1
ঘুম। হ্যাঁ ঘুম, ঘুম জিনিসটা সবারই খুব প্রিয়। এই আপনার, আমার, মানে আমাদের মতন মানুষের। বিশেষ করে যদি সেটা শীতের সকালের হয়, যখন চরম ঠাণ্ডার মধ্যে হালকা রোদের ওম এসে জড়িয়ে ধরে। তো অচিনও ঘুমোচ্ছিল তেমনি সুন্দর এক শীতের সকালে, ওর মাথার পাশের কাঁচের জানালাটা দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ এসে যেন আব্রু দিয়ে যাচ্ছে অচিনের মুখে, পরম শান্তিতে রোদ জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে অচিন। স্বপ্ন দেখছিল ও, গভীর জঙ্গল, একঝাঁক সাদাকালো টিয়াপাখি উড়ে বেড়াচ্ছে, নীল নীল সব গাছপালা, দূরে হলুদ পাহাড়ের গায়ে রামধনু রঙা মেঘ, আর ওর থেকে দূরে দাঁড়িয়ে নিশা। নিশার কাঁধ থেকে কালো চুলের ঢেউ পাহাড় বেয়ে নামছে, ওর পিঠ থেকে দুটো ডানা বেরিয়ে এল, ও উড়ছে, ও নিশার কাছে যাচ্ছে, এই ছুঁয়ে ফেলল বোধহয়। কিন্তু নাহ্, ঘুম ভেঙ্গে গেল সঞ্জয়ের ধাক্কায়, স্বপ্নটাও ভেঙ্গে চুরমার, হঠাৎ সঞ্জয়ের ধাক্কায় তাই খানিকটা বিরক্ত বোধ হয় তার, শরীরটা সাড়া দিতে ক্লান্ত বোধ করে, তাও অনিচ্ছুক হয়েও অস্বস্তি মাখা মুখে চোখ খোলে অচিন। প্রথমে আলোতে কিছু ভাল করে ঠাহর করতে পারে না, পরে আলোতে চোখটা সয়ে এলে দেখে সঞ্জয় ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসু চোখে দেখছে ওকে। “কী রে? ঘুম হল?”
“হল আর কোথায়? তুই ঘুমোতে দিলি কোথায়?” বলতে বলতে উঠে বসে অচিন। কিন্তু একটা খটকা লাগে ওর! কী হল? সঞ্জয় ওর ঘরে এল কী করে? ও তো কাল দরজা ভালো করে বন্ধ করেই ঘুমোতে গিয়েছিল! ভালো করে চারিদিকে দেখে নিয়ে ওর বুঝতে বাকি থাকে না! ওর হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে মাথা নেড়ে সঞ্জয় বুঝিয়ে দেয় যে ওর সন্দেহ ঠিকই! আবার? ভয়ে আঁতকে ওঠে অচিন। এই অবস্থাটা খুব ভালো করে জানে ও। সব থেকে বেশি ভয়ও খায় ঠিক এই পরিস্থিতিটাকেই।
সঞ্জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞাসা করে,” আজকে ……কত তারিখ রে সঞ্জয়?”
সঞ্জয় ওর আগেকার প্রতিক্রিয়াগুলো ভেবে বুঝতে পারে না সত্যি কথা বলবে কী বলবে না। বন্ধুর চোখের জিজ্ঞাসা এড়াতে পারে না বেচারা, বলে,”আজ তো… ১১ই মার্চ। জানিস তো তুই!” একটু হেসে অস্বস্তি কাটানোর চেষ্টা করে সঞ্জয়। অচিনের দুর্বল অথচ কঠিন স্বর শোনা যায়,” সে তো হল! তুই খুব ভালো করেই জানিস সঞ্জয়, সাল জিজ্ঞাসা করেছি আমি। কোন সাল এটা?” সঞ্জয় আর কোনো চেষ্টা করে না এড়িয়ে যাওয়ার, শঙ্কিত গলায় বলে,”২০২১!”
