটা দাগ রয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই সায়নকে এসিপি দেখেছেন তখনও তাঁর মাথায় কোন আঘাত ছিল না তাহলে এই আঘাত পেল কিভাবে? তাহলে কী সায়নই অনুরিমার খুনী ।
এসিপি সায়নকে জিজ্ঞাসা করলে সায়ন তৎক্ষণাৎ এসিপিকে উত্তর দেয় অন্ধকারে ওয়াসরুমে যেতে গিয়ে তার মাথায় আঘাত লেগেছে।
আচ্ছা অনুরিমা যখন যখন মারা যায় তখন কোন চিৎকারের আওয়াজ শুনেছ।
নাহ্! অন্ধকার ছিল যদিও কিন্তু কোন আওয়াজ তো শুনিনি। এইসব কথা বলতে বলতেই এসিপির সন্দেহ গিয়ে পড়ে সায়নের ওপর। সায়ন ছাড়া এখানে তৃতীয় ব্যক্তির আসা সম্ভব নয়। তাহলে সায়নই খুন করেছে। সায়নকে এইসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেই সায়ন জানায়, “বিশ্বাস করুন আমি রিমাকে খুন করিনি!”
এসিপি বলে কী করে বিশ্বাস করব তোমায়? এমন কোন কাজ কী তুমি করেছ বিশ্বাস করার মত।
আচ্ছা অনুরিমার সাথে কী কারও শত্রুতা ছিল?
সেরকম তো ছিল না। সবার সাথেই রিমা খুব ভালভাবে মিশতে পারত। কিন্তু স্যার একদিন আমি আর রিমা একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। সেখানে কতগুলো লোক রিমাকে আজেবাজে কথা বলতে থাকে তাদের মধ্যে একজন সম্ভবত তাঁর নাম শংকর সে ওঁর সাথে অসভ্যতামী করতে শুরু করেছিল। এইসব দেখে আমি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। আমার সাথে হাতাহাতি হয়। সেই মূহুর্তে ওখানে পুলিশ চলে আসে এবং ওদেরকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার সময় অবশ্য শংকর বলেছিল সে রিনাকে এর শাস্তি দেবে। কিছুদিন পর জানতে পারি ওদের সবার দুবছরের জেল হয়েছে।
এটা কতদিন আগেকার ঘটনা?
তা প্রায় ছয় মাস হবে।
আচ্ছা তাহলে সন্দেহের তালিকায় আরও একটা নাম যুক্ত হল। মিঃ সেন আপনি খবর নিন এই শংকরের ব্যাপারে।
পরের দিন সকালে মিঃ সেন এসিপি স্যারের কাছে এসে জানায় এক সপ্তাহ আগেই শংকর জেল থেকে পালিয়ে গেছে। তবে খবর নিয়ে জানতে পেরেছি যে, শংকর ওঁর বাড়িতে যায়নি। এই কথা শুনে এসিপি ঠিক করে সে নিজে একবার গিয়ে সমস্ত ঘটনাটা দেখবে। কথামতই এসিপি শংকরের বাড়িতে যাওয়ার আগে পাড়া-প্রতিবেশীর থেকে শংকরের ব্যাপারে বিভিন্ন খোঁজ-খবর নিতে থাকে। কিন্তু কেউই শংকরের ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ এসিপিকে দিতে পারে না। এমতাবস্তায় এসিপি শংকরের বাড়িতে গেলে প্রথমেই শংকরের মা দরজা খুলে কিছুটা অবাক হয়ে যায়।
এসিপি শংকরের মায়ের কাছে জানতে চান, শংকর কোথায়?
শংকরের মা জানায় শংকর এখানে নেই। ছয় মাস আগে ওকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তারপর শুনেছিলাম ওঁর জেল হয়েছে।
আপনি জানেন না, শংকর এক সপ্তাহ আগে জেল থেকে পালিয়েছে।
নাহ্! জানি না। আপনারা এখানে কেন?
একটা মেয়ের খুনের ব্যাপারে আপনার ছেলেকে দরকার। আপনার ছেলে একটা মেয়েকে খুন করেছে।
কী বলছেন।
আচ্ছা! আপনার ছেলে যদি কখনও এখানে আসে আমাদের সাথে সাথেই জানাবেন।
ঠিক আছে স্যার!
শংকরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে এসিপি তাঁর গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোক এসিপিকে ডেকে বলেন আপনারা শংকরকে খুঁজছেন?
হ্যাঁ! আপনি কী করে জানলেন?
নাহ্! আমি এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ আপনাদের কথাবার্তা শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। স্যার আমি এরমধ্যে একদিন রাতে শংকরকে এখানে আসতে দেখেছিলাম। ওঁর বাড়িতে একটা পিছনের দিকে দরজা আছে সম্ভবত শংকর ওই পিছনের দরজা দিয়ে প্রতিদিন রাতে আসে আবার সকাল হলেই এখান থেকে চলে যায়। এই দরজাটা দিয়ে বেরলে সোজা গিয়ে পড়বে জঙ্গলে আর জঙ্গল পেরলেই শহরের রাস্তা। এইসব শুনে এসিপি সিভিল ড্রেসে দুজন অফিসারকে রেখে যান শংকরের বাড়ির সামনে। যাতে কেউ বুঝতে না পারে শংকরকে খোঁজার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। এসিপি ভেবেছিল আজ না হয় কাল শংকর এখানে ঠিক আসবেই। আর ঠিক তাই হল আজকে রাতেই শংকর এসেছিল। সোজা তাকে নিয়ে আসা হয় থানায়। ওখানে যাওয়ার পর অফিসাররা ওঁর মুখ থেকে কথা বের করার জন্য অনেক রকমই ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু শংকর নিজের দোষ কিছুতেই স্বীকার করেনি। ওর মাথায়ও ক্ষতের দাগ। এসিপি জানতে চান, কিভাবে লাগল মাথায়? স্যার পালাতে গিয়ে কেটে গেছে। কেন করেছিলি এমন আবার হুমকিও দিয়েছিলিস? ভুল করেছিলাম কিন্তু বিশ্বাস করুন স্যার আমি কিছু করিনি। তাহলে পালাচ্ছিলিস কেন? স্যার ভয় থেকে। আবার যদি জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
আচ্ছা মিঃ সেন সন্দেহ করার মত কিন্তু দুজন হল- সায়ন আর শংকর। দুজনেরই মাথায় আঘাতের চিহ্ন আবার ডাঃ গাঙ্গুলীকেও এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। যেহেতু ডাঃ গাঙ্গুলীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাই আমরা এটা বুঝতে পারছি না যে ওঁর মাথায়ও ক্ষতের চিহ্ন আছে কী না? আচ্ছা মিঃ সেন এক কাজ করুন দুজনের ব্লাড গ্রুপ টেস্ট করাতে দিন। ফুলদানিতে লেগে থাকা রক্ত সাথে অনুরিমার নখে লেগে থাকা রক্ত আর এই দুজনের রক্ত যদি মিলে যায় তবে কেসটা অনেকটাই সলভ্ হয়ে যাবে।
ওকে স্যার! আমি এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
পরের দিন সকালে মিঃ সেন এসিপির রুমে আসেন ময়নাতদন্ত এবং ব্লাড গ্রুপের রিপোর্ট নিয়ে। ভিতরে ঢুকে স্যারকে বলেন ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে এটা পরিষ্কার হয় যে, শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। আর ব্লাড গ্রুপ এখানে সন্দেহ প্রকাশ করার মত কিছু আছে। সায়নের ব্লাড গ্রুপ বি পজেটিভ আর শংকরের ও পজেটিভ। যদিও ডাঃ গাঙ্গুলীর ব্লাড গ্রুপ জানা নেই। অনুরিমার ব্লাড গ্রুপ এ পজেটিভ।আর ফুলদানিতে যে রক্তের দাগ ছিল ওটা এবি পজেটিভ। কিন্তু সমস্যা একটাই অনুরিমার নখে যে রক্ত লেগে ছিল সেটা বি পজেটিভ। তাঁর মানে মিঃ সেন সেই রাতে সেখানে দুজন ছিল রিমাকে বাদ দিয়ে। তাহলে কী সায়ন খুন করেছে? যাই হোক সায়নের মেডিকেল টেস্ট করতে হবে কারণ অনুরিমার নখে লেগে থাকা রক্তের সাথে সায়নের ব্লাড গ্রুপ মিলে যাচ্ছে। সবকিছু যাতে পরিষ্কার হয় সেই কারণে সায়নের মেডিকেল টেস্ট করানো হয়। মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট এলে জানতে পারে সব কিছুই নরম্যাল। তাহলে খুন করল কে? কেন?
