হটাৎ বৃষ্টি’ | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | শ্রী স্নেহাশিস সামন্ত | Bengali Murder Mytery Story | 9F10
0 (0)

অফিস আর সংসারের কাজ যেন আর ভাল লাগছে না। একটা অদ্ভুত ক্লান্তি ক’দিন হল আমায় ঘিরে ধরেছে। কারণটা যদিও আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। সবেতেই মনে হচ্ছে একটু কোথাও চলে যাই। এ যেন এক দমবন্ধ পরিস্থিতি। বাবা বেঁচে থাকতে বলতেন ‘যখনই অস্বস্তি হবে একটু নিভৃতে কোথাও কাটিয়ে আসিস খোকা।’ আজ অফিস ফেরত ভাবলাম একটু পার্কে কাটিয়ে আসি। ইদানিং গ্রামের পার্কগুলো বেশ সুসজ্জিত হয়েছে। বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের বৈকালবেলা কাটানোর একটা বেশ সুন্দর জায়গা বটে। শিশুগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের শৈশবের কথা বড্ড মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘এনা’-কে নিয়ে এখানে অন্তরা মাঝে মাঝে আসতে পারে, অথচ সেও নিজের কাজের অজুহাত দেখিয়ে মেয়েটার ছেলেবেলাটাকে সেভাবে এনজয় করতে দিচ্ছে না। দোষ যদিও অন্তরাকে দেওয়া যায় না, কারণ সংবাদপত্রের কাজ যে বিশেষ দায়িত্বের। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি কোনও কিছুতেই তো বাড়িতে বসে থাকার অবকাশ নেই অন্তরার। গত কয়েক বছরে  ঘূর্ণিঝড়ের কভারেজ সবটাই নিজস্ব ভাষায় তুলে ধরার এমন সুযোগ অন্তরা কখনও ছাড়ে না। যদিও আমি বাধাও দিইনি কোনওদিন। মে মাসটা বড্ড বেশি কাজ নিয়ে অফিস আর বাড়ি করতে হয় অন্তরাকে। আজ কেন জানি না পার্কে বসে বসে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া সুন্দরী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকার দিনগুলো মনে পড়ছে। সেদিন ও এমনই এক পার্কে বসে প্রেমের সমুদ্রে ডুব দিয়েছিলাম আমি। সেদিন অন্তরা আমার তাঁর দিকে হাঁ করে আড়চোখে তাকিয়ে থাকা দেখে যা বলেছিল তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। সে বলেছিল ‘তুমি কি আমায় এভাবে আড়চোখে দেখেই কাটিয়ে দেবে? নাকি বিয়ে করে নিজের অর্ধাঙ্গিনী করবে।’ কথাটা বাকিরা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে আমায় বলেছিল ‘এতদিন আমরা ক্লাস ফাঁকি দিলাম যার জন্য, সেই বেছে নিল তোর মতো এমন শান্ত ছেলেটিকে!’ আমি সেদিন অন্তরার কথায় কিছু বলিনি। মেয়েদের ব্যাপারে আমি আবার একটু বেশি লজ্জা পেতাম। বাড়ি ফেরার পথে হাত ধরে টেনে কিস করার সেই আলো-আঁধারি মুহূর্ত আজ যেন বড্ড মনে পড়ছে। এক নিঃশ্বাসে দীর্ঘ এক চুম্বন যেন আমাকে স্থির হয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সেদিন এইরকম নির্জন এক পার্কের কাছেই সে প্রেম নিবেদন করেছিল এভাবে। গ্রামের ছেলে হয়ে শহুরে মেয়েদের এমন আদপকায়দা আমাকে কিছুটা অস্বস্তিতে তো ফেলেছিল। কিন্তু বড় চাকরি আর আধুনিকতার সাথে মানিয়ে নিয়ে আজ আমি বেশ সুখী। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন এক দমবন্ধ পরিস্থিতি কেন! বসে ছিলাম শেষ বেঞ্চটায়। দূরে বাচ্চাগুলোর চলে যাবার সাথে সাথে স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলে উঠল। মনে হল কোনও সুন্দরী মহিলা পিঠে ব্যাগ কাঁধে এদিকটায় আসছে। চোখের চশমা খুলে রাখার জন্য দূর থেকে ঠিক চিনতে পারিনি। সামনে আসতে চিরাচরিত পারফিউম চিনিয়ে দিল সে আমার স্ত্রী অন্তরা।

“কি গো হটাৎ অফিস থেকে ফিরে এখানে বসে আছ?”

আমি চশমা পরে বললাম “ভাল লাগছে না, তাই এখানে বসে আছি।”

অন্তরা আমার মনকে হালকা করার জন্য বলল “মনে পড়ে শুভ সেদিনের সেই কথা;লজ্জায় তুমি আমার দিকে তাকাতে পারনি। এমনই এক পার্কে তোমার আমার প্রথম এক হবার মুহূর্ত। তোমার লজ্জা কাটাতেই আমি সাহসী হয়ে তোমাকে কিস করেছিলাম। লোকে কী বলবে এসবের তোয়াক্কা করিনি।”

“হুম মনে পড়ে।”