সংখ্যা গুলো যেন কালা জাদু জানে, হতবাক, বিস্মিত করে দেয় অচিনকে। কী প্রতিক্রিয়া দেবে ভেবে পায় না, কেমন যেন সব গুলিয়ে ওঠে, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, কম্পিত, বিস্মিত গলায় উচ্চারিত হয়, “২০২১! এটা ২০২১!তার মানে …… তার মানে .. একটা গোটা বছর হারিয়ে গেছে আমার সঞ্জয়, গোটা একটা বছর।” দুর্বল শরীরটা বেশিক্ষণ চাপ সহ্য করতে পারে না, মাথার ভেতরটা গুলিয়ে ওঠে, হারিয়ে যেতে থাকে চেতন, অচেতন, বিশ্বাস, অবিশ্বাস আর নিজের শরীরের ওপর অধিকার। বিছানায় লুটিয়ে পড়তে পড়তে আবছা চোখে দেখে ডাক্তারবাবু দৌড়ে আসছেন ঘরের দরজা দিয়ে সঞ্জয়ের ডাক শুনে আর বন্ধ হয়ে আসা কানে শেষ ক’টা কথা প্রবেশ করে,” আপনাকে বলেছিলাম না… কথা না ….” আর শুনতে পায় না অচিন, হারিয়ে যায় কালো সমুদ্রের অতল নেশায়।
2
অচিন বিশ্বাস, কবি, লেখক, সাহিত্যিক অচিন বিশ্বাস, এই নামেই তাকে চেনে সকলে। আরও একটু কাছের লোক যাঁরা, মানে শুধু পরিচিতের থেকে একটু বেশি, তাঁরা চেনেন খামখেয়ালি, অন্যমনস্ক, লম্বা ছিপছিপে চেহারার একটা ছেলেকে, যে বাস্তবের থেকে কল্পনার জগতেই বেশি ঘুরে বেড়ায়, যে এই টেকনোলজির যুগেও বইকে বেশি প্রাধান্য দেয়, যার কাছে মার্ক জুকারবার্গের থেকে রবীন্দ্রনাথ, সুনীলের দাম অনেক বেশি। যে ভাবুক, যে স্বপ্নিল, যে ওই হিন্দিতে যাকে বলে স্বপ্নের সওদাগর, ঠিক তাই। এইবার আসা যাক সেইসব ব্যাক্তির কাছে যাঁরা অচিনের কাছের লোক, তাঁদের মতে অচিনের একটা নিজের জগত আছে যাতে বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। এই জগতে একলা ঘুরে বেড়াতেই বেশি পছন্দ করে অচিন, লেখার জন্য এই জগতে একটা গল্প বোনে, সেটাকে রক্ত মাংসের মত সত্যি রূপ দেয়, তারপর সেটা পাতায় ফুটিয়ে তোলে শব্দ দিয়ে। এঁদের মধ্যে কেউ এই দুনিয়াটাকে রক্ষা করেন, কারন তাঁরা জানেন এই দুনিয়াটা ভালো থাকলে অচিনও ভালো থাকবে, আর বাকিরা চেষ্টা করেন এই দুনিয়াটা থেকে অচিনকে বের করে আনতে, কারণ তাঁরা জানেন অচিনকে বাস্তবের মাটিতে না দাঁড় করাতে পারলে ভবিষ্যতে অচিন অনেক দুঃখ পাবে, যেটা এখন তাঁরা আছেন বলে তাও এড়ানো যাচ্ছে, তাঁদের মতে আরও একটা কারণ হচ্ছে অচিনের বর্তমান যে অবস্থা তার জন্য এই কল্পনাপ্রবণ মনটাই দায়ী। তবে এই শেষোক্ত দুটো দলেরই একটা কারণে মিল আছে, মানে একটা কারণ কমন আছে যে, এঁরা সকলেই অচিনকে খুব ভালোবাসেন, বা বলা ভাল নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসেন।
