রাহিত মেডিকেলের মর্গে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটা কেমন যেন ধোঁয়াটে নীল আবছা আলোয় ঘেরা। প্রচন্ড ঠান্ডা। বাইরে আর একটা ঘরে অনেক লাশ। তারপর এই ঘর। এই ঘরে লাশগুলো শীতল করে রাখা আছে। যেন পচে না যায়। কেউ যদি কিছুদিনের মধ্যে খোঁজে আসে তাহলে লাশগুলো দিয়ে দেওয়া হয়। না হলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মেডিকেল কলেজে। সেখানে কাটাকাটি করা হয়। ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠে রাহিতের।
এই ঘরটা প্রচন্ড ঠান্ডা হলেও রাহিতের বেশ ভালো লাগছে। বাইরে এই কাঠফাটা রোদের চেয়ে লাশগুলোর সাথে বসে থাকা ঢের ভালো। রাহিত এসেছে তার বন্ধু রনির আত্নীয়ের লাশের খোঁজে। রনির আত্নীয় দূরসম্পর্কের হওয়ায় রনির মধ্যে তেমন দুঃখ নেয়। একজন মানুষ মারা গেলে যে দুঃখ হয় অনেকটা তেমন৷ তবে রনি যে দুঃখের অভিনয় করছে তা রাহিত ভালো মতই জানে। এতদিনের বন্ধুত্ব এটুক চেনাটাই যেন বাধ্যতামূলক।
অনেকটা দায়ে পড়েই এসেছে রনি। আত্নীয়গুলো নিতান্তই অজপাড়া গাঁয়ের, চাষাভুষা। এই শহরের নিয়ম কানুন কিছুই জানে না। আর এই নিয়মগুলোতে অনেকটাই অভ্যস্ত রনি। যার লাশের খোঁজে এসেছে সে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। একের পর এক লাশের বক্স খুলে দেখানো হচ্ছে লাশগুলো।
রাহিত মনযোগ দিয়ে দেয়ে দেখছে একের পর এক বক্সগুলো। বক্সগুলো লোহার। অস্পষ্ট সাদা রঙ। পুরো ঘরে শীতলীকরণ যন্ত্র লাগানো থাকলেও বক্সগুলোর ভিতর বরফ দেওয়া। আসলে দেওয়া নাকি ভিতর থেকেই তৈরি হচ্ছে বুঝল না রাহিত।
বক্স নম্বর ৪৯ খুলে দেখা হল। বক্স খুলতেই একটা মেয়েকে দেখতে পেল রাহিত। পুরো শরীর সাদা কাপড়ে জড়ানো। মেয়েটার মুখে লেগে আছে হাসি। একটা হাস্যকর হাসি। আবার অনেকটা পৌশাচিকও বলা যেতে পারে। দুপাশের ঠোঁট টেনে দেওয়া হয়েছে। মৃত মানুষ যে হাসতে পারে এটা দেখেই হাসি আসে রাহিতের। ফিক করে হেসে ফেলে সে। যে কয়েকজন তার হাসি শুনতে পেয়েছে সবাই রাহিতের দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে থাকে। কেউ এইরকম দুঃখ ঘেরা ঘরে যে হাসতে পারে এটা হয়তো কারও জানা ছিল না। রাহিত তার ভুল কর্ম দেখে যেন বিপাকে পড়ে গেল। কিন্তু এই নিয়ে তাকে বিশেষ মাথা ঘামাতে হল না।
হঠাৎ করেই তীব্র একটা কান্নার শব্দ শুনল রাহিত। তীব্র একটা আর্তনাদ। পাশ ফিরে তাকাতে গিয়েও তাকাল না রাহিত। বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা যার লাশের খোঁজে এসেছিল পাওয়া গেছে। তাই তার কাছের মানুষগুলো কেঁদে উঠল। বিষয়টা কষ্টের হলেও সেই হাসিময় মৃত মুখটাই বেশি মনে পড়ছে রাহিতের। বক্সটা বন্ধ করা হয়েছে। আবার যেন ওই হাসি দেখা হাসতে ইচ্ছে করছে রাহিতের।
যে লাশটার খোঁজে এসেছিল ওই লাশটা নিয়ে বের গেল। এখন ছাড়পত্র আনতে হবে। রাহিতের ঘর থেকে বের হতেই প্রচন্ড গরম বাতাসের একটা ধাক্কা লাগল। এই গরমে গা যেন পুড়ে যাচ্ছে। ছাড়পত্র নেওয়াটা ঘন্টা দুইয়ের ধাক্কা। একটা বেঞ্চিতে বসল রাহিত। সামনে কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে রনি।
রাহিতের মনে হয় আরও কিছুটা সময় যদি মর্গে কাটানো যেতে পারত। আচ্ছা এখন যেয়ে যদি বসে থাকে রাহিত; ভালোই তো হবে? কাজ শেষে একসাথে যাওয়া যাবে।
রাহিত রনির উদ্দেশ্যে বলল,”রনি, খুব গরম লাগে। গা পুড়ে যায়। আমি কিছুক্ষণ মর্গে বসে থাকি। তুই থাক কাজ শেষে কল দিস।”
রনি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,”বাড়ি পালাবি তাই বল? এত নাটক করিস ক্যান? মর্গে যাবি মজা করিস। ওখানে সাধারণ মানুষ যেতেই ভয় করে আর তুই নাকি ওখানে বসে থাকবি? পাগল পেয়েছিস আমাকে?”
