Getting your Trinity Audio player ready...
|
খবরটা এল দুপুরবেলা। লাঞ্চটা সবে সেরে একটু ঢুলুঢুলু হয়েছে সার্থক। ক্যান্টিনের মাংস-ভাতটা আজ জম্পেশ হয়েছিল। মাংসের ঝোলটা আজ যা বানিয়েছিল না হরিদা, বাড়তি দু’হাতা ভাত নিতে হয়েছিল তাকে! হরিদা ক্যান্টিনের হেডকুক, অনেকবছর ধরে আছে, হাতে জাদু আছে হরিদার! ওঁর হাতের রান্না খেলে যে কোন বড় রেস্টুরেন্ট ওঁকে তুলে নেবে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই! যারা লালবাজারের বদনাম করে তাদের প্রত্যেককে ক্যান্টিনে এনে হরিদার হাতের রান্না খাওয়ানোর ইচ্ছে হয় সার্থকের- নে, কতো নিন্দে করবি কর! দুনিয়ার সব জিনিষ খারাপ হয় না, পাঁকের মধ্যেও পদ্ম ফোঁটে! তবে লালবাজারকে ‘পাঁক’-এর সাথে তুলনা করাতে একটু অপ্রস্তুত লাগল নিজের। লালবাজার আজও শহরের প্রাণকেন্দ্র। কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া নানাবিধ অপরাধ এবং অন্যায়ের রাশটা লালবাজারই ধরে রাখে। আর কোন সরকারি দপ্তরকে এত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় কিনা জানা নেই সার্থকের। পাঁচ বছর এই ডিপার্টমেন্টে আছে সে, আগে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে ছিল, দু’ বছর হল স্পেশাল ব্রাঞ্চ জয়েন করেছে। নিজের ডিপার্টমেন্টের প্রতি সে কতোটা গর্ববোধ, কতটা শ্লাঘা অনুভব করে তা বর্ণনাতীত। তাই লালবাজারকে পাঁক সে কখনই মনে করে না, বরং তার কাছে সেটা স্বর্গের পুষ্করিণীর চাইতেও পবিত্র মনে হয়!
যেই খবরটা এল সেটা এরকম, ডানকুনিতে একটা সফট-ড্রিংক্স তৈরির কারখানাতে আগুন লেগেছিল গতরাতে। মাঝরাত্তিরে ঘটনাটি ঘটেছিল। কোন কর্মচারী সে সময়ে উপস্থিত ছিল না বটে কিন্তু আগুন লেগে প্রচুর যন্ত্রপাতি পুড়ে গেছিল। ফ্যাক্টরির প্রায় সাতখানা ইউনিট ছিল সবকটারই প্রায় অগ্নিদগ্ধ অবস্থা। প্ল্যান্টেশন ইউনিট তো পুড়ে ছাই! যা অনুমান করা হচ্ছে, প্রায় কোটি টাকার জিনিষ নষ্ট হয়েছে। সারারাত ধরে জ্বলেছে পুরো ফ্যাক্টরিটা! যে দুজন নাইটগার্ড সেখানে পাহারারত ছিল তারা নাকি আগুনের আঁচ পেয়েছে অনেক পরে। এতে স্পষ্ট হয় তারা দুজনই কুম্ভকর্ণের ঘুম ঘুমাচ্ছিল! টের পাওয়ার পর যখন দমকলে খবরটা জানানো হয় এবং যে দ্রততার সঙ্গে দমকল সেখানে পৌঁছে অগ্নিনির্বাহের কাজ আরম্ভ করে ততক্ষনে ফ্যাক্টিরর অর্ধেকটাই আগুনের পেটে চলে গেছে!
খবরটা দিলেন দত্তদা। সমীরণ দত্ত। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। সার্থকের সঙ্গে বিশেষ খাতিরদারি আছে। প্রথম ফোরসে জয়েন করার পর সার্থক এনার আন্ডারেই শিক্ষানবিশ ছিল। সার্থকের চেয়ে দশ বছরের সিনিয়ার, বয়সে এবং অভিজ্ঞতায়। বলা যায়, সার্থকের একরকম ‘লালবাজার তুতো ভাই’ এই সমীরণ দত্ত! সার্থকের মোবাইলে ফোন করে যখন খবরটা বলা আরম্ভ করেন তখন সার্থককেও কুইনাইন গেলা মুখে সব শুনতে হয়েছিল! দুপুরের মাংসভাতের আমেজটা সেখানেই ইতি হয়ে যায় এবং যে আসন্ন ভাতঘুমটাকে সে দু চোখের কাছে নিয়ে এসেছিল সেটাকে বিনাবাক্যব্যয়ে রিটার্ন পাঠাতে হয়!
“তা আগুনটা কীভাবে লাগল জানা গেছে কি?” সার্থক প্রশ্ন করে।
“সেটাই তো আসল প্রশ্ন! আমাদেরই তো সেটা খুঁজে বার করতে হবে, ফ্যাক্টরিতে আগুনটা কীভাবে লাগল, বা কে লাগাল!”
“লাগাল মানে? আগুনটা কেউ ইচ্ছে করে লাগিয়েছে বলতে চাইছেন?” সার্থক বিস্ময়ের সাথে বলল।
“সেরকম পসিবিলিটিজ তো থাকতেই পারে, আমাদের সবকটা দরজাই তো খোলা রাখতে হবে, তাই না? তাছাড়া সোজা জিনিষকে যদি ব্যাঁকাভাবে নাই বা দেখব, নটে শাঁকের তলায় মাছের আঁশটে গন্ধই যদি না পাব তাহলে গোয়েন্দা বিভাগে আছি কী করতে ভায়া!” দত্তবাবু হেসে জবাব দিলেন।
এমন কথা শোনার পর সার্থকের বিগড়ে যাওয়া মেজাজটা একটু হলেও হাল্কা হল। খানিক হেসে সে জবাব দিল, “বেড়ে ডায়লগ ঝাড়লেন তো! আজকাল খুব বাংলা ওয়েবসিরিজ দেখছেন বুঝি?”
“আরে রাখো তোমার ওয়েবসিরিজ! একে এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ড কীভাবে সুরাহা হবে তার ঠিক নেই তুমি পড়েছ ওয়েবসিরিজ নিয়ে! কি আছে ওই ওয়েবসিরিজে তোমার?”
“ছি, এরকম ওয়েবসিরিজের নিন্দে করবেন না। ওখানে কিন্তু পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে খুব গ্লোরিফাই করে দেখানো হয়। আমার তো দেখে গর্বে বুক চওড়া হয়ে যায়!”
“এই কেসটা সল্ভ করলে তোমার বুক আরও চওড়া হবে। তখন দেখবে নতুন করে জামাকাপড়ের মাপ নিতে হচ্ছে!”
“আচ্ছা দত্তদা, আমি এটা বুঝছি না, ঘটনাটা ঘটেছে যখন ডানকুনিতে, তখন স্পেশাল ব্রাঞ্চের কাছে খবর আসছে কেন? সেখানকার থানার পুলিশ তাহলে কি করবে?”
“ওদের তরফ থেকেই খবর পাঠানো হয়েছে ভায়া! ওরা স্পেশাল ব্রাঞ্চ আর ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টকে কেস হ্যান্ডেল করতে দিতে চায়। দে আর এক্সপেক্টিং সাম্থিং সিরিয়াস, মে বি আ টেররিস্ট ইনভলভমেন্ট!”
“বাবারে! এতদূর ভাবা হয়ে গেছে! এত দেখছি ব্লকবাস্টার সিনেমার স্ক্রিপ্ট তৈরি হচ্ছে!”
“এটা মজা করার সময় নয় সার্থক। খোদ হাওড়া কমিশনারেট কেসটা দেখছেন, ওখান থেকেই সিদ্ধান্ত হয়েছে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে ইনভলভ করার জন্য। খবরটা পেয়েই আমি তোমায় জানালাম। বিকেলের মধ্যে আশা করি অর্ডারও চলে আসবে। অ্যান্ড আই ফিয়ার, থিংস উইল গো টু ফার। ওরা আই বিতেও ইনভলভ করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে শুনছি!”
“যাহ কেলো! একেবারে আই বি? তাহলে আর সিবিআইই বা বাকি থাকে কেন, তাদেরকেও খবর দিক, তারপর সবাই মিলে একটা ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে যাওয়ার তদন্ত করি!” সার্থক সামান্য উত্তেজিত হয়ে জবাব দেয়।
“অতদূর মনে হয় না যেতে হবে। স্পেশাল ব্রাঞ্চই বোধহয় এর সুরাহা করতে পারবে, যদি ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকে সিনসিয়ারলি কাজ করে!”
দত্তদার কথার মধ্যে একটা হাল্কা ঠেস অনুভব করে সার্থক, তবে কিছু মনে করে না। ওদের মধ্যে ছোটখাটো ইয়ার্কি-ঠাট্টা লেগেই থাকে। মুখে হাল্কা হাসি নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, সামনে বিশাল বাম্বু আসতে চলেছে!”
“এই কেসটা সাল্টে নিয়ে তোমায়ে একদিন বাঁশের আচার খাওয়াব। দেখবে, বাঁশ সম্বন্ধে তোমার ধারনা পাল্টে যাবে! এখন রাখছি, হাই কমান্ডের অর্ডারটা হাতে এলে একবার দেখা করো।” বলে ফোন রেখে দিলেন দত্তদা।
একটা লম্বা ঢেঁকুর তুলল সার্থক। দুপুরের মাংসভাতের ঢেঁকুর। হঠাৎ এই উটকো ঝামেলা এসে যাওয়াতে আবার সেই চটকে যাওয়া ভাতঘুমটার কথা মনে হল তার! একটা ফ্যাক্টরিতে ঘটে যাওয়া অ্যাকসিডেন্টে নিয়ে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এই বাড়াবাড়িটা মোটেই ভালো লাগছে না, এ যেন মশা মারতে কামান দাগা! শেষে কী হবে তা ভগবানই জানেন!