আগেরবার যখন অচিনের শরীর খারাপ হয়েছিল, পাক্কা তিন তিনটে মাস লেগেছিল ওর পুরোপুরি সুস্থ হতে। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন খুব সাবধানে চোখে চোখে রাখতে, ওই বিশেষ ঘোরার জায়গাটা এড়িয়ে যেতে। যেখানে ও প্রায়ই যেত, বারবার যেত, নিজের অজান্তেই। সে প্রায় চার কী পাঁচ বছর আগেকার কথা, অচিন তখন এদিক, ওদিক ঘুরে বেড়াত একা একাই, শতবার বললেও কারোর কথা কানেই তুলত না। নিশাকে পর্যন্ত সঙ্গে নিত না; সেইরকমই একবার কোথায় যেন গিয়েছিল, কোনো যোগাযোগ ছিল না বাড়ির সাথে, বাড়ির লোক খুব বেশি চিন্তা করেনি কারণ ও এইরকম করে থাকে চিরকাল, ফোনে অবধি যোগাযোগ করা যায় না ওর সাথে। কিন্তু, তিন চারটে সপ্তাহ এরকম কেটে যাওয়ায় খোঁজ খোঁজ রব ওঠে, প্রখ্যাত সাহিত্যিক, তাই পুলিশ ও বেশ তৎপরতার সাথে কাজ করতে থাকে। তারপর মাঝখানে ওর খোঁজ আর পাওয়া যায়নি, শেষে বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রামে ওকে এক সরকারি হাসপাতালে খুঁজে পাওয়া যায়, খুব দুর্বল, জ্বর গায়ে, আর স্মৃতি বলতে আরো বছর তিনেক আগের কথা, যখন আগের বার ও এদিকে এসেছিল, রিসেন্ট কোনোকিছু একেবারেই মনে নেই। সঞ্জয় আর নিশা বহু চেষ্টা আর বহু পরিশ্রমে সুস্থ করে তুলেছিল ওকে।
ওর এই অবস্থা আবার ফিরে এসেছে, এবারে তাও একটু অন্য রকম, একটু যেন সয়ে নিয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে ওকে বীরভূম যেতে দেওয়াই হয়নি, তো গত এক সপ্তাহ ও কোথায় ছিল কী করেছে, ওই জায়গাটাই কী, কেনই বা ও ওখানে বারবার যায় ,কিচ্ছু জানা যায় নি। এসব কথা সঞ্জয় প্রেসকে জানিয়েছে, হাই প্রোফাইল কেস, প্রেসও ছিনে জোঁকের মতন লেগে আছে। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে যেটুকু সঞ্জয় জানতে পেরেছে তা হল এই যে, কালকে সন্ধ্যাবেলা যখন খুব জোরে বৃষ্টিটা নামল তখন একটা জিপ এসে দাঁড়াল হসপিটালের সামনে, তার থেকে টলতে টলতে নামল অচিন, ডাক্তারবাবু দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন এক পেশেন্টের সঙ্গে, কিছু বুঝতে পারার আগেই অচিন তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে ওঁর সামনে, আর পড়েই জ্ঞান হারায়। কেসটা একটু অদ্ভুত বলেই ডাক্তারবাবুর পরিচিতি ছিল অচিনের সাথে, তার ওপর তিনি মানে অচিন পাবলিক ফিগার। তো ডাক্তারবাবু কালবিলম্ব না করে তৎক্ষনাৎ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, পরে মনে পড়লে বাইরে এসে দেখেন যে জিপে করে অচিন এসেছিল সেইটা আর নেই। ভালো দেখতে না পেলেও ডাক্তারবাবুর মনে হয়েছিল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের জিপের মতন দেখতে জিপটা। এইসব কথা সঞ্জয়, আর মিডিয়ার কাছে জানায়নি, পুলিশকে জানাবে ভেবেছে, তবে পরে যদি প্রয়োজন হয়। বোনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে এখন সঞ্জয়কে।
আজকে আবার এই সময়ে বৃষ্টি নামল, জানলার বাইরে অন্ধকার রাত আর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, চিন্তায় মগ্ন সঞ্জয় কর, অচিনের একমাত্র বন্ধু। কী হয়েছে অচিনের? ওর কী কোনো বড় ধরনের রোগ হয়েছে, কী করে ভুলে যাচ্ছে সব কিছু? না কি এটা অতিরিক্ত স্বপ্নের দুনিয়ায় ভাসার ফল? বাস্তবটা কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে ওর! কী করে ঠিক হবে যদি জানা যেত!