“তারপর তোমার সাথে সেই ঘনিষ্ঠতার পর সারারাত ঘুমাতে পারিনি জান। কখনও বলিনি। মা বুঝতে পেরে বলেছিল ‘প্রেমে পড়েছিস!’ মায়েরা সব বোঝে। আর দেখ এনা হবার বছর তিনেক পর থেকে অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে আমি আর তুমি একে অপরকে সময়ই দিতে পারি না। আমরা এক বাড়িতে থেকেও যেন স্বামী-স্ত্রীর জীবন যাপন করছি না। স্পেস নেই। বিশ্বাস কর শুভ, আজ বড্ড মনে হয় শহরে তোমার আর আমার অফিসের কাছাকাছি একটা জায়গা কিনে বাড়ি করতে হবে। বাবা, মায়ের পর বাকি জ্ঞাতিদের সাথে আর কতদিন কাটাব। এবার নিজেদের জন্য আলাদা একটা কিছু করতেই হবে।”

অন্তরার মনের কথা আমি পড়ে ফেলতে পারি। জানি ওর কথাগুলো ভুল নয়। আমিও তো চেষ্টা করছি, কিন্তু আমার যা স্যালারি তাতে হাওড়া শহরের বুকে ভাল জায়গা কিনে বাড়ি করা বেশ চাপের। যদিও অন্তরা এক্ষেত্রে আমায় সাহায্য করবে। গ্রাম থেকে যাতায়াত আমার পক্ষেও বেশ কষ্টকর, সেখানে অন্তরা সেও বাস জার্নি করে তাঁর সাংবাদিকতার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে এনাও বড় হচ্ছে, ভাল স্কুলে পড়ানোর শখ আমারও আছে, তাই ভাবছি অফিসের কলিগ স্বপনদা অর্থাৎ স্বপন নিয়োগীকে একবার বলে দেখব। শুনেছি ওঁনার পরিচিতি বেশ বড় বড় মানুষদের সাথে। জায়গা-জমি পেতে আবার পরিচিত লোকের সাহায্য লাগে। আমার আবার একটু কম টাকার মধ্যে হলে তবে ভাল হয়, নাহলে সারাজীবন ইমআই দিতে দিতেই শেষ হয়ে যাব। মেয়ের ভবিষ্যত বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। বাবার যা সঞ্চয় তা কিছুটা গ্রামের বাড়ি আর মন্দির সংস্কার করতে চলে গেছে। তাই লোন নিলেও ব্যাপারটা বেশ ভেবে নিতে হবে।

অন্তরা আস্তে আস্তে বলল “কী গো আমায় একটু জড়িয়ে ধর না প্লিজ। কতদিন এভাবে পার্কে বসে সন্ধ্যার এমন মুহূর্ত এনজয় করিনি।”

আমার হটাৎ মনে হল মনটা বেশ হালকা লাগছে। তার মানে অন্ততার উপস্থিতি আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত এক প্রশান্তি এনে দিল। আমি নানারকম দুশ্চিন্তা ভুলে অন্তরাকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খেলাম।

১৭ই এপ্রিল

অফিস পৌঁছে আমি সোজা চলে গেলাম স্বপনদার ঘরে।

“আরে শুভ যে তা কী ব্যাপার?”

“না এমনি।”

“এমনি এমনি শুভ মিত্র আমার কেবিনে! এ যেন অদ্ভুত ঠেকছে।”

“আসলে স্বপনদা আপনার কাছে একটা আর্জি ছিল। যদি সম্ভব হয় তো -“

“আরে আরে এত সংকোচ করছ কেন ভাই। বল বল কী ব্যাপার?”

“আমার স্ত্রী অন্তরার ভীষণ ইচ্ছা যে শহরে কোনও একটা জমি পেলে বাড়ি করার -“

আমার কথা শেষ হবার আগেই স্বপনদা বলল “এর জন্য এত কিন্তু কিন্তু করার কী আছে শুভ? তুমি নিশ্চিন্তে থাক। কালই আমার এক পরিচিত লোকের সাথে তোমার দেখা করাচ্ছি। গড়ফার কাছে জায়গা পেলে অসুবিধা নেই তো?”

আমি উৎফুল্ল চিত্তে বললাম “এ তো আমার সৌভাগ্য স্বপনদা। মেয়েটার অ্যাডমিশন করানোর জন্য ভাল স্কুল, অন্তরার অফিস আর আমার অফিস সবই তো একেবারে কাছাকাছি হবে তাহলে। আপনি আমার মনের ভার লাঘব করে দিলেন দাদা। ধন্যবাদ।”

“এসব ধন্যবাদ ও ফর্মালিটি পরে কোরো। আপাতত জমিটা পাও, তারপর বাড়ি করে গৃহপ্রবেশে জমিয়ে খাইয়ে দিও, তাহলেই আমি খুশি হব শুভ।”

আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম।

অফিস ফেরত অন্তরাকে ফোনে সবটা জানালাম।

বাসে ফিরতে ফিরতে আজ বড্ড বাবার কথা মনে পড়ছিল। তিনিও চেয়েছিলেন শহরে একটা প্রপার্টি করতে, যাতে আমার ভবিষ্যত জীবন ভাল হয়। কিন্তু আমি নিজে গ্রাম থেকে বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছি, তবু মনে হয় এনার জন্য অন্তত আমি বাবা হয়ে সেই ইচ্ছাটা পূরণ করি। স্বপ্ন প্রায় সত্যি হবার পথে।

১৮ই এপ্রিল

সকালে ফোন করল স্বপনদা।

“হ্যালো, হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন দাদা!”