“আরে আমার তো কোন ভয় করল না। ভালোই লাগছিল বরং। আমি ওখানেই যাব।”
“হ্যাঁ ওখানে তোকে ঢুকতে দিবে যা?”
“চোখ ফাঁকি দিয়ে যাব দেখিস। গেম খেলার সময় দেখিস না সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কেমন পালিয়ে যায়”
রাহিত বলতে বলতে উঠে চলে গেল। রনি বুঝল রাহিত বাড়ি চলে যাবার জন্য তাকে এসব বুঝাছিল। রাহিতকে সেই ছোট থেকে চেনে রনি।
রাহিত মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে অনেক লাশ। অনেকজন আসছে যাচ্ছে। এই ঘরটা পার হলেই শীতল সেই ঘর। সেই ঘরে মানুষ খুব কম যায়। কেবল লাশ নেওয়া আর রাখার সময়। আর বিশাল বড় একটু অন্ধকার। কেউ তেমন খেয়াল করবে না। কিন্তু এই ঘরটা পার হয়ে ওই ঘরে যাওয়াটা পরীক্ষা। ছয়জন ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন নার্স আর বাইরের লোক তো আছেই। বাইরের লোকগুলোর সাথে মিশে গেল রাহিত। যেন ওদের সাথেই এসেছে। তারপর পিছনে ঘুরে দরজার দিকে এগিয়ে যায় রাহিত। দরজায় হাত রাখতে শীতল একটা অনুভব বয়ে যায়। বড্ড ভালো লাগল রাহিতের। কিন্তু ঘাড়ের কাছে উষ্ণ একটা অনুভূতিতে পিছনে ঘুরে। চমকে যায় রাহিত। একজন বেঁটে মানুষ তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আছে। বিশ্রী একটা নাক। যেন অন্য কোথা থেকে তুলে আনা হয়েছে।
“কই যান?”
প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠে রাহিত। একটু থামল কিন্তু কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছে না রাহিত। এলমেলো করে বলতে শুরু করল,
“জ্বী.. মানে..মানে…”
“মানে মানে কি? লাশ চুরি?”
“না না… এক আত্নীয় মারা গেছে খুঁজতে এসেছি।”
“পারমশিন কই?”
রাহিত বুঝল পারমশিন বলতে পারমিশন বুঝিয়েছে।
“নাই।”
মানুষটা রেগে বলল,
“মজা নাকি? নাই মানে? এই ঘরে ইচ্ছে মত ঢুকা যায় না। অনুমতি আনেন। অনুমতি ছাড়া এখানে যাওয়া যাবে না। আর যদি চেষ্টা করেন তাইলে খবর আছে।”
রাহিত হাবার মত মুখ করে শুনল। “আচ্ছা।”
রাহিত বের হওয়ার দরজার দিকে হাটতে শুরু করল। যদিও এটা রাহিতের অভিনয়। রাহিতের সেই ঘরে যাওয়া লাগবে। অন্তত সেই লোকটার কথার প্রতিশোধ নিতে। রাহিত পিছন ফিরে তাকাল। মানুষটা অন্য দিকে এগুচ্ছে। এই সুযোগ। রাহিত আর কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা ঘরের দিকে। দরজা খুলেই ঘরে ডুকে গেল রাহিত। দরজাই হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল রাহিত। কেউ দেখে ফেলেছে কিনা এই ভয়ে দাঁড়িয়ে রাহিত। একমিনিট হয়ে এল প্রায়। কেউ এল না। তার মানে কেউ বুঝতে পারেনি। রাহিত একটা দীর্ঘ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
রাহিত ভাবছে সবাই এই ঘরটাকে কেন এত ভয়ংকর ভাবে? এখানে এই রকম ঠান্ডা একটা পরিবেশ। মেয়েটার লাশটা আবার দেখতে ইচ্ছে করল রাহিতের। দেখা যায়? হ্যাঁ। কতো যেন ছিল? হ্যাঁ মনে পড়েছে ৪৯। খুলে দেখল সেই হাসি এখনও আছে। এবারও হাসি এল রাহিতের। তবে আগের মত অতটা না। পাশে দেখে বেশ খানিকটা রক্ত পড়ে আছে। কাউকে আনার সময় হয়তো পড়ে গেছে। ঘরটা অন্ধকার হওয়ায় রক্তটাও কেমন যেন কালটে লাগছে।
মেঘের গর্জন শুনতে পেল রাহিত। এই গরমে বৃষ্টি হলেই বাঁচা। কিন্তু বাইরে তো বাতাস ছিল না একটুও। মেঘের গর্জন শুনলেই রাহিতের ঘুম আসে। খুব ঘুমতে ইচ্ছে করে।
রাহিত ভাবতে থাকে আচ্ছা এখানে কী ঘুমানো যায়। খুব শীত। তারপর আবার মেঘের গর্জন। ওই তো একটা লাশ রাখার বেড। ঘুমালেই তো হয়। কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না তো। যদি কেউ চলে আসে। রাহিত ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়ে। যা হবে পরে দেখা যাবে।
কাজ শেষে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি গেল রনি। আত্মীয়গুলোকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। অনেক ক্লান্ত লাগছে রনির। লম্বা একটা ঘুম দিবে।