২
শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের মধ্যে বসে রয়েছে ছ’ ছ’টি মাথা। ঘরের হাওয়া ঠাণ্ডা হলেও ঘরে উপস্থিত ছ’জনই যে একটা ব্যপারে উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে একটা বিষয়ে সেটা পরিষ্কার হচ্ছে তাদের অভিব্যাক্তিতে। আজ ভোরবেলা ডানকুনির দাসপাড়া অঞ্চলের একটি ঠাণ্ডা পানীয় প্রস্তুতকারক ফার্মে যে অগ্নিকাণ্ডটি ঘটেছে সেটার তদন্তে নামার আগে প্রাথমিক কিছু কথাবার্তা সেরে নিচ্ছেন কলকাতা পুলিশের কর্তাব্যাক্তিরা। তাদের মধ্যে ইন্টালিজেন্স ডিপার্টমেন্টের দু’জন প্রতিনিধিও আছেন। যদিও ঘটনাটা ডানকুনিতে ঘটেছে, কিন্তু সেখানকার পুলিশ ডিপার্টমেন্টেই লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের কাছে কেসটা তুলে দিয়েছে কিছুটা অপারগ হয়েই, কিছুটা তাদের ওপর অগাধ আস্থা রেখে, কিছুটা দ্রুত সুরাহার তাগিদে। তারা এমনও আশঙ্কা করছেন, পানীয় তৈরির কারখানাতে ঘটে যাওয়া অগ্নিকান্ডটা নিছকই সহজ, সরল ঘটনা নয়, এর পেছনে হয়ত কোন দুস্কৃতিদের কীর্তিকলাপ রয়েছে। তাই, ব্যা পারটাকে একটু গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করবার অনুরোধ করা হয়েছে সেখানকার পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে।
মিটিঙের মধ্যমনি যিনি তিনি বর্তমানে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনার অরিন্দম গুহ। রয়েছেন স্পেশাল ব্রাঞ্চেরই আরেক অফিসার প্রিয়ব্রত বাগচি। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট থেকে সমীরণ দত্ত একাই এসেছেন। রয়েছেন স্পেশাল ব্রাঞ্চেরই ইন্সপেক্টর সার্থক বসু। ইন্টালিজেন্স ব্যুরো র দুজন অফিসার উপস্থিত রয়েছেন এই মিটিঙে, পার্থসারথি মজুমদার এবং ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং এই মিটিঙে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চলেছেন।
ডিসিপি অরিন্দম গুহ প্রথমে শুরু করলেন, “জানি এই মুহূর্তে এইরকম মিটিং করাটা একরকম যুক্তিহীন মনে হতে পারে, তবু কিছু জিনিষ একটু আলোচনা করে নেওয়া দরকার। ডানকুনির সেই ফ্যাক্টরিতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটাকে ইতিমধ্যেই টেররিস্ট অ্যাটাক বলে অ্যান্টিসিপেট করা হচ্ছে। অন দ্যাট নোট, আমি জানতে চাই, ডানকুনি বা তার পার্শ্ববর্তি অঞ্চলে কি সাম্প্রতিক কালে কোন টেররিস্ট অ্যাক্টিভিটি হয়েছে কি? বা সেরকম কোন রিপোর্ট আছে?”
সমীরণ দত্ত, সার্থকের দত্তদা জবাব দিলেন, “রিসেন্ট পাস্টে সেরকম কোন ঘটনার খবর নেই, দু’ একটা খুচরো-খাচরা রাজনৈতিক গণ্ডগোলের খবর আসে, কিন্তু সেগুলোকে টেররিস্ট অ্যাক্টিভিটি বলা যায় না কোনভাবেই। তবে দু’বছর আগে সেখানে একটা শুট-আউটের খবর আসে। দিনদুপুরে জনবসতির মধ্যে গুলি চালাচালি হতে শোনা যায় আচমকা, তবে কাদের মধ্যে এই গুলিগালাজ হয়েছিল কিছু বোঝা যায়নি। কেউ গ্রেফতারও হয়নি। এই ঘটনার আর তদন্তও হয়নি। আর তারও তিন বছর আগে, ডানকুনিরই এক পরিত্যক্ত কারখানা থেকে প্রচুর বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার হয়। মেশিনগান, রাইফেল, ম্যাগাজিন ইত্যাদি। এই খবরটা অনেকেই জানে। কাগজে এ নিয়ে লেখালিখিও হয়। কয়েকজন প্রাইম সাস্পেক্টকে ইন্টারোগেট করা হয়েছিল, কিন্তু কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। আমাদের কাছে এতটুকু ইনফরমেশনই আছে, যদি সাম্প্রতিক ঘটনার নিরিখে ধরা হয়।”
ডিসিপি একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, “হুম, আপনি যা ইনফরমেশন দিলেন তাতে টেররিস্ট অ্যাক্টিভিটির কোন সলিড কোন রিপোর্ট পেলাম না, তবে আগে তেমন ঘটনা ঘটেনি বলে এখনও ঘটবে না বা ভবিষ্যতে ঘটার সম্ভাবনা নেই, এই কথাটা জোর দিয়ে বলা যায় না। হতে পারে সেখানে দুষ্কৃতিদের নতুন কোন ঘাঁটি তৈরি হয়েছে, এবং তা পুলিশের নাকের তলাতেই হয়েছে, তাদের নাগাল পাওয়া যায়নি, তারাই হয়ত এই ঘটনাটা ঘটিয়েছে! তবে বিষয়টাতে এতটাও গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা যেটা ভয় পাচ্ছি সেটা নাও হতে পারে, তবে আমরা একটা সম্ভবনার কথা মাথায় রেখে এগোবো। কি বলো আই বি?”
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি কে লালবাজারে সবাই “আই বি অফ আই বি” বলে ডাকে। বছর পঁয়ত্রিশের এই তরুণ সরকারি গোয়েন্দাটিকে দেখতে একেবারে গল্পের বইয়ের গোয়েন্দাদের মতই। যেন বইয়ের পাতা ওলটাবার সময় সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে! ছ’ ফুটের ওপর হাইট, সাথে ঋজু, সমর্থ, মেদহীন চেহারা। তার সাথে রয়েছে চৌকশ মাথা এবং নিদারুণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। এরই মধ্যে নিজের কাজের মাধ্যমে অনেক পালক জোগাড় করে ফেলেছেন নিজের টুপিতে! ডিসিপির কথাতে ইন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ওরফে আই বি জবাব দিলেন, “অফ কোর্স স্যর, আমাদের এখনই এতটা অ্যাপ্রিহেন্সিভ হওয়ার দরকার নেই। আগে সেখানে টেররিস্ট অ্যাক্টিভিটি হচ্ছে কিনা সেটা জানার জন্য আমাদের সেখানকার লোকাল থানার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, সেখানকার সমস্ত ফোনকল, ইন্টারনেট অ্যাকসেস ট্র্যাক করতে হবে, কোন পকেট ইন্সিডেন্স হয় কিনা সেটার জন্যও অপেক্ষা করতে হবে, বাট দোজ আর দ্য ডিফারেন্ট লাইন অফ ইনভেস্টিগেশন, আমাদের এখন আসল ঘটনার ওপর জোর দেওয়া দরকার।”
ডিসিপি বললেন, “ঠিকই বলেছ, আগে এই কেসের সুরাহা করা উচিত, দুষ্কৃতিদের নিয়ে পরে আলাদা করে ভাবব। তাহলে আর দেরী করা কেন, চল সবাই বেরিয়ে পড়ি!”
৩
অগ্নিনির্বাপনের কাজ অনেকক্ষণ আগে সারা হয়ে গেলেও এখনও ফ্যাক্টরির ভেতর থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে ক্রমাগত। ফ্যাক্টরির গেটের সামনে প্রচুর মানুষের জটলা। এরা অধিকাংশই ফ্যাক্টরির কর্মচারী। কয়েকটা প্রেসের গাড়িও দেখা যাচ্ছে। কারখানার গেটের সামনে প্রচুর পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে, তারা বাইরের ভিড় আটকাচ্ছে। কারখানার সামনে ব্যারিকেড রয়েছে।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি র সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে সার্থক, প্রায় ছায়ার মতই লেগে রয়েছে। এতদিন ভদ্রলোকের অনেক গুণগান শুনে এসেছে, কিন্তু কাছাকাছি আসার সুযোগ ঘটেনি। এবার যখন একসঙ্গে কাজ করবার অবকাশ ঘটেছে তখন এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই ছাড়বে সার্থক। লক্ষ্য করবে ইন্দ্রজিতের ইনভেস্টিগেশন প্যাটার্নটাকে। শিখবে অনেক কিছু। মাত্র তিন বছরের বড় তার থেকে ইন্দ্রজিৎ, এরই মধ্যে যা সব কর্মকাণ্ড করেছে যার কোন জবাব নেই। সেগুলো সার্থককে খানিকটা উজ্জীবিত এবং খানিকটা ঈর্ষানীত্ব করেছে! সে বুঝতে পারছে, তাকে যদি এরকম ক্যারিয়ার গ্রাফ বানাতে হয় তাহলে তাকেও ইন্দ্রজিতের মত এমন শার্পলি কেস ইনভেস্টিগেট করা জানতে হবে। তাই, তার সঙ্গে কাজ করাটা সার্থকের কাছে অনেকটা ট্রেনিং পিরিয়ডের মত হবে।
প্রথমেই তারা যে বিল্ডিংটাতে ঢুকল, সেটা একটা প্রোডাকশনাল ইউনিট। সার্থক এর আগে কখনও কোন সফটড্রিংক্সের কারখানায় ঢোকেনি বটে তবে তার একটা হাল্কা ধারণা আছে ভেতরে কী কর্মকাণ্ড হয়। যেই বড় বড় দানবাকৃতির ট্যাংকগুলো সে সামনে দেখতে পাচ্ছে সেগুলো আসলে এক একটা ফারমেন্টেশন চেম্বার। সেগুলোর একপাশে বড় বড় সিলিন্ডারের মধ্যে রয়েছে কার্বন ডায়ক্সাইড গ্যাস যেগুলো সুগার সিরাপের সঙ্গে মিশিয়ে সফট ড্রিংক্স তৈরি করা হয়, মোটামুটি এরকম প্রক্রিয়াই হয়ে থাকে সব যায়গায়। ঘরের একদম কোনায় রয়েছে দু’ দু’খানা বড় জলের ট্যাঙ্ক এবং একটি ডাইলুশান ইউনিট। প্রত্যেকটা চেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়েছে মোটা-মোটা পাইপলাইন দিয়ে। এগুলি প্রত্যেকটাই যে অগ্নিদগ্ধ সেটা তাদের গায়ে কালসিটে ছোপ দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে। গোটা কারখানায় যে কতোবড় অগ্নিকান্ড ঘটে গেছে সেটা মনে করতেই শিহরন জাগছে সার্থকের মনে। দমকলের লোকেদের তার মানে বিশাল বেগ পেতে হয়েছে পুরো আগুনকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য!