3
আকাশটা সকাল থেকেই ঘোলাটে, কেমন পাগলা গারদের পাগল গুলোর চোখের মতন, কাল রাত অবধি কেঁদেও বোধহয় তার মনের ভার নামেনি, আজ সকালেও তাই অজস্র মনখারাপ দানা বাঁধছে। সঞ্জয়ের কাঁধে ভর রেখে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল অচিন। হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে দিলেও শরীরটা এখনও পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে। তাই হাঁটাচলা করতেও একটু সাহায্য দরকার হয়ে পড়ে। অচিন রাতে রোজ দুঃস্বপ্ন দেখে, একটা হুড খোলা জিপ, হাল্কা ঝোপঝাড়, মাথার ওপর ছাতার মতন শালপাতার সারি, দূরে জংলি জানোয়ারদের আওয়াজ ভেসে আসছে, আর…..খুব কষ্ট করে মনে পড়ে একটা ছোটো পাতায় ঘেরা গুহামুখ। তার ভেতর ঢুকতে গেলেই তীব্র চোখ ধাঁধানো আলো, উফ্ অসহ্য অসহ্য সে আলো…..। ঘুমের মধ্যে ছটফট করে ওঠে, নিশা পাশ থেকে সব বুঝতে পারে, কিন্তু কোনোদিন কিছু জিজ্ঞাসা করে না। অচিনের ঘুম ভেঙ্গে গেলে ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রাইব করা ওষুধটা বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে। নিশার এই আবেগ ছাড়া ব্যবহার অচিনের চোখ এড়িয়ে যায় না। কিন্তু, ও নিশাকে দোষারোপ করে না, কারই বা ভালো লাগে, নিশা তো এই ঝামেলা গত কয়েক বছর ধরে পোয়াচ্ছে। তাই ও কেমন পাথরের মতন হয়ে গেছে, মেনে নিয়েছে এটাই ওর ভবিতব্য। অচিনও রোজ প্রায় একই স্বপ্ন দেখে, রোজ এক ভাবেই ঘুম ভেঙ্গে যায়, তাও স্বপ্নের কথাটা কাউকে বলে না, না সঞ্জয়কে না নিশাকে।
অচিনকে বাড়িতে নার্সের কাছে রেখে ডাক্তার বর্মণের সঙ্গে কথা বলতে যায় নিশা আর সঞ্জয়।
“ডাক্তারবাবু, আগেরবার তো এমন হয়নি, উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখেনি ও, সুস্থ হতেও এত সময় লাগেনি তাহলে এবার কেন হচ্ছে এরকম?”
বর্মণ বলেন, “দেখুন নিশাদেবী আমি আপনাদের আগেই বলেছিলাম, আগেরবার ডোজটা একটু বেশি ছিল, তিন তিনটে বছরের কথা ভুলে গিয়েছিল অচিন….”
বর্মণকে থামিয়ে কথা বলে ওঠে সঞ্জয়, “ওসব ছাড়ুন আপনি, বলুন আর কী করা যায়? কী করে ঠিক করা যায় ওকে?”
ডাক্তার বর্মণ একটু নিচু গলায় বলেন, “ওকে পুরোনো কথা জিজ্ঞাসা করুন, জোর করে মনে করানোর চেষ্টা করুন, যদি দেখেন যে পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাচ্ছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে থেমে যাবেন। আর একটা কথা…..এবার খরচা একটু বেশি হয়েছে, পরের ডোজটার জন্য…..”
নিশা নিজের ব্যাগ থেকে কতকগুলো কড়কড়ে নোট বর্মণের হাতে গুঁজে দিলে হাসি মুখে উঠে চলে যান উনি। কঠিন শীতল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে সঞ্জয়, নিশাকে বলে, “যত না আমদানি তার থেকে বেশি তো এঁর জন্য গুনতে হবে দেখছি।”
নিশা নিজের চেয়ার থেকে এগিয়ে এসে শক্ত করে সঞ্জয়ের হাতটা ধরে বলে, “চিন্তা করিস না দাদা আর তো মাত্র একবার ব্যাস্! সারাটা জীবনের জন্য নিশ্চিন্ত। দশ বছরের পরিশ্রমের ফল আমাদের হাতের মুঠোয়!”