চোখ খুলল রাহিত। চোখ মেলে তাকাতেই চমকে গেল রাহিত। কোথায় এসেছে? সব কিছুই অচেনা তার। কিছুই মনে পড়ছে না। তারপর মনে পড়ল সে তো মর্গে। ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়েছিল। তারপর ঘুমিয়ে গেল। হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল রাহিত। দুইটা উনপঞ্চাশ মিনিট। আচ্ছা রাত না দুপুর? সে এই ঘরে এসেছে তিনটার দিকে। তার মানে এখন রাত? ভয় পেয়ে যায় রাহিত। বুঝতে পারে এই ঠান্ডায় তার শরীর অসাড় হয়ে গেছে প্রায়। এতটা সময় এই ঘরে থেকে এই অবস্থা। কিন্তু রনি তাকে না নিয়ে চলে গেল? নাকি রনি বুঝতেই পারেনি রাহিত এখানে আছে? রাহিতের ভীষণ ভয় করতে থাকে। কী করবে সে? কীভাবে বের হবে? এখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত। কল দিলেই তো ঝামেলা শেষ। ফোন বের করল রাহিত। ফোন বন্ধ। ফোনের পাওয়ার বাটন চাপ দিল। চালু হচ্ছে। সাথে সাথে রাহিতের বুকটাও যেন লাফাচ্ছে। অন হয়েছে। রাহিত কল দিতে যাবে সেই সময় বন্ধ হয়ে গেল। আর চালু হল না। রাহিত ভেঙ্গে পড়লো। মনে মনে গালি দিয়ে বলল সব সময় চার্জ থাকে আর জীবন মৃত্যুর খেলায় নেই। তাহলে কি কোন উপায় নেই? আচ্ছা মেডিকেলে নিশ্চয় ডাক্তার নার্স থাকবে। দরজাটা খুলে দেখা যাক। অসাড় শরীর নিয়ে কষ্ট করে উঠে রাহিত। এগোতে পারছে না। প্রচন্ড শক্তি দিলেও যেন একটা ফোঁটা এগোতে পারছে না। অবশেষে দরজার দোরগোড়ায় রাহিত। ধাক্কা দেয় একটা। দরজা খুলল না। আবার ধাক্কা দিল রাহিত। বুঝল দরজা বন্ধ। রাহিতের ভিতর ভয়টা যেন হুহু করে বেড়ে গেল। যদিও রাহিত ভেবে নিয়েছিল দরজা বন্ধ থাকবে। তবুও ভয়টা বাড়ে। কী করবে এখন রাহিত? এই ঠান্ডায় রাত পার করতে পারবে না রাহিত। সকাল হতে হতে মরে যাবে। আফসোস হয় রাহিতের। তখন কেন যে মর্গে আসতে ইচ্ছে করল? কেন লোকটার কথায় জেদ করে এই ঘরে এল। আচ্ছা রনি কি তার কথা ভুলে গেল? খোঁজ নিতে এল না একবারও? তাকে কি এই ঘরেই মরে যেতে হবে? আচ্ছা চিৎকার করলে কি কেউ শুনতে পাবে না? ডাক্তার নার্সরা তো পাবে। চিৎকার শুরু করল রাহিত। গলার সমস্ত শক্তি দিয়ে ডাকছে, “কেউ আছেন? আমি এই ঘরে বন্দী। কেউ আছেন? দয়া করে দরজাটা খুলেন!” তারপর গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগল দরজায়। কিন্তু লোহার দরজা এক চুল পরিমাণ নড়ল না। আচ্ছা এই শব্দ কি কেউ শুনতে পেল? নাকি পেল না? কেউ কি তাকে উদ্ধার করতে আসবে? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। কিন্তু কেউ এল না। বুঝল তার চিৎকার কারও কান পর্যন্ত পৌছায়নি। এভাবে কয়েকবার চেষ্টা করল রাহিত। কিন্তু বুঝতে পারল এই বৃথা চেষ্টা কারও কাছেই পৌছাবে না। কারণ এই ঘর থেকে শব্দ গেলেও বাহিরে ঘর পর্যন্ত যাবে তারপর আর যাবে না। তবে কি এই ঘরেই শেষ হয়ে যাবে রাহিত? চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে রাহিত। এই ঘর আসলেই যেন এক মৃত্যুপুরী। জীবিত মানুষকে মৃত্যু দিয়ে দেয়।
সব আশা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ল রাহিত। ঠান্ডাটা আরও বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে তার দাঁত পর্যন্ত কাঁপতে শুরু করল। পুরোনো দিনের সুখময় স্মৃতি মনে করছে। তার বেড়ে ওঠা। এত ভালো বন্ধুগুলোর সাথে আর দেখা হবে না। কত ভালো সময় না পার করেছে তারা। আর আজ সব শেষ।
হঠাৎ কটকট করে শব্দ হল। দরজা খোলার শব্দ। রাহিত খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। নিশ্চয় কেউ শুনতে পেয়ে দরজা খুলছে। নইলে রনি এসেছে। যে কেউ হতে পারে। অবশেষে তার মুক্তি। ঘুরে তাকাল রাহিত। কিন্তু দরজা তো বন্ধ। তাহলে? তারপর যা দেখল সেটা রাহিত কল্পনাও করতে পারেনি। তার হৃদপিণ্ড চিরে যেন রক্ত ছিটকে আসবে।
তার চোখের সামনে একটা বাক্স খুলছে। নিজে থেকেই। আস্তে আস্তে করে খুলে গেল। ভয়ে উঠে দাঁড়াল রাহিত। তার এখন একটুও শীত করছে না।
আচ্ছা এটা কত নম্বর বক্স? ৪৯? হ্যাঁ এটা তো ৪৯ নম্বর।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল রাহিত। তার কি কোন ভুল হচ্ছে? ঠান্ডায় মাথা কাজ করছে না? ভুল দেখছে? না সে তো ঠিক দাঁড়িয়ে আছে। বক্সটা অর্ধেক খুলে গেল।
ভিতরে থাকা লাশটা উঠছে। রাহিত ভয়ে পিছাতে শুরু করে। উঠে বসল লাশটা। আচ্ছা এটাকে কি এখন লাশ বলা যায়? লাশ তো মৃত। কিন্তু এটা তো জীবন্ত। মেয়েটা উঠে মাথাটা রাহিতের দিকে ঘোরালো। রাহিতের ভয়ে হাত পা কাঁপছে। মেয়েটার হাসিটা এক দফা বেড়ে গেল। কিন্তু এবার রাহিতের হাসি এল না। বরং ভয়টা এক ধাক্কায় বেড়ে গেল।
মেয়েটা হাসি মুখে বলল,
“আমার হাসিটা কেমন?”