“না না সেরকম কিছু নেই।”

“আজই বৈকালে! বেশ তাহলে একসাথে চলে যাব। বেশ বেশ তাহলে রাখি-“

“ভাল থাকবেন, ওকে ছাড়ছি। “

ফোন ছেড়েই তৈরি হয়ে আমি অন্তরাকে বললাম “জান আজ স্বপনদা জমি দেখাতে নিয়ে যাবে। দামে পোষালে আজই রাজি হয়ে যাব।”

অন্তরা বলল “আমিও কি আসব বৈকালে?”

“চলে এস। তাহলে ফোনে জানিয়ে দেব,ওকে!”

বৈকালে অফিস থেকে একটু আগে বেরিয়ে চলে গেলাম গড়ফার কাছে। আশেপাশে সেভাবে বসতি গড়ে ওঠেনি। অনেকটা দূরে কয়েকটা বাড়ি, তাও বেশি উঁচু নয়। ফ্ল্যাট বলতে সেটা কয়েক কিলোমিটার দূরে। গড়ফার আশেপাশে সেভাবে জনবসতি নেই বললেই চলে। বিঘের পর বিঘে ফাঁকা জমি। জলা জমি বোধহয় একটু একটু ভরানোর চেষ্টা করলেও পুরোটা সম্ভব হয়নি। মনে প্রশ্ন জাগল যে এত জমি কিভাবে ও কারা সরকারের থেকে পারমিশন পেল যে ভরাট করবে! এটা তো অপরাধ ও অনৈতিক ব্যাপার। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল জমির যদি মালিকানা ঠিক থাকে, আইনত যদি কোনও বাধা না থাকে তবে অসুবিধা কোথায়?

স্বপনদা একজন ব্যবসায়ীর সাথে আলাপ করালেন আর সঙ্গে সঙ্গে হাজির হলেন একজন নেতা। যিনি শাসক দলের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও বটে! তিনি আশ্বস্ত করে জমির কাগজ ঠিকঠাক দেখিয়ে ভরাট হওয়া সেই জমিটার রেজিস্ট্রি করলেন। অথচ বাকি জমিগুলোর কোনও বিক্রেতা পেলেন না। আমি দেখলাম রাস্তার ধারের ওই একটা প্লট ছাই দিয়ে  বোজানো আর ওটাই আমার জন্য বিক্রি করলেন মিঃ রতন আগরওয়াল। যদিও তার পাশে কয়েকটা জমি অর্ধেক বোজানো হয়ে ফাঁকা পড়ে আছে। পিছনের প্লট সরকারি জমি আর আমার পাশের প্লটটা কিছু বনপালা হয়ে আছে। দূরের জমিগুলো সেভাবে বিক্রি হয়নি।

দাম বেশ ভালই পড়ল। লোনের টাকা আর বাবার জমানো গচ্ছিত দিয়ে জমি কিনে বাড়ি শুরু করলাম একমাসের মধ্যে। অচেনা জায়গা তাই বিল্ডিং মেটিরিয়াল নিলাম ওই মন্ত্রী মহাশয়ের লোকের থেকে। শুনলাম কয়েকদিন কাজে বাঁধা এসেছিল, তবে বাকিটা বেশ তাড়াতাড়ি মিটে গেল। কিন্তু সত্যিই কী মিটে গেল! আমার মনে কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করছিল। কোনও এক কারণে এক রাজমিস্ত্রি হটাৎ করেই পাগলের মতো আচরণ করতে থাকে আর ঠিকাদার তাঁকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা বেশ অবাক করেছে আমায়। যাইহোক মার্বেলের কাজ শেষে রঙ করিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম নভেম্বর মাসের রাসপূর্ণিমার দিন। অফিস কলিগ সহ আমার স্ত্রী অন্তরার পরিচিত অনিমেষ দত্ত সহ প্রায় একশ জন নিমন্ত্রিত ছিল। গৃহপ্রবেশের যাবতীয় আয়োজন স্বপনদার পরিচিত লোকজনের দ্বারা সংঘঠিত হল। গ্রামের কাকা-কাকিমারা এলেন অন্তরাকে সবটা গুছিয়ে দিতে। এনার স্কুলের কয়েকজন বন্ধুর পরিবার খুব আনন্দ করে পরিবেশটাকে আন্তরিক করে তুললেন। অন্তরার অফিসের বস অর্থাৎ সম্পাদক মহাশয় মিঃ সুবিমল আচার্য ও সিনিয়ার সাংবাদিক কাম এডিটর অনির্বাণ সান্যাল খুব আন্তরিকতার সঙ্গে সময় কাটালেন। সুবিমলবাবু জানালেন শীঘ্রই অন্তরার একটা প্রোমোশন হবে আর সেটা আগামীদিনের জন্য সারপ্রাইস হিসাবে থাকুক। অন্তরা কত দক্ষ ও কাজের প্রতি কতটা নিষ্ঠাবান সেটা বোঝাতে সুবিমলবাবু সব রকম চেষ্টাই করলেন। নিজের স্ত্রীর এমন প্রশংসা অন্যের মুখে শুনতে মন্দ লাগছিল না। সবই মোটামুটি ঠিকঠাক চলছিল, তাল কাটল বৈকালের দিকে। ঠিক যাবার আগে একজন অভিভাবক বললেন “মিঃ শুভ আপনি জমিটা অন্য কোথাও কিনতে পারতেন। জায়গাটা ভাল নয়।” কিন্তু এ কথাটা শুনে আমার মনে কতটা ব্যাথা লাগল সেটা উপলব্ধি করার আগে স্বপনদার চোখে এক অদ্ভুত চাহনি লক্ষ্য করলাম। যাইহোক এমন শুভদিনে এহেন এক অশুভ কথা মনটাকে বড্ড ভারাক্রান্ত করে তুলল।

৩০শে নভেম্বর

মেঘলা আকাশে নিম্নচাপের ভ্রূকুটি! সকালে খবর কাগজ খুলে বসেছি হটাৎ কাজের মেয়েটি জানাল “বাবু গত বছরের পুরানো কাগজ দেখেছেন?”