অচিনের দিনগুলো একদম ভালো কাটছে না, একটা লাঠি দিয়ে গেছে সঞ্জয় ওকে, ওটাতে ভর দিয়ে কিছুক্ষণ একা একা ঘুরে বেড়ায় অচিন, আর ভাবতে থাকে সারাক্ষণ, কী যে ভাবে বলা মুশকিল, আগের কথাও হতে পারে আবার ভুলে যাওয়া পিছনের কথাও। নিশা আর সঞ্জয় ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলতে গেছে, নার্সও বেরিয়েছে বাইরে, মাঝে মাঝে খুব কষ্ট করে মনে করার চেষ্টা করে ওর হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো। মনে পড়ে না, মনে পড়ে না। আরো অনেক পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায় ওর। কীভাবে সেইবার নিজের বই লঞ্চের দিন সঞ্জয়ের সাথে আলাপ হয় বছর বারো আগে, তারপর বাড়িতে যাতায়াত আর নিশার সাথে পরিচিতি গড়ে ওঠা, কয়েক বছরের মধ্যেই ওর আর নিশার বিয়ে। সঞ্জয় আর নিশা যেন ওর জীবনে আশীর্বাদের মতন এসেছে, এই কঠিন সময়ে ওরা না থাকলে কী যে হত ভেবেই ভয় করে অচিনের। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে যায়, বসে পড়ে দোতলার ওর প্রিয় আরামকেদারায়, এইটাতে বসেই যত ভাবনা চিন্তা করত ও, ঘুম আবার জড়িয়ে আসে অবসন্ন মনটায়, অচিন শ্রান্ত, ক্লান্ত শরীরটা সঁপে দেয় আরামকেদারায় গদিতে।
4
অচিন বিশ্বাস বিখ্যাত সাহিত্যিক, প্রচুর বই বিক্রি ওর, তাছাড়াও পৈতৃক সম্পত্তিও নেহাত কম কিছু নয়। আজকের দুনিয়ায় আপনি বা আমি সাদা চোখে যা দেখে থাকি তা অনেকটাই ওপরের কভার ছাড়া আর কিছুই নয়। সঞ্জয়, শিক্ষিত, বেকার, ওর বোন নিশাও তাই, ওরা দুই ভাই বোনে কষ্ট করেছে প্রচুর, তাই যখন অচিনের সাথে বোনের বিয়ে দেওয়ার কথাটা প্রথম আসে সঞ্জয়ের মাথায় তখন নিশা কোনো আপত্তি জানায়নি। পরে কয়েক মাস ধরে ধীরে ধীরে অচিনের পুরো সম্পত্তির ওপরে নজর পড়ে সঞ্জয় আর নিশার, বাকি জীবনটা উপভোগ করা যাবে বেশ ভালোই। স্বপ্ন মোটামুটি সত্যি হয়েই এসেছে।
অচিনের লেখা বইগুলোর রয়্যালটির মোটা টাকা আর ওর অগাধ সম্পত্তির বেতাজ বাদশাহ এখন সঞ্জয় আর নিশা, হ্যাঁ মানে অচিন এখনও ঠিক আছে, কিন্তু আর একটা ডোজ, ব্যাস আর কিছু মনে থাকবে না ওর, আর সহ্য করতে পারবে না ওর দুর্বল মন, প্রথমে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি, তারপর পুরোটা, সবটা! আনন্দে নেচে ওঠে মনটা সঞ্জয়ের, হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নিশাকে ফোন করে, ও প্রান্তে নিশার গলার স্বর ভেসে আসে, “হুম্, বল”।
“কী করছে অচিন? ঘুমোচ্ছে নাকি? ওষুধটা দিয়েছিস?”
“হ্যাঁ রে, দিয়েছি। একটা কথা বলবি? আমরা পারব তো রে? আর কষ্ট করতে হবে না বল!”