দেখতে দেখতে দশ দিন কেটে গেছে ডাঃ গাঙ্গুলীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এদিকে অনুরিমার মৃত্যুরহস্যও উদঘাটন হয়নি। এমন সময় একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে থানায়।
হ্যালো! পুলিশ স্টেশন। আমি ডাঃ গাঙ্গুলী বলছি। আমার খুব বড় বিপদ। আপনারা তাড়াতাড়ি এখানে আসুন।
ডাঃ গাঙ্গুলী আপনি কোথায় আছেন?
আমি ঠিক বলতে পারব না এটা কোন জায়গা। প্লিজ আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন। এইটুকু বলে ফোনটা কেটে যায়। ফোনটা কেটে যেতেই লোকেশন ট্র্যাক করতে বলেন এসিপি । লোকেশন অনুযায়ী পৌঁছে দেখল এটা শহর থেকে একটু দূরে বাইপাসের ধারে একটা সদ্য নির্মিত ফ্ল্যাট ব্লিডিং। সেইখানেই ডাঃ গাঙ্গুলীর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। মুখ থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। ঘটনাটি সবেমাত্র ঘটেছে মনে হয়। মিঃ সেন একটু খবর নিন সায়ন এখন ঠিক কোথায় আছে?
ওকে স্যার! আমি এখনি জানছি। স্যার সায়ন এখন অফিসে আছে।
মিঃ সেন এই ঘটনাটা ঘটার পিছনে শংকরের ভূমিকা থাকতে পারে না। তাহলে পড়ে থাকল কে? সায়ন। ওঁর ভূমিকা থাকতেই পারে কারণ ওঁর স্ত্রী খুন হয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবে ডাঃ গাঙ্গুলীর ওপর কোন একটা রাগ থাকতেই পারে।
ডাঃ গাঙ্গুলীর মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ময়নাতদন্তের জন্য। এসিপি সবাইকে জানায় ডাঃ গাঙ্গুলীর মৃত্যু এখনই যেন সবাই জানতে না পারে। এবার আমাদের একটা শেষ চেষ্টা করতেই হবে। তবেই এই কেসটা সলভ্ হবে। এই বলে এসিপি সায়নকে ফোন করে জানায় ডাঃ গাঙ্গুলীকে পাওয়া গেছে। ডাঃ গাঙ্গুলীকে একজন খুন করতে এসেছিল কিন্তু সে পারেনি খুন করতে। ডাঃ গাঙ্গুলী এখনও বেঁচে আছেন। ওঁকে নিউ লাইফ নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে। আশা করি উনি সুস্থ হয়ে উঠলে ওঁর নিখোঁজ আর অনুরিমার মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করতে পারব আমরা।
এর উত্তরে সায়ন জানায় এটা তো খুবই ভাল খবর।
ওকে মিঃ চ্যাটার্জী দরকারে আপনাকে থানায় আসতে হতে পারে।
অবশ্যই স্যার!
