Getting your Trinity Audio player ready...
|
আজ দুদিন হল আমরা কালিম্প এসেছি। এবারে এসে উঠেছি মর্গান হাউসে। কালিম্পং শহর থেকে মাত্র দু’কিলোমিটার দূরে রয়েছে গল্ফ কোর্স। এর ঠিক উল্টো দিকেই ব্রিটিশ আমলের তৈরি এই বাংলো। সারা বছর পর্যটকদের ভিড় থাকে এই মরগান হাউসে। আশেপাশের অনেকেই একে ‘ভূত-বাংলো’ বলে ডাকেন। রাতে তো বটেই, ভরদুপুরেও বাংলোয় একটা বেশ গা ছমছমে ভাব লক্ষ্য করছিলাম আমি।
ভুতের দেখা তখনও অবধি অবশ্য পাইনি আমরা। তবে শ্রীকান্তদা টিটোদি কে ভূত দেখিয়েই ছাড়বে বলে ঠিক করেছে। ভূত যে আছে তার প্রমাণ টিটোদি কে এবার সে দিয়েই ছাড়বে। শ্রীকান্তদা র কাছে নাকি কনফার্ম খবর রয়েছে যে মরগান হাউসে সাহেব ভূতেরা ঘুরে বেড়ায়।
আমরা কোনো হিল স্টেশনে ঘুরতে যাওয়ার আগে টিটোদি তার পুঙ্খানুপুঙ্খ একটা বিবরণ আমাদেরকে দিয়ে থাকে যাওয়ার ঠিক আগের দিন রাতে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
টিটোদি বলেছিল, মরগান হাউস সম্ভবত 1930 এর দশকে নির্মিত হয়েছিল। এটি ল্যান্ডস্কেপ বাগান এবং সুন্দর পাহাড়ের জন্য খ্যাত। মরগান হাউসটি বিশেষ ভাবে দুজন মানুষের বিবাহ উদযাপন করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এদের মধ্যে একজনের নাম জর্জ মরগান। উনি এবং ওঁর স্ত্রী ছিলেন একটি নীল বাগানের মালিক। বিয়ের পরে এটি দীর্ঘকাল তাদের গ্রীষ্মকালীন বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নবদম্পতি এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশ্রেণী কে খুব সুন্দরভাবে উপলব্ধি করতেন। বলাই বাহুল্য নতুন জীবন শুরু করার উপযুক্ত জায়গা ছিল এটি। তবে, মরগানদের কাছে শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি সুখকর হয়ে ওঠেনি কারণ মিসেস মরগান অকাল মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং তারপর মিঃ মরগান শীঘ্রই বাসা থেকে চলে যান। একটি ট্রাস্ট ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পরে বাড়ির মালিকানা গ্রহণ করেছিল এবং সরকার এই সম্পত্তিটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। এটি এখন হোটেল হিসাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। মিসেস মরগানের আকস্মিক মৃত্যুর নেপথ্যে অনেকে রহস্যের সন্ধান পান। কিছু লোক বিশ্বাস করেন যে তার স্বামী মারা যাওয়ার আগে তাকে নির্যাতন করেছিলেন এবং তাই, তার অসন্তুষ্ট আত্মা এখনও বাড়িটিতে ঘুরে বেড়ায়। যদিও, মিসেস মরগানের ভূতের কোনও দর্শন পাওয়া যায় নি, তবে লজের লোকেরা নাকি করিডোরে হাই হিলযুক্ত পাদুকার শব্দ শুনতে পেয়েছে।
এই লজে শুটিং করে গেছেন সুনীল এবং নার্গিস দত্ত, কিশোর কুমার, লীনা চন্দাভারকর, ওম প্রকাশ প্রমুখ বলিউড অভিনেতা। এই বাড়িতে তাদের থাকার প্রমাণ হিসাবে, দেওয়ালে তাদের দেওয়া প্রশংসাপত্রগুলি ঝো লানো রয়েছে, যেটা সেখানে গেলেই তোরা দেখতে পাবি। বাঙালি অভিনেতা উৎপল দত্তও প্রায়শই কালিম্পং ঘুরে দেখতেন এবং এই জায়গাতেই থাকতেন।
আমরা টিটোদির বর্ণনা শুনে জায়গাটা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা করে ফেলেছিলাম। যখন এখানে এসে পৌঁছলাম তখন সেই ধারণা হুবহু মিলে গেল।
ঠিক আমাদের মতোই আরও তিনজন বয়স্ক ভদ্রলোক এখানে ঘুরতে এসেছেন। তারাও আমাদের মত মরগান হাউসেই আছেন। ওঁরা এসেছেন গতকাল। তবে ওঁরা ঠিক ঘুরতে এসেছেন বললে ভুল বলা হবে। ওঁরা এসেছিলেন একটা কয়েন এক্সিবিশন এবং একটা নিলামে অংশগ্রহণ করার জন্য।
এই তিনজন ভদ্রলোকের মধ্যে একজন হলেন গোপাল চক্রবর্তী। উচ্চতা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি গায়ের রং বেশ ফর্সা, রোগা ছিপছিপে চেহারা, ঠোঁটের কোণে একটা বেশ বড় সাইজের তিল রয়েছে। চুল আর গোঁফ নিয়মিত রং করেন। তাই তার যে ৫০ বছর বয়স সেটা দেখে এক্কেবারেই মনে হয় না। তিনি থাকেন কোচবিহারে।
দ্বিতীয় জন হলেন মধুসূদন কর্মকার উচ্চতা ৬ ফুট গায়ের রং শ্যামবর্ণ ,বেশ মোটাসোটা চেহারা। বেশ ফিটফাট থাকেন ভদ্রলোক সব সময়। এঁর মাথায় চকচকে টাক। এঁর বয়স ও ৫০এর আশেপাশে। এঁর বাড়ি শিলিগুড়ি।
তৃতীয়জন হলেন ভূষণ সেন উচ্চতা 6 ফুট 2 ইঞ্চি, গায়ের রং ফর্সা, মাথায় কোকড়ানো চুল,সুস্বাস্থ্যবান নিয়মিত ব্যায়াম করেন দেখে বোঝা যায়। এঁর বয়স আন্দাজ 55। ইনি এসেছেন কলকাতা থেকে।
আরও একজন অবশ্য ওঁদের সাথে এসেছেন। তবে তিনি এখানকারই বাসিন্দা। বাসিন্দা বললেও ঠিক ভুল বলা হবে। ওঁর বাড়ি কলকাতায় তবে তিনি এখানে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরের একাউন্টেন্ট পদে কর্মরত। তাই আপাতত তিনি এখানেই থাকেন। এই ভদ্রলোকের তিনজনের সাথে সুসম্পর্ক থাকার দরুন তিনিও এখানে এসেছেন এঁদের সঙ্গ দিতে। ভদ্রলোকের নাম প্রসেনজিৎ দত্ত, উচ্চতা ৬ ফুটের একটু বেশি। ফর্সা গায়ের রং চোখ দুটো বেশ কটা কটা, সুস্বাস্থ্যবান। দেখে মনে হয় ওঁর বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। মাথায় সবসময় সুগন্ধি তেল মাখতে পছন্দ করেন। কাছে গেলেই সব সময় খুব সুন্দর গন্ধ পাওয়া যায়।
এঁর অবশ্য এখানে রুম নেওয়া নেই। বাকিদের সাথেই রুম শেয়ার করে থাকবেন।
আমরা একটা ডিলাক্স রুম নিয়েছিলাম, তিনজন এক রুমে থাকবো বলে। শ্রীকান্তদা র ভুতের ভয় ভালই আছে তাই সে একসাথেই থাকার প্রস্তাব দিয়েছে। সেজন্য আমরা ডিলাক্স রুম নিয়ে নিয়েছি। ওই ভদ্রলোক তিনজন তিনটে ডাবল বেড রুম বুক করেছেন, যেহেতু ওঁরা একাই থাকবেন। এখানে কোন সিঙ্গেল বেড রুম নেই। তাই বাধ্য হয়ে হয়তো ওঁদেরকে ডবল বেড রুমই বুক করতে হয়েছে।
আমাদের সাথে খুব বেশি আলাপ হয়নি এঁদের। কাল এঁরা এসেছেন সন্ধ্যাবেলায়, শুধু হালকা আলাপ পরিচয় হয়েছে ডিনারের টেবিলে। ওঁরাও বেশ কয়েকদিন এখানে থাকবেন বলে এসেছেন। আসলে এখানে থেকে প্রকৃতিকে এত সুন্দর ভাবে উপভোগ করা যায়। সেই অনুভূতি ঠিক বলে বোঝানো সম্ভব নয়। খুব কম লোকই যদিও একই জায়গায় এতদিন থাকে। সবার ঢুকতে ঢুকতেই বেরোবার সময় হয়ে যায়। আমরা অবশ্য এ ধরনের ঘুরতে ভালোবাসি না। আমরা একটা জায়গায় কয়েকদিন থেকে জায়গাটা সম্বন্ধে নাড়ি-নক্ষত্র জেনে তারপর সেখান থেকে ফিরি। এই ভদ্রলোক তিনজন ও মনে হল আমাদের মতোই।
প্রেমা তামাং মানে আমাদের এখানকার কুক এসে একবার বেড টি দিয়ে গেছে। আমরা সবাই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বাইরে এসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে চা খাচ্ছিলাম।
“অপূর্ব!” শ্রীকান্তদা বার কয়েক শব্দটা বলল।
টিটোদি খুব সুন্দর সাদা লাল একটা ট্রাউজারের সেট পড়েছে, আমি কাঞ্চনজঙ্ঘার থেকে বেশি টিটোদি কেই দেখছিলাম। সেই ব্যাপারটা অবশ্য কেউ লক্ষ্য করেনি সবাই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতেই ব্যস্ত ছিল।
আমরা রুমের বাইরে একটা বেঞ্চে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম আর গল্প করছিলাম। প্রেমা এসে বলে গেল ব্রেকফাস্ট করতে যাওয়ার কথা। চায়ের কাপগুলো বেঞ্চের ওপরে রেখে দিয়ে আমরা ব্রেকফাস্ট করতে চলে গেলাম।
ব্রেকফাস্ট এর টেবিলে বসে দেখলাম ওই ভদ্রলোক কয়েক জন বসে আছে টেবিলে। কালো রং এর ওভাল শেপ টেবিল। খুব রিসেন্টলি রং করা হয়েছে মনে হচ্ছে দেখে। টেবিলের দুপাশে দুটো কাঠের স্ট্যান্ড এর ওপর বসানো বাহারি লাইট। টেবিলের ঠিক ওপরে একটা পুরনো আমলের ঝাড়বাতি। আর চারধারে দেওয়ালে রংবেরঙের পেন্টিং ঝোলানো রয়েছে।
আমরা টেবিলে এসে বসতেই প্রেমা পুরো টেবিল সাজিয়ে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। একটা বেতের ঝুড়িতে ছিল টোস্ট করে রাখা পাউরুটি, আরেকটা ঝুড়িতে ছিল মস্ত সাইজের কলা, আর দুটো বাটিতে বাটার আর জ্যাম। কাচের গেলাসে সুন্দর করে সাজানো দুধ আর সাথে কনফ্লেক্সও ছিল।
আমরা ব্রেকফাস্ট শুরু করতে যাব তখন দেখলাম ওই ভদ্রলোক কয়েকজন কিছু ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছে মনে হল একটু চিন্তিত। তাই আমরা যে এসে বসেছি সে ব্যাপারটা ওঁরা অতটা লক্ষ্য করেননি।
“আমরা শুরু করলুম,” ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে কথাটা বলল শ্রীকান্তদা।
“হ্যাঁ হ্যাঁ শুরু করুন। লক্ষ্য ই করিনি ঠিক আপনাদেরকে।”
যিনি কথাটা বললেন তাঁর নাম গোপাল চক্রবর্তী। চেহারার বর্ণনা আপনাদেরকে আগেই দিয়েছি। আসলে ফেলুদার মত টিটোদি ও বিশ্বাস করে যে প্রথমেই একটা চেহারার বর্ণনা দিয়ে দেওয়া উচিত পাঠকদের। তা না হলে পাঠকরা ঠিক ভিজুয়ালাইজ করতে পারে না।
“আপনারা কি কোনো ব্যাপারে চিন্তিত?” টিটোদি পাউরুটিতে জোর এক কামড় লাগিয়ে প্রায় আধ চোখ বন্ধ অবস্থায় চিবোতে চিবোতে কথাটা বলল।
“না মানে, শুনেছেন তো বোধহয় এটাকে লোকে ভূতের বাড়ি বলে।” ভূষণ সেন কথাটা বলল।
“তা শুনেছি। কেন আপনারা কি কিছু দেখেছেন নাকি?” টিটোদি জানতে চাইল।
এ ওর মুখের দিকে তাকায় থাকি করার পর প্রসেনজিৎবাবু বললেন,
“চক্রবর্তী বাবুর ঘরে নাকি কাল ভূত এসেছিল,” একটু তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতেই কথাটা বললেন ভদ্রলোক।
“তাই নাকি আপনি দেখেছেন? ভূত দেখার জন্যই তো এখানে এসেছি মশাই। আমার এই ডিটেকটিভ বান্ধবী বিশ্বাসই করে না যে ভূত আছে।” শ্রীকান্তদা বেশ খুশি হয়েই কথাটা জিজ্ঞেস করল।
শ্রীকান্তদা একটু উত্তেজিত হয়েই বোধ-জ্ঞান হারিয়ে টিটোদি র আসল পরিচয়টা দিয়ে দিল। এতে টিটোদি যে খুব একটা খুশি হল না সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা গেল।
– “আপনি ডিটেকটিভ নাকি?” এতক্ষণ ধরে চুপ করে বসে থাকা মধুসূদন কর্মকার এবার জিজ্ঞেস করল।
টিটোদি একটু মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
“তা বেশ তো, আপনি একটু তদন্ত করে দেখুন না সত্যি ভূত এসেছিল নাকি?” গোপালবাবু একটু ভয় ভয় মুখ করেই কথাটা বললেন।
“কি হয়েছিল সেটা তো আগে বলুন!” টিটোদি বলল।
“মাঝরাতের দিকে একবার দরজায় খট খট শব্দ পেয়ে আমার ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমে ভাবলাম মনের ভুল তারপর কিছুক্ষণ পরে আবার একই রকম শব্দ শুনতে পাই। এবার ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলে দেখি কেউ নেই ঘরের বাইরে। কেউ এসে ঘুরে গেছে কিনা দেখার জন্য সবার রুমের কাছে গিয়ে দেখি, সব রুমেই দরজা বন্ধ এবং আলো ও বন্ধ। তাই কাউকে আর ডিস্টার্ব করিনি । ফিরে এসে দেখি আমার আলমারির দরজা খোলা। আমার সন্দেহ হয় আমি তো অনেকক্ষণের জন্য বাইরে বের হয়েছিলাম। সেই সময় ঘরের কোন জিনিস কেউ নিয়ে যায়নি তো? কিন্তু আলমারি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি কোন জিনিসই চুরি যায়নি।”
“ঠিক আছে তাহলে তো একবার দেখতে হয় ব্যাপারটা। আপনাদের মানে বাকিদের সবার রাতে ঘুম ঠিক হয়েছে?” টিটোদি বলল।
সবাই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো যে সবার ঘুম ঠিকই হয়েছে রাতে।
“আপনি কখন শব্দটা শুনতে পান রাতে?”