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি প্রথমে গোটা ঘরটা একবার ঘুরে দেখল, তারপর একটা ফারমেন্টেশন চেম্বারের দিকে এগিয়ে গিয়ে সেটার গায়ের পোড়া অংশটায় আঙ্গুল বুলিয়ে তারপর সেই আঙ্গুলটা নাকে শুকল অনেকক্ষণ। গোটা ব্যপারটা সার্থককে খুব অবাক করল।
দত্তদা পাশ থেকে বললেন, “কিছু কি বুঝতে পারলেন?”
“হুম, দেখছিলাম আগুন লাগানোর জন্য পেট্রল বা কেরোসিন জাতীয় কোন দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছি কিনা। কারণ এত বড়-বড় চেম্বারের একেবারে মাথা অবধি আগুন এমনি-এমনি ধরবে না!”
“তা কী বুঝলেন ? সেরকম কিছু কি ব্যবহার করা হয়েছে ?”
“তাই যদি হত তাহলে পুড়ে যাওয়ার পরও গন্ধ থাকত বাতাসে। কিন্তু এখন তো ঘরে সেরকম কোন গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই শুঁকে দেখলাম। একটা তেলতেলে গন্ধ তো আছেই, তবে সেটা পেট্রোলের নয়! আপনিও শুঁকে দেখুননা” বলে নিজের হাতটা দত্তদার নাকের সামনে ধরল ইন্দ্রজিৎ।
“হ্যাঁ তাই তো! আমিও তো পাচ্ছি! কেমন ঘি-ঘি গন্ধ। মহাভারতের জতুগৃহের কথা মনে পড়ে গেল!” গন্ধ শুঁকে দত্তদা বললেন।
ইন্দ্রজিৎ হাল্কা হেসে বলল, “হ্যাঁ, সেরকমই তো মনে হচ্ছে, তবে ফরেনসিক টেস্ট করা জরুরি। তাহলেই বোঝা যাবে কী ব্যবহার করা হয়েছিল। আচ্ছা, আগুনটা কীভাবে লাগল সেটা জানা কি গেছে?”
“সর্টসার্কিট। একই সঙ্গে ফ্যাক্টিরির সাতটা ইউনিটে। এখনও গোটা ফ্যাক্টরিতে ইলেক্ট্রিসিটি নেই!”
“তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে এটা প্রিপ্ল্যান্ড। একই সঙ্গে সাতটা ইউনিটে সর্টসার্কিট হওয়া, এটা তো আর নিছক অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে না, যখন একটা ইউনিটের সঙ্গে আরেকটা ইউনিটের কোন যোগাযোগ নেই!”
শুনে অবাক হল সার্থক। সেরকম হলে কোনভাবেই এটাকে অ্যাকসিডেন্ট বলা যায় না! একই সঙ্গে সাতটা আলাদা ইউনিট, একই প্রেমিসেসের মধ্যে হলেও যাদের মধ্যে কোন কানেকশন নেই, সেখানে একসাথে সর্ট সার্কিট হওয়াটা অবিশ্বাস্য ব্যপার!
“যদি অ্যাক্সিডেন্ট না হয়ে থাকে, তাহলে অ্যাক্টিভিটিটা কাদের? টেররিস্ট?” দত্তদা প্রশ্ন করলেন।
“দেখুন, যা শুনেছি, ফ্যাক্টরির সিকিউরিটি খুব কড়া। তাই বাইরের লোকের পক্ষে ভেতরে ঢুকে প্রত্যেকটা ইউনিটের ইলেক্ট্রিক কানেকশনে গণ্ডগোল পাকানো, পাশাপাশি ফ্যাক্টরির মেশিনের গায়ে ইনফ্লেমেবল সাবস্ট্যান্সের সাহায্যে আগুন ধরানো, সেটাও সবার অলক্ষ্যে করা মোটে সোজা কাজ নয়! এবং ব্যপারগুলো একদিনে হয়নি, ধীরে ধীরে করা হয়েছে। টেররিস্টরা এত খাটতে যাবে কেন, একটা বোম্ব ব্লাস্ট করলেই তো কাজ হাসিল হতো! তবে তাদের অসাধ্য কিছু নেই। তবে এটুকু পরিষ্কার যে বা যারা এই কাজটা করেছে, তাদের এই ফ্যাক্টরির ভেতরকার সম্বন্ধে যথেষ্ট ধারনা আছে!”
“তার মানে কি ভেতরের লোক এই কাজগুলো করেছে ?” সার্থক এবার মুখ খুলল।
“অসম্ভব কিছু নয়। আমি তো বললামই বাইরের লোকের পক্ষে এত সুক্ষভাবে কাজটা করা এতটা সোজা নয়। আবার এমনও হতে পারে, গোটা প্ল্যানটা হয়ত টেররিস্টরাই ফেঁদেছে, একজিকিউট করেছে ভেতরের লোক, যাকে বা যাদেরকে সেই টেররিস্টরা ব্যবহার করেছে!”
কথাটা শুনে খানিকক্ষনের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেছিল সার্থক। ইন্দ্রজিতকে সে যতটা চৌখশ ভেবেছিল, সে তার থেকেও কয়েক ডিগ্রি বেশি! তার চিন্তাভাবনাগুলোই অন্য খাতের! না, তার কাছ থেকে অনেককিছু শিখতে হবে সার্থককে!
৪
যে সফটড্রিংক্সের ফ্যাক্ট্রিরিতে আগুন লেগেছে, তার প্রোডাক্টের নাম ‘উল্লাস’। সার্থক দেখেছে তাদের বোতলের গায়ে ইংরেজিতে লেখা প্রোডাক্টের নাম, দু’ একবার গলায় ভিজিয়েছে। মূলত তিন রকম ফ্লেভারের কোল্ড ড্রিংক্স তারা বানিয়ে থাকে- কোলা, লেমন এবং অরেঞ্জ ফ্লেভার। অনেকটা পেপসি, লিমকা এবং মিরিন্ডার আদলে। খারাপ লাগেনি খেতে, এমনকি মিরিন্ডা, লিমকার সাথে স্বাদের তেমন কোন তারতম্য লক্ষ্য করেনি সে। সার্থক সফট ড্রিঙ্কের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু জানে না, তবে শুনেছে পৃথিবীর সর্বপ্রথম সফটড্রিংক্স প্রস্তুতকারক সংস্থা কোকাকোলা তাঁদের ফর্মুলা কখনও লিক হতে দেয়নি, এবং গত একশ চৌত্রিশ বছর ধরে সেটা যখের ধনের মত আগলে রেখেছে।
‘উল্লাস’ কোম্পানির দুইজন মালিক। সৌমেন্দুশেখর দাশগুপ্ত এবং রাজদীপ ঘোষ। দু’জনে পার্টনারশিপে এই কোম্পানিটা শুরু করেন ছ’ বছর আগে। এনাদের সম্বন্ধে অনেক তথ্যই ইতিমধ্যে জোগাড় করা হয়েছে। এনারা দুজনে শুধু ব্যবসার পার্টনারই নন, অভিন্নহৃদয়ের বন্ধুও বটে। দুজনই ফুড টেকনলজি নিয়ে পড়েছেন, একই ব্যাচ। তবে পাশ করার পর দুজনেই আলাদা ফার্মে কাজ শুরু করেন। তারপর বহুদিন সেসব জায়গায় কাজ করার পর দুজনে মিলে একসাথে ব্যবসা করার কথা ভাবেন। সেই মত শুরু করেন তাঁদের যাত্রাপথ। প্রথমে তাঁরা বের করেন পটেটো চিপস। প্রথমে কিছু টাকা লগ্নি করে ছোট একটা কোম্পানি চালু করে প্রোডাকশন আরম্ভ করেন। প্রোডাক্টের নাম দেন ‘রকমারি চিপস’। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ‘রকমারি চিপস’ সবার হাতে-হাতে, চায়ের টেবিলে যায়গা পেতে থাকে। ব্যবসায় প্রাথমিক সাফাল্য আসার পর ওঁরা প্রোডাকশন বাড়ান। উলুবেড়িয়ায় জমি কিনে প্রথম বড় ফ্যাক্টরি বানান। সেসব অবশ্য দশ বছর আগের কথা, ‘রকমারি চিপস’ এর ব্যবসা তারপর থেকে বেড়েছে বই কমেনি! এরপরই এনারা ঠিক করেন সফট ড্রিংক্সের প্রোডাক্ট বানানোর। ব্যপারটা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল তাঁদের কাছে। কারন মানুষে নতুন চিপস চেখে দেখলেও কোল্ড ড্রিংক্সের ব্যপারে খুঁতখুঁতে হয়, নতুন প্রোডাক্ট সহজে ট্রাই করতে চায় না। কিন্তু ওঁরা এই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেছিলেন, এবং ‘উল্লাস’কে বাজারে এনেছিলেন। বাজারে আসার পর ‘উল্লাস’ একটু-একটু করে মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল, এবং পাঁচ বছর যেতে না যেতেই নামি-দামী ব্র্যান্ডদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্যবসা করতে লাগল! ব্যবসায় এই বিপুল সাফল্য দেখে সৌমেন্দুবাবুরাও ‘উল্লাস’ এর নতুন-নতুন ফ্লেভার বাজারে আনতে লাগলেন। তাঁদের এই উন্নতির ফলস্বরূপ ওঁরা গতবছর “বেস্ট অন্ত্রেপ্রনার অ্যাওয়ার্ড” পান। সবকিছুই যখন ঠিকঠাকই চলছিল, তখন এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ড তাঁদের যে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিল, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না! দুই বন্ধুর মধ্যে সব থেকে ভেঙ্গে পড়েছিলেন রাজদীপবাবু। শোনা যায়, ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার খবরটা শুনে উনি প্রায় হিস্টেরিয়া রুগির মত আচরণ করছিলেন, অনেক কষ্টে তাঁকে শান্ত করানো হয়। এমনও খবর আছে যে তিনি নাকি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। বছর তিনেক আগে পাহাড়ে ট্রেকিং করতে গিয়ে ওঁর একমাত্র ছেলে মারা যায়। ছেলের মৃত্যুর শোক নিতে না পেরে ওঁর স্ত্রীও সুইসাইড করেন। পরপর এই দুটো ধাক্কা তিনি নিতে পারেন নি। প্রায় পাগলের মত হয়ে যান। দীর্ঘ চিকিৎসার ফলে তাঁকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো হয়। এখনও নিয়মিত তিনি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যান, ডিপ্রেশন কমানোর ওষুধ খান! এই দুই পার্টনারকে যখন পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়, তখন কোম্পানির তরফ থেকে অনুরোধ করা হয় রাজদীপবাবুকে বেশি প্রশ্ন না করার জন্য। উনি সেশনে উপস্থিত থাকবেন, কিন্তু প্রশ্নের সব জবাব দেবেন সৌমেন্দুশেখরবাবু, এমনটাই কথা হয়।
দত্তবাবুই প্রথমে প্রশ্ন করলেন, “আপনার কি মনে হয়, এই আগুন লেগে যাওয়ার ব্যপারটা কি পুরোটাই অ্যাক্সিডেন্ট?”