সেদিন রাতে এসিপি সবাইকে নির্দেশ দেয় ডাঃ গাঙ্গুলীর কেবিনের বাইরে থাকতে। রাত তখন এগারোটা ডাঃ গাঙ্গুলীকে দেখার জন্য এক ডাক্তার কেবিনের ভিতরে যায়। কারও বুঝতে বাকি থাকে না এই যে আসল খুনি। সেই ডাক্তার ঢুকে গিয়ে ডাঃ গাঙ্গুলীর পিছন থেকে গলা চেপে ধরতেই পিছন থেকে কে যেন সেই ডাক্তারের মাথায় বন্দুক তাক করেন। তারপর চাদর সরাতেই দেখেন মিঃ সেন শুয়ে আছেন। পিছন থেকে এসিপি ডাক্তারের মাস্ক খুলতেই দেখা যায় এ আর অন্য কেউ নয় সায়ন চ্যাটার্জী। অনুরিমার স্বামী। ওদের সন্দেহই ঠিক তাহলে। সায়নকে থানায় নিয়ে আসা হয়।
কেন এই খুন করেছে সে? এইসব ঘটনা জানতে চাওয়ায় সব ঘটনা বলতে থাকে সায়ন। সে প্রায় আট বছর আগের কথা। আমার সাথে পল্লবীর সম্পর্ক ছিল সেই ছোটবেলা থেকে। আমি বিজনেসের জন্য এমবিএ পড়তে থাকি আর পল্লবী ডাক্তারী।
পল্লবী আর অনুরিমা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। আমার সাথেও অনুরিমার ভাল সম্পর্ক ছিল। আমরা মাঝে মধ্যেই তিনজনে একসাথে ঘুরতে যেতাম। একদিন পল্লবী ডাঃ গাঙ্গুলীর চেম্বারে যায় কোন একটা দরকারে। দরজা খুলতেই পল্লবীর কানে আসে ডাঃ গাঙ্গুলী তাঁর এক সহকর্মীর সাথে কিডনি বিক্রি নিয়ে কি সব কথা বলছিলেন। কিছুক্ষণ শোনার পর পল্লবীর কাছে এটা পরিষ্কার হয় ডাঃ গাঙ্গুলী সবার চোখের আড়ালে কিডনি পাচারের ব্যবসা করছেন। কিন্তু ওখান থেকে চলে যাওয়ার সময় আচমকাই পল্লবীর হাত লেগে ডাঃ গাঙ্গুলীর চেম্বারের বাইরে থাকা একটা কাঁচের ফুলদানি মাটিতে পড়ে যায়। ফুলদানির আওয়াজে তাঁরা সজাগ হয়ে যায়। পল্লবীকে ওখানে দেখতে পেয়ে বাইরে এসে জানতে চান, কী দরকার? কেন এসেছ তুমি? কিন্তু এটা বুঝতে পারে না যে, পল্লবী তাদের কথোপকথনের সবটাই শুনে নিয়েছে। বাড়ি ফিরে পুরো ঘটনাটা আমাকে আর অনুরিমাকে বলে। আমি পুরো ঘটনাটা বিশ্বাস করলেও অনুরিমা বিশ্বাস করতে পারেনি। অনুরিমা ভেবেছিল পল্লবী ভুল শুনেছে।
অনুরিমা একদিন ডাঃ গাঙ্গুলীকে সমস্ত ঘটনাটা খুলে বলে। ডাঃ গাঙ্গুলী হেসে উড়িয়ে দেয় ব্যাপারটা। অনুরিমাকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, পল্লবী যা শুনেছে ভুল শুনেছে। একজন রুগীর কিডনি সংক্রান্ত ব্যাপারে সে তাঁর সহকর্মীর সাথে আলোচনা করছিল। কিন্তু অনুরিমাকে এই কথা বললেও ডাঃ গাঙ্গুলী পল্লবীর ব্যাপারে সজাগ হয়ে যায়। আমি পল্লবীকে সাবধানে থাকতে বলেছিলাম। একদিন কলেজ ছুটির পর ডাঃ গাঙ্গুলী পল্লবীকে দেখা করতে বলেছিল। কিন্তু যেদিন দেখা করতে গিয়েছিল সেই দিনই পল্লবীর কলেজের ছাঁদ থেকে পড়ে মৃত্যু হয়। যদিও সবাই এটা আত্মহত্যা বলেই জেনেছিল। আমি জানতাম এটা পরিকল্পিত খুন ছিল। টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করা হয়েছে সবার।