সেই বীরভূমের হসপিটালে খুঁজে পাওয়া, ডাক্তার বর্মণের বলা বনদপ্তরের জিপ আগাগোড়াটাই ঠিক ছকে নিয়েছিল সঞ্জয়, কোনো ভুল হয়নি। শুধু ইনজেকশন আর ডাক্তারের খরচটা একটু বেশি হয়ে গেল, তা যাক এগুলো তো ইনভেস্টমেন্ট। বোনকে আশ্বাস দিয়ে ফোনটা রেখে দেয় সঞ্জয়, ব্যালকনিতে আসে নিজের, এ বাড়িটাও অচিনের কেনা, ও থাকে এখন। নাহ্ ছেলেটা খারাপ নয়, শুধু শুধু মাঝখানে পড়ে একটু কষ্ট পেল বেচারা। বাইরে হাল্কা মেঘে বিদ্যুতের চমক যেন সঞ্জয়ের হয়ে হেসে দিচ্ছে আর গুড়গুড় শব্দে বলছে “শাবাশ!” কত কিছুর বলিদান দিতে হয়েছে সঞ্জয়কে, তাও লক্ষ্য থেকে একচুলও সরেনি। সমানে দৌড়েছে নিজের লক্ষ্যের দিকে, মনুষ্যত্ব, বিবেক কোনো কিছুই সঙ্গে নিয়ে আসেনি আর। নিশা প্রথমে একটু আপত্তি করেছিল এই ঠাণ্ডা মাথার খুনে, কিন্তু টাকা বড় বালাই। নিজের মনে হেসে ওঠে সঞ্জয়।
আজকে যখন ও দেখা করতে গিয়েছিল অচিনের সাথে, অচিন অনেকটা সুস্থ, কিন্তু অদ্ভূত একটা ঘোরের মধ্যে ছিল, কত রকম ভাবে কৃতজ্ঞতা জানালো ওকে আর নিশাকে ওর জীবনে আসার জন্য। একসাথে সেলিব্রেট করল ওরা সবাই। হায় রে ছেলে! সত্যি মাঝে মাঝে বড় খারাপ লাগে অচিনের জন্য। ভাবতে ভাবতে আধো ঘুম জড়িয়ে আসে চোখে, মাথাটা হেলিয়ে পরম প্রশান্তিতে চোখ বোজে সঞ্জয়।
নিশা অচিনের মাথার পাশের সোফায় আধশোয়া, অনেক রিল্যাক্সড লাগছে, অচিন গায়ে পাতলা চাপাটা দিয়ে ওর দিকে পিছন ফিরে শুয়ে, নিশা হাসে আগামীর স্বপ্নে বুঁদ হয়ে, যেন নেশা লেগে গেছে ওর, জীবনটা অনেক সুন্দর হবে এইবার, অচিনের সাথে বিয়ে হলেও মন থেকে কখনো কোনো টান অনুভব করেনি নিশা ওর প্রতি, অচিন নিজের লেখা পড়া নিয়েই থেকেছে চিরকাল, নিশা আটকায়নি কখনো কিন্তু বারবার করে নিশাকে কোনো কাজ করার জন্য পারমিশন নিতে হয়েছে অচিনের, এই অলিখিত পরাধীনতা মেনে নেওয়া যে কী কষ্টকর তা শুধু নিশাই জানে, ও তাই দাদাকে বলে দিয়েছে যে যদি কখনো সম্পত্তির ভাগ হয় ওকে বেশি দিতে হবে, যেহেতু কষ্টটা ওর বেশি। কেমন একটা ঘোরে পড়ে যেন, ঝাপসা হয়ে আসে চোখদুটো, কিছুক্ষণ এইরকম থাকে তারপরেই জ্ঞান হারায় নিশা।
5
নিশার ঘুম ভাঙে, আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায় ও, দেখে ওর মাথার কাছে বসে আছে অচিন, সকালের হালকা রোদ এসে পড়েছে ওর ডান গালের ওপর, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও নিশার দিকে, কিন্তু কই অসুস্থ লাগছে না তো ওকে! বরং নিশারই যেন মাথাটা কেমন ধরে আছে। অচিনের দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকায় নিশা। ও তো শোফায় বসে ছিল, কিন্তু খাটে এল কখন? আর এটা তো ওদের শোবার ঘর না কোথায় এটা? চমকে ওঠে নিশা। অচিনের দিকে মুখ ফেরাতেই অচিন বলে ওঠে, “কেমন লাগছে এখন?” নিশা যেন যন্ত্রচালিতের মতন উত্তর দেয়, “ভালো…মাথাটা একটু ধরে আছে এখনো, আর, আর শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে।”
অচিন বলে, “স্বাভাবিক যা ধকল গেল তোমার ওপর দিয়ে।”
কী ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে নিশা বুঝে উঠতে পারে না। জিজ্ঞাসা করতে যায় অচিনকে সব না জানা উত্তরগুলো, “কোথায় আমি? কী ধকল গেছে আমার ওপর দিয়ে? তুমি কবে ঠিক হয়ে গেলে? কী হয়েছে! কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”