সৌমেন্দুবাবু বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বললেন, “একদমই না! আমি নিজে এক সপ্তাহ আগে লোক ডেকে ফ্যাক্টরির সমস্ত ইলেক্ট্রিক লাইন চেক করিয়েছিলাম, কোন গন্ডগোল পাওয়া যায়নি। আর যদি গণ্ডগোল থেকেও থাকে, তাহলে একসাথে সাতটা আলাদা-আলাদা জায়গায় সর্ট সার্কিট হওয়াটা কাকতালীয় ব্যপার নয় কি?”
“তাহলে কি মনে হয়? কাজটা কে করে থাকতে পারে ?” এবার ইন্দ্রজিৎ প্রশ্ন করল।
প্রশ্নটা শোনার পর সৌমেন্দুবাবু একটু ক্ষুন্নই হলেন। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, “তা আমি কি করে বলব ? এটা বের করাও কি আমার কাজ ? তা আপনারা আছেন কি করতে!”
ইন্দ্রজিৎ আবার বলল, “আপনার কি কারোর ওপর সন্দেহ হয়? মানে আপনার কি মনে হয় এটা কোন রাইভাল কোম্পানির কীর্তিকলাপ হতে পারে ?”
সৌমেন্দুবাবু সেই রুক্ষ মেজাজ নিয়েই বললেন, “না, প্রথমত আমার কারোর সাথে কোন রাইভালরি নেই! সবাই স্বতন্ত্রভাবে নিজেদের ব্যবসাটা করি, রাইভাল হতে যাবো কেন! আর আমার যারা সো কলড রাইভালস আছে মার্কেটে, সে হাই প্রোফাইল হোক কী লো প্রোফাইল, তারা এরকম নীচ, কুরুচিপূর্ণ কাজ করবে বলে মনে হয় না!”
“সে তো আপনি আবেগতাড়িত হয়ে কথাগুলো বলছেন, এমনটাও তো হতে পারে, যারা ওপর-ওপর আপনাদের সাথে ভালো ব্যবহার করছে, তারাই তলায়-তলায় আপনাদের হিংসে করে! আপনাদের এই হঠাৎ সাফল্য পাওয়া, “বেস্ট অন্ত্রেপ্রনার” পুরস্কার পাওয়া, এসব হয়ত তারা ভালো চোখে দেখছেন না!”
এর উত্তরে সৌমেন্দুবাবু কোন কিছু বললেন না, শুধু একবার ওঁর পার্টনার কাম বন্ধু রাজদীপবাবুর দিকে দেখলেন, যিনি জড়পদার্থের মত তাঁর পাশের চেয়ারে বসে আছেন, চারপাশে কি কথাবার্তা চলছে সেদিকে কোন হুঁশ নেই!
এবার দত্তদা বললেন, “আচ্ছা প্রফেশনাল রাইভালরির কথা বাদই দিন, আপনাদের সঙ্গে অন্য কারোর সাথে কোন ঝামেলা হয়েছিল কি? মানে আপনারা যখন এই ফ্যাক্টরি সেট-আপ করার কথা ভাবেন বা প্ল্যান করেন, তখন জমি সংক্রান্ত বিষয়ে কারোর সাথে কোন বচসা হয়েছিল কি? যেমন ধরুন লোকাল অ্যাক্টিভিস্ট, এলাকার গুন্ডা বা রাজনৈতিক কোন নেতার সঙ্গে ? একবার মনে করে দেখুন না!”
দত্তদার এই প্রশ্নে সৌমেন্দুবাবু কেমন চিন্তিত হয়ে গেলেন, মুখ দেখে মনে হল তিনি যেন স্মৃতি হাতড়ে কোন কিছু বের করার চেষ্টা করছেন! তারপর খানিকক্ষন ভাববার পর বললেন, “হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ফ্যাক্টরিটা বানানোর সময় যখন জমিটা কিনেছিলাম, তখন একটা লোকাল রাজনৈতিক দল এর আপত্তি করেছিল। বাচ্চা-বাচ্চা সব ছেলেমেয়ে, কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র সব, তারাই এই রাজনৈতিক দলের সদস্য সব। রাজনৈতিক আদর্শে তারা ছিল লেফট উইং। তাদের দাবী ছিল, যে কুড়ি বিঘে জমির ওপর আমাদের ফ্যাক্টরি নির্মাণের কাজটা হওয়ার কথা ছিল, সেখান থেকে ছ’ বিঘে জমি আমরা যেন ছেড়ে দি। সে ছ’ বিঘে জমির ওপর চাষের কাজ হবে, বাকি চোদ্দ বিঘে জমির ওপর হবে ফ্যাক্টরির কাজ, এমনটাই ছিল তাদের দাবী। তাদের এই দাবী অবশ্য একেবারেই অন্যায্য ছিল না। যেই কুড়ি বিঘে জমি আমরা ফ্যাক্টরি বানাতে কিনি, সেটাতে যে ডিসপুট ছিল আগে জানতাম না। যে চাষিদের কাছ থেকে আমরা জমিটা কিনি, তাদের কাছ থেকে চোদ্দ বিঘে জমির দলিল জোগাড় করলেও বাকি ছ’ বিঘে জমির কোন স্থায়ী মালিকানা পাওয়া যায়নি, তাই কোন দলিলও পাওয়া যায়নি। এটাকেই তারা ইস্যু বানিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল! কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে। সেই ছ’ বিঘের মালিকানা আমরা পেয়ে গেছি। ফ্যাক্টরির কাজও শুরু হওয়ার মুখে। কিন্তু এই ছেলেমেয়েগুলো পিছু হঁটছিল না। রোজই কন্সট্রাকশন সাইটে এসে কাজ বন্ধ রাখার জন্য বিক্ষোভ, নয় ঘেরাও করছিল। শেষে নিরুপায় হয়ে লোকাল এমএলএকে বলে ব্যপারটার নিস্পত্তি করতে হয়!”
“সেটা কীভাবে?” ইন্দ্রজিৎ প্রশ্ন করল।
সৌমেন্দুবাবু একটু থেমে বললেন, “ব্যপারটাতে আমাদের কোন হাত ছিল না। আমরা শুধু স্থানীয় এমএলএকে আমাদের অসুবিধার কথা জানিয়েছিলাম, উনি বলেছিলেন যে উনি ব্যপারটা দেখবেন। কয়েকদিন পরই পুলিশ এসে সেই আন্দোলনরত ছেলেমেয়েদের প্রত্যেককেই গ্রেফতার করে। তাদের প্রত্যেকের চোদ্দ দিনের জেল হয়! ব্যপারটা এত বাড়াবাড়ির পর্যায় যাবে বুঝতে পারিনি। আমরা সমস্যা থেকে দ্রুত সমাধান চেয়েছিলাম, কিন্তু ছেলেমেয়েগুলোর জেল হোক এটা চাইনি! খুব খারাপ লেগেছিল ঘটনাটাতে!”