সেই দিন থেকেই আমার প্রতিশোধ নেওয়ার পর্ব শুরু হল। পল্লবীর এইভাবে চলে যাওয়াতে আমি অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলাম। তখন অনুরিমা আমাকে সামলাতে শুরু করে। আমিও ওঁর সাথে প্রেমের অভিনয় চালিয়ে গেলাম কারণ ডাঃ গাঙ্গুলীর কাছে পৌঁছনোর রাস্তা ছিল অনুরিমা। অনুরিমা যখন নার্সিংহোমে জয়েন করল ঠিক তাঁর পরেই আমরা বিয়ে করি। তারপর যেদিন ডাঃ গাঙ্গুলী নিখোঁজ হয় সেদিন দুপুরে ওঁর সাথে আমার কথা হয়। বলেছিলাম একটা ক্রিটিক্যাল কেসের ব্যাপারে আলোচনা করার আছে। আমি জানতাম ডাঃ গাঙ্গুলী কোন রাস্তা দিয়ে যাবেন। আমি মাঝ রাস্তায় ডাঃ গাঙ্গুলীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ডাঃ গাঙ্গুলীর গাড়ি ওই রাস্তা দিয়ে যখন আসে আমি ওঁকে হাত দেখাই। ওঁকে জানাই আমার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে তাই আমাকে একটু অফিস পর্যন্ত যদি ছেড়ে দিতে পারেন। উনি আমার থেকে সমস্ত ঘটনা শোনার পর আমাকে ওঁর গাড়ীতে উঠতে বলেন। গাড়িতে ওঠার পর প্রথমে আমাদের স্বাভাবিক কথোপকথন হয়। ডাঃ গাঙ্গুলী ওঁর পরিচয় দেন এবং আমিও আমার পরিচয় দিই। আমার থেকে সমস্ত পরিচয় জানতে পেরে এবং পল্লবীর কথা জানতে পেরে তিনি কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়ে ব্রেক হারিয়ে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেন এবং সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যান। আর আমি ঠিক এর সুযোগ নিয়ে ডাঃ গাঙ্গুলীকে অপহরণ করে শহর থেকে একটু দূরে আমার এক বাগান বাড়িতে রাখি। যার ঠিকানা অনুরিমাও জানত না। সবার মনে একটা সন্দেহ তৈরী করার জন্য আমি ডাঃ গাঙ্গুলীর মোবাইল থেকে অনুরিমাকে একটা মেসেজ করি দেখা করতে যাওয়ার জন্য। যাতে পুরো সন্দেহটাই অনুরিমার ওপরে এসে পড়ে। অনুরিমা যখন দুপুরে জানাল সে ডাঃ গাঙ্গুলীর বাড়িতে দেখা করতে যাবে সেই সুযোগটাই কাজে লাগাই আমি। ভেবেছিলাম ওখান থেকে ডাঃ গাঙ্গুলী পালিয়ে যেতে পারেন এই ভেবে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ডাঃ গাঙ্গুলীকে ওই বাগান বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে এনে রাখি। আমার চোখের সামনে রাখতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম স্টোররুমে আটকে রেখে যদি বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে রাখি তাহলে কারুর কোন সন্দেহ হবে না। ওঁকে রেখে দিয়ে ঠিক সময়মত আমি ডাঃ গাঙ্গুলীর বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির হই। কিন্তু রাতে যখন আমরা বাড়ি ফিরে আসি ততক্ষণে ডাঃ গাঙ্গুলীর জ্ঞান ফিরে এসেছিল। তখন গাঙ্গুলী সবটা বুঝতে পেরে এখান থেকে পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করে। পালিয়ে যাবার সময় ডাঃ গাঙ্গুলীর সাথে অনুরিমার ধাক্কা লাগে। ডাঃ গাঙ্গুলী অনুরিমাকে সবটা জানায়। তখন অনুরিমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় ডাঃ গাঙ্গুলীকে আমি এখানে লুকিয়ে রেখেছি। আমি পুরো ঘটনাটা বুঝতে পেরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সাথে সাথেই আমার বাড়ির মেন লাইনটা অফ করে দিই। অনুরিমা সবকিছু জেনে যাওয়াতে প্রথমে ভেবেছিলাম ডাঃ গাঙ্গুলীকে খুন করব তারপরে অনুরিমাকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেব। অনুরিমা এইসব জানতে পেরে চিৎকার করতে থাকে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ডাঃ গাঙ্গুলী পালিয়ে যেতে গেলে ডাঃ গাঙ্গুলীকে সামনে থাকা