রাহিত কথাটা শুনে চমকে উঠল। কী বলবে? মাথা যেন কাজ করছে না। আমতা আমতা করে বলল,
“হাস্য…কর… না মানে সুন্দরক।”
মেয়েটা চিৎকার করে হাসতে শুরু করল। পৈশাচিক একটা হাসি।
মেয়েটা বলল,”তুই এখানে কেন?”
রাহিত আবার ভয় পেল। কী বলবে? সে ভুল করে চলে এসেছে? নাকি অন্য কিছু বলবে? কাঁপা গলায় বলল,
” বাইরে প্রচন্ড গ..গরম ছিল। আমি ঠান্ডা হতে এসেছিলাম। তারপর ঘুমিয়ে যায়। বুঝতে না পেরে সবাই দরজা বন্ধ করে চলে যায়।”
মেয়েটার হাসি আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল। হাসতে হাসতে বলল,
“হা…হা…হা… ভুল ভুল ভুল তুই। আমি তোকে নিয়ে এসেছি এখানে।”
রাহিত বিস্ময়ের চোখে,
“আপনি নিয়ে এসেছেন মানে?”
“আমার মুখের হাসি দেখে যে হাসবে সেই বন্দী পড়ে যাবে এই ঘরে আমি পাব মুক্তি। তুই হেসে ফেলেছিলি আমার হাসি দেখে। হা…হা.. হা…তোকে বেঁধে ফেলি হাসির মায়ায়। সেই মায়ার টানে তুই এখানে।”
রাহিত মনে একটু সাহস আনল। তার ভয় পেলে চলবে না।
“আপনার হাসিতে মায়া আছে?”
মেয়েটা বোকার মত তাকাল।
“কেন মায়া নেই?”
আবার হেসে উঠেলো মেয়েটা। বলল,”মায়া আছে মায়া আছে। সব মায়া কী ধরা যায় না বোঝা যায়? কখন যে কার মায়ায় কে বাধা পড়ে যায়। কে বুঝতে পারে? আমার হাসিটা হাস্যকর আবার সুন্দর আবার ভয়ংকর! এই যে এখন তুই ভয় পাচ্ছিস ঠিক তেমনি।এই মায়ায় তুই এখানে এসেছিস!”
মেয়েটার দাঁতগুলো চকচকে সাদা। চুল দেখা যায় না। সাদা কাপড়ে ডাকা। পুরো শরীর সাদা কাপড়ে বাধা আছে। এই হালকা আলোয় তার মুখটা যেন জ্বলজ্বল করছে।
সুন্দর দেখতে হলেও এই মুখটা দখতে রাহিত ভয় পাচ্ছে। রাহিত গলা শক্ত করে বলল,
“কেন এনেছেন আমায়? এখানে? “
” হাহাহা.. শেষ করে দেবো তোকে। তুই মেয়েদের দিকে খারাপ নজরে তাকাস তাই না? মৃত একটা মেয়ের দিকেও সে ভাবেই তাকিয়েছিলি?”
“না না মোটেও খারাপ না আমি। আমি কখনওই খারাপ চোখে মেয়েদের দিকে তাকায় না। “
“সেটা তুই ওপরে ওপরে। কিন্তু আমি তোর মনের কথা জানি।”
“কী জানেন?”
“তুই শেষ এখানেই তোর মৃত্যু হবে!”
মৃত্যু শব্দটা শুনে রাহিত চমকে উঠল। মৃত্যু? তাকে এখানেই শেষ হয়ে যেতে হবে? বাঁচার কি কোনও রাস্তায় নেই? বুদ্ধি ভাবতে থাকে রাহিত।
“মৃত্যু? হ্যাঁ আমি মরব। হয়তো এখানেই। কিন্তু আপনাকে ভয় পেয়ে না। এই শীতে এমনিতেই মরে যাব।”
“না না এই শীতে তুই মরবি না। তোকে সুযোগ দিলাম পালা পালা এখান থেকে”
দরজাটা হুট করেই খুলে গেল। বাইরেই সদর।
মেয়েটা বলল,
“পারবি পালাতে? আমার সীমার বাইরে যেতে? এই মেডিকেলের বাইরে যেতে পারলেই তোর মুক্তি। তোর সময় পঞ্চাশ মিনিট। তোকে আমি ঠিক তিনটা উনপঞ্চাশে শেষ করে দেবো। তোর সময় শুরু। পারবি?”