আমি বললাম “গতকাল বলছ?”

“না না বাবু গতবছরের।”

আমি বুঝতে বা পেরে বললাম “কেন? গতবছরের কাগজ আজকে পড়ে কী করব?”

এরপর আর কিছু সে বলল না। অদ্ভুত কথা শুনে মাথাটা ধরে গেল।

“কই গো অন্তরা এককাপ কফি হবে?”

ভিতর থেকে মিষ্টি স্বরে অন্তরা জবাব দিল “নিয়ে আসছি।”

দুজনে বারান্দায় বসে রাস্তায় যাতায়াত করা পথচলতি মানুষদের দেখতে লাগলাম আর হালকা শীতের আমেজ উপভোগ করতে লাগলাম। রোদের দেখা সেভাবে পাচ্ছিলাম না। দূর থেকে ট্রেনের আওয়াজ শুনতে খুব একটা খারাপ লাগছিল না। আজ মনে হচ্ছিল অফিস যাব না। এমনিতেই বৃষ্টি হবে, তার মধ্যে ঘরে বসে একটু লেখালিখি করলে মন্দ হয়ে না। নতুন বাড়ি আর এমন সুন্দর পরিবেশে মনটা যেন বাড়িতে থাকতেই ইচ্ছা করছিল। অন্তরার আবার আজ দুপুরে অফিস, রাতে ফিরতে দেরি হবে।

যাইহোক অন্তরা রান্নাঘরে গেলে আমি আজকের কাগজটা পড়তে লাগলাম। মনে হচ্ছিল গতবছরের কোন কাগজ দেখার কথা বলছিল কাজের মেয়ে মালতি, সেটাও পারলে খুঁজে দেখি। যাইহোক আজকের কাগজের একটা খবর পড়ে বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল।

খবরটা এরকম –

‘হাওড়া শহরে প্রোমোটারি রাজ নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন। প্রশাসন ও পুলিশ এই নিয়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে। কোনও এক বড় মন্ত্রী ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের জন্য একাধিক জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। পুলিশ যা না পারছে তাঁদের অপূর্ণ কাজ কেউ আড়ালে করছে। অপরাধীদের ভয় দেখাচ্ছে, কেউ কেউ এলাকা ছাড়া। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত! সরকার এই ব্যাপারটা অনুসন্ধানের জন্য এক প্রাইভেট গোয়েন্দাকে কাজে লাগিয়েছে। গোয়েন্দা নিজের পরিচয় গোপন করে বেআইনি জমির ব্যবসা ও দালালির খবর সংগ্রহ করে সরকার কিংবা পুলিশের কাজে সাহায্য করছেন। পাশাপাশি কে ভয় দেখাচ্ছে, এটাও তিনি দেখছেন।”

খবরটা পড়ে আসলে অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি কী ভুল করলাম এখানে জমি কিনে! মনটা খচখচ করতে লাগল। রাতের দিকে হটাৎ আমার বাড়ির পাশের প্লটে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে কয়েকজনের ধীরে ধীরে হেঁটে যাওয়ার শব্দ পেলাম। চোর বা দুষ্কৃতী থাকলেও থাকতে পারে, কারণ এলাকাটা খুব নির্জন। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ অন্তরা বাড়ি ফেরার পথে আসতে গিয়ে অন্ধকারে দেখেছে আমাদের জমি বিক্রি যিনি করেছেন সেই রতন আগরওয়ালকে। এটা শুনে খুব অবাক হয়নি। হয়তো কোনও কাস্টমারকে জমি দেখাতে এনেছিলেন, কিংবা –

আমার ভাবনা বেশিদূর গেল না, কারণ এনা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল “বাবা এবার ডিসেম্বরের ছুটিতে আমরা কোথাও বেরিয়ে আসব। না করবে না কিন্তু।”

মেয়ের আবদার ফেলতে পারি না, কিন্তু জানি না আদৌ এবছর শীতে কোথাও যাওয়া হবে কিনা!

পরদিন সকালে আমি হাঁটতে বেরিয়ে জলার দিকে একজনকে পড়ে থাকতে দেখে জল-কাদা মেখে এগিয়ে গেলাম। সামনে গিয়ে চমকে উঠলাম। একি! এত রতন আগরওয়াল! আমার মাথার শিরা ফুলে উঠল। তাহলে কাল হেঁটে যাওয়ার শব্দ ও অন্তরার কথা অনুযায়ী রতনবাবুর এদিকে আসা সত্যি ছিল। তিনি এদিকে এসেছিলেন! কিন্তু এটা কী হল? একটুও বিলম্ব না করে ফোন লাগলাম লোকাল থানায়। মিনিট পঁচিশ পরে এলেন একজন ইন্সপেক্টর ও কয়েকজন কনস্টেবল। রতন আগরওয়ালের মৃতদেহ তুলতে এলেন। আমি প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার জন্য কয়েকটা প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর বসাক। পরিচয় হল এবং সজ্জন মনে করে আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমি খোঁজ নিইনি যে রতন আগরওয়াল মারা গেলেন কী করে! যদিও খবরের কাগজের সূত্রে জানতে পারলাম রতনবাবুকে কেউ ঘাড় মটকে হত্যা করেছে। আশেপাশের লোকজনের মতামত এটা অশরীরী বা অতৃপ্ত আত্মার কাজ। ব্যাপারটা যদিও আমি খুব একটা বিশ্বাস করলাম না।

 এইভাবে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। অন্তরা একদিন অফিস থেকে ফিরল অনেকটা রাতে। আমি আসতে জিজ্ঞাসা করলাম “কী ব্যাপার গো, আজ এত দেরি হল?”