অচিন বাধা দেয়, উত্তর না দিয়ে ওকে ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে চুপ করতে বলে ইশারায়। বলে, “বললাম না অনেক ধকল গেছে তোমার ওপর দিয়ে। ডাক্তারবাবু মানে আমাদের ডাক্তার বর্মণ বেশি কথা বলতে মানা করেছেন তোমাকে, আর উত্তেজনা তো তোমার সংজ্ঞা হারিয়ে দিতে পারে তাই চুপটি করে ঘুমোও এখন, আমি পরে আসছি আবার।” অচিন চলে যায়।
নিশা ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, নাহ্ চলায় কোনো আড়ষ্টতা নেই, হাতে লাঠিটাও নেই! এক রাতের মধ্যে হঠাৎ করে কী এমন হল ভেবে পায় না নিশা। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ ভাবতে হয় না ওকে, সত্যিই ওর শরীর খুব দুর্বল, খুব বেশিক্ষণ মানসিক চাপ সহ্য করার অবস্থায় ও নেই, নিশা ক্লান্ত ভাবে ঢলে পড়ে বিছানার কোলে।
আমি আগেই বলেছি, ঘুম জিনিসটা সব্বার প্রিয় সে আমারই হোক বা আপনার, ঘুমোতে মানুষ খুব ভালোবাসে, কোনো চাপ নেই, হাজার রকমের চিন্তা নেই, শারীরিক আর মানসিক বিশ্রাম। শরীরের রিস্টার্ট পুরো। সঞ্জয় অবুঝ শিশুর মতন মুখ করে, শান্তিতে, নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল, অচিন এসে ঘরের আলোটা জ্বালতেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল, আলোর ছড়ায় ঘরের নিষ্পাপ ভাবটা পুরো কেটে গেছে, শেষ হয়ে গেছে। সঞ্জয়ের চোখটা জ্বালা করে ওঠে তীব্র আলোয়, প্রথমে কিছু দেখতে না পেলেও ধীরে ধীরে চোখ সয়ে আসে, সঞ্জয় দেখে অচিন ওর মুখের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। ও চমকে ওঠে, ঘুমের রেশ পুরো কেটে যায়, কিন্তু উঠতে গেলে বাধা দেয় অচিন, জোর করে শুইয়ে দেয় ওকে, বলে, “সঞ্জয় তোকে বারবার মানা করেছি না? এরকম হলে উঠবি না বিছানা ছেড়ে জলদি। ডাক্তারবাবুর সাথে কথা হয়েছে আমার উনি জানিয়েছেন তোর পুরোপুরি সুস্থ হতে এখনো কয়েকটা সপ্তাহ লাগবে। তাড়াহুড়ো করিস না ওতে হিতে বিপরীত হতে পারে, আমি আছি তো চিন্তা নেই।”
সঞ্জয়ের নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না, যে লোকটা অসুস্থ ছিল সে তাকে জোর করে শুইয়ে দিল, তার জায়গায় সে নিজেই এখন ডাক্তারের চিকিৎসায়! ভালো করে চারিদিকে তাকায় সঞ্জয়, একি! এটা তো হসপিটাল! ও হসপিটালে শুয়ে আছে! উঠতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না, মাথাটা খুব ধরে আছে, অচিন আবার হাতে ধরে ওকে শুইয়ে দেয়। নিষ্ফল আক্রোশে বিষধর সাপ যেমন ছোবল মারে, সঞ্জয়ের একটা হাত তেমনি জোরে নেমে আসে ওর বেডের ওপর। অচিন লক্ষ্য করে, বলে, “ভাই বিশ্বাস কর, তোর অবস্থা আমি বুঝতে পারছি রে, কিন্তু কী করবি শরীর খারাপ যখন…”।
উত্তেজনায় মাথার দপদপানিটা বেড়ে ওঠে সঞ্জয়ের। ও চোখ বোজে। জ্ঞান থাকতে থাকতে ও দেখে হসপিটালের হলে পাশাপাশি দুটো ঘর, দুটোর মাঝে দরজা আছে। একটা ঘরে ও নিজে শুয়ে আর একটাতে নিশা, অচেতনের গভীরে হারিয়ে যেতে যেতে শোনে দূর থেকে ভেসে আসে অচিনের আর ডাক্তার বর্মণের মিলিয়ে আসা গলার স্বর, ওরা কথা বলছে। অচিন জিজ্ঞাসা করছে, “ওরা ঠিক হবে বলুন ডাক্তারবাবু?” আর বর্মণ উত্তর দিচ্ছে,” নিশ্চয়ই হবে, আপনি ভরসা রাখুন, শুধু এবারে….” মিলিয়ে যায় ওদের কথা, ওরা চলে গেছে আর কথা শোনা যায় না ওদের। ভিতরে রাখা ডিজিটাল ঘড়িতে চোখ পড়ে দেখে ওটা নিঃশব্দে সময় জানাচ্ছে রাত এগারোটা, আর তার নীচে লেখা তারিখ ৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১!!