টিটোদি জিজ্ঞেস করল।
“রাতের বেলায় আন্দাজ দুটো হবে।” গোপালবাবু বললেন।
“আপনার কোনও বন্ধু আপনার সাথে মশকরা করছে না তো?” টিটোদি একটু হেসে নিয়ে বলল।
“সেটা আপনি তদন্ত করে দেখুন ম্যাডাম। আপনি যখন ডিটেকটিভ তখন তো সেটা আপনাকেই বলতে হবে।” হাসতে হাসতে কথাটা বললেন ভূষণবাবু।
“কেউ মশকরা করলে আমাকে এখনই বলে দাও। আমার কিন্তু খুব ভয় হচ্ছে। আমি বাবা ভূতের খুব ভয় পাই।”
গোপালবাবু কথাটা বললেন। ভদ্রলোক যে বেশ ভয় পেয়েছেন সেটা ওঁর চেহারা দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
“আচ্ছা ঠিক আছে। সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আপনারা আগে ব্রেকফাস্ট শেষ করুন। তারপর না হয় আমি একবার গোপালবাবুর ঘরে গিয়ে দেখছি।” টিটোদি বলল।
সবাই ব্রেকফাস্ট শেষ করার পর, সবাই মিলে আমরা এসে পৌছালাম গোপালবাবুর ঘরে। গোপালবাবুর ঘরটা এই বিল্ডিং এর একদম শেষ প্রান্তে। তার পাশেই ঘন বাগান। কেউ দরজা ধাক্কা দিয়ে যদি পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে তাহলে অবশ্য বোঝার কোনও উপায় নেই। কারণ পিছনের দিকটা এমনিতেই অন্ধকার।
ঘরে ঢোকার আগে ভদ্রলোক জুতো জোড়া খুলে তারপর ভেতরে ঢুকলেন। অগত্যা তাঁর দেখাদেখি আমাদের সবাইকেই তাই করতে হল।
“তোর ঘুরতে এসেও এরকম শুচিবাইয়ের মত স্বভাবটা আর গেল না।” মধুসূদনবাবু বললেন।
“হাইজিন বলে তো একটা ব্যাপার আছে। সেটা তো মানবি নাকি!” গোপালবাবু বললেন।
ঘরে ঢুকেই প্রথম প্রশ্নটা করলো টিটোদি,
“আপনি আলমারির চাবি কোথায় রাখেন?”
“টেবিলের উপরেই তো থাকার কথা। কিন্তু ফিরে এসে দেখি আলমারির দরজায় লাগানো।”
আলমারি সব জিনিসপত্র দেখার পর টিটোদি বলল – “আপনি নিশ্চিত যে কোনও কিছু চুরি যায়নি?”
“হ্যাঁ তা মোটামুটি নিশ্চিত। ওই কতগুলো কয়েন, মিশরের একটা মূর্তি আর দুটো বুদ্ধমূর্তি ছাড়া সেরকম কিছু তো ছিল না। জামাকাপড় যে রকম ছিল সেরকমই আছে। আলমারিতে টাকা-পয়সাও বিশেষ কিছু ছিল না।”
“কয়েন কটা ছিল?”
“৩০ টা ছিল। কালই কয়েন এক্সিবিশন শেষ হয়েছে। কাল ওখান থেকে এই প্যাকেটটাতে ঢুকিয়ে আনি।”
“এখন গুনে দেখেছেন?”
“তা দেখিনি তবে থলির ওজন দেখে মনে হল ঠিকই আছে।”
“একবার দেখুন তো গুনে।”
ভদ্রলোক একটা লাল রঙের রেশমের থলির থেকে কয়েনগুলো বের করে বিছানায় রেখে গুনতেই দেখা গেল সেখানে ২৯ টা কয়েন রয়েছে।
“ও মাই গড। একটা কয়েন যে একেবারে হাওয়া।” গোপালবাবু বললেন।
“আপনি নিশ্চিত ৩০ টাই ছিল? এক্সিবিশন থেকে আনতে গিয়ে কোথাও পড়ে যায় নি তো?” টিটোদি বলল।
“না না আমি তো গুনেই ঢুকিয়েছি। কম হবার তো কথা নয়।”
“আপনার এক্সিবিশনটা কোথায় হয়েছিল?”
“কালিম্পং গ্যালারিতে। আমি আর মধুসূদন এক্সিবিশনে পার্টিসিপেট করেছিলাম।”
“আর আপনারা বাকি দুজন করেননি?”
“না আমরা অকশনে পার্টিসিপেট করার জন্য গিয়ে ছিলাম। সেখানেই এক্সিবিশন শেষ হওয়ার পর একটা অকশন ছিল।” ভুষনবাবু কথাটা বললেন।
“আপনার এই কয়েনের দাম তো খুব বেশি নয়। এগুলোতো রুপোর নারায়নী কয়েন মনে হচ্ছে দেখে। দু আরাই হাজার টাকা দাম হবে।” টিটোদি বলল।
“দাম সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। এগুলো কিছুদিন আগে আমাদের বাড়ীর পুরোনো সিন্দুকে পাওয়া গেছে। আসলে পুরনো জিনিসের শখ রয়েছে আমার। সব যে ভালো চিনি তাও নয়। কিন্তু ব্যাপার কি জানেন? আমাদের অনেক পুরনো বনেদি টাইপের বাড়ি। বাড়িতে একটা মিউজিয়াম মতো বানিয়েছি তাই এসব কিনে ঘরভর্তি করি আর কী। চক্রবর্তী বাড়ি বলতে লোকে এখনো এক ডাকেই চেনে সেই রাজ আমল থেকেই। তাই বাড়ির সেই ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য আমাদের একটু এসব করতে হয়।” গোপালবাবু বললেন।
“ওর দাম ৩ হাজারের ভিতরেই হবে। ঠিকই বলেছেন এই ম্যাডাম।” মধুসূদনবাবু বলল।
“আচ্ছা এখন থেকে চাবিটা নিজের কাছেই রাখুন গোপালবাবু। আর আমি একটু খুঁটিয়ে দেখছি কিছু বুঝতে পারি কিনা। আর একটা জিনিস জানবার ছিল মধুসূদনবাবুর কাছ থেকে!” টিটোদি বলল।
“বেশ তো বলুন কি জানতে চান?” একটু অবাক হয়েই মধুসূদনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“আপনার কাছে কটা কয়েন আছে? আর সেগুলো কি এরকমই নারায়ণী মুদ্রা?”