অন্তরা বলল “আর বোলো না; ইদানিং একটা রিপোর্ট তৈরি করার ব্যাপার নিয়ে বড্ড খাটুনি হচ্ছে। সঠিক দিশা পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে আমি গোয়েন্দা হয়ে যাব।”

আমি বললাম “ব্যাপারটা কী?”

অন্তরা বলল “কাল রবিবার। সকালে বসে ব্যাপারটা পুরোটা তোমায় বলব। আপাতত আমি ফ্রেশ হতে গেলাম।”

রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমাতে যাবার আগে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে রাস্তায় একটিবার তাকাতে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। একজন সারাশরীর ঢাকা ব্যক্তি একদৃষ্টে আমাদের জানলার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। চোখ দুটো রক্তবর্ণ। মণি দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে চোখের মণি যেন কোটরের ভিতরে বহুদিন হল ঢুকে গিয়েছে। যেন কতদিনের অতৃপ্তি নিয়ে সে এদিকে চেয়ে আছে। আমি তৎক্ষণাৎ ধপাস করে সশব্দে জানলা বন্ধ করতেই  অন্তরা জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল।

“কী হল গো?”

আমি কিছু বলতে পারলাম না। রাতে আমার এহেন আচরণ দেখে অন্তরা উত্তরের অপেক্ষায় রইল। আমি চুপ হয়ে খাটের একপাশে সরে বসে রইলাম। এনা ততক্ষনে ঘুমের দেশে। অন্তরা আমার কাছে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করলে আমি যেন সেভাবে পারছিলাম না। মনের মধ্যে অনেকগুলো ঘটনার আতঙ্ক ঘিরে ধরছিল। যদিও অন্তরার শরীরের স্পর্শে আমার সমস্ত দুশ্চিন্তা এক নিমেষে কোথায় চলে যায়। তাই অনভ্যাস সত্ত্বেও অন্তরার সাথে বহুদিন পর মিলিত হলাম। দুজনের এমন উদ্দাম প্রেমের মাঝে সাক্ষী রইল আকাশের বাঁকা চাঁদ। অন্তরা আমার শরীরে মিশেই ঘুমিয়ে গেল। আমিও কখন ঘুমিয়ে পড়লাম তার আর খেয়াল ছিল না। সকালে উঠে রোদের আলো চোখে পড়তে দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে অন্তরা।

“কী মহাশয়, কাল তো ছাড়তেই চাইছিলে না!”

আমি বললাম “পাশের ঘরে মেয়ে আছে আর তুমি কী সব বলছ!”

অন্তরা বলল “যখন আমায় জড়িয়ে ধরে কিস কর, তখন মেয়ে আছে মনে থাকে?”

আসলে এসব ব্যাপারের আবেগ কী নিয়ন্ত্রণ করা যায়! যাইহোক আজ সকাল সকাল হলুদ শাড়ি আর কপালে সিঁদুর পরে অন্তরা কী করতে চাইছে সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি ঘুম চোখেই বললাম “সত্যি বলছি আজ তোমাকে যেন ছাড়তে ইচ্ছা করছে না। তা কী ব্যাপার বল তো?”

অন্তরা একটা তারিখ দেখিয়ে বলল “আজ কত তারিখ?”

“৫ই ডিসেম্বর !”

“আজকের দিনটা ভুলে গেলে তুমি?”

লজ্জিত হয়ে বললাম “সত্যিই ভুলে গেছি গো, আজকে আমাদের -“

কথা শেষ হবার আগেই এনা একটা কাগজে রঙতুলি নিয়ে লেখা সামনে এসে দাঁড়াল –

‘হ্যাপি anniversary বাবা-মা।’

দুজনের একসাথে বললাম “দুস্টু মেয়ে!”

রবিবার আবার আজকে বিবাহবার্ষিকী, অথচ আমি ভুলেই গেছি। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম আমি ভুললেও অন্তরা ভোলেনি। সন্ধ্যাবেলা অনিমেষদা সহ গোটা পনেরো পরিচিতদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। যাইহোক সকালে বারান্দায় বসে কফি খেতে খেতে ভুলেই গেলাম গতকাল রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই রহস্যময় লোকটির কথা। অন্তরা কফি হাতে ইজি চেয়ারে বসে এক চুমুক দিয়ে বলল “কাল যেকথা বলব বলেছিলাম –

আসলে কয়েকদিন হল আমাদের সম্পাদক সুবিমলদা আমাকে ক্রাইম রিপোর্ট ও ক্রাইম নিয়ে একটা পর্ব শুরু করতে বলেছেন। বাস্তবে ঘটা এমন কাহিনীকে রিপোর্ট আকারের পাশাপাশি একটু গল্পের মতো করে পরিবেশন করতে বলেছেন। কালই সন্ধ্যায় অনির্বাণদা একটা নিউজ নিয়ে হাতে ধরাল। সঙ্গে কিছু ছবি। খবরটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি সময় ভুলে গিয়েছিলাম, আর রাত হয়ে যায় ফিরতে।”

“নিউজটা কী ছিল” বললাম আমি। অন্তরা কফিটা শেষ করে বলল “একটা মানুষের মৃত্যু ঘটে অথচ খুনি কে তা ধরতে পুলিশ মাসের পর মাস লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু খুনি যে তাঁর আশেপাশের কেউ সেটা বুঝেও প্রমান পাওয়া যায়নি। মোটিভ জানা গেছে, কিন্তু খুনি অধরা।”

আমি বললাম “স্ট্রেঞ্জ!”