কথা শেষে হাসতে থাকে মেয়েটা। পুরো ঘরে কম্পিত হয় তার শব্দ।
“পারব, পারব।”
মেয়েটা হাসতে থাকল।
রাহিত ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ঘর থেকে বের হয়েই যেন তার মুক্তির ছোয়া লাগল। এই মেডিকেল তার নখ দর্পণে।
দৌড়াতে থাকে। কিন্তু এই সময়ে কত মানুষ থাকে কিন্তু আজ মেডিকেলে কেউ নেই। কেন এমন? কোন নার্স পর্যন্ত নেই। রাহিত কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বড় দরজায় চলে এল। সামনে গেলে একটা বাঁক তারপর বাইরে। রাহিত দৌড়াতে থাকে।
এই দিনটার কথা তাকে ভুলে যেতে হবে। আর কখনও সে মর্গে যাবে না। এই বার শেষ বার ছিল। এই ভুল সে আর কখনও করবে না। পৃথিবীর অনেক কিছুই রহস্যজনক। কখন কী হয় কিছুই ভাবা কিংবা বলা যায় না। যেমনটা হল আজ। কল্পনাও করতে পারেনি রাহিত।
ভাবতে ভাবতে থমকে দাঁড়াল রাহিত। হঠাৎ কোথায় এল? এটা তো মেডিকেলের মাঝে। কিন্তু সে তো বাইরের রাস্তায় ছিল। রাস্তা ভুল করল? নাকি মেয়েটার ছলনা সব?
আবার দৌড়াতে শুরু করে রাহিত। কিন্তু বারবার ভুল কোন রাস্তায় চলে যায়। হঠাৎ সব আলো নিভে যায়। রাহিত ভয়ে লাফিয়ে ওঠে। বুকে হাত দিয়ে দেখে ধড়াস ধড়াস করছে। পুরো মেডিকেলটা আরও রহস্যময় হয়ে উঠে। আলো নিভে গেলেও চারপাশ দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো আসছে। কিন্তু একটা শব্দও নেয়। শুধু রাহিতের শব্দ ছাড়া। এই রকম মেডিকেল কখনও দেখেনি রাহিত। এই মেডিকেলে শব্দের জন্য সবাই বিরক্ত হত। আর শব্দ ছাড়া মেডিকেল এত ভয়ংকর হয়তো কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
দূরে একটা আলো দেখছে রাহিত। কিন্তু রাহিতের পা যেন আর চলছে না। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত রাহিত। কিন্তু মৃত্যু ভয়ে পা চালিয়ে যাচ্ছে রাহিত।
ওখানে কে আছে? কোন মানুষ? যে তাকে পথে দেখাতে পারবে?
এগিয়ে গেল রাহিত। দেখে ছোট একটা লাইট জ্বলছে। আর একজন মহিলা হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। রাহিতের বুকে তখনও এক ঝাঁক ভয়।
“এই যে শুনছেন?”
রাহিত মহিলাটার উদ্দেশ্যে বলে। মহিলাটা মাথা তুলে। অল্প আলোই যা বোঝা যাচ্ছে মুখটা কালো। বেশ বয়স্ক।
“হ্যাঁ? কি প্রয়োজন?”
“জ্বী আমি রাস্তা চিনতে পারছি না। বের হবার পথ যদি বলে দিতেন।”
মহিলাটা একটু হেসে উঠল।
“ওহ তাই বলুন আচ্ছা আমি একজনকে ডেকে দিচ্ছি সে আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছে। অন্ধকারে চিনতে পারবেন না।”
মহিলাটা ডাকল,”সুমিতা এই সুমিতা এই দিকে আয়।”
রাহিত দেখল কেউ একজন আসছে। রাহিত জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা কোন আলো নেই কেন?”
“শহরে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে কী পুড়ে গেছে। আর আমাদের জেনারেটার নষ্ট।”
“আচ্ছা কিন্তু কেউ নেই কেন? পুরো মেডিকেলে? কী সমস্যা?”
“এই মেডিকেলের একপাশ ঠিক করা হবে। তাই সবাই ছুটিতে।”
রাহিত বুঝতে পারল না ব্যাপার কী। সে তো আজ দুপুরেও সব ঠিক দেখেছে। তাহলে? কিন্তু রাহিত আর কথা বাড়াল না। তার হাতে বেশি সময় নেয়। তাকে এখান থেকে বের হতে হবে।
মেয়েটা চলে এসেছে। রাহিতকে বলল,
“আসুন আমার সাথে।”
রাহিত হাটতে থাকল। কিন্তু মেয়েটা বড্ড আস্তে হাঁটে। তার হাতে বেশি সময় নেয়। যদিও রাহিতের মনে ভয়টা অনেকটা কমে গেছে। রাহিত তবুও বলল,
“আপনি একটু জলদি যেতে পারবেন?”
“এত তাড়া কেন?”
রাহিত ইতস্তত করে বলল,”না এমনি?”
“ভয়ে আছেন?”
“না তেমন কিছু না।”
“কিন্তু আমি যে আপনার চোখে ভয় দেখতে পারছি। যে ভয় পেয়ে থাকে সে অন্যের ভয় বুঝতে পারে।”
“আপনার কিসের ভয়?”