“আপনি কি মনে করেন যে সেই ছেলেমেয়েগুলোই এতদিন বাদে তাদের সেই অপমানের বদলা নিয়েছে এইরকমভাবে?” পাল্টা প্রশ্ন করল ইন্দ্রজিৎ। পাশে বসে সার্থক মোবাইলে সব কথাবার্তা রেকর্ড করতে থাকল।
প্রশ্নটা শুনে সৌমেন্দুবাবু খানিক বিব্রতবোধ করলেন বলে মনে হল। স্পষ্ট জবাব দিতে পারলেন না। ইতস্ততভাব নিয়েই বললেন, “ওদের যে লিডার ছিল, অনিকেত নাম, সে পরে আমায় একবার শাসিয়েছিল। তখন সে সবে জেল থেকে খালাস পেয়েছে। একদিন সে হঠাৎই আমার গাড়ির সামনে চলে এল কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে! আমি সেসময়ে ফ্যাক্টরি থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। আমার কিছু বলার আগেই দেখলাম অনিকেত একটা থান ইঁট ছুঁড়ে আমার গাড়ির পেছনের কাঁচটা ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। তারপর আমাকে এই বলে শাঁসালো যে আমার কোম্পানি সে বন্ধ করেই ছাড়বে! আমি পুলিশকে কিছু জানাইনি, ব্যপারটা যেতে দিয়েছিলাম। কয়েকদিন আগেই ওদের জেল হয়েছে, আবার ওরা শাস্তি পাক সেটা চাইনি। তাছাড়া অনিকেতদের কখনই আমার শত্রু বলে মনে হয়নি। ঘটনাটা ছয় বছর আগের, ওরা কিছু করার থাকলে এতদিনে করে ফেলত! আর কিছু যদি করতও, এত বড় অঘটন ঘটাবার ক্ষমতা তাদের আছে বলে মনে হয় না!”
“বুঝলাম, অনিকেত বা ওর দলের কেউই আপনার চোখে ক্রিমিনাল নয়, কিন্তু কাদেরকে মনে হয় এরকম? কাউকে সন্দেহ হয় কি? মানে ধরুন ফ্যাক্টরি তৈরি করবার সময় কোন লোকাল মাফিয়া বা জমির দালাল- এরা কেউ ঝামেলা করেনি?” ইন্দ্রজিৎ প্রশ্ন করল।
“নাহ, এই ধরনের সমস্যার মধ্যে আমায় পড়তে হয়নি কারন লোকাল এমএলএর সঙ্গে আমার হৃদ্য তা ছিল সেটা আমি আগেও বলেছি। ওঁদের পার্টি ফান্ডে মোটা টাকা ঢালার পর উনিই আমায় আশ্বস্ত করেছিলেন যে এসব সমস্যায় আমায় পড়তে হবে না!”
“বাহ! আপনার শত্রুর সংখ্যা তো আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে দেখছি! এদিকে আমাদের কাজ ক্রমাগত মুশকিল হয়ে যাচ্ছে!” হাল্কা হেসে বললেন দত্তদা, কিন্তু ঘরের থমথমে পরিবেশ দেখে মনে হল কেউ তাঁর কৌতুক তারিফ করার মত মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয়!
* * *
“একসঙ্গে সাতখানা ইউনিটের ইলেক্ট্রিক কানেকশনে সর্ট সার্কিট হওয়াটা আশ্চর্যের হলেও অসম্ভব তো কিছু না! ঘটনাটার প্রবাবিলিটি কম হলেও একেবারে কাকতালীয় তো বলা যায় না?”
ফ্যাক্টরিটার কাছেই একটা চায়ের দোকানে চা সহযোগে তিন জনের মধ্যে আলোচনাটা চলছে। প্রেসের গাড়িগুলো চলে গেছে। কারখানার কর্মচারীদের যেই ভিড়টা লক্ষ্য করা গেছিল সেটাও অনেকটা হাল্কা হয়ে গেছে।
“এত বড় কোম্পানির এরকম ত্রুটিপূর্ণ ইলেক্ট্রিক কানেকশন হবে এমনটা আশা করা বোকামি! তাছাড়া ইন্টেরোগেশনের সময় সৌমেন্দুবাবু তো বললেনই সে উনি কয়েকদিন আগেই গোটা কারখানার ইলেকট্রিক কানেকশন পরীক্ষা করেছিলেন।” দত্তদার প্রশ্নে জবাব দিল সার্থক।
“সেটাও কথা” চায়ে একটা চুমুক মেরে দত্তদা বললেন, “সৌমেন্দুবাবুর সাথে কথা বলেও তো জানা গেল যে ওঁর সন্দেহের তালিকাতেও কেউ নেই। উনি সবাইকেই ক্লিনচিট দিয়েছেন! এমন নয় তো, যে উনি কাউকে গোপন করতে চাইছেন ?”
“মানে আপনি বলতে চাইছেন সৌমেন্দুবাবু জানেন, যে আগুন কে লাগিয়েছে, কিন্তু উনি মুখ খোলেননি, এমনটা করে ওঁর কি লাভ?” প্রশ্ন করল সার্থক।
“তুমি এই হাইপ্রোফাইল লোকেদের ভেতরকার গল্প জানো না ভায়া! এদের বাইরেটা যতটা ঝলমলে, ভেতরটা ততটাই অন্ধকার! হয়ত ঝুলি থেকে ম্যাও বেড়িয়ে পড়বে, তাই হয়ত আসল নামটা জেনেও বলেনি, আপনি কি বলেন ইন্দ্রজিৎবাবু?”
দত্তদার প্রশ্নের জবাব ইন্দ্রজিৎ দিল না। কোন একটা চিন্তার মধ্যে ডুবে গিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে যেতে থাকল।
“আর রাজদীপবাবুর কথা ককী বলবেন? উনি তো কথাবার্তা চলাকালীন মুখই খোলেননি! আমার তো মনে হয় উনিও অনেক কিছু জানেন, কিন্তু গোটা সেশনটাই বিহ্বলের মত বসে কাঁটিয়ে দিলেন!”
“দাঁড়াও না! ইন্টেরোগেশন তো শেষ হয়নি। আবার তাঁকে জেরা করা হবে, তখন আর মানসিক সমস্যার দোহাই দিয়ে পার পাবেন না! আজকের দিনটা অনেকটাই ওঁকে সিম্প্যাথাইজ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, পরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে ওঁকেই আরও চেপে ধরা হবে! তাই তো ইন্দ্রজিৎবাবু ?”
দত্তদার কথায় এবারও ইন্দ্রজিতের কাছ থেকে কোন উত্তর পাওয়া গেল না। চায়ের শেষ চুমুকটা দিয়ে কাগজের কাপটা দুমড়ে ছুঁড়ে দিল সামনে দিকে। তারপর পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে গ্যালারিতে গিয়ে একটা ছবি বের করল। সেটা পুড়ে যাওয়া ফ্যাক্টরির ভেতরকার ছবি। সেই ছবিকে জুম করে সার্থকদের সামনে ধরে বলল, “চিমনিগুলোর গায়ে এরকম ফ্যানের মত যন্ত্রগুলো কী বলতে পারবেন ? আমার আবার এই যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে কোন আইডিয়া নেই তেমন। আগে অনেক কারখানায় গেছি বটে কিন্তু কোন চিমনিতে এমন জিনিষ লক্ষ্য করিনি। কোন নতুন প্রযুক্তি কি?”
দত্তবাবু ছবিটা দেখে হেসে বললেন, “এরকম পাখা তো এখন অনেক ফ্যাক্টরির চিমনিতেই লাগানো থাকে দেখেছি! উন্নত সব প্রযুক্তি। তবে এর মেকানিজম সম্পর্কে আমায় কিছু জিজ্ঞেস করবেন না মশাই, এ বিষয়ে আমিও আপনার তিমিরেই!”
ইন্দ্রজিৎ ছবিখানা আরও জুম করে বলল, “কারখানার চিমনিতে ফ্যান লাগানোর ব্যপারটা আমিও জানি, কিন্তু ফ্যানগুলোর গায়ে সরুসরু পাইপগুলো লাগানো রয়েছে, সেগুলোই আমাকে ভাবাচ্ছে!”
সার্থকও স্পষ্ট দেখতে পেলো, চিমনিগুলোর গায়ে যে ফ্যানের কথা ইন্দ্রজিৎ উল্লেখ করছে, সেগুলোর দু’পাশ দিয়ে দু’টো সরু পাইপ বেরিয়েছে, কিন্তু সেগুলো ইন্দ্রজিতের এত চিন্তার কারন কেন হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটা তার মাথায় আসছে না। নাহ, এই আই বি লোকটা নিজেই খুব রহস্যের!
৫
রাজদীপ ঘোষের আত্মহত্যার খবরটা আচমকা যেন তদন্তের স্রোতটাকেই নড়িয়ে দিল। কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে এরকম একটা খবর আসতে পারে! ভদ্রলোক মানসিক সমস্যায়ে ভুগছিলেন বহুদিন, কারখানায় আগুন লেগে যাওয়ার ঘটনাটা যেন তাঁকে অবসাদের চরম সীমায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন।
রাজদীপবাবুর বাড়ি আলিপুরে। বিলাসবহুল বাড়িতে দুইজন পরিচারক, একজন দারোয়ান ও এক পোষা কুকুর নিয়ে থাকতেন রাজদীপবাবু। অল্পদিনের ব্যবধানে স্ত্রী ও পুত্রকে হারিয়ে একেবারে পাথরের মত হয়ে গিয়েছিলেন। নিঃসঙ্গতাই তাঁর একমাত্র সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছিল! ব্যবসায়িক কাজকর্ম করতেন যন্ত্রের মত, তাতে একাগ্রতা হয়ত ছিল, কিন্তু হৃদয়ের যোগ ছিল না! সামাজিক জীবন বলেও কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল না তাঁর কাছে। গুহামানবের মত কাজ থেকে ফিরে ঘরে ঢুকে পড়তেন, আর বাইরের কারো সাথে কথা বলতেন না।
রাজদীপবাবুর বডিটা পাওয়া যায় তাঁর বাড়ির পেছনের চাতালে। দু’তলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিলেন তিনি। ওঁর বডিটা পোস্টমরটেমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওঁর মৃত্যুটা কি কেবলই সুইসাইড? না এর পেছনে আরও বড় কোন রহস্য আছে সেটা বের করবার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
“একজন ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের পেশেন্টের পক্ষে এরকম আত্মহত্যার পদক্ষেপ নেওয়াটা আশ্চর্যের কিছু না। সেদিন ইন্টেরোগেশন চলাকালীন ওঁর হাবভাব দেখে বোঝাই যাচ্ছিল যে উনি বড় রকমের কোন শক খেয়েছেন। তাই, ওঁর মৃত্যুটা মর্মান্তিক হলেও আমি আশ্চর্য হইনি তাতে!”