অন্তরা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল “হুম সেটাই তো প্রশ্ন। কারণ খুন বা যেকোনও ক্রাইমের ক্ষেত্রে মোটিভ জানতে গোয়েন্দা বা পুলিশের মাথা খারাপ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে মোটিভ জানলেও খুনি ধরা যাচ্ছে না।”

আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম “মোটিভটা কী?”

অন্তরা সামনে একটা কাগজ মেলে ধরে বলল “প্রেম ঘটিত ব্যাপার।”

আমি বললাম “এটাই কী তোমার বস সুবিমলবাবুর দেওয়া সেই সারপ্রাইস! তোমার প্রোমোশন?”

অন্তরা হেসে বলল “সেরকমই বটে। মাঠে, ঘাটে গিয়ে আর ঝড়ের সংবাদ কিংবা অন্যান্য খবর সংগ্রহের বদলে এবার অফিসে কিংবা বাড়িতে বসে ক্রাইম রিপোর্ট লিখতে হবে। মাঝে মাঝে সেগুলোর সূত্র ধরে পুলিশের শরণাপন্ন হতে হবে।”

“সে যাইহোক এ কাজের তো একটা নিজস্ব সময় থাকবে। তোমার মতো করে এগিয়ে যাবে।”

অন্তরা হাসল।

হটাৎ বাইরে একটা গাড়ির শব্দ হতে আমি জাস্ট উঠে দেখলাম একটা ফোর হুইলার আমাদের দরজার সামনে এসে হর্ন দিচ্ছে। আমার বলার আগেই অন্তরা বলল “অনিমেষদা এসেছেন।”

অন্তরা বারান্দা থেকে মুখ তুলে বলল “আস্তে অনিমেষদা। আমি আসছি…”

অন্তরা একপ্রকার দৌড়ে নিচে গিয়ে মূল ফটক খুলে দিল আর গাড়িটা ভিতরে প্রবেশ করল। অনিমেষদা আজ সন্ধ্যায় আসলে অবাক হতাম না। কিন্তু এমন সকালে!

“এস এস দাদা,বল কী নেবে” বললাম আমি।

“আরে আরে শুভ ব্যস্ত হও না। আমি এসেছি যখন কিছুক্ষন রয়েছি।”

আমি বললাম “আজ সন্ধ্যায় আসছ তো?”

অনিমেষদা বলল “সে আর বলতে, তোমার বউটি গতকাল দেখা করে নিমন্ত্রণ করে গেছে। সুতরাং সে সুযোগ ছাড়ি কী করে বল ভায়া!”

“নিশ্চয়ই দাদা। তা এখন এলে কিছু প্রয়োজন?”

অনিমেষদা আমাকে রাগানোর জন্য অন্তরার দিকে চেয়ে বলল “দেখলে বোন, সকালে এসেছি বলে তাড়াতে চাইছে। আরে তোমাদের প্রেমের মাঝে আমি কী শক্তি কাপুর হব নাকি ভায়া!”

আমি লজ্জিত হয়ে বললাম “ছিঃ ছিঃ অনিমেষদা, এ তো তোমারও বাড়ি।”

অনিমেষদা হেসে বলল “বেশ বেশ অনেক রসিকতা হয়েছে। এবার আসি কাজের কথায়।”

আমি ভাবতে লাগলাম কী এমন ব্যাপার যার জন্য অনিমেষদার মতো এমন একজন গল্প লেখক তথা সরকারি কর্মচারী ছুটির দিনে আমাদের বাড়ি এলেন!

অন্তরা যে অনিমেষদাকে বড্ড আপন ভাবে আর সেই যে আজ ডেকেছে সেটা কিছুক্ষন পরেই বুঝতে পারলাম।

“দেখ অন্তরা তোমার বর্ণনা অনুযায়ী সুন্দরলাল মৈত্র মারা গেছেন দশ বছর আগের ২৩শে জুন। মার্ডার ওয়েপন পাওয়া যায়নি। তুমি জানিয়েছ মোটিভ পরিষ্কার। আমি বলছি না! মোটিভ তোমরা বুঝতে পারনি।”

অন্তরা বলল “মানে?”

অনিমেষদা বলল “খুনের মোটিভ প্রেম নয়। বরং অন্য একটা দিক রয়েছে। সেটা জমিজমা সংক্রান্ত ও আরও একটা ব্যাপার রয়েছে। সেটা একটু কাগজ ও সুন্দরলালের পরিচিত লোকজনের সাথে কথা বলেই জানা যাবে। এই দেখ কয়েকটা ছবি যা সুন্দরলালবাবুর খুন হবার পর খবর কাগজে প্রকাশিত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের। ধারাবাহিক ভাবে তাঁরা নিজেদের নির্দোষ প্রমান করে মিডিয়া বাইট দিয়ে গেছেন। কয়েকজন তো বেশ গণ্যমান্য মানুষ।”

কয়েকটা ছবি তুলে অন্তরা দেখল আর বলল “আমি এই ছবি দেখেছি। আমাকে সিনিয়ার অনির্বাণদা এই ছবিগুলো দিয়েছে, যাতে স্টাডি করতে সুবিধা হয়।” আমি হাতে নিয়ে নিউজটা পড়তে লাগলাম। বছর দশেক আগে কলকাতায় খুন হওয়া ব্যবসায়ী সুন্দরলাল মৈত্রের খবরটা। বেশ ইন্টারেস্টিং বটে!