ফুলদানি দিয়ে মাথায় আঘাত করি। তখন ডঃ গাঙ্গুলী সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে যায়। এমতাবস্থায় অনুরিমার চিৎকার আরও বাড়তে থাকে। অনুরিমার চিৎকার বন্ধ করার জন্য পিছন থেকে আমি ওঁর গলা চেপে ধরি। ওঁ নিজেকে বাঁচানোর জন্য ফুলদানি দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করে। কিন্তু সবশেষে ওঁর মৃত্যু হয়। ভেবেছিলাম ওঁর মৃত্যু হলে ডাঃ গাঙ্গুলীর নিখোঁজ রহস্য চাপা পড়ে যাবে। আমি ডাঃ গাঙ্গুলীকে নিজের হাতে মারতে চেয়েছিলাম। অনুরিমার মৃত্যু হলে আমি এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করে সাথে সাথেই ডাঃ গাঙ্গুলীকে আমার গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে আমার অফিসের স্টোররুমে রাখি। এত জিনিসের মধ্যে ডাঃ গাঙ্গুলীকে পাওয়া সম্ভব হবে না। ভেবেছিলাম আপনারা বাড়ি তল্লাশি করলেও আমার অফিস তল্লাশি করবেন না। আর সুযোগ বুঝে ডাঃ গাঙ্গুলীকে আমার বাগান বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খুন করব। ঠিক সেই রকমই হল। আপনারা আমার সারা বাড়ি তল্লাশি করলেও আমার অফিস কিন্তু তল্লাশি করেননি সেই দিন। যখন ডাঃ গাঙ্গুলীর বিষয়টা আরও ভাবাচ্ছিল তখন আমি বুঝলাম ওঁকে এখানে রাখাটা সেফ হবে না। তাই আমি ওঁকে বাইপাসের ধারে জনবসতিহীন একটা সদ্য নির্মিত ফ্ল্যাটে নিয়ে যাই ওখানে ওঁর হাত পা মুখ বেঁধে রেখেছিলাম।
কিন্তু যেই মুহুর্তে আমি ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম ঠিক তখনই ডাঃ গাঙ্গুলী আপনাদের কাছে সাহায্য চেয়ে ফোন করেছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি ফিরে এলে সবটা জানতে পারি। জানতে পেরে ওঁকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। ডাঃ গাঙ্গুলী পালাতে গিয়েছিল ঠিক তখনই আমি পিছন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলাম। এরপর উনি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন আর বাকীটা আপনাদের কাছে পরিষ্কার।
ডাঃ গাঙ্গুলীর ব্যাপারটা তো নয় বুঝলাম কিন্তু আপনি অনুরিমাকে মারলেন কেন? অনুরিমা তো আপনার স্ত্রী ছিল। অনুরিমাকে আমি কোনদিনই ভালোবাসিনি। আমি পল্লবীকে ভালবাসতাম। পল্লবীর মৃত্যুর পর আমি অনুরিমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলাম। ডাঃ গাঙ্গুলীর কাছে পৌঁছাবার জন্য অনুরিমাকে ব্যবহার করেছিলাম। সেদিন যদি অনুরিমা পল্লবীর কথাগুলো বিশ্বাস করত আর সব কথা ডাঃ গাঙ্গুলীকে গিয়ে না বলত তাহলে আমাকে পল্লবীকে হারাতে হত না। আজকে আমাদের সুখের সংসার হত। সেই কারণেই যারা আমার কাছ থেকে আমার পল্লবীকে কেড়ে নিয়েছে, তাদের কাউকেই আমি এই পৃথিবীতে থাকতে দেব না।
জানেন এই দুজনকে খুনের জন্য আপনার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
হতেই পারে। কিন্তু আমার তাতে কোন আক্ষেপ নেই। আমি আমার এই জীবন রেখেই বা কী করব। যে জীবনে আমার ভালোবাসার মানুষটাই নেই। ভালোবাসার জন্য মানুষ পারে না এমন কোন কাজ নেই। আজ সত্যিই আমি আমার পল্লবীকে জিতিয়ে দিয়েছি। আর কিছু জানি না। এবার আপনারা আমাকে নিয়ে যেতে পারেন!!
–সমাপ্ত–