“শুনবেন? ভয় না কষ্ট। শুনুন তাহলে। আমি ছোট থেকে অনেক সুন্দরী ছিলাম। সব ছেলেরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। যদিও কাউকে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু হঠাৎ একসময় একটা ছেলেকে ভালো লেগে যায়। প্রেমে পড়ে যাই আমি। দুইজনের মধ্যে ভালোবাসাও গভীরতা পায়। শুরু ভয় সম্পর্কের ভয়ানক গভীরতা।”
“তারপর?”
“তারপর যখন আমি বুঝতে পারি তাকে ছাড়া বেঁচে থাকা আমার জন্য অসম্ভব তখন সে দুরত্ব বাড়াতে থাকে। আমি ঝটপট করতে থাকি। একদিন রাতে সে বলে আমাকে বিয়ে করবে। আমি বাড়ি থেকে পালাই। তারপর সেই রাতে আমাকে সে আর তার কিছু বন্ধু বন্দী করে। ধর্ষণ করে আমাকে।”
তারপর রাহিত চোখ বড় বড় করে তাকায় তার দিকে। এত সুন্দর একটা মেয়েকে কেউ ভালো না বেসে এমন করতে পারে কীভাবে?
“তারপর?”
“তারপর ঠিক রাত দুইটা উনপঞ্চাশ মিনিটে…”
দুইটা উনপঞ্চাশ শুনেই ভিতরটা আটকে উঠে রাহিতের। কোথায় সে শুনেছে।
তারপর মেয়েটা বলে,”তারা আমাকে হত্যা করে।”
মেয়েটা ঘাড় ঘুরে তাকায় রাহিতের দিকে। রুপ বদলাতে শুরু করে। সেই লাশের মেয়েটার মত চোখ ; ফ্যাকাশে মুখ। ভয়ে পড়ে যায় রাহিত।
এটা সেই মেয়েটা। হাসতে থাকে মেয়েটা। ভয়ে পিছনে সরতে থাকে রাহিত।
“কি তুইও তো সেই ছেলে গুলোর মত তাই না? খারাপ বিষাক্ত।”
রাহিত চিন্তা করতে না পারলেও চিন্তা করতে থাকে।
মেয়েটা খারাপ ছেলেদের শেষ করতে চায়। সে যদি বুঝাতে পারে সবাই এক না হয়তো বেঁচে যাবে। রাহিত না না বলে চিৎকার করে।
“পালাতে পারলি না তাহলে? যা সময় এখনও আছে।”
রাহিত আবার দৌড়াতে শুরু করে। কিছুটা পথ গেলিই বাইরে। ওই তো বাইরের দরজা দেখা যাচ্ছে। আর কয়েক পা মাত্র কয়েক পা।
কান্নার শব্দ ভেসে এল রাহিতের কানে। পাশে তাকায়। একটা মেয়ে কাঁদছে। রাহিত থেমে যায়।
তাকিয়ে থাকে। এটা তো সেই নার্সটা যে তাকে পথ দেখাচ্ছিল। অপরূপ সুন্দরী। কিন্তু রাহিত তার কাছে যাবে না। পালাতে হবে। মেয়েটা তখনই বলে উঠে,
“আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ? অসহায় মেয়েটাকে?”
রাহিত থমকে দাঁড়ায়।
“না কিন্তু!”
“তুমি দেখবে না আমার কষ্ট? তারা কীভাবে শেষ করে দিল আমায়?”
“ইয়ে।”
“কখনও কোন নারীর খোলা বুক দেখেছ? কীভাবে চিরে ফেলেছে তারা? কীভাবে শেষ করে দিয়েছে? “
রাহিত চমকে উঠে। কী বলল এগুলো।
মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠেলো, “দেখবে না? আমাকে? আমি কি খুব খারাপ?”
মেয়েটা তার বুকের জামার বোতাম খুলছে। একটা দুইটা তিনটা। মাঝ বরাবর এসে চোখগুলো লাল করে তাকাল রাহিতের দিকে। বড় বড় চোখ।
আবার আগের রুপ। রাহিত প্রচন্ড ভয় পায়। কী ভুল করল সে?
“কী? নারীর শরীর দেখলে সব ভুলে যেতে হয়? নারীর শরীরের মুল্য দিলি ভালোবাসতে শিখলি না?”
রাহিত ভয়ে আবার দৌড়াতে যাবে। তখনি মেয়েটা তার বুকের ওপর জামা ধরে জোরে টান দেয়। তার বুক ছিড়ে আসে আগুনের হল্কা। রাহিতকে টানতে শুরু করে। রাহিত হারিয়ে যেতে থাকে।
মেয়েটা বলতে থাকে,
“তোর সময় শেষ। মায়ায় পড়ে হেরে গেলি তুই।
এখন পড়ে থাক ওই লাশের ঘরে
যে ঘরে লাশরা তার গল্প করে
ভিন্ন লাশের ভিন্ন মরণ
জীবনে তার কত বারণ
তারা জীবিত আজ মৃত্যুর কাছে
মৃত্যু ছাড়া কে বা বাঁচে?”
মেয়েটা আবার হাসতে থাকে। তার হাসিতে কম্পিত চারিদিক। রাহিত চিৎকার করতে থাকে শেষ চিৎকার। মেয়েটা আবার বলে,
“আজ থেকে নতুন পশু বন্দী হল। আমার আজ মুক্তি। দেখ কেমন আত্মাহীন শরীর লাগে। যে শরীর পুরুষরা খুঁজে নারীর ভিড়ে।”
মেয়েটা আবার চিৎকার করে হাসতে থাকে। আরও জোরে আরও জোরে। এই চিৎকার অনেকটা মনের ভিতরের চিৎকার।
ভোরের আলো ফুটছে। মর্গে দাঁড়িয়ে আছে রনি। তার চোখ আতঙ্ক আর ভয়।
অফিসার সায়েদ দাঁড়িয়ে তার সামনে। ভিন্ন প্রশ্ন করছে।
“তো রনি। আপনি বলছেন যে রাহিতকে নিয়ে কোন আত্মীয়ের লাশ খুঁজতে এসেছিলেন তাই না?”