অনিমেষদা এবার অন্তরাকে বলল “তুমি কী ক্রাইম রিপোর্ট নিয়েই এগোবে?”

অন্তরা আনন্দের সাথে বলল “নিশ্চয়ই অনিমেষদা। তুমি সাথে থাকলে কোনও ব্যাপার নয়।”

আমি কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে বললাম “অনিমেষদা অফিস আর তাঁর লেখালিখি ছেড়ে তোমার এই কাজে কিভাবে সাহায্য করবে বল তো অন্তরা?”

অনিমেষদা হেসে জবাব দিল “পারব শুভ, নিশ্চয়ই পারব। সময় এলে তুমিও বুঝতে পারবে কিভাবে পারব।”

অনিমেষদার হেঁয়ালির অর্থ আমি কিছুই বুঝলাম না। আমি যেন নানারকম ঘটনার সম্পর্কে তথ্য পেতে পেতে কেমন জটিল এক অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি।

সন্ধ্যায় সকলে এলেন বিবাহবার্ষিকীতে। আনন্দমুখর পরিবেশে বেশ হুল্লোড় করে সন্ধ্যাটা কেটে গেল। অনিমেষদা বেশ অনেকটা সময় আড়ালে গিয়ে অন্তরার সাথে কথা বলল। অন্যদিকে সুবিমলবাবু একটু বেশি অন্তরার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করতে লাগলেন। ব্যাপারটা ভাল লাগেনি আমার।

১৪ই ডিসেম্বর

আজ শনিবার। আজ এনার স্কুল নেই আর আমারও ছুটি। ইচ্ছা হল বেরিয়ে আসি কোথাও। কিন্তু অন্তরার কথা ভেবে মনে হল আজ কী ও পারবে! অন্তরা আমার মনের কথা পড়ে নিয়ে বলল “আজ ইচ্ছা হচ্ছে রেসকোর্স গ্রাউন্ড-এ মিলিটারি ট্যাটু অর্থাৎ নানা কসরত দেখতে যেতে চাইছ। তাই তো?”

আমি বললাম “সে তো বটেই। কয়েকবছর কলেজ ফেলে এসেছিলাম। তারপর আর হয়ে ওঠেনি। আজ মনের মধ্যে বড্ড ইচ্ছা করছে সেই ছেলেবেলার মতো হেলিকপ্টার দেখতে ও সেনাবাহিনীর যুদ্ধের নানা কৌশল দেখতে। তুমি তো পারবে না?”

অন্তরা বলল “বিজয় দিবস উপলক্ষে আমাদের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে আছেন সিনিয়ার এডিটর অনির্বাণদা আর একজন। সুতরাং আমিও চাইলে তাঁকে সাহায্য করতে পারি আর হয়তো তোমাদের সাথে ওখানে পৌঁছে দেখা হয়ে গেলেও অবাক হও না।”

অন্তরার কথা শুনে মনটা ভরে গেল। এনা ছুটে এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলল “বাবা আজ আমায় কলকাতার সবচেয়ে দামি রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে হবে কিন্তু!”

যবে থেকে নতুন স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছে, তবে থেকেই এই দামি ব্যাপারটা নিয়ে এনার আবদার যেন বেড়ে গেছে। গ্রামে ছিল যখন এরকম করত না। আসলে ওর বন্ধু সিদ্ধার্থ রায়ের বাবা মিলিটারি ম্যান, আর তিনি সবসময় বড় বড় জায়গায় যান। ফলে ওঁর সাথে মিশে সেরা জিনিসের প্রতি একটা টান এনার হয়েছে। আমি কুলাতে পারছি তাই ব্যাপারটা অসুবিধার নয়। যাইহোক কথা অনুযায়ী আমি আর এনা বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ গড়ফা থেকে নিজের গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব। পাশে ঘোড়ার উপর বসে প্র্যাকটিস করছে সেনাবাহিনী। তারই পাশে প্রদর্শনী রয়েছে বিভিন্ন অস্ত্র ও রেডারের। এনা আমার হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে ঢুকে গেল সেই প্রদর্শনীর জায়গায়। একজন ব্যক্তি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁকে আমি চিনি বলে তো ঠিক মনে হল না, তবে লোকটির ছবি কোথাও দেখেছি। কিন্তু কোথায়! মনে পড়ল না। এনা একটা পিস্তল দেখিয়ে বলল “বাবা এদিকে এস প্লিজ। দেখ এটা আমি অনিমেষ আঙ্কেলের কাছে দেখেছি।”

আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম আর কিছু বললাম না।

একজন সেনা আমাকে দেখে বললেন “আসুন স্যার। আপনাদের জন্যই এই আয়োজন।”