“হ্যাঁ সবই নারায়নী মুদ্রা। আমার কাছে 10 টা রয়েছে এরকম একই রকমই দেখতে।” মধুসূদনবাবু বললেন।
“আচ্ছা আপনারা অকশন থেকে কি কি জিনিস কিনে ছিলেন?” টিটোদি প্রশ্ন করল।
“আমি একটা মিশরের মূর্তি কিনি। প্রসেনজিৎ কয়েকটা কয়েন কিনেছে। মধুসূদন একটা বৌদ্ধমূর্তি কেনে ওটা সিকিমের পুরনো একটা মূর্তি। আর ভূষণ কিছু কেনেনি।”
“তাহলে আপনি এত দূর থেকে কিজন্য এসেছেন?” টিটোদি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আমাকে আর কিনতে দিল কোথায়! অকশনের দিন আমার শরীরটা একটু খারাপ ছিল তাই আমি গোপাল কে বলি আমার জন্য মিশরের মূর্তিটা কিনে নিয়ে আসতে। দামটা যেন ও ফোনে কনসাল্ট করে নেয়। শেষে সে ফিরে এসে বলে কিনা তার পছন্দ হয়েছে মূর্তিটা। তাই অগত্যা আমার আর কিছুই কেনা হলনা। আর তাছাড়া আমরা চারজনই অনেকদিনকার পরিচিত। এসব পুরোনো জিনিস সংগ্রহ করতে গিয়েই আলাপ। কালিম্পং এলাম সবাই মিলে। কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করা গেল। জানেন তো এখন আমরা সকলেই বড্ড একা। ছেলেমেয়েরা সবাই এস্টাবলিশ। সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। তাই আমরা মাঝে মাঝে এরকম এক হয়ে একটু আড্ডা মারি। এগুলো তো অজুহাত মাত্র। তবে হ্যাঁ মিশরের মূর্তিটা নেওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল আমার।” ভুষনবাবু বললেন।
“আমার মিউজিয়ামে এরকম মিশরের কোন জিনিস নেই। তাই এরকম একটা পেলে গ্ল্যামারটা একটু বাড়বে আর কি।” হাসতে হাসতে বললেন গোপালবাবু।
এখন আমরা সবাই দাঁড়িয়েই কথা বলছিলাম। গোপালবাবু সেটা লক্ষ্য করে হঠাৎ বললেন,
“এই দেখেছেন আপনাদের কাউকে বসতেই বলিনি। একটু এডজাষ্ট করে সবাই বসে পড়ুন। ম্যাডাম আপনারা পান খান তো? এরা কেউ খায় না। আমার আবার একটু পরপর পান না হলে চলে না।”
“আমার সঙ্গীরা কেউ খায় না। আমিও যে খুব বেশি খাই তাও নয়। তবে এখন একটা চলতে পারে কিন্তু জর্দা ছাড়া।” টিটোদি বলল।
ভদ্রলোক যে পান খাওয়ার ব্যাপারে খুব সৌখিন। সেটা এমন সুন্দর সরঞ্জাম দেখেই বোঝা যায়। পান খাওয়ার জন্য পিতলের বাসনের পুরো সেট বানিয়ে রেখেছেন ভদ্রলোক। একটা বড় বাটিতে কেটে রাখা পান, একটায় সুপা রি, একটায় খয়ের আরেকটাতে রয়েছে কী সব রংবেরঙের মসলা। চুনটা শুধু রেখেছেন মেঝেতে একটা প্লাস্টিকের কাপে।
আমরা সবাই বসে ছিলাম, খানিকক্ষণ পর গোপালবাবু টিটোদিকে একটা পান বানিয়ে হাতে দিয়ে তারপর নিজের জায়গায় বসল।
“প্রসেনজিৎবাবু কাল রাতে কার ঘরে শুয়ে ছিলেন?” টিটোদি জিজ্ঞেস করল।
“ভূষণের ঘরে। ওই ঘরেই সবাই মিলে গল্প করছিলাম। শেষে সবাই চলে গেল। তারপর আমার দুজন ওখানেই ঘুমিয়ে গেলাম।” প্রসেনজিৎবাবু জবাব দিলেন।
গোপালবাবু র ঘরে বসে বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা মেরে ওঁকে সাহায্য করার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে আমরা নিজের ঘরে পৌঁছালাম। টিটোদি গোপালবাবু কে জানিয়ে এলো যে সে এই ব্যাপারটা ভালো করে খতিয়ে দেখবে।
আমরা আজকে ঠিক করেছিলাম একটু কালিম্পং বেড়াতে যাব। লাঞ্চ বাইরে করে নেব প্রেমাকে বলে দেওয়াও হয়েছিল। আমাদের জন্য শুধু ডিনারের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছিল। কারণ আমাদের ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
কিন্তু গোপালবাবুর রুম থেকে ফিরে আমাদের রুমে এসে সবে তৈরি হতে শুরু করেছি তখনই শুরু গেল ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা। এই সময় বৃষ্টি সাধারণত দেখা যায় না। এপ্রিল মাস এখন। তাই আমরা ছাতা নিয়েও আসিনি। আর তাছাড়া এই বৃষ্টিতে বেরিয়ে কোন লাভও নেই তাই আমাদেরকে যাওয়া ক্যানসেল করতে হল।
“প্রেমাকে বলে দিয়ে আয় আজ দুপুরে খিচুড়ি আর ডিমের ওমলেট করতে।” টিটোদি একটা কম্বল টেনে বিছানায় শুতে শুতে কথাটা বলল।
আমি উঠে গিয়ে কিচেনের দিকে চলে গেলাম। প্রেমাকে খিচুড়ি আর ডিমের ওমলেট এর কথাটা বলতেই সে জানাল কোন অসুবিধা নেই, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
আমি ফিরে এসে রিডিং ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে শ্রীকান্তদার কথামত একটা ভূতের বই খুলে পড়তে শুরু করলাম। একটা অন্ধকার ভাব চলে এসেছিল সাথে বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্যে এরকম একটা হন্টেড প্লেস। এখানে ভূতের বই পড়াটা বেশ জমবে।
টিটোদি কে কয়েনের ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করাতে সে বলল
“মনে হয় কেউ একজন মশকরা করে ছে। এরকম ভূ তের জায়গায় এসে বন্ধুদের পেছনে অনেকেই লেগে থাকে। এ নিয়ে বেশি ভাববার কিছু নেই।”
“তাহলে কয়েনটা কোথায় গেল?” আমি বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম।
“একটু খটকা লাগছে। কিন্তু কেউ চুরি করলে সব কটা কয়েনই নিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি? হতে পারে পরে যে মশকরা করার জন্য নিয়েছে সে পরে আবার কয়েনটা ফেরত দিয়ে দেবে।”
“আর যদি ফেরত না দেয় তাহলে ভূত যে আছে এটা প্রমাণ হবে তো?” শ্রীকান্তদা বেশ আগ্রহ নিয়ে কথাটা বলল।
“বাজে বকিস না। আচ্ছা ঠিক আছে আমাকে সত্যি সত্যি কয়েনটা বের করতে হবে যেভাবেই হোক। আমি অত খুঁটিয়ে দেখিনি চারপাশটা। কিন্তু এবার তোর ভুল ভাঙানোর জন্য দেখতেই হবে মনে হচ্ছে। আর তুই আগ বাড়িয়ে কেন বলতে গেলি যে আমি ডিটেকটিভ? এবার যে নিয়েছে সে সাবধান হয়ে যেতে পারে।”
“তাহলে তুই বিশ্বাস করবি না যে ভূত আছে।” শ্রীকান্তদা বলল।
“আগে দেখা যাক কয়েনটা পাওয়া যায় নাকি তারপরে এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে।” টিটোদি বেশ গম্ভীর হয়ে বলল।
কখন যে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ঠিক খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল গোপালবাবুর ডাকে
“আপনারা সবাই যে একেবারে ঘুমিয়ে গেছেন দেখছি। খেতে যাবেন না আপনারা?”
আমরা সবাই উঠে বিছানার উপর বসলাম। টিটোদি বলল
“একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর কি।”
“আর বলবেন না ম্যাডাম। কয়েনটা দেখছি আলমারি র নিচে পড়ে আছে। হয়তো আমি এক্সিবিশন থেকে ফিরে আলমারিতে ঢোকানোর আগে গোনার সময়ই পড়ে গিয়েছিল।” ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন।
“কিন্তু ওই দরজার শব্দটা?” শ্রীকান্তদা একটু নিরাশার ভঙ্গিতেই কথাটা বলল।
“হ্যাঁ শব্দটা কিন্তু ঠিকই শুনেছিলুম। কে যে অত রাতে দরজা ধাক্কা দিয়ে গেল সেটা তো বুঝতে পারছি না। পুরো ভৌতিক ব্যাপার মশাই।”
“আমার ধারণা আপনার ওই তিন বন্ধুর মধ্যে কেউ একজন আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য এটা করেছে।” টিটোদি বলল।
“যাইহোক আপনি একটু দেখুন ভেবে কিছু উদ্ধার করতে পারেন নাকি। খাবার বোধ হয় হয়ে গেল। দারুন আইডিয়া দিয়েছেন আপনারা। আমরা তো শুনেই এক বাক্যে রাজি। এই ওয়েদারে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা কোনও কথা হবে না। চলুন দেখি এগোনো যাক। আমি বাকিদের ডেকে নিয়ে আসি আপনারাও আসুন।”
ভদ্রলোক বাকিদের ডাকতে বেরিয়ে যেতেই আমি টিটোদিকে বললাম
“তুমি ডিটেকটিভ শুনে কেউ কয়েনটা ফেরত দিয়ে যায়নি তো?”
“সেটা হলেও হতে পারে। তবে কেউ কয়েন নিলে একটা কয়েন কেন নেবে সেটাই ভাবছি। যাক গে চল, প্রচুর খিদে পেয়েছে খেয়ে নেওয়া যাক।”
“এই ভুতুড়ে পরিবেশ, সাথে বৃষ্টি তার সাথে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা। ভাবা যায়! ভাগ্যিস তুই বলেছিলি টিটো।” শ্রীকান্তদা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলে উঠলো।
টেবিলে গোল হয়ে বসে খেতে খেতে ভূষণবাবু বললেন
“কি ম্যাডাম, তাহলে কি ভূতেই আবার কয়েন ফেরত দিয়ে গেল নাকি! কী বলবেন এটাকে? হা হা হা!”
ভদ্রলোক বেশ মজা পেয়েছেন বোঝা গেল। কিন্তু তাঁকে বিশেষ আমল না দিয়ে টিটোদি বলল
“সেটা বলার জন্য আরেকটু সময় দরকার। আপনারা তো কদিন রয়েছেন তার মধ্যে আশা করি এর একটা কিনারা করতে পারব। আর তাছাড়া আলমারির নিচটায় তখন খুঁজে দেখা হয়নি।”
“এখন আলমারির নিচে কী করে তোর চোখ গেল গোপাল?” মধুসূদনবাবু বললেন।
“প্রসেনজিতের একটা চটি আলমারির নিচে ঢুকে গেছিল, ও ওটা ধরে টানতেই কয়েনটা বেরিয়ে এল।” গোপালবাবু বললেন।
“ডিটেকটিভ এর কাজটা কিন্তু তাহলে আমিই করে দিলাম।” বলে প্রসেনজিৎবাবু খানিক হাসলেন।
“দরজায় শব্দটা কে করেছিল সেই রহস্য তো এখনো উত্তর হল না। তাই ডিটেকটিভ এর কাজ এখনো বাকি আছে।” টিটোদি একটু হেসে জবাব দিল।
“কয়েন যখন পাওয়াই গেছে তখন মিছি মিছি ও রহস্যের আর সমাধান করে আর কি লাভ। সবাইকে গিয়ে তো বলতে পারব যে সত্যি ভূত দেখতে পেয়েছি মরগান হাউসে।” মধুসূদনবাবু কথাটা বললেন।
“আরে বাবা আমি বলছি ওটা সত্যি ভূত এসেছিল। অনেকেই এখানে ভূত দেখেছে এর আগে।” শ্রীকান্তদা বেশ কনফিডেন্টলি কথাটা বলল।
“আচ্ছা বেশ তাহলে ধরেই নিলাম ভূত এসেছিল। আমি আমার তদন্ত বন্ধ করছি।” টিটোদি বলল।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘরে ফিরে বিছানায় উঠে কম্বলটা টেনে শুয়ে নিয়ে আমি টিটোদি কে প্রশ্নটা করলাম
“তুমি কি তাহলে তদন্ত ছেড়ে দিলে? গোপালবাবুর রুমে কে এসেছিল সেটা একটু খুঁটিয়ে দেখবে না?”
“কেউ যে এসেছিল সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। বাগানে ধনেপাতা গাছগুলো নষ্ট করে ফেলেছে কেউ কাল রাতে। সন্ধ্যাবেলাতেও দেখেছিলাম ভালোই ছিল।” টিটোদি বেশ গম্ভীর হয়েই কথাটা বলল।
“তাহলে এখন তুমি কি করবে?” আমি বেশ আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞেস করলাম।
“আমার মনে হয় বাকি তিনজনের মধ্যে কেউ একজন ভয় দেখানোর জন্য এটা করেছে। এ নিয়ে আর বেশি ভাববার কোন মানে হয় না।” টিটোদি বলল।
* * *
পরদিন বেশ সকালেই আমরা চলে গেলাম কালিম্পং ঘুরে দেখতে। আমরা যখন ঘর থেকে বের হই তখন সকাল আটটা। আমরাই প্রথম ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ি। ফিরে গিয়ে লাঞ্চ করব এরকমই বলে এসেছি প্রেমাকে।
প্রথমে কিছুক্ষণ পায়ে হেঁটেই শহরটাকে ঘুরে দেখব ঠিক করলাম। কতগুলো গাড়ী দার্জিলিং যাচ্ছে দেখে শ্রীকান্তদা টিটোদি র দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ,
“এখান থেকে দার্জিলিং এ ডাইরেক্টলি গাড়ি যাচ্ছে! শিলিগুড়ি হয়েই তো যেতে হবে নিশ্চয়ই? অনেক সময়ের ব্যাপার তো!”
‘তোর মুন্ডু।’ বেশ গম্ভীর ভাবে জবাব দিল টিটোদি।
আসলে শ্রীকান্তদার এই অদ্ভুত সমস্যা রয়েছে। আমাদের সাথে বেশ ভালোই ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু রাস্তাঘাট সম্পর্কে একেবারেই ধারণা নেই। তাই টিটোদির কাছে মাঝে মাঝে ধমকও খায় এই নিয়ে।
টিটোদি আবার বলতে শুরু করল,
“দার্জিলিং এখান থেকে ৫০ কিলোমিটার পশ্চিমে। তিস্তা বাজার হয়েই তো আমরা এলাম, লক্ষ্য করলি না! সেখান থেকে একটা রাস্তা বাঁদিকে চলে গেছে, যেটা দিয়ে পেশক হয়ে দার্জিলিং যাওয়া যায়।”
“কালিম্পং নামটা ভারী অদ্ভুত তাই না?” আমি বললাম
“কালিম্পং শব্দের মধ্যেই এর নামের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। এই শহরে এক সময় ভূটানের রাজ্যপালের কেন্দ্রীয় দফতর ছিল। ‘কালিম’ শব্দের অর্থ হল ‘রাজার মন্ত্রী’ এবং ‘পং’ শব্দের অর্থ হল ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’। শুনে হয়তো অবাক হবি যে,একসময় এই শহর দিয়েই ভারত-তিব্বতের মধ্যে বাণিজ্য চলত।”
সোনালি ওক গাছের ঘন অরণ্যের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার এই অদ্ভুত অনুভূতিই বোধহয় কালিম্পং-এর অন্যতম আকর্ষণ। কালিম্পং এর চমৎকার আবহাওয়া এবং এর কাছাকাছি অঞ্চলে আরও বেশ কিছু পর্যটন কেন্দ্র থাকায় আমাদের মত লোকজনের অন্যতম ভ্রমণ ঠিকানা হয়ে উঠেছে এই শহর। পাহাড়ের কোলে কত সুন্দর ভাবে সাজানো এই শহর।
আমরা হেঁটে হেঁটে ভালোই আনন্দ উপভোগ করছিলাম। এই অঞ্চলের পুরোটাই রেইন ফরেস্ট। রেইন ফরেস্ট শব্দটা প্রথম শুনেছিলাম টেলিভিশনের কোনো একটা খবরের চ্যানেলে, রেইন ফরেস্ট আগুন লেগে গেছে অনেক জায়গায় সেটা দেখাচ্ছিল টেলিভিশনে। তখনই টিটোদির কাছ থেকে জেনে ছিলাম যে সাধারণ ফরেস্ট আর রেইন ফরেস্টের একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। রেইন ফরেস্টে প্রচুর বৃষ্টি হয়। ফলে গাছগুলো হয় অনেক বড়, উঁচু এবং সতেজ পাতা বিশিষ্ট। আর সাধারণ বনের গাছগুলো থাকে বেঁটে, চিকন এবং পাতা বিবর্ণ।
একটা জায়গায় দেখলাম লেখা রয়েছে এই শহরের উচ্চতা ৪,১২৫ ফুট। দার্জিলিংয়ের অনুপাতে এ শহর যে অনেকটাই নিচুতে সেটা এখানে আসার রাস্তা দেখলেই বোঝা যায়। এখানে সেরকম ধরনের উৎরাই নেই। কালিম্পং এর ঠিক পাশেই ডেলো আর দুরপিনদাঁরা। এই দুই পাহাড়ের খাঁজেও গড়ে উঠেছে আরও এক শৈলশহর। সেটা আমরা অবশ্য আজ দেখতে যাব না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর টিটোদি ট্রাভেল গাইড এর মত আমাদের বলতে শুরু করল
“এই শহরের নানা ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন হয়েছে। সুদূর তিব্বত থেকে রেশম ব্যবসায়ীরা জেলেপা লা পার করে কুপুপ, জুলুক, আরিতার হয়ে টানা এক মাস চলার পর কালিম্পংয়ে আসতেন। এখান থেকে দেশের নানা প্রান্তে সেই রেশম রফতানি হত। ১৮৭০ সালে ভুটান রাজার থেকে ইংরেজরা ছিনিয়ে নেয় এই শহর। তারপর অন্য সাজে সেজে ওঠে শহর। এই শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানান দ্রষ্টব্য। এবারে হয়তো সবটা ঘুরে দেখা হবে না আমাদের।
কালিম্পং বৌদ্ধধর্মের একটি কেন্দ্রও বটে। মধ্য ঊনবিংশ শতাব্দির আগে পর্যন্ত কালিম্পং ও তার সংলগ্ন অঞ্চলগুলি পর্যায়ক্রমে শাসন করেছে সিকিম ও ভুটান।
১৭০৬ সালে ভুটানের রাজা একটি যুদ্ধে জয়লাভ করেন এবং তিনি এই এলাকাটি সিকিমের রাজার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন। তখন তিনিই এই অঞ্চলের নতুন নাম রাখেন কালিম্পং।
পরে, ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে, গোর্খারা কালিম্পং আক্রমণ করে জয় করে নেয়। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধ হয়। তারপর ১৮৬৫ সালে সিঞ্চুলার চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী তিস্তা নদীর পূর্বদিকের ভুটানি-অধিকৃত অঞ্চলগুলি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আওতাভুক্ত হয়। এই সময় কালিম্পং একটা ছোটো গ্রাম মাত্র ছিল। মোটে দু’টি কী তিনটি পরিবার এখানে বসবাস করতেন। এই বছরই অ্যাশলে ইডেন নামে এক বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস অফিসারের তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনে এই শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। এটাই ছিল কালিম্পং শহরের প্রথম ঐতিহাসিক নামোল্লেখ।
১৯৮৬ সালে জাতিগত ভিত্তিতে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (জিএনএলএফ) ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। দাঙ্গা হয়। চল্লিশ দিনের বনধ ঘোষিত হয়। কালিম্পং বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়। আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে রাজ্য সরকার সেনাবাহিনীকে তলব করে। এরপর শিলিগুড়ি মহকুমা ছাড়া বাকি দার্জিলিং জেলা নিয়ে স্বশাসিত সংস্থা দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল গঠিত হয়। ২০০৭ সালে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি নতুন করে মাথাচাড়া দেয়। এবার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা।”
মাঝে মাঝে মনে হয় টিটোদি র মাথায় হয়তো এক্সট্রা কোনও মেমোরি চিপ বসানো আছে। এতকিছু যে সে মনে রাখে কী করে সেই জানে।
বেশ খানিকক্ষণ ঘুরে আমরা গেলাম একটা কিউরিও শপ এর দিকে। কালিম্পংয়ে রয়েছে নানা কিউরিও শপ। দেখলাম এখানে রয়েছে মুখোশ-সহ নানা অ্যান্টিক কালেকশন। দরদাম না করে নিলে অবশ্য ঠকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আশেপাশের লোকজনের কেনা দেখে অন্তত সেটাই মনে হল।
“চল তো একবার কালিম্পং আর্ট গ্যালারিটা দেখে আসি।” টিটোদি শপ থেকে বেরোতে বেরোতে কথাটা বলল। আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল ওই ভদ্রলোকেদের কয়েন এক্সিবিশন এর কথা।
কালিম্পং আর্ট গ্যালারিতে এসে এদিক-ওদিক ঘুরে দেখার পর অফিসে বসে থাকা একজন নেপালি মহিলার দিকে এগিয়ে গেল টিটোদি। আমরা অবশ্য ভেতরে না গিয়ে বাইরে দাড়িয়েই কথাবার্তা শুনছিলাম।
“আচ্ছা একটু কথা বলতে পারি আপনার সাথে?”
“হাঁ বোলিয়ে।”
“এখানে কয়েকদিন আগে একটা কয়েন এক্সিবিশন হয়েছিল?”
“হাঁ ও তো খতম হো গ্যয়া দো দিন পেহেলেই।”
“ঠিক আছে ওর কোন ছবি পাওয়া যেতে পারে?” “হাঁ উস এক্সিবিশন কে বারে মে এক বুক পাবলিশ হুয়া হ্যায়। আপ লে সাকতে হ্যায়।”
ভদ্রমহিলার কাছ থেকে 200 টাকা দিয়ে টিটোদি কয়েন এক্সিবিশন সম্পর্কে পাবলিশ হওয়া বইটা সংগ্রহ করে নিল। আমি বইটা হাতে নিয়ে দেখলাম বেশ ভালো কোয়ালিটির বই। ছবিগুলো সব একেবারে জীবন্ত মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই খুব ভালো ক্যামেরা দিয়ে তোলা। প্রিন্টিং কোয়ালিটিও অসামান্য।
আমরা যখন ঘরে ফিরে এলাম, তখন বিকেল তিনটে। খাবারগুলো গরম করে টেবিলে দিয়ে দিলো প্রেমা। ওই ভদ্রলোকদের খাওয়া হয়ে গিয়েছে ওঁরা রুমে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সেটা আমরা প্রেমার কাছ থেকে জানতে পারলাম।
খেয়ে নিয়ে আমরা সবাই বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। আজ সারাদিন যা হাঁটাহাঁটি হয়েছে তাতে ঘুম বেশ ভালই আসবে। কিন্তু আমাদের দুজনকে অবাক করে দিয়ে টিটোদি রিডিং ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে নতুন কিনে আনা বইটা পড়তে শুরু করে দিল।
আমার ঘুমে চোখ প্রায় লেগেই এসেছিল আর শ্রীকান্ত তার নাক ডাকার শব্দ ও বেশ ভালোই পাছিলাম চোখ লাগার আগে অব্দি। ঘুমটা ভেঙে গেল টিটোদির ডাকে।
“তোর ম্যাগনিফাইং গ্লাস টা কোথায়?”
“আছে হয়তো ব্যাগে।” আমি ঘুম ঘুম চোখে উত্তর দিলাম। “এখনই দে একবার দরকার আছে।”
আমি কোনো রকমে অলসতা কাটিয়ে গ্লাসটা বের করে টিটোদিকে দিলাম। নতুন কিনে আনা বইটার পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা দিয়ে দেখছিল টিটোদি।
আমার আর কিছুতেই ঘুম এল না। কিছুক্ষণ পর টিটোদি বলল
“চল তো একবার গোপালবাবুর রুম থেকে ঘুরে আসি।”
“ঠিক আছে চলো। ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা দাও ব্যাগের ভেতর রেখে দিই নাহলে পরে খুঁজে পাবেনা।”
“না ওটারও কাজ আছে।” বেশ গম্ভীরভাবে কথাটা বলল টিটোদি।
আমরা গোপালবাবু র রুমে গিয়ে দরজায় নক করতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন গোপালবাবু।
আমাদের ডাকেই মনে হয় ঘুম ভেঙে গেছে ওঁর। দেখে মনে হল সদ্য ঘুম থেকে উঠেছেন। কথা জড়ানো অবস্থায় আমাদের বললেন
“আসুন বসুন। আমি একটু টয়লেট থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
আমরা একটা সাদা ধবধবে চাদর পাতা ফাঁকা বিছানা দেখে তাতেই বসে পড়লাম। বিছানা দেখে মনে হচ্ছে এটা ভদ্রলোক ব্যবহার করেন না। আমাদেরকে খুব বেশিক্ষণ বসতে হল না। বাথরুম থেকে ফিরে এসে ভদ্রলোক একটা চেয়ার নিয়ে আমাদের সামনে বসতে বসতে বললেন
“আপনারা কখন ফিরলেন?”
“এই হবে প্রায় দু’ঘণ্টা। আপনাকে মনে হয় ঘুম থেকে তুলে দিলাম।” টিটোদি বলল।
“হ্যাঁ একটু ঘুমিয়ে গেছিলাম ঠিকই। কিন্তু ডেকেছেন ভালোই করেছেন। একটু জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।”
“আচ্ছা আপনার কয়েনগুলো কি একবার একটা একটু দেখতে পারি? তখন ভালো করে দেখা হয়নি, এরকম রাজ আমলের কয়েন তাই একটু দেখার কৌতুহল হচ্ছে আর কী।”
টিটোদি যে কয়েনগুলো দেখার জন্যই ম্যাগনিফাইন গ্লাসটা সাথে করে নিয়ে এসেছে সেটা এখন বেশ ভালোই বুঝতে পারলাম।
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই।” কথাটা বলে ভদ্রলোক আলমারিটা খুলে কয়েনগুলো রেশমের থলি থেকে বের করে আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন।
“টিউবলাইটটা একবার জ্বালিয়ে দে তো নিলু।” কয়েনগুলো হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে কথাটা বলল টিটোদি।
আমি উঠে গিয়ে আমাদের ডান হাতে থাকা কাঠের সুইচ বোর্ডটার দিকে এগিয়ে গিয়ে দুটো সুইচ ট্রাই করতেই ঘরের টিউবলাইটটা জ্বলে উঠলো।
টিটোদি অনেকগুলো কয়েনের মধ্যে থেকে একটা বিশেষ কয়েন বের করে নিয়ে সেটাকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ভালো করে দেখতে থাকল। আমি লক্ষ্য করলাম তার মুখ গম্ভীর। কপালে আমার খুব পরিচিত তিনটে ভাঁজ। যার অর্থ কোনও একটা হিসেব মিলছে না। আমাদেরকে কিছু খোলসা করে না বলে কয়েনগুলো গোপালবাবুকে ফেরত দিয়ে দিল টিটোদি।
মিনিট পাঁচেক গল্প করে টিটোদি বলল,
“একবার একটু প্রেমাকে চায়ের কথা বলে আসি কেমন? আপনার জন্যও বলব নাকি?”
– “না আমি একটু পরে খাচ্ছি।”
“ঠিক আছে তাহলে ডিনারের টেবিলে সবার একসাথে দেখা হচ্ছে।”
আমরা গোপালবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে ই টিটোদি আমাকে অবাক করে দিয়ে মধুসূদনবাবুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
দরজার কড়া নাড়তেই ভদ্রলোক দরজা খুলে আমাদের ভেতরে বসতে বললেন। আমি সম্পূর্ণ ভাবে অবাক হয়ে গেলাম এরকমভাবে ভদ্রলোককে মিথ্যা কথা বলার কী দরকার ছিল! আমরা যে মধুসূদনবাবুর ঘরে আসছি সেটা গোপালবাবু জানলেই বা অসুবিধা কোথায়!
দুটো চেয়ার টেনে আমরা দুজন বসার পর মধুসূদনবাবু বলল,
“কেমন ঘুরলেন আপনারা আজকে?”
“বেশ ভালোই।” আমি উত্তরটা দিলাম।
“আপনার সাথে একটু কথা ছিল,” টিটোদি বলল, “আপনার কয়েনগুলো কি একবার দেখা যায়?”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই।” কথাটা বলেই ভদ্রলোক টেবিলের ওপরে রাখা চাবিটা নিয়ে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলেন।
“আপনার আলমারির চাবি কি এই টেবিলেই থাকে?” টিটোদি প্রশ্নটা করল।
“হ্যাঁ তাই তো থাকছে। এখানে আসার পর থেকে এখানেই তো আছে। কেন বলুন তো?”
“এখানে রেখে কাজটা ঠিক করেননি বলেই মনে হচ্ছে। আলমারিটা খুলে কয়েনগুলো একবার বের করুন তাহলেই বোঝা যাবে।” টিটোদি বলল।
“বলেন কি?” ভদ্রলোক একটা প্লাস্টিকের বক্স আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বিস্ময়কর ভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল।
বাক্সটা খুলে, কয়েনগুলো গোনা শেষ করেই টিটোদি বলল,
“একটা কয়েন তো মিসিং বলে মনে হচ্ছে!”
ভদ্রলোক টিটোদির হাত থেকে বাক্সটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে কয়েনগুলো গু নতে গুনতে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল ,
“দশটা কয়েন ছিল, এখন তো দেখছি নটা আছে। কিন্তু আপনি কীভাবে সন্দেহ করলেন?”
“আপনার কয়েনগুলো কোন রাজার আমলের নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন?”
“হ্যাঁ অবশ্যই লক্ষীনারায়ন।”
“একদম ঠিক বলেছেন। গোপালবাবুর কয়েনগুলো ছিল নরনারায়ণের আমলের। আমি আপনাদের এক্সিবিশনের ছবিগুলো দেখতে পাই সদ্য পাবলিশ হওয়া একটা বইতে। সেখান থেকেই ব্যাপারটা জানতে পারি। গোপালবাবুর ছবিগুলোর হাফ এরও বেশি আমি ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। সবগুলোই নরনারায়ণের আমলের। তারপর আমি গোপালবাবু র ঘরে গিয়ে দেখতে পাই তার মধ্যে একটা কয়েন লক্ষ্মীনারায়ণের আমলের। তখনই আমার সন্দেহ হয়। আপনার ঘরে চলে আসি।”
এবার আমি টিটোদি র মিথ্যে বলার কারনটা কিছুটা অনুমান করতে পারছিলাম। টিটোদি কী তাহলে গোপালবাবুকে সন্দেহ করছে!
“তাহলে কি আমার কয়েন নিয়েছে ও?” মধুসূদনবাবু বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“হতেও পারে। একটা অন্যরকম কয়েন ওঁর সংগ্রহে চলে আসবে সেই জন্য প্রথমে কয়েন হারানোর নাটক করে পরে আপনার থেকে কয়েন নিয়েছে। পরে আপনার কয়েন হারানোটা ধরা পড়লেও ভৌতিক ব্যাপার বলে এটাকে চালিয়ে দিতে পারবেন।”
“কিন্তু সেটা তো আমাকে বললেই বদলাবদলি করে নেওয়া যেত। আর ওকে অনেক দিন থেকেই চিনি। শেষে এরকম একটা বাজে কাজ করে বসলো।” মধুসূদনবাবু বললেন।
“ঠিক আছে আপনি এখনই কাউকে কিছু বলবেন না। আমি কয়েনের বাকি ছবিগুলো একবার ভালো করে খুঁটিয়ে দেখি।” টিটোদি বলল।
“তাই দেখুন। আমি তো ভাবতেই পারছি না।” মধুসূদনবাবু ফ্যাকাশে মুখ করে কথাটা বললেন।
“আপনার গোপালবাবুকে কেমন লোক বলে মনে হয়?”
“বেশ ভালোই লোক। প্রায় পাঁচ বছর ধরে আমাদের আলাপ। বাড়িতেও গেছি ওর বার দুয়েক। একটা কয়েন এর জন্য শেষ অবধি এরকম করবে! কী জানি বাপু!”
“আচ্ছা আমি আপনার ঘরটা একটু পরীক্ষা করে দেখতে চাই। আপনার কোন আপত্তি নেই তো?” টিটোদি বলল।
“বেশ তো দেখুন না। আপত্তি থাকবে কেন! আপনি তো আমার উপকারই করছেন।”
টিটোদি চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে আলমারির হাতলটা ধরে আলমারীটা খুলে ভেতরটা ভাল করে দেখল। তারপর আমার হাত থেকে কয়েনের বাক্সটা নিয়ে সেটাকে আলমারির ভেতর রেখে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল
“মনে কর মধুসূদনবাবু বাথরুমে গেছে। দরজাটা ভেতর থেকে ভাজানো রয়েছে। তুই বাইরে থেকে চটপট এসে ভেতরে রাখা বাক্স থেকে একটা কয়েন বের করে নিয়ে আবার বাইরে যা।”
টিটোদির কথামতো আমি পুরো ব্যাপারটাই সম্পূর্ণ করলাম। টিটোদি খুব খুঁটিয়ে পুরো ব্যাপারটা দেখছিল। আমি কথা মত একটা কয়েন বের করে তার হাতে দিতেই,
আমাকে ইশারায় বসতে বলে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নিয়ে আলমারির কাছে গেল। সবকিছু ভালো করে খুঁটিয়ে দেখার পর পকেট থেকে ফিতে বের করে কী সব মাপজোক করল, যার মাথা মুন্ডু আমি বা মধুসূদনবাবু কেউই কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মত তাকিয়ে থাকলাম।
সব পর্যবেক্ষণ শেষ করে চেয়ারটা টেনে নিয়ে আবার আগের জায়গায় বসল টিটোদি। তার মুখ গম্ভীর, কপালে আর মুখে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট।
“আপনি এখনই কাউকে কিছু বলবেন না। ব্যাপারটা খুব জটিল হয়ে যাচ্ছে। গোপালবাবু আপনার রুমে এসেছিল কিনা জানি না তবে অন্য একজন ঠিকই এসেছিল। আমার একটু সময় লাগবে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে। ততক্ষণ অবধি স্পিকটি নট।”
“আমি কাউকে কিছু বলবো না এই ব্যাপারে আপনি আশ্বস্ত থাকতে পারেন।” মধুসূদনবাবু বললেন।
* * *
দরজায় খটখট শব্দ শুনে ঘুমটা যখন ভাঙলো, তখন ঘরে জ্বালানো টিউব লাইটের আলোতে দেখতে পেলাম টিটোদি উঠে দরজার দিকে যাচ্ছে। শ্রীকান্তদা তখনও বেশ দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। দরজাটা টিটোদি খুলে ফেলতেই দেখতে পেলাম দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে গোপালবাবু। মুখ দেখে মনে হল বেশ ভয় পেয়েছেন। আমি মোবাইলটার সুইচ টিপে একবার সময়টা দেখে নিলাম। রাত বারোটা।
“আজকে আবার দরজায় খট খট। প্রথমে সেদিনকার মতই কেউ মশকরা করছে ভেবেই দরজাটা খুলি। খুলে দেখি বাইরে কেউ নেই , আর দরজার বাইরে রাখা আমার জুতো জোড়াও সেখানে নেই। অনেকটা দূরে বাগানের কাছে পড়ে রয়েছে। আমি একটু ভয়ে ভয়েই এগিয়ে গিয়ে জুতো জোড়া নিয়ে আসি। কিন্তু ফিরে এসে টেবিলের কাছে আসতেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। সেখানে এই কাগজটা দেখতে পাই।”
বলেই ভদ্রলোক টিটোদির দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন। ততক্ষণে আমিও দরজার কাছে চলে এসেছি। কাগজটাতে রক্তের মত লাল রং দিয়ে লেখা রয়েছে সাবধান। আর তাতে একটা মানুষের মাথার খুলি আঁকা।
কাগজটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ ভেবে টিটোদি বলল
“চলুন তো আপনার ঘরে গিয়ে দেখি একবার।”
আমাদের কথাবার্তায় ততক্ষণে শ্রীকান্তদা ও বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে আমাদের পাশে।
আমরা চারজন মিলে গোপালবাবু র ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের সবাইকে বাইরে দাড়াতে বলে ঘরের ভেতরটা অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখল টিটোদি। তারপর ফিরে এসে বলল,
“কাল সকালে আপনার বন্ধুদের সাথে একটু কথা বলতে হবে। ঘুম থেকে কখন ওঠেন ওঁরা?”
“ঐতো প্রেমা যখন চা দিয়ে যায় তারপরই সবাই উঠে বাইরে আসে।”
“তার মানে সকাল ছটা অবধি অপেক্ষা করতে হবে।” একটু গম্ভীর মুখ করে টিটোদি বলল।
“আমার তো খুব ভয় করছে রাতে যে কী করে থাকবো!”
“কোন ভয় নেই। আপনি অসুবিধা হলেই আমাদেরকে ডাকবেন। দরকার হলে আমাদের কেউ এসে আপনার সাথে থাকবে।”
ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করে ঘরে ফেরার পর আমাদের দুজনকে ঘুমোতে যেতে বলে, টিটোদি রিডিং ল্যাম্প জেলে কালিম্পঙ আর্ট গ্যালারি থেকে কিনে আনা বইটা পড়তে শুরু করল আর তার সাথে আমাদেরকে ওয়ার্নিং দিয়ে দিল আমরা যেন কোনওভাবেই তাকে ডিস্টার্ব না করি।
ঘন্টাখানেক পরেও আমার ঘুম আসছিল না। শ্রীকান্তদারও যে একই অবস্থা সেটা তার বার বার পাশ ফিরে শোয়া দেখেই বুঝতে পারছিলাম। টিটোদি এবার রিডিং ল্যাম্পটা অফ করে, বইটা রাখতে রাখতে বলল।
“তোরা কি ঘুমিয়েছিস?”
আমরা দুজনের কেউই ঘুমাইনি দেখে বলল,
“খুব অদ্ভুত ব্যাপার বুঝলি! কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছি না। সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে।”
“এখন অবধি তো কিছুই খুলে বললে না। কী বুঝতে পারলে সেটা তো বলো।”
“খুলে বলার সময় এখনো আসেনি।” বেশ গম্ভীর মুখ করে কথাটা বলল টিটোদি।
“তুমি তো প্রথমে গোপালবাবুকে সন্দেহ করছিলে!”
“গোয়েন্দার কাজই হল সন্দেহ করা। আর গোপালবাবু ছাড়াও যে অন্য কারো ইনভলভমেন্ট এতে আছে সেটা বিকেলেই বুঝতে পেরেছিলাম।”
“তুমি তখন মধুসূদনবাবুর ঘরে মাপামাপি করে কী বুঝলে?”
– “প্রথমে মধুসূদনবাবুর কয়েন গোপালবাবু র কাছে কি করে গেল সেটা ভাবি। একবার মনে হল গোপালবাবু নিজেই নিয়ে থাকতে পারেন। তারপর মধুসূদনবাবুর ঘরে গিয়ে তোকে আলমারির থেকে কয়েন গুলো বের করতে বলি। তখন লক্ষ করি তুই একদম আলমারির দরজার গা ঘেঁষে কাজটা করলি। সেটা কেন করলি বল তো?”
“সেটাই তো স্বাভাবিক কারণ সময় খুব কম আর তাছাড়া পুরো দরজাটা খুললে শব্দ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”
“ঠিকই বলেছিস, আমাদের অপরাধীও একই জিনিসটাই করেছে, আমি হলেও তাই করতাম হয়তো। এটাই হিউম্যান সাইকোলজি। বেশিরভাগ মানুষ এই জিনিসটাই করবে। তো যাই হোক আমি ভালো করে ম্যাগনিফাইন গ্লাস দিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর আলমারির একটা জায়গাতে তেলাক্ত ভাব লক্ষ্য করি।”
“ওটা কি তাহলে কারো চুলের তেল?” অজান্তেই আমার মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে গেল।
“একদম ঠিক ধরেছিস। মধুসূদনবাবুর মাথায় চুল নেই, কাজেই তার মাথার থেকে নিশ্চয়ই লাগবে না। গোপালবাবু র হাইট ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। কিন্তু তেলের দাগটা পেয়েছি প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। ভূষণবাবু এবং প্রসেনজিৎবাবু দুজনেরই হাইট ওই রেঞ্জের। তাই তাদের মধ্যে যে কেউ একজন আলমারি খুলে থাকতে পারে বলেই মনে হচ্ছে।”
“এমনিও তো কোনও কারণে ওদের দুজনের কেউ আলমারির কাছে যেতে পারে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“তা অবশ্যই পারে। সবকিছুই সম্ভাবনা। এ জগত টাই টিকে আছে অনেক সম্ভাবনার ওপর। এরকম অনেক সম্ভাবনা ধরেই আমাদের এগিয়ে চলতে হয়। তার মধ্যে কিছু ঠিক হয় আবার কিছু ভুল ও হয়। প্রবাবিলিটি থিওরি খুব ইম্পর্ট্যান্ট বুঝলি তো।”
“তাহলে কয়েনটা গোপালবাবুর কাছে গেল কি করে? আর দুদিন ধরে কেউ গোপালবাবুর ঘরের দরজা ধাক্কাই বা দিচ্ছে কেন?” শ্রীকান্তদা জিজ্ঞেস করল।
“হতে পারে ভদ্রলোক নিজেই একটা সিন ক্রিয়েট করতে চাইছেন। যাতে মধুসূদনবাবুর কয়েন উধাওয়ের ব্যাপারটা জানাজানি হলে সেটা ভৌতিক ব্যাপার বলেই মনে হয়।”
“আচ্ছা মধুসূদনবাবুও তো আজকে ভয়টা দেখিয়ে থাকতে পারেন। ওঁর কয়েন গোপালবাবু নিয়ে নিয়েছেন বলে।”
“ওঁকে দেখে মনে হয় না এত সাহস হবে ওঁর এই রাতের বেলায় বেরিয়ে এসব করার। আর তাছাড়া আমি ওঁকে এখন একটু ওয়েট করে দেখতে বলেছি আশাকরি ভদ্রলোকের সে কথা শুনবেন।” টিটোদি বলল।
“তাহলে এখন কী করবে?”
“এখন আপাতত ঘুমাবো। কাল সকাল ছটায় মনে করে অবশ্যই ডেকে দিবি। ভূষণবাবুর ঘরে একবার যেতে হবে এবং সেটা বেড টি দেওয়ার সময়ই। আর হ্যাঁ, এখন একটু স্টাডি করে যা পেলাম সেটা মারাত্মক। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের সমস্ত চিন্তাভাবনা নতুন করে ভাবতে হবে। সেটা কনফার্ম হবার জন্য একটু কা লিম্পং ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনা করতে হবে।”
আমরা সবাই লাইট বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়েছি। অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই কিছুতেই ঘুম আসছিল না। সকাল পৌনে ছয়টায় অ্যালার্মটা দিয়ে রাখলাম মোবাইলে। এখনো অবধি যা বোঝা গেল তাতে কয়েন চুরির ব্যাপারে একমাত্র মধুসূদনবাবুকে সন্দেহ তালিকার থেকে বাইরে রাখছে টিটোদি। আলমারি খোলার ব্যাপারে টিটোদির অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে প্রসেনজিৎবাবু এবং ভূষণবাবু দু’জনকেই সন্দেহ করতে হয়। আবার এও হতে পারে গোপালবাবুর বলা পুরো ভুতুড়ে ব্যাপারটাই আসলে মন গড়া। আবার যদি গোপালবাবুর কথা সত্যি হয় সে ক্ষেত্রে মধুসূদনবাবু ও রাতে দরজায় শব্দ করে থাকতে পারে। কিন্তু টিটোদি সেটা বিশ্বাস করতে চাইছেনা। পুরো ব্যাপারটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। তারমধ্যে আবার কী একটা মারাত্মক ব্যাপারে সন্ধান পেয়েছে বলল টিটোদি। সে ব্যাপারটা সম্পর্কেও খোলসা করে কিছু বলল না আবার!
অ্যালার্মের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল কোনরকমে উঠে গিয়ে টিটোদিকে ডাকতে যাব দেখি সে উঠে বিছানায় বসে আছে।
“তুমি উঠে পড়েছ?” ঘুম ঘুম চোখে জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ ঠিক সাড়ে পাঁচটায় অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। যদি মিস করে যাই তাই তোকেও বলেছিলাম অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে। এখন তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে চল। ভূষণবাবুর রুমে যেতে হবে।”
শ্রীকান্তদাকে একরকম জোর করেই রুম থেকে বের করে নিয়ে আসলাম আমরা। বাইরে এসে কয়েক মিনিট হাঁটাহাঁটি করতেই আমরা দেখতে পেলাম চায়ের কাপ ভর্তি ট্রে হাতে নিয়ে প্রেমা এগিয়ে আসছে। টিটোদি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে আমাদের চা টাও ভূষণবাবুর ঘরে দিয়ে দিতে বলল।
আমরা ভূষণবাবুর ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লাম। খানিকক্ষণ পর ভূষণবাবু এসে দরজা খুললেন।
“এত সকালে কী মনে করে?” আমাদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে কথাটা বললেন ভদ্রলোক।
“আসলে আমরা হাঁটছিলাম বাইরে। আপনার এখানে চা নিয়ে আসছে দেখে আমাদেরটাও আপনার এখানেই দিয়ে দিতে বললাম।”
“আচ্ছা বেশ। ভেতরে আসুন আপনারা।”
প্রেমা চা দিয়ে চলে যাওয়ার পর, চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে তৃপ্তি ভরা ঠোঁটে একটা শব্দ করে প্রসেনজিৎবাবু বললেন,
“আপনারা আর কদিন থাকবেন এখানে?”
“কালকের দিন অবধি আছি। এতদিনের প্ল্যান করে আসিনি অবশ্য কিন্তু বেশ ভালো লেগে গেল তাই আরও দুদিন বুকিং এক্সটেন্ড করে নিলাম।” টিটোদি বলল।
“আমিও তো আজই চলে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু সবার সাথে আড্ডা মেরে ভালোই সময় কেটে যাচ্ছে। তাই অফিসে ফোন করে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে নিলাম। আবার একসাথে কবে সবার দেখা হবে কে জানে!”
“আপনারা কি মাঝেমাঝেই মিট করেন?”
“তা করি। তবে সবাই একসাথে হয়ে ওঠে না। অনেক বছর পর সবাই মিলে একসাথে মিট করলাম। আসলে আমাদের পরিচয়টা এরকম বিভিন্ন এক্সিবিশনে গিয়েই।”
“আপনারা কি আজ কোথাও ঘুরতে যাবেন নাকি?” ভূষণবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ একবার কালিম্পং এর বাকি জায়গাগুলো ঘুরে দেখব।” টিটোদি বলল।
“আজ ওয়েদার বেশ ভালই আছে মনে হচ্ছে। ঘুরে আসুন ভালোই লাগবে।” প্রসেনজিৎবাবু বললেন।
“একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে তো ভুলেই গেছি!গোপালবাবুর সাথে আপনাদের কথা হয়েছে কি? কাল রাতে নাকি আবার তার ঘরে ভূত এসেছিল।”
“তাই নাকি! না ওর সাথে তো আর দেখা হয়নি সকালে। আপনি কখন জানতে পারলেন?” প্রসেনজিৎবাবু বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“কাল রাতেই এসেছিলেন ভদ্রলোক। তখন প্রায় রাত বারোটা হবে।” টিটোদি বলল।
শেষ হয়ে যাওয়া চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে ভূষণবাবু দরজার বাইরে রেখে এলেন।
“আপনার বা পায়ের নিচের দিকে পায়জামায় সাদা ওটা কী লেগেছে?” ভূষণবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল টিটোদি।
একটু দাঁড়িয়ে গিয়ে নিচে ঢুকে পায়জামাটা লক্ষ করে ভূষণবাবু বললেন
“ও হ্যাঁ তাই তো। আমি তো ঠিক লক্ষই করিনি। হয়তো টুথপেষ্টের দাগ হবে।”
ভূষণবাবু কাপটা বাইরে রাখার পর, কা পের চা টা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে এক পকেট থেকে মোবাইল আরেক পকেট থেকে রুমালটা বের করতে গিয়ে টিটোদির হাত থেকে রুমালটা পড়ে গেল। রুমালটা তুলতে গিয়ে রীতিমতো খাটের নীচে ঝুঁকে পড়তে হল টিটোদিকে।
রুমালটা তুলে নিয়ে ইশারায় আমাদের উঠতে বলল টিটোদি। ওঁদের আপাতত বিদায় জানিয়ে আমরা ঘরে ফিরে এলাম।
“কিরে কী বুঝলি?” আমার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল টিটোদি।
“রুমালটা তুমি ইচ্ছে করে ফেলেছ সেটা বুঝলাম। কী দেখতে পেলে বলতো?”
“যাক তুই ইম্প্রুভ করছিস। দেখলাম ভূষণবাবুর বিছানার নিচে আলতার বোতল।”
“আলতা! চিঠিটা তাহলে ভূষণবাবু লিখেছে?”
একটু হেসে নিয়ে টিটোদি আবার জিজ্ঞেস করল,
“শ্রীকান্ত তুই অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ করলি?”
“কার ব্যাপারে বলছিস? আমি তো দুজনের কারো মধ্যেই অস্বাভাবিক কিছু দেখলাম না।” শ্রীকান্তদা বলল।
“টিটোদি, ভূষণবাবুর প্যান্টের নিচে সাদা দাগ।”
“সেটা তো আমিই জিজ্ঞেস করলাম। দাগটা কিসের সেটা বল!”
“ভদ্রলোক তো বললেন টুথপেস্টের দাগ।” শ্রীকান্তদা বলল।
“তোর মুন্ডু।” একটা বিরক্তির ভাব নিয়ে টিটোদি বলল।
“গোপালবাবু র ঘরের মেঝেতে চুনের গেলাসটা উল্টে ছিল। ওটার কি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“এক্সেলেন্ট।”
“তাহলে কি চিঠিটা ভূষণবাবুই লিখেছে? কিন্তু যদি লিখেও থাকে তাহলে কেন? এর সাথে কয়েন চুরির বা কী সম্পর্ক!”
“তুই একটু ভাব। আমি সব বলে দিলে তো হয়েই গেল। অবশ্য কয়েন চুরির ব্যাপারটা তোর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আমাকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছে ব্যাপারটা বুঝতে, তবুও এখনও নিশ্চিত হতে পারছি না। আজকের লাইব্রেরীতে গেলে কিছুটা নিশ্চিত হতে পারব আশা করি।”
একটা সামান্য কয়েন এর ব্যাপারে জানতে টিটোদিকে লাইব্রেরীতে যেতে হবে! বেশ অবাক হচ্ছিলাম আমি। সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে গোপালবাবুর কয়েন চুরি হল তারপর জানা গেল ওটা আসলে নিচেই পড়েছিল। তারপর টিটোদি জানাল উদ্ধার হওয়া কয়েনটা আসলে মধুসূদনবাবুর। গোপালবাবুই হয়তো কয়েনটা সরিয়েছে মধুসূদনবাবুর কাছ থেকে, আর তারপর ভূতের ব্যাপারে নাটক করছে সেরকমই ধারণা করেছিলাম আমরা। এখন দেখা যাচ্ছে ভূষণবাবু চিঠি লিখে সত্যিই ভয় দেখিয়েছে গোপালবাবু কে, কিন্তু কেন! গোপালবাবু কি তাহলে অজান্তেই কয়েনটা নিয়েছে! বারবার সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। টিটোদিকে এসব নিয়ে এখন জিজ্ঞেস করে কোন লাভ হবে না সেটা আমি ভালোই জানি। তাহলে আর কি এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই!
ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে আমরা রওনা দিলাম কা লিম্পং ডিস্ট্রিকট লাইব্রারির দিকে। সকালে গিয়ে প্রথমে একটা করে কার্ড বানালাম আমরা। তারপর লাইব্রেরিয়ানের কাছে গিয়ে তিনটে বই চাইল টিটোদি ,
Studies in Indian Coins by D.C. Sircar,
A Rare Gold Coin of Koch Kingdom by Bijoy Kumar Sarkar and Debajit Dutta,
আর
Symbols in Naranarayan’s Mudra and a Case of Khyrim Coins by S.K. Bose.
আমাদেরকে ১০ মিনিট পরে আসতে বলল লাইব্রেরিয়ান। আমরা বাইরে রাখা বেঞ্চে এসে বসলাম। টিটোদি বলল,
“আমার এখানে একটু সময় লাগবে। তোরা দুটো জায়গা ঘুরে আয় ততক্ষণে। একটা হল ডক্টর graham’s হোম আরেকটা পাইন ভিউ নার্সারি। একটা লোকাল ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাবি। আমার হয়ে গেলে আমি ফোন করে নেব।”
“হোম এ গিয়ে আমরা কী করব!” আমি বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“ওটা কোনও সাধারণ হোম নয়। শোন তাহলে তোদের গল্পটা বলি।
১৮৬৫ সালের ডুয়ার্স যুদ্ধের পরে ভুটান থেকে ব্রিটিশ শাসনে সম্প্রতি যুক্ত হওয়া ছোট্ট কালিম্পং গ্রামে মিশনারি কাজ করতে স্কটল্যান্ডের ইয়াং মেনস গিল্ড এর প্রতিনিধি হিসাবে জন অ্যান্ডারসন গ্রাহাম কলিম্পং পৌঁছেছিলেন। কালিম্পং পৌঁছানোর মাত্র কয়েক বছর পরেই মিঃ গ্রাহাম একজন সমাজ সংস্কারক হিসাবে কাজ করতে শুরু করেছিলেন। যিনি সেই সময়কার ব্রিটিশ ভারতের “পুওর হোয়াইট প্রবলেম” সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। “পুওর হোয়াইট” রা ছিল ব্রিটিশ পিতৃপুরুষ এবং “নেটিভ” মায়েদের সন্তান যাদের সমাজে কোন রকম স্বীকৃতি ছিল না। ব্রিটিশ এবং উচ্চবিত্ত ভারতীয়দের দ্বারা বিরত থাকা মিশ্র-বর্ণের শিশুরা শহরের রাস্তায় মারা যেত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। এইসব বাচ্চাদের ই St. Andrew’s Colonialএ পড়াশোনা করানো হত। হিমালয়ের বিশুদ্ধ বাতাসে বাচ্চাদের এই সুন্দর স্কুলটি নিঃসন্দেহে এখনও সবার নজর কাড়বে। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৭ সনে এই হোম এর নাম পরিবর্তন করে ডক্টর গ্রাহামস হোম করা হয়। বহু বিখ্যাত লোক এখান থেকে পড়াশোনা করেছেন যাদের মধ্যে রয়েছেন সম্প্রতি কালের ভুটানের দুই রাজা, বলিউড সিনেমাটোগ্রাফার, রাইটার এমনকি ইউপিএসসির চেয়ারম্যান পর্যন্ত ।
এখানকার ভবনগুলি বেশিরভাগ স্কটিশ স্থপতিদের,তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল।”
১০ মিনিট পর লাইব্রেরিয়ানের কাছে গিয়ে খোঁজ করতেই তিনটে বইই পাওয়া গেল। বইগুলোর প্রথম পাতা উল্টাতেই এক্সেশন কার্ড তিনটে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে টিটোদি জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বুঝলি?”
আমি কিছু না বুঝেই হাঁদার মতো তাকিয়ে থাকলাম। শ্রীকান্তদারও একই অবস্থা।
“তিনটে বইই এর আগের জনকে একই ডেটে অর্থাৎ ফার্স্ট এপ্রিল ইস্যু করা হয়েছিল।”
“মানে একজনই তিনটে বই নিয়েছিল?”
“তাই তো মনে হচ্ছে।”
“কি কোইন্সিডেন্স তাই না?”
“এটা কোনও কোইন্সিডেন্স নয়। ভেবে চিনতেই বইগুলো একসাথে নেওয়া হয়েছে। আমি যেভাবে ইন্টারনেট থেকে এগুলোর খোঁজ পেয়েছি। সিম্পল ভাবে সেই ব্যক্তিটিও খোঁজ পেয়েছিল একইভাবে।”
“এ তো দেখছি রহস্য একদম জমজমাট।” শ্রীকান্তদা বলল।
“শোন নিলু তোকে একটা কাজ করতে হবে। এক্সেশন কার্ডে লেখা কার্ড নাম্বার গুলো একেবারে অস্পষ্ট আর ওভাররাইট করা রয়েছে। এটা দেখে কিছুতেই লাইব্রেরী কার্ড নাম্বার বের করা সম্ভব নয়। তুই যেকোনও একটা বই তোল লাইব্রেরী থেকে। ইসু রেজিস্ট্রারের ভালো করে লক্ষ্য করবি এই তিনটে বই ফাস্ট এপ্রিল কার নামে ইস্যু করা হয়েছে আর কার্ড নম্বর কী আছে।”
“আমি কী বই তুলব?”
“যা খুশি একটা তোল। “
প্রায় মিনিট কুড়ি পর আমি ফিরে এসে টিটোদিকে বললাম,
“নাম তো দেখতে পেলাম না। কার্ড নাম্বারটাও নোট করেনি ঠিকমত। এখানের ডকুমেন্টেশন একেবারে ভুলভাল। আর তিনটে জায়গাতেই একই লোকের সিগনেচার করা মনে হল।”
“একই লোকের সিগনেচার থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কার্ড নাম্বারটা পেলেও কিছু বোঝা যেত। আসলে দিনের দিন পড়ে ফেরত দিলে কার্ড নম্বর, নাম এসব ভালো করে নোট করে না এরা। শুধু কার্ডটা জমা রেখেই বইটা দিয়ে দেয়। বাড়িতে নিয়ে গেলে তাহলে সবকিছু নোট করে।”
টিটোদিকে একা ছেড়ে দিয়ে আমরা একটা লোকাল ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম ডক্টর graham’s হোমে। ওখানে পৌঁছে দেখলাম পুরো জায়গা এখনও স্কটিশদের আভিজাত্য ধরে রেখেছে। ঠিকই বলেছে টিটোদি। এখানকার ভবনগুলি যে স্কটিশ স্থপতিদের,তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল সেটা এখনো দেখলে বেশ বোঝা যায়।
“দারুন জায়গা কিন্তু। না এলে মিস করতুম। কি বলো নিলু?”
“অবশ্যই।”
“তারপর এই কেসটার কী বুঝলে? আমার তো সবটাই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।”
“এখনো আমি অত ভালো করে কিছুই বুঝতে পারছি না। গোপালবাবু সত্যি বলছে না মিথ্যা, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। উনি যদি নিজেই কয়েনটা নিয়ে থাকেন তাহলে ভুষনবাবু
ওর ঘরে গিয়েছিল কেন? কিছুতেই হিসেব মিলছে না। ওই বই তিনটৈই বা কে নিয়েছিল? সেটাও তো কিছু খোলসা করে বলল না টিটোদি।”
“রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে দেখছি।”
“ঠিকই বলেছ।”
“তোমার কি মনে হয়, মরগান হাউসে ভূত আছে না নেই?”
– “এই রে, কঠিন প্রশ্ন। আমার এ বিষয়ে কোনও ধারনাই নেই।”
আমরা হয়তো আরও কিছুক্ষণ এখানে থাকতাম। কিন্তু আমরা এখানে আছি শুনে টিটোদি ফোনে বলল, আমাদের যদি এই জায়গা ঘোরা হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আমরা যেন পাইন ভিউ নার্সারি চলে আসি ওর যা দরকার ছিল সেটা বইতে পেয়ে গেছে।
আমরা নার্সারীর কাছে পৌঁছাতেই দেখি টিটোদি টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে আছে।
রাস্তার সঙ্গেই নার্সারিটি। এখানে পাইন খুব জনপ্রিয় বলেই হয়তো নার্সারির নামের সঙ্গেও পাইন জুড়েছে।
নার্সারীর ভেতরে ঢুকে কতগুলো ক্যাকটাসের সামনে এগিয়ে গিয়ে টিটোদি জিজ্ঞেস করল
“ক্যাকটাস কী বল তো?”
“এক ধরনের উদ্ভিদ। মানে এটি কাঁটা জাতীয় উদ্ভিদ।”
“ঠিকই বলেছিস। কত রকমের ক্যাকটাস আছে পৃথিবীতে জানিস?”
আমি বা শ্রীকান্তদা দুজনেই মাথা নাড়লাম। এ আমাদের পক্ষে জানা কিছুতেই সম্ভব না।
“বিশ্বে ১৭০০ র ও বেশি প্রজাতির ক্যাকটাস আছে।”
“বলিস কি? আমি তো ভাবতেই পারছিনা!” শ্রীকান্তদা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইল না যে সত্যিই এত রকমের ক্যাকটাস থাকতে পারে।
“হ্যাঁ। শুনে অবাক লাগলেও এটাই সঠিক। প্রাচীন গ্রিক শব্দ ককটক থেকেই সম্ভবত এর নামকরণ। মরুভূমির ক্যাকটাসের কাঁটা আরও ধারালো হয়। ক্যাকটাস এর অভিযোজন ক্ষমতা খুব বেশি। যে কোনও পরিবেশর সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে। এজন্য মরুভূমিতে ক্যাকটাস দিব্যি হেসে খেলে বেড়ে ওঠে।”
নার্সারিটা খুব বেশি বড় না হলেও এর সংগ্রহ কিন্তু বেশ চোখে লাগার মত। মাঝখানে লম্বা লন আর দুপাশে ক্যাকটাস বন। বাঁ য়ে গ্রিন হাউজ এর ছোট ছোট ছাউনি। ডানে বড় জায়গা নিয়ে একটা অনেক বড় প্ল্যান্টেশন প্ল্যান্ট।
একটা বোগেনভেলিয়া এত সুন্দর লাল হয়েছিল সবার চোখ যেতে বাধ্য। আমি টিটোদির সাথে বোগেনভেলিয়া এর পাশে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলে নিলাম।
“আচ্ছা তুমি বইগুলোতে কী পেলে?” আমি নার্সারির ভেতর হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলাম।
“যা এক্সপেক্ট করেছিলাম সেটাই পেয়েছি। কয়েনটা গোপালবাবু নিজে সরায়নি, সরানো তো দূর উনি তো এ বিষয়টা জানেনই না। তার নিজের যে কত বড় ক্ষতি হয়েছে সেটাও তিনি বুঝতে পারছেন না। কিন্তু অপরাধী কে সেটা এখনো নিশ্চিত হতে পারছি না।”
“ওঁর ক্ষতি হতে যাবে কেন! আর তাহলে গোপালবাবুর আরেকটা কয়েনই বা গেল কোথায়? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”
“যথা সময়ে সব বুঝতে পারবি।”
“অনেকক্ষণ তো হল এবার প্যারাগ্লাইডিংটা করতে গেলে হয় না। আজকে কিন্তু করব কথা ছিল।”
টিটোদি বলেছিল আজ আমরা প্যারাগ্লাইডিং করব। আমরা আর সময় নষ্ট না করে প্যারাগ্লাইডিং এ যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে বসলাম।
“তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। লাইব্রেরীর রেজিস্টারে তিনটে সিগনেচারই সবুজ কালি দিয়ে করা ছিল।” আমি যেতে যেতে বললাম।
“হোয়াট? এ কথাটা আগে বলিসনি কেন? তোর উপর ভরসা করাটাই আমার ভুল হয়েছে। ড্রাইভার জি আপ গাড়ি ঘুমাইয়ে অউর জলদি কালিম্পং ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরির চলিয়ে।”
ড্রাইভার কথামতো গাড়িটা ঘুড়িয়ে নিতেই টিটোদি বলল,
“আমাকে নামিয়ে দিয়ে তোরা রুমে চলে যা। আর রুমে গিয়ে লক্ষ্য রাখবি ওই চারজনের মধ্যে কেউ যেন চলে না যায়। মধুসূদনবাবুকে গিয়ে একা ডেকে বলবি কয়েন চোর ধরা পড়েছে। সবাইকে যেভাবেই হোক আটকে রাখতে। তারপর আমি এসে সব বলছি।”