রনি কাঁপা গলায়,”হ্যাঁ।”
“সবাই লাশ নিয়ে বের হয়ে গেল। রাহিতও নিশ্চয় গিয়েছিল?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে রাহিত আবার এখানে এল কীভাবে?”
“রাহিত আমাকে বলেছিল যে সে এখানে আসবে।”
“তাহলে যখন রাহিতের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না তখন কেন আপনি এখানে না এসে অন্য জায়গায় গেলেন?”
“রাহিত বলল তার গরম লাগছে সে মর্গে বসে থাকবে। আমি মজা ভাবলাম কারণ এখানে ইচ্ছে করলেই তো আর আসা যায় না? আমি ভাবলাম এই গরমে সে বাড়ি চলে গিয়েছে।”
“তারপর রাত এগারোটায় রাহিতের মা আপনাকে ফোন করে বললেন যে রাহিত বাড়ি আসেনি।”
“হ্যাঁ। আমি ভাবলাম হয়তো কোথাও গিয়েছে। ফোন বন্ধ। তারপর বন্ধুদের ফোন করলাম কেউ খোঁজ দিতে পারল না। তখন আপনাদের কাছে যাওয়া”
“যখন আপনি ধরেই নিয়েছিলেন রাহিত মর্গে আসবে না। তাহলে আবার কেন মনে হল ও মর্গে এসেছে।”
“আমি রাহিতের ছোট কাল থেকে বন্ধু। তাই ও কোথায় কোথায় যায় জানি। সব জায়গায় আমি খুঁজেছি কিন্তু পায়নি তখন মনে হল হয়তো এখানে এসেছে”
“তারপর এখানে ঢুকতে পারলেন না তখন আমাদের নিয়ে ঢুকে দেখলেন রাহিত এখানে মরে গেছে।”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু আমার যে মনে হচ্ছে আপনি রাহিতকে মেরে এই মর্গে জমিয়ে রাখলেন। তারপর বাকিটা আপনার নাটক।”
“কিন্তু আমি রাহিতকে কেন মারব। আমার বন্ধু রাহিত। সেই ছোটবেলা থেকে। সে কীভাবে মরলো আমি জানি না।”
রনি কাঁদতে শুরু করল।
অফিসার সায়েদ কঠিন গলায় বলল,
“হয়তো পুর্বের কোনও রাগ পুষে রেখেছিলেন। তারপর এই ভাবে প্রতিশোধ “
রনি কাঁদতে কাঁদতে না না বলে চিৎকার দিতে থাকে।
অফিসার সায়েদ রনিকে বসতে বলল। রনি কান্না নিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে।
রাহিতের মাকে ডাকল। কিন্তু তার মার সাথে কথা বলার অবস্থা নেয়। এবার ডাকল এই মর্গের যে দায়িত্বে আছে তাকে। বেটে মত সেই মানুষটা এল।
“বলুন স্যার।”
“আপনি এই মর্গের দায়িত্বে আছেন তাই না?”
“জ্বি স্যার।”
“এখানে রাহিত মানে এই মানুষটা এল কীভাবে?”
“স্যার এই লোকটা এই মর্গে বিনা অনুমতিতে ডুকতে এসেছিল। আমি তাকে নিষেধ করি। সে নাকি তার কোন আত্মীয়ের লাশ খুঁজতে এসেছিল। সে চলে যায়। তারপর আমিও করিমকে দায়িত্ব দিয়ে একটা কাজে যাই।”
“করিমকে ডাকেন।”
করিম এল। লোকটা কালো। ভীতু ধরনের। কাঁপছে।
“তো করিম। আপনি ভিতরে কেউ আছে না দেখেই মর্গ বন্ধ করে দিলেন? এখন মৃত্যুর দায় কার?”
করিম থথমত খেয়ে বলল,
“না স্যার। হঠাৎ বৃষ্টি এল। আমাদের জেনাররেটর নষ্ট ছিল। আর বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে কী যেন পুড়ে গেছে। সময় লাগবো ঠিক করতে। তাই রেফ্রিজারেটর চালানোর মত কিছু ছিলনা। যেন ভিতরের লাশ পচে না যায় তাই আমাকে বন্ধ করে দিতে বলে মর্গ। লাইট নাই। আমি জোরে জোরে ডাকলাম ভিতরে কেউ আছে কি না। কোন সাড়া নেই। ভাবলাম কেউ নেই। তখন বন্ধ করে দিই। আর খুলিনি স্যার। আমি জানি না স্যার কী হয়েছে।”
“আচ্ছা আপনি যান।”
দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে সায়েদ। পাশে ছিল ফরেনসিক ডিভিশনের কৌশালী।
কৌশালী বলল, “স্যার আমি প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝতে পেরেছি কী হয়েছে।”
“হ্যাঁ বলুন।”
“আমার মনে হয় রাহিতের ভ্যাসোভেগাল সিনকোপ ছিল। ভ্যাসোভেগাল সিনকোপ সমস্যাটি থাকার অর্থ হল, এক ফোঁটা রক্ত দেখলেও সে ব্যক্তির হৃদস্পন্দন অর্থাৎ হার্ট রেট মুহূর্তের মাঝে কমে যাবে। এ সময়ে পায়ের রক্তনালীগুলোতে রক্ত জমা হয় এবং মস্তিষ্ক থেকে রক্ত নিচের দিকে চলে যায়। রক্তচাপও কমে যায়। ফলে ওই মানুষটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। মাথা ঘুরত বা চিন্তা শক্তি এলোমেলো হত এই ধরনের। যখন রনির সাথে মর্গে আসে তখনও তার এই সমস্যা হয়। কিন্তু রাহিত বুঝতে পারিনি। সে এই মর্গের ঠান্ডাটা ভালো অনুভব করে। এই সমস্যাই গরম লাগে প্রচন্ড। ফলে ব্রেইন তাকে সংকেত এই ঘরে থাকার সংকেত দেয়। তারপর সে যখন বাইরে যায় তখন গরমের কারণে ব্রেইন তাকে আবার এই ঘরে আসতে বলে। আসে পাশে রক্ত থাকে ফলে ব্রেইনে তখনও সেই ভ্রম থেকে যায়। “
“তারপর? এখানে থেকে গেল?”