আমি চারিদিকে শুধু দেখতে লাগলাম আর তখন আর একজন সেনা বললেন “দেখিয়ে সাহাব, আপ কা বেটি বহুত চুলবুলি হ্যায়। বো কিসি সে ডরতা নেহি। আপ ভি আইয়ে প্লিজ।”

সেনা জওয়ানদের আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বিভিন্ন বন্দুক যা বিভিন্ন যুদ্ধের সময় ব্যবহার হয়েছিল, সেগুলো দেখে ওঁদেরই ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী মাঠের নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে গিয়ে আসন গ্রহণ করলাম। শীত থাকলেও মাঠের রোদের দাপটে বেশ ভাল লাগছিল। এনা আর আমি দুটো চেয়ারে বসে পড়লাম। মাঠে তখনও প্রস্তুতি চলছিল। ঠিক মিনিট দশেক পর মিলিটারিদের কসরত শুরু হল। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে হেলিকপ্টার উড়ে আসতে লাগল। কোনোটায় ভারতের পতাকা লাগানো তো কোনোটায় মিলিটারিদের নির্দিষ্ট জোনের পতাকা নিয়ে আমাদের সামনে চক্কর দিতে লাগল। প্রায় তিনটে নাগাদ পিছনে একটা ডাক শুনে দেখি অন্তরা, সাথে একজন ভদ্রলোক। হাতে ক্যামেরা আর কিছু কাগজ নিয়ে নমস্কার করলেন। পরিচয় হতে জানলাম উনি অনির্বাণ সান্যাল। সিনিয়ার এডিটর কাম অন্তরার গাইড। ব্যাপারটা এই কারণেই বললাম আসলে অনির্বাণবাবু অন্তরার যেকোনও কাজে সাহায্য করেন। নিজের বিষয় বহির্ভূত হলেও সংবাদপত্রের স্বার্থে উনি সর্বদা এগিয়ে আসেন। একথা অন্তরা আগেই বলেছে।

ওরা ওদের কাজ করতে লাগল আর এনা জেদ ধরল মায়ের কাছে যাবে। এনাকে আমি অন্তরার কাছে রেখে আবারও চেয়ারে বসলাম। প্রায় শেষের দিকে হটাৎ একটা চিৎকার শুনে কানটা সেদিকে চলে গেল। দৌড়ে গিয়ে দেখি অন্তরা চিৎকার করছে আর কেউ একজন দৌড়ে ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। মিলিটারির দল তাঁকে আটকানোর চেষ্টা অবধি করছে না। সামনে গিয়ে দেখি এনা মাটিতে শুয়ে। অনির্বাণবাবু চোখে-মুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে।

আমি ওঁদের পাশে বসে চেঁচিয়ে বললাম “এনা মা কী হয়েছে তোর! ওঠ বলছি।”

কিছুক্ষন পর এনা চোখ খুলতে জিজ্ঞাসা করলাম “কী হয়েছে মা তোর?”

এনা পাশের এত লোকজনের ভিড় দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়ে তার মায়ের হাত ধরে কাঁদতে লাগল।

কান্না থামতে বাকিদের অনুরোধ করে সরে যেতে বললাম। কয়েকজন সেনা আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেও অন্তরা রাগের মাথায় বলল “আপনাদের সাহায্য আমাদের লাগবে না। প্লিজ সরে যান -“

মিলিটারিরা এমন প্রস্তাব বোধহয় কোনও সাধারণ মানুষ বা সাংবাদিকের কাছ থেকে কখনও পায়নি। তাই হতকচিত হয়ে বললেন “সরি সরি ম্যাডাম। আপনি যা মনে করেন।”

অন্তরা নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের জল মুছে এনাকে জড়িয়ে ধরে বলল “কী করছিল লোকটা?”

এনা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল “জান মা লোকটা আমাকে একটা পিস্তল দেখিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল আর বলছিল মাকে বলবি বাড়াবাড়ি না করতে। আমি ভয়ে বললাম ‘ছেড়ে দাও আমায়, ছেড়ে দাও…’

তখনই পিস্তল উঁচিয়ে উপরে গুলি করল আর তারপর আমার আর মনে নেই।”

অনির্বাণবাবু বললেন “সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ওড়ার শব্দের মধ্যে গুলির শব্দ চাপা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু কে উনি আর কেনই বা তোমাকে সাবধান করতে চাইছে?”

অন্তরা বলল “সুন্দরলাল মৈত্রের হত্যার রহস্য নিয়ে আর্টিকেল লিখছি বলেই এই ইনসিডেন্ট নয় তো?”

আমি বললাম “এক্সাক্টলি অন্তরা। তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমরা যখন এই মাঠে আসি সেনার প্রদর্শনীর কাছে একজন লোককে বলা ভাল মিলিটারি পোশাকে থাকা একজন ব্যক্তিকে খুব চেনা চেনা লাগছিল। সেই লোকটি তোমার কাগজের খবরের সাথে থাকা সেই সন্দেহভাজন ব্যক্তির মধ্যে একজন, যিনি সুন্দরলাল মৈত্রের বন্ধু ছাড়াও বিজনেস পার্টনার ছিলেন।”

আমার কথার সূত্র ধরে অন্তরা বলল “এবার আমার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার। ওই লোকটিই এনাকে পিস্তল দেখিয়ে আকাশে গুলি করে ভয় দেখিয়ে আমাকে এই কেস নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করতে বারণ করছে। এর অর্থ যাইহোক আমি আর থামছি না।”

আমি বললাম “তাহলে কী সেই লোকটিই ছিল?”

অন্তরা বলল “