দত্তদার কথার উত্তরে সার্থক কোন জবাব দিল না। উত্তর দেওয়ার মত মনের অবস্থাও ছিল না তার। রাজদীপবাবুর মৃত্যুটা এতটাই অকস্মাৎ ঘটল যে প্রস্তুত হওয়ার সুযোগই পাওয়া গেল না। সার্থকের বারবার মনে হচ্ছিল যে রাজদীপবাবু এই কেসের ব্যপারে অনেক কিছু জানতেন। হয়ত এমন অনেক তথ্য তাঁর কাছে ছিল যা এই তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারত। কিন্তু ওঁর মৃত্যুর সাথে-সাথে সেই সবকিছু অজানাই থেকে গেল।
“ইন্দ্রজিৎবাবু কোথায় জানো কিছু? সকাল থেকে তো দেখছি না!”
তাই তো? এখন দুপুর তিনটে বাজে, আজ সারাদিন ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির কোন হদিশই পাওয়া যায়নি ডিপার্টমেন্টে! রাজদীপবাবুর সুইসাইডের খবরটা পাওয়ার পর তাকে একবার ফোন করেছিল সার্থক, কিন্তু ইন্দ্রজিৎ ফোন ধরেনি। নিশ্চয়ই কোন জরুরি কাজে ব্যস্ত ছিলো, তাই জবাব দিতে পারেনি। এদিকে মামলা এত জটিল জায়গায় পৌঁছে গেছে যে সেটার নিষ্পত্তি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছ! তার ওপর রাজদীপবাবুর এই আত্মহত্যা আরও জট পাকিয়ে তুলেছে। এখন গোটা কেসটাই নতুন করে সাজাতে হবে, এবং এর দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে, ডিপার্টমেন্টের সুনাম যেখানে জড়িয়ে রয়েছে!
রাজদীপবাবুর আত্মহত্যার খবরে সৌমেন্দুবাবুর প্রতিক্রিয়া নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু উনি কোন জবাব দেননি। ওঁর এ হেন আচরণ অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়, উনি তো শুধু ওঁর পার্টনারকেই হারাননি, দীর্ঘদিনের বন্ধুকেও হারিয়েছেন। লালবাজার থেকেও আর চাপ দেওয়া হয়নি। পুলিশ মাত্রেই অমানবিক নয়!
ইন্দ্রজিৎ এল সাড়ে পাঁচটার সময়। তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল যে সারাদিন বেশ ধকল গেছে তার ওপর, লাঞ্চ করবার সময়ও পায়নি! ক্যান্টিনে গিয়ে তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে এসে হাজির হল সে। সঙ্গে একজন অফিসারকে দিয়ে অনেককটা ফাইলপত্র আনাল।
“আজ সারাদিন বেশ দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে বলো?” দত্তদা প্রশ্ন করলেন। এতদিনের মধ্যে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নামিয়ে এনেছেন সম্পর্কটাকে।
“হ্যাঁ, তা একটু করতে হয়েছে। অনেক তথ্যও জোগাড় করেছি!” বলে টেবিলে রাখা ফাইলগুলোর দিকে দেখালেন। যেগুলো দেখে সার্থকের মনেও কৌতূহল বাড়ল।
“এগুলোর মধ্যেই কি সেসব ইনফরমেশন আছে?” দত্তদা জিজ্ঞেস করলেন।
“সবই বলব, আগে একটু চা আনানোর ব্যবস্থা করুন!”
দত্তদা একজন কনস্টবলকে ইশারা করলেন। অফিসে চা তৈরিই থাকে ফ্লাস্কে। কনস্টেবলটি শুধু তিনটে কাপ বের করে সেগুলো বেসিনের জলে ধুয়ে তাতে গরম চা ঢেলে পরিবেশন করল।
চায়ে চুমুক দিয়ে ইন্দ্রজিৎ বলল, “প্রথমেই আমি গেছিলাম রাজদীপবাবু আর সৌমেন্দুবাবুর উকিলের অফিসে। তাদের এই ফ্যাক্টরির কার কতটা মালিকানা, কার ভাগে কতটা পড়ছে, কে হবে এদের ওয়ারিশ এসব জানতে। সেখানে যা জানলাম তা অতি সহজ-সরল হিসেব। দুজনই কোম্পানির অর্ধেক শরিক, অর্থাৎ মালিকানা হাফ-হাফ, আর দুজনই একে ওপরের ওয়ারিশন। মানে দুজন পার্টনারের মধ্যে একজন যদি মারা যান, তবে অপরজন মালিকানা পাবেন। এবং ভবিষ্যতে সেই পার্টনারও যদি মারা যান, তবে তাঁর অবর্তমানে কোম্পানির মালিকানা পাবে তাঁর সন্তানেরা, যদি তাঁর কোন সন্তান থেকে থাকে!”
“বাহ! এত খুব সহজ-সরল হিসেব। কোন ঝুট-ঝামেলা নেই, দুজনের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টির অবকাশ নেই !” দত্তদা উত্তর দিলেন।
“সেটা ঠিকই, কিন্তু এখানেও একটা প্যাঁচ আছে। প্রপার্টির কাগজে এমনটা তো লেখা আছে যে দুই মালিকের অনুপস্থিতিতে ফ্যাক্টরির দলিল যাবে ছেলেমেয়েদের নামে। তাতে দুই মালিকের সন্তানদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হবে প্রপার্টি। কিন্তু এখানেই হয়েছে গণ্ডগোল, কারণ সৌমেন্দুবাবুর এক ছেলে ও এক মেয়ে থাকলেও রাজদীপবাবুর একমাত্র ছেলে মৃত। সেক্ষেত্রে যদি ব্যপারটা এমন হত যে রাজদীপবাবুর বদলে সৌমেন্দুবাবু যদি মারা যেতেন, তাহলে কোম্পানির সম্পূর্ণ মালিকানা পেতেন রাজদীপবাবু। ভবিষ্যতে তিনি মারা গেলে পরে আইনত সৌমেন্দুবাবুর ছেলেমেয়েদের কাছেই ঘুরে ফিরে কোম্পানির মালিকা এসে পৌঁছাত কারণ রাজদীপবাবুর কোন ওয়ারিশ নেই। ওঁর স্ত্রীও মৃতা, ওঁর সন্তানও মৃত!”
“ওরে বাবা, এত বিস্তর জটিল কেস! শুধু চায়ে হবে না দেখছি!” বলেই দত্তদা পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট ধরালেন। যদিও অফিসের ভেতরে ধূমপান নিষিদ্ধ, তবে মাঝে-মাঝে প্রোটোকল ভাঙ্গা হয়ে থাকে!
“কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটা ঘটেছে। রাজদীপবাবু তো বিনা ওয়ারিশনেই মারা গেছেন। অর্থাৎ ওঁর পোরশনের মালিকানার কোন অংশীদার থাকছে না, পুরোটাই এখন সৌমেন্দুবাবুর ভাগে চলে আসছে! রাজদীপবাবু আত্মহত্যা করে সৌমেন্দুবাবুর একরকম সুবিধাই করে দিয়েছেন!” সার্থক বলল।
“একেই বলে ভাগ্য! কারোর পৌষমাস তো কারোর সর্বনাশ!” সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন দত্তদা।
“তবে সৌমেন্দুবাবুর তুঙ্গে থাকা বৃহস্পতির গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়,” বলে ইন্দ্রজিৎ টেবিলের ওপর থেকে আরও একটা ফাইল তুলে চায়ের কাপে একটা চুমুক মেরে বলল, “উকিলের চেম্বার থেকে বেরিয়েই আমি গেছিলাম ইন্সিওরন্স অফিসে। ‘উল্লাস’-এর ইন্সিওরন্স যিনি করেছিলেন, সেই এজেন্টের সাথে কথা বলত!”
“তা সেখানে কি জানা গেল?” উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন দত্তদা।
“যেটা জানা গেল তা হচ্ছে, ‘উল্লাস’-এর শুধু গোটা কারখানাটাই বীমা করা ছিল না, সঙ্গে-সঙ্গে তার প্রত্যেকটা মেশিন পার্ট, ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ইন্সিওরেন্স করিয়ে রেখেছিলেন এই দুই বন্ধু কাম পার্টনার। প্রতিমাসে তাঁরা প্রিমিয়াম ভরতেন, এবং সে অ্যামাউন্টও কিছু কম ছিল না, দু’ লাখ টাকা! দু’জনেই অর্ধেক করে দিতেন।”
“তা হতেই পারে। ‘উল্লাস’-এর টার্নওভার তো কিছু কম ছিল না। ওঁরা যে কোম্পানির ইন্সিওরেন্সের পেছনে এত টাকা খরচা করবেন এ তো বলাই বাহুল্য!” সিগারেটে আরও একটা টান দিয়ে বললেন দত্তদা।
“হ্যাঁ, এবং পাঁচ বছরে সে টাকা কয়েক কোটিতে পৌঁছেছে! এবং সব থেকে আশ্চর্যের ব্যপার, ইন্সিওরেন্সের সব কাগজপত্র রয়েছে রাজদীপবাবুর নামে, আর তিনি নমিনি করেছেন সৌমেন্দুবাবুকে, ওঁর বন্ধু কাম বিজনেস পার্টনারকে!”