“ব্যাপারটা ঠিক তা না। এখানে চালাকির সঙ্গে ঢুকে পরে। তারপর এখানে আবার রক্ত দেখে ফলে ব্রেইনে আরও বেশি সমস্যা হয়। মাথা ঘুরতে ঘুরতে পড়ে যায় এই ট্রলিতে। ট্রলিতে তার শুয়ে থাকার কোণ থেকে এটা স্পষ্ট। ট্রলির সাথে মাথায় লাগে। কিন্তু আঘাতটা তেমন গুরুতর না। কিন্তু জ্ঞান হারায়। ফলে যখন করিম ডাকে ভিতরে রাহিত কোন সাড়া দিতে পারেনি। তারপর করিম দরজা লাগিয়ে দেয়। ঠান্ডা বাড়তে থাকে। ঠান্ডার জন্য মারা যায় রাহিত। এই ঠান্ডা কিছুক্ষণ সহ্য করা গেল বেশি সময় থাকলে মৃত্যুটা অনিবার্য। আর রাহিত প্রায় বারোটা ঘন্টা এখানে রয়েছে।”
“আমারও তাই মনে হচ্ছে কৌশলী। তবে সে একবার যদি উঠতে পারত ডাক দিতে পারত হয়তো বেঁচে যেত হয়তো।”
“হয়তো। আমার মনে আর একটা কথা ঘুরছে স্যার। যদিও এটা তদন্তের জন্য প্রয়োজন নেই তবুও মনে হচ্ছে। রাহিত শুয়ে থেকে কি স্বপ্ন দেখছিল? স্বপ্নে হয়তো মারা গেল রাহিত। বিজ্ঞান বলে স্বপ্নে কেউ কখনও মারা যায় না। তবে সে যতক্ষণ বেঁচে ছিল স্বপ্ন দেখেছে। তারপর হয়তো স্বপ্নে মারা গিয়েছে আর বাস্তবেও।”
“হতেই পারে কৌশলী। আমার আর একটা কথা মনে হচ্ছে। তার মৃত্যু এখানেই লেখা ছিল। নইলে কেন আজ এখানে আসবে? কেন আজ বিদ্যুৎ চলে যাবে? অন্যদিন হলে মর্গে অনেকবার আসা যাওয়া করত কেউ।”
“জ্বী স্যার।”
“তদন্তে কবিতা একজন অনভিজ্ঞ তদন্তকারীর কাজ হলেও আমার মাথায় একটা কবিতা আসছে কৌশলী। কার লেখা মনে নেয়। শোনো,
প্রতিটা সময় মৃত্যুর কাল
তাই কারও মৃত্যু হয় না অকাল
মৃত্যু আসার নেই কারণ
যখন তখন হবে মরণ”
“কবিতাটা তেমন একটা সুন্দর না।”
“সুন্দর না হলেও সত্য।”
“হ্যাঁ স্যার।”
আরেকজন এসে দাঁড়াল সায়েদের সামনে,
“স্যার আমাদের তদন্ত বন্ধ করতে বলা হয়েছে। রাহিতের বাবা একজন বড় কর্মকর্তা। তার নিষেধ। তাকে হিমঘরে রাখতে বলা হয়েছে। কালকের মধ্যে তার বাবা দেশে আসবেন।”
কৌশলী বিস্ময়ের চোখে বলল, “কিন্তু স্যার। তদন্ত না করলে তো আমরা আসল রহস্য বের করতে পারব না। কল্পনাটা সঠিক কিনা।”
“পৃথিবীতে অনেক রহস্য রয়েছে কৌশলী। সব রহস্য কখনওই আমরা জানব না। এই রহস্যটাও না হয় অজানাই থাক।”
সায়েদ বাকি কর্মীদের নির্দেশ দিল রাহিতকে একটা বক্সে রেখে সিল করে দিতে তার বাবা না আসা পর্যন্ত।
রাত তিনটা উনপঞ্চাশ….
সায়েদকে রাখা হয়েছে উনপঞ্চাশ নম্বর বক্সে। হঠাৎ কটকট করে বক্সটা খুলতে লাগল। সায়েদ উঠে বসল। মুখে সেই হাসি। পৈশাচিক সেই হাসি।
হা…. হা….হা….