কথামতো টিটোদিকে নামিয়ে দিয়ে আমরা মন খারাপ করে মরগান হাউসে ফিরে যেতেই বাইরে বারান্দায় মধুসূদনবাবুর সাথে দেখা হয়ে গেল। টিটোদির কথামতো তাকে সব বুঝিয়ে বললাম। সবটা শুনে মধুসূদনবাবু বলল,
“কারও তো আজকে যাওয়ার কোন প্ল্যান নেই। তবুও আমি দেখছি কেউ যেতে চাইলে আটকাব।”
আমরা ঘরে এসে একটু ফ্রেশ হয়ে প্রেমাকে চা দিতে বললাম। আমি আর শ্রীকান্তদা দুজনেই চুপচাপ এবং বেশ গম্ভীর। সবটাই দুজনের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
“এসব নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। চলো একটু রেস্ট নিয়ে নি। একটু পরে টিটো আসলেই পুরো ব্যাপারটা ক্লিয়ার হবে।”
খুব বেশিক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হলনা। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর টিটোদি এসে হাজির হল। বেশ হাসিখুশি মনে হল দেখে। ঘরে ঢুকেই বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,
“প্রেমাকে বলে দে কফি আর পকোড়া দিতে। আর ওঁদের চারজনকে নিয়ে ডাইনিং রুমে চলে যা। আমি দশ মিনিটে আসছি।”
আমি কাফি আর পকোড়া খাওয়ার জন্য সবাইকে ডাইনিং রুমে চলে আসতে বললাম। সবাই প্রায় তখনই চলে এলো। 10 মিনিট পর টিটোদি ও এসে হাজির হল।
প্রেমা কফি দিয়ে গেছে। পকোড়া হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলল।
“সবাই কাপ হাতে নিয়ে নিন। খেতে খেতেই গল্পটা শুরু করি।” টিটোদি বলল।
সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে থাকল।
“কিসের গল্প?” গোপালবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আপনার রুমের আসা ভূতের গল্প।”
“তাহলে ভূতই এসেছিল বলছেন?” ভূষণবাবু বলল।
“প্রথম থেকেই শুরু করি। তাহলে সবাই সব বুঝতে পারবেন। প্রথম দিন গোপালবাবুর ঘরের দরজায় ভূতের টোকা দেওয়ার পর আমি ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পারি ঘরে কেউ এসেছিল। কিন্তু কে সেটা তখনো বোঝা যায়নি। তারপর গোপালবাবুর হারিয়ে যাওয়া কয়েন আবার ফিরে পাওয়া গেল।
আমি আপনাদের এক্সিবিশনে ছবিগুলো ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পারি গোপালবাবুর কয়েনগলো ছিল কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণের আমলের। আর মধুসূদনবাবুর কয়েনগুলো ছিল রাজা লক্ষ্মীনারায়ণের আমলের। নারায়ণী কয়েন এর বিশেষত্ব এই যে, কয়েনগুলো একই রকমের দেখতে হলেও তাতে রাজার নাম লেখা থাকত।
আর আমি দেখে অবাক হই যে গোপালবাবুর রুমে যে কয়েনটা মেঝে থেকে পাওয়া যায় সেটা লক্ষ্মীনারায়ণের আমলের।”
“বলেন কি!” গোপালবাবু চমকে উঠলেন।
“হ্যাঁ প্রথমে আমার ধারণা হয়, একটা অন্যরকম কয়েন পাওয়ার লোভেই হয়তো আপনি এটা করে থাকতে পারেন। কিন্তু মধুসূদনবাবু এটা মানতে চাইলেন না। তারপর আমি মধুসূদনবাবুর আলমারিটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পারি আলমারিতে যে হাত দিয়েছিল তার হাইট আপনার থেকে অনেক বেশি। আচ্ছা প্রসেনজিৎবাবু আপনার কি কয়েন সম্পর্কে আগ্রহ একটু বেশি?”
“না। আমার তো পুরনো জিনিসের প্রতি একটু আগ্রহ আছে। কয়েনের ওপরও আছে।” “আপনার এতটাই আগ্রহ যে আপনি লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াশোনা করা শুরু করে দিলেন।”
এবার আমার মাথায় বিদ্যুৎ চমকানোর মতো একটা ব্যাপার খেলে গেল, সবুজ কালি তো অ্যাকাউন্টেন্টরাই ব্যবহার করে।
“এতে কী প্রমাণ হয়? আপনি কী প্রুভ চাইছেন? আর আপনাকে কে বলল যে আমি লাইব্রেরীতে গিয়ে কয়েনের বই পড়েছি?”
“তিনটে বই লাইব্রেরীতে একই দিনে ইস্যু করা হয়েছিল। আর যাকে ইস্যু করা হয়েছিল তার সই সবুজ কালি দিয়ে রেজিস্টারে করা ছিল।”
“সবুজ কালি দিয়ে কি শুধু আমি একাই সই করতে পারি। আপনি এত বুদ্ধি কোথায় রাখেন?”
“উত্তেজিত হবেন না আমাকে আগে শেষ করতে দিন। আমি আপনার সই এর ছবি তুলে নিয়ে গিয়ে আপনার অফিসের লোকজকে দেখাতেই সবাই সেটা আপনার সই বলে চিনতে পারে।”
“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন। আমি কয়েনটা চুরি করে গোপালবাবুর রুমে ফেলে এসেছি! আমি যদি নিয়েই থাকি তাহলে গোপালবাবুর রুমে কেন ফেলব!”
“কারণ আপনি যে তার আগেরদিনই গোপালবাবুর আলমারি থেকে একটা কয়েন সরিয়ে ফেলেছিলেন। সেটা আমি ধরে ফেলাতে একটা কয়েন চুরি করে নিয়ে ওখানে ফেলে রাখেন।”
“তখন থেকে আপনি যা তা বলে যাচ্ছেন। আমি কয়েন নিলে একটা কয়েন কেন নিতে যাব!”
“কারণ ওটা যে কোন সাধারণ কয়েন ছিল না। ওর ঐতিহাসিক গুরুত্ব যে প্রচুর। আপনি হয়তো জানেন না গোপালবাবু আপনার ত্রিশটা কয়েন এর মধ্যে একটা কয়েন ছিল মহারাজা বিশ্ব সিংহের আমলের। অনেক ঐতিহাসিক এখনো বিশ্বাস করেন যে নরনারায়ণের আগেও কোচবিহারের নারায়ণী মুদ্রা ছিল। কিন্তু সেটা এখনো অবধি কেউ খুঁজে পায়নি। আপনার পূর্বপুরুষেরা কোনও মামুলি কয়েন রেখে যায়নি সিন্দুকে।
প্রসেনজিৎবাবু আপনার দরজায় নক করে অনেকবার। আপনি বাইরে বেরিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে শুরু করলে। তিনি দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে তাড়াতাড়ি আপনার আলমারি থেকে কয়েনটা বের করে নিয়ে চলে যান কিন্তু তাড়াহুড়োতে চাবিটা আলমারিতেই রেখে যান। কয়েন চুরির ব্যাপারটা আপনারা কেউ জানতেও পারতেন না। আমি যখন নিছক কৌতুহলবশতই আপনাকে কয়েনগুলো গুনতে বলি তখন ব্যাপারটা ধরা পড়ে। এবারে প্রসেনজিৎবাবু দেখলেন আমি ডিটেকটিভ, তাই যাতে এটা নিয়ে বেশি নাড়াঘাঁটা না হয়, তার জন্য উনি মধুসূদনবাবুর কাছ থেকে একটা কয়েন নিয়ে আপনার ঘরে ফেলে গেলেন। এবারে মধুসূদনবাবুর ঘরে গিয়ে আলমারির দরজায় কারো মাথার চুল থেকে লাগা তেলের ছাপের উচ্চতা দেখে বুঝতে পারি হয় ভুষনবাবু নয়তো প্রসেনজিৎবাবু কেউ একজন এসেছিলেন আলমারি খুলতে। কিন্তু তখনও রহস্যটা পরিষ্কার হয় না কারণ তখন অবধি আমার ধারণা কয়েনটা আপনিই নিয়েছেন। তারপর আপনাদের এক্সিবিশনের সব ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পারি ওখানে একটা রাজা বিশ্ব সিংহের আমলের কয়েন ছিল। আর লাইব্রেরীতে সবুজ কালি দেখে খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে এটা প্রসেনজিৎবাবুর সই কারণ এই রংয়ের কালি সাধারণত অ্যাকাউনটেন্টরাই ব্যবহার করেন। তারপরেই আমি ওঁর অফিসে গিয়ে খোঁজখবর করে জানতে পারি যে সইটা ওঁরই। ওঁর অফিস থেকে কেউ টেলিফোনে খোঁজখবর এর কথা বলে দিতে পারে তার জন্য আমি নীলুকে বলে দিই কাউকে এখান থেকে বের হতে না দিতে।”
“আপনি এরকম মনগড়া গল্প বলতেই পারেন। এতে কিছুই প্রমাণিত হয় না।”
“কাল পুলিশ এসে সবকিছু সার্চ করলেই যা প্রমাণ হওয়ার হয়ে যাবে। আর তাছাড়া ওই কয়েন নিয়ে আপনি কিছুই করতে পারবেন না। এমনিতেও ধরা পড়ে যাবেন। আমার প্রমাণ করতে একটুকু অসুবিধা হবে না যে ওটা আপনি চুরি করেছেন।”
“এত বড় একটা ব্যাপার, আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু আমার ঘরে কয়েন পাওয়ার পরেও দরজার নক করে গেল কে? আরও চিঠিটাই বা কে দিয়ে গেল।”
“ভূষণবাবু আপনি এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না আমি বলব?”
“আমি? আমি কি করে জানব?” ভুষনবাবু যেন আকাশ থেকে পড়ল।
“আপনাকে আমি সেদিন জিজ্ঞেস করি আপনার প্যান্টে সাদা কিসের দাগ। ওটা ছিল গোপালবাবুর রুমে পড়ে থাকা চুনের দাগ। আপনার এই কান্ডের জন্য আমার সব হিসেব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কয়েন চুরির সাথে যে এর কোন যোগাযোগ নেই সেটা আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। তা আপনি এটা কেন করতে গেলেন? মূর্তিটা আপনাকে দেয়নি সে জন্যই কি?”
“তাছাড়া আবার কী! আমি এত খাটাখাটনি করে মূর্তিটার খোঁজ খবর নিলাম আর শেষে কিনা এরকমভাবে ছিনিয়ে নিল গোপাল! তাই ভাবলাম ওকে ভয় দেখিয়েই একটু মনের ঝালটা মেটাই।”
“প্রসেনজিৎবাবু আপনি কি কয়েনটা দেবেন না আমি কালকে পুলিশ ডাকব?” টিটোদি বলল
“এই নিন কয়েন। এই কয়েন আমি না নিলে সারা জীবন গোপালদার কাছে পড়ে থাকত। এর মূল্য ও কোনদিনই বুঝত না। আমার একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল কয়েনটার প্রতি।”
“আপনি সেটা সরাসরি গোপালবাবকে বলতে পারতেন। কোনভাবেই এটা বলে আপনার চুরিটাকে জাস্টিফাই করা যায় না।” টিটোদি বলল।
কয়েনটা আমরা সবাই হাত বদল করে দেখে নিলাম আর একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকলাম। একই রকমই দেখতে প্রায় বাকি কয়েনগুলোর মত শুধু একটা নামই যা আলাদা।
গোপালবাবু মধুসূদনবাবুর কয়েনটা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, ভূষণবাবুকেও মূর্তিটা অকশনে কেনা দামেই বিক্রি করে দিয়েছিলেন। আর এই কয়েনটাকে তিনি মিউজিয়ামে ডোনেট করে দেবেন বলেছেন, হয়তো সেটা ইতিহাস বদলে দেবে কোনও একদিন! প্রসেনজিৎবাবুর বিরুদ্ধে কোনও কেস অবশ্য আর করা হয়নি। আমরাও পরদিন প্যারাগ্লাইডিংটা করে তারপর শিলিগুড়ি ফিরেছিলাম। পাইন ভিউ নার্সারিতে বোগেনভেলিয়া গাছের তলায় তোলা টিটোদি আর আমার ছবিটা আমি ওয়ালপেপার করে রেখেছি মোবাইলে। আমাদের সম্পর্কটাও কখনও বোগেনভেলিয়া গাছটায় ফুটে থাকা আগুন লাল রঙের মতই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে কিনা সেটা বোধহয় সময়ই বলবে।