“অসাধারণ! রাজদীপবাবু যেন নিজের বন্ধুর আখেরটা গুছিয়ে দেবার জন্যই এতসব কিছু করেছেন বলে মনে হয়, অন্তত দেখে তো সেরকমই লাগছে!” সার্থক বেশ উত্তেজিত হয়েই বলল কথাটা।
ইন্দ্রজিৎ হেসে বলল, “গল্প এখানেই শেষ হয়নি! পলিসিতে এমনও লেখা আছে, ‘উল্লাস’-এর গোটা কারখানা যদি নষ্ট হয়ে যায়, বা তাতে কোন আগুন ধরে, বা তার মেশিনপত্র নষ্ট হয়ে যায়, তবে ইন্সিওরেন্সের পুরো টাকাটাই পাওয়া যাবে, এবং সেটা ক্লেম করতে পারবেন রাজদীপবাবু। এবং তাঁর যদি অকস্মাৎ মৃত্যু হয়, তবে সেই টাকাটা পাবে যাকে তিনি নমিনি করেছেন, অর্থাৎ সৌমেন্দুবাবু!”
“সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে, তারপর?” দত্তদা বললেন।
মুখের হাসিটা জিঁইয়ে রেখে ইন্দ্রজিৎ বলল, “তারপরই তো মজা দত্তদা! রাজদীপবাবু ইন্সিওরেন্সের টাকাটা হাতে পান তেইশে নভেম্বর, অর্থাৎ আজ থেকে দু’দিন আগে, এবং কারখানায় আগুন লেগে যাওয়ার দু’দিন পর, আর উনি মারা যান গতরাতে, মানে চব্বিশে নভেম্বর, ইনসিওরেন্সের টাকাটা তোলার একদিন বাদে!”
“হোলি শিট!” দত্তদার মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে এল! উনি উত্তেজিত হয়ে হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিলেন, এবং সমান উত্তেজনা নিয়েই বললেন, “তার মানে যেটাকে আমরা আত্মহত্যা মনে করছিলাম সেটা একটা প্রি-প্ল্যান্ড মার্ডার!”
“আর এই প্রি-প্ল্যান্ড মার্ডারটা আর কেউ করেনি, করেছে রাজদীপবাবুরই প্রাণের বন্ধু সৌমেন্দুবাবু?” একই পরিমাণ উত্তেজনা নিয়ে বলল সার্থক।
“সেটা জানতে গেলে ধৈর্য্য ধরে বসতে হবে আরও কিছুক্ষন!” ইন্দ্রজিৎ টেবিল থেকে আরও একখানা ফাইল তুলে নিয়ে বলল, “প্রি-প্ল্যান্ড মার্ডার সম্বন্ধে না হয় ধারণা করা গেল, কিন্তু প্রি-প্ল্যান্ড অ্যাকসিডেন্ট সম্বন্ধে একটু জেনে নেওয়া যাক!”
“হোয়াট!” উত্তেজনায় দত্তদা বোধহয় পাগলই হয়ে গেলেন! বললেন, “তার মানে ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে যাওয়ার ঘটনাটা সত্যিই প্রি-প্ল্যান্ড ছিল?”
“সেটা তো আমরা আগেই অনুমান করেছিলাম, তাই না? কিন্তু প্রমাণ করতে পারছিলাম কই! আমি অবশ্য যে কাগজগুলো পেয়েছি সেগুলো জোরালো প্রমাণ না হলেও তা থেকে অনেককিছু বলা যায়!”
“সেগুলো কী?” সার্থক প্রশ্ন করল।
“সেগুলো ‘উল্লাস’-এর গত দুই বছরের কিছু রিকুইজিশন আর কিছু বিল!”
দত্তবাবু বললেন “সেগুলো থেকে কি জানা গেল?”
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইন্দ্রজিৎ ফাইল থেকে একটা কাগজ তুলে বলল, “এটা হল ফ্যাক্টরির চিমনিতে স্পেশাল ফ্যান বসানোর রিকুইজিশন। এখানে যা তারিখ আছে সেটা দু’বছর আগের। এরপরই রয়েছে সেই ফ্যানের পারচেজ অর্ডার এবং বিল। সবই দু’ বছর আগেকার।”
“মানে তোমার মোবাইলে সেদিন যেই পাখাগুলোর ছবি দেখেছিলাম এগুলো তারই বিল?” দত্তদা প্রশ্ন করলেন।
“একদমই। এইরকম একশটা ফ্যান কেনার রিকুইজিশন এবং তার প্রত্যেকটার বিল রয়েছে। প্রত্যেক চিমনি পিছু একটা করে ফ্যান লাগানোর কথা বলা হয়েছে। সব বিলই হয়েছে কোম্পানির নামে, অর্থাৎ ‘উল্লাস’-এর নামে। আর যেই কোম্পানি থেকে ফ্যানগুলো কেনা হয়েছিল তাদের অফিস কলকাতাতেই। সেখানে গিয়ে খোঁজ করতেই জানলাম সে বছর ‘উল্লাস’-এর তরফ থেকে ঠিক অতগুলো ফ্যানই কেনা হয়েছিল!”
“তারপর?” সার্থক গল্প শোনার আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল।
“তারপর আরও কয়েকটা বিল হাতে আসে, সবই একই বছরের, কিন্তু দু’মাস পরের ডেটের। সেই ফ্যানগুলো ইকুইপ করার বিল, মানে চিমনিগুলোর গায়ে ফ্যান বসাতে কতো খরচা হয়েছিল তার বিল। যে কোম্পানি থেকে ফ্যানগুলো কেনা হয়েছিল তারাই সেগুলো বসিয়েছিল চিমনির গায়ে, তেমনটাই বলা আছে বিলে!”
“সবই বুঝলাম, কিন্তু এর সাথে ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগবার কি সম্পর্ক?” দত্তদা যেন ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলেন।
ইন্দ্রজিৎ তার রহস্যময় হাসিটা হেসে পকেট থেকে মোবাইল বের করে সেদিনের তোলা ছবিটা সামনে রেখে বলল, “আমি আগেও বলেছিলাম, চিমনির গায়ে ফ্যান লাগানোতে আমার কোন সমস্যা নেই, সমস্যা হল সেই ফ্যানগুলোর গায়ে সাপের মত বেয়ে ওঠা পাইপগুলোকে নিয়ে। আর আমার খটকা যে নির্ভুল, সেটার প্রমাণও পেলাম, কারণ যেই বিলগুলো আপনাদের দেখালাম, সেগুলো প্রত্যেকটাই চিমনির গায়ে ফ্যানের বিল, সেখানে কোন পাইপের কথা উল্লেখ নেই!”
বলে ইন্দ্রজিৎ ঘরের মধ্যে উপস্থিত সেই নির্বাক, হতভম্ব হয়ে যাওয়া মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, তারপর সেই ফাইল থেকে আরও একখানা কাগজ বের করে বলল, “মামলা আরও ইন্টারেস্টিং হয়, যখন এর ছ’মাস বাদে আরও একখানা বিল আমার হাতে আসে, এবং সেই বিলটা দেখে আমি খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম। বিলটা ছিল দশ গ্যালন জুনিপার গাছের তেল কেনার বিল, এবং সেই বিলটা করা হয়েছিল সৌমেন্দুবাবুর নামে। আর একটু খুঁজতেই আমি সেই তেলের নামে করা রিকুইজিশনটাও হাতে পাই, যেখানে সৌমেন্দুবাবু স্পষ্ট বিবৃতি দিয়েছিলেন যে জুনিপারের তেল মেশিনের কলকব্জা স্বয়ংক্রিয় রাখতে এবং জং ধরবার হাত থেকে বাঁচাতে ব্যবহার করা হয়, এবং তিনি এই তেল কিনছেন শুধুমাত্র চিমনির গায়ে সদ্য লাগানো পাখাগুলোতে ব্যবহারের জন্য। এর থেকে আমার ধারণা হয়, এই কারনেই সেই পাখাগুলোর গায়ে পাইপ লাগানো থাকত, যাতে সেই পাইপের সাহায্যে জুনিপারের তেল সেই পাখা অবধি পৌঁছায়!”
দত্তদা প্রশ্ন করলেন, “হ্যাঁ, কিন্তু এটা তোমার সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছে কেন ?”
“এই কারণেই যে জুনিপার গাছের তেল একটি দাহ্য পদার্থ। এ তেল শুধু মেশিনের মরচে ধরা থেকেই বাঁচায় না, তাতে আগুনও ধরাতে পারে! এবং আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো। এই তেলের সাহায্যে আগুন ধরলে পরে তাতে কোন উত্তাপ হয় না, শুধু আলোই হয়! তাই, লোহা কিংবা ধাতুর ওপর এই তেলের সাহায্যে আগুন ধরালে শুধু তেলের স্তরটাই পোড়ে, ধাতব অংশটায় পোড়া রং ধরলেও তাতে কোন ক্ষতি হয় না!” এই বলে ইন্দ্রজিৎ নিজের ব্যাগ থেকে একটা প্লাস্টিকের শিশি বের করে টেবিলের ওপর রাখল। সেটার ভেতরে কিছু তরল পদার্থ দেখা যাচ্ছিল। ইন্দ্রজিৎ সেটার থেকে দু’ ফোঁটা হাতের আঙ্গুলে ঢেলে বলল, “নিউ মার্কেটে অনেক খোঁজাখুঁজির পর এ তেল জোগাড় করেছি! দেখুন তো, গন্ধটা চিনতে পারেন কিনা!” বলে তেলের ফোঁটা ঢালা আঙ্গুলটা দত্তদার নাকের সামনে এনে ধরল ইন্দ্রজিৎ। গন্ধটা শুঁকতেই দত্তদা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এ- এত সেই গন্ধ!”
“একশবার! এবং এই গন্ধই পুড়ে যাওয়া মেশিনগুলোর গায়ে ছিল!” বিজয়গর্বের একটা হাসি হেসে বলল ইন্দ্রজিৎ।
“তার মানে ফ্যাক্টরিতে আগুন ধরাবার জন্য এই জু-জু-” উত্তেজনায় দত্তদার কথা জড়িয়ে গেল। সার্থকের বুকের ভেতরটাও যেন ঢিপঢিপ করতে লাগল। সে যেন একটা দুর্দান্ত থ্রিলারের গল্প শুনছে!