কয়েক সপ্তাহ পরের কথা, এখন সঞ্জয় আর নিশা শারীরিকভাবে অনেকটা সুস্থ, কিন্তু কী একটা মানসিক আঘাত যেন লেগেছে ওদের দুজনকেই, একটা ঘরেই এখন শিফ্ট করে দেওয়া হয়েছে ওদের। অচিন প্রায়ই আসে খোঁজ নিয়ে যায় ওদের। আজকে আসেনি ওর কী একটা নাকি কাজ আছে। নিশা বিশেষ কথা কিছুই বলে না এখন, শুধু সারাদিন কেমন গুম হয়ে বসে থাকে চুপচাপ। সঞ্জয় তাও চেষ্টা করে মাঝে মধ্যে নার্স বা জুনিয়র ডাক্তারের সাথে কথা বলার, এই কয়েক সপ্তাহ ধরে শুধু বলে, “একবার ডাক্তার বর্মণকে ডেকে দিন না, দরকার আছে ওঁর সাথে।”
ওরা উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে যে,” এখানে ডাক্তার বর্মণ বলে কেউ নেই, কতবার বলেছি আপনাকে।” এখন আর তাই ওরা উত্তর ও দেয় না। নিশা একদিন শুধু ,” মিথ্যে কথা সব মিথ্যে কথা” বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল ব্যাস ওইটুকুই আর কিছু বলেনি কোনোদিন। ডাক্তারবাবুর পরামর্শে ঘরে টিভি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাই প্রোফাইল কেস, নার্সরা আলোচনা করছিল, প্রখ্যাত সাহিত্যিক অচিন বিশ্বাসের স্ত্রী ও শ্যালক একসাথে অসুস্থ, ওঁদের কথার সাথে গত এক বছরের বাস্তব ঘটনার কোনো মিল নেই, মিডিয়াও বেশ ভালোই কভার করছে কেসটা, অথচ ওঁরা কিন্তু পাগল হয়ে যাননি, শুধু গত এক বছরের তথ্য ভুল বলছেন। অনেক বোর্ড বসে আলোচনা হয় কিন্তু সদুত্তর মেলে না।
সঞ্জয় টিভিটা অন করে দেয়, নিশাও তাকায় টিভির দিকে, বই মেলায় একটা বই এর লঞ্চ অনুষ্ঠান হচ্ছে, অচিনের বই, ওর লেখা প্রথম থ্রিলার। ইন্টারভিউ চলছে এখন, বই এর ব্যাপারে সাংবাদিকদের প্রশ্নে অচিন উত্তর দেয়, “একজন খুব বড় ব্যবসায়ীকে এক ভাইবোনের জুটি ফাঁসাতে চায় নিজেদের জালে, তাকে ওষুধ দেওয়া হয় দিনের পর দিন যাতে তার স্মৃতি সব তালগোল পাকিয়ে যায়, আর সম্পত্তির মালিকানা আসে তাদের নামে, এই হল গল্প, সাইকোলোজির ব্যাপারটা ওই সাল হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেই আছে পড়ে মতামত জানাবেন। আর হ্যাঁ আর একটা কথা এটা আমার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে বলুন! আমার স্ত্রী ও তাঁর দাদা দুজনেই অসুস্থ, চিকিৎসাধীন। আমার এই বই আমি ওঁদের উৎসর্গ করেছি।”
সঞ্জয় আর নিশা তাকায় একে অপরের দিকে আর নার্স এগিয়ে এসে বলে শুয়ে পড়ুন বিকেলে চেক আপ এর সিডিউল আছে, বলে টিভির রিমোটটা নিয়ে অফ করে দিয়ে চলে যায়।।