“হ্যাঁ জুঁজু- এই জুঁজুই ভর করেছিল সৌমেন্দুবাবুর মাথায়, লোভের জুজু! তিনি অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে গোটা ব্যপারটাকে সাজিয়েছিলেন! এটা ছিল ওঁর বহুদিনকার মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা। একই সঙ্গে কোম্পানির প্রপার্টি এবং ইন্সিওরেন্সের টাকা কীভাবে একসঙ্গে আত্মসাৎ করা যায় সে ভাবনা অনেকদিন ধরেই তাঁর মাথাতে ছিল। তার আরও একটা আন্দাজ আমি পেয়েছি,” বলে আরেকটা কাগজ তুলে নিয়ে বলল, “সর্বশেষ বিল, যেটা ছ’দিন আগের তারিখে করা। বিলটা হল ফ্যাক্টরিতে সেই ইলেকট্রিক কানেকশন তদারকি করবার বিল, যেটা সৌমেন্দুবাবুর কথা অনুযায়ী, কারখানায় আগুন লাগার একসপ্তাহ আগে হয়েছিল, আজকের দিনের হিসেব করলে যেটা দশদিন আগের ডেট হয়, কিন্তু বিলের ডেট আছে আজ থেকে ছ’ দিন আগের ডেটের, মানে ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার দু’দিন আগে ভিজিলেন্সটা হয়েছিল!”
সার্থক বলল, “আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, ভিজিলেন্স আগে হয়েছে, বিল পরের ডেটে হয়েছে!”
ইন্দ্রজিৎ জবাব দিল, “তা হতেই পারে, কিন্তু বিলে আবার ভিজিলেন্সের ডেট হিসেবে ছ’দিনকার আগের তারিখই বলা আছে!”
“তার মানে ভিজিলেন্স করবার দুটো দিন যেতে না যেতেই সর্ট সার্কিটটা হয়?” সার্থকের প্রশ্নে বিস্ময় ঝড়ে পড়ল!
“এসব কি হচ্ছে? তার মানে ভিজিলেন্সের ব্যপারটা গোটাটাই-”
“গোটাটাই সাজানো!” দত্তদার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ইন্দ্রজিৎ বলল, “ওটা ছিল ভিজিলেন্সের নামে কারখানার ইলেক্ট্রিক কানেকশনগুলোতে গণ্ডগোল পাকিয়ে দেওয়া, যাতে নির্দিষ্ট দিন তারগুলো থেকে সর্টসার্কিট হয়, এবং কারখানাতে আগুন লাগে! এতে এতটাই উন্নত প্রযুক্তি এবং সুক্ষ টাইমিংয়ের খেলা ছিল যে, সর্ট সার্কিটটা এমন সময় হল, যখন কারখানায় কেউ ছিল না, অর্থাৎ ফাঁকা কারখানায় নিরাপদে যাতে আগুনটা লাগতে পারে, সে ব্যবস্থা করেছিলেন সৌমেন্দুবাবু!”
সার্থক বলল, “কিন্তু যেই লোকগুলো ভিজিলেন্সের কাজ করার নাম ইলেকট্রিকের তারে এমন গণ্ডগোল করেছিল, তারাই বা সৌমেন্দুবাবুর কথাতে এমন ঘৃণ্য কাজ করতে যাবে? নাকি সৌমেন্দুবাবু তাদেরকে মোটা টাকা খাইয়ে এমন কাজ করতে বাধ্য করেছিলেন?”
ট্রেডমার্ক হাসিটা হেসে ইন্দ্রজিৎ জবাব দিল, “আমি এখানেও অথেনটিক ইনফরমেশন জোগাড় করেছি। ‘উল্লাস’ কোম্পানির যাবতীয় ইলেকট্রিকের কাজ করেছিল যেই সংস্থা, আমি তাদের অফিসেও গেছিলাম, এবং খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওই বিশেষ দিনে তারা ‘উল্লাস’-এ কোন ভিজিলেন্সের কাজে যাননি। এবং সেদিন তারা কোথায়-কোথায় ভিজিলেন্সের কাজে গেছিলেন, সে রেকর্ডও চেক করলাম, কিন্তু ‘উল্লাস’-এর নাম দেখলাম না!”
“ম-মানে?” দত্তদা প্রশ্ন করলেন।
“মানে এই বিলও ফলস এবং যারা ভিজেলেন্সের কাজ করতে এসেছিল তারাও প্রত্যেকে ফলস! যেটা সত্যি তা হল কারখানায় আগুন লাগানোর পেছনে একজনেরই হাত এবং মাথা রয়েছে- সৌমেন্দুবাবুর! কীভাবে এবং কি কায়দায় করেছেন সেটাও পরিষ্কার, চিমনির গায়ের ওই আজব পাখাগুলোর সাহায্যে গোটা কারখানার ভেতরে, প্রত্যেকটা মেশিনের গায়ে জুনিপার অয়েল ছেঁটানো হয়েছিল, এবং সেটা দু-একদিন নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল এই প্রক্রিয়া। এবং পুরোটাই হত যখন ওয়ার্কিং আওয়ারস শেষ হয়ে যেত এবং কর্মচারীরা বাড়ি ফিরে যেত, যাতে কেউ টের না পায়!”
“কিন্তু সৌমেন্দুবাবু এত সব করতে গেলেন কেন? ওনাদের ব্যবসা তো ঠিকঠাকই চলছিল, শুধুই কি কারখানার সম্পূর্ণ মালিকানা আর ইন্সিওরেন্সের টাকাটা পাওয়ার জন্য?” সার্থক উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করল।
“মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আজ অবধি যতগুলো বই লেখা হয়েছে, তা দিয়ে নাকি একটা শহরকে ঢেকে দেওয়া যাবে, কিন্তু মানুষের মনের হদিশ কি সত্যিই পাওয়া গেছে ? সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের আড়ালে ছোট-ছোট তরঙ্গ অদেখাই থেকে যায়, তেমনই আমাদের তরঙ্গময় জীবনের আড়ালেও অনেক চোরাস্রোত বয়, যেগুলো আমরা টের পাই না! লোভের চোরাস্রোত, ঈর্ষার চোরাস্রোত, নিরাপত্তাহীনতার চোরাস্রোত! এই স্রোত যখন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখনই হয় মুশকিল। সৌমেন্দুবাবু আর রাজদীপবাবুদের দুটো ব্যবসাই বেশ রমরমিয়ে চলছিল, চিপস আর কোল্ডড্রিংক্সের। প্রতিদিনই উন্নতির নতুন লক্ষ্যে পৌঁছাছিলেন তারা। কিন্তু এত সাফল্যের মাঝেও সৌমেন্দুবাবুর মনে কোথাও হীনমন্যভাব ফুটে উঠছিল। তাঁর মনে হচ্ছিল, এই সাফল্য, এই প্রতিপত্তিতে দুজনের সমান অধিকার থাকলেও রাজদীপবাবু যেন সিংহভাগ জুড়ে আছেন! সবকিছু যেন তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। এতবড় বিপর্যয় ঘটে গেছে রাজদীপবাবুর জীবনে, তবু উনি যেন অবিচল থেকে সবকিছু সামলাচ্ছিলেন। একটা শোকতাপগ্রস্থ মানুষ কি করে এতটা মনের জোর পায় সেটা ভেবে অবাক হতেন। তাঁর মনে হত, তাঁদের সাফল্যের জন্য যা সব পুরস্কার জুটত, সেসব রাজদীপবাবুরই প্রাপ্য, তিনি সেখানে ভাগ বসাচ্ছেন অনৈতিকভাবে! এই হীনমন্য ভাব থেকে জন্ম নেয় জিঘাংসার! তিনি তখন সর্বনাশের খেলায় মেতে ওঠেন। কারখানায় আগুন লাগাবার প্ল্যান করেন। গোটা ব্যপারটাকে এমন ভাবে সাজান যেন দেখে মনে হয় অ্যাক্সিডেন্ট!”
“আমি এখনও গোটা ব্যপারটা হজম করতে পারছি না! লোভ, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা যাই হোক না কেন, সেটা কি বন্ধুত্বের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় যে নিজের বন্ধুকেও হত্যা করতে হয়?” হতাশার সুরে বললেন দত্তদা।
“এখানেও একটু ফাঁক রয়েছে। রাজদীপবাবুর ছাদের সিসি ক্যামেরার যা ফুটেজ রয়েছে তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে রাজদীপবাবু নিজেই তাঁর বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিচ্ছেন! অতএব সৌমেন্দুবাবু যে সরাসরি তাঁকে খুন করেছেন এটা বলা যাবে না। তবে রাজদীপবাবুর বাড়ির কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি যে সেদিন রাতে সৌমেন্দুবাবু এসেছিলেন রাজদীপবাবুর বাড়িতে, এবং তাঁদের মধ্যে অনেকক্ষন কথা কাটাকাটি হয়। হতে পারে, সেই বচসার মধ্যে সৌমেন্দুবাবু তাঁর বন্ধুকে এমন কিছু কথা বলেন যাতে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়া রাজদীপবাবু আত্মহত্যা করবার সিদ্ধান্ত নেন, সেটাও তো এক ধরনের মার্ডারই হল, তাই না!” ইন্দ্রজিৎ প্রত্যয়ের সঙ্গে জবাব দেয়।
ঠিক সেই সময়ই একজন পুলিশ ইনস্পেক্টর ঘরে ঢুকে বলল, “এইমাত্র খবর পেলাম, সৌমেন্দুবাবু ওঁর লেক গার্ডেনসের ফ্ল্যাট থেকে ওঁর গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন! আমাদের লোক ওঁকে ফলো করছে, তাদের ধারণা, উনি এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছেন!”
শুনেই ইন্দ্রজিৎ সচকিত হয়ে বলল, “কুইক, আমাদেরকেও এখুনি বের হতে হবে! কোনও ভাবেই সৌমেন্দুবাবুকে হাতের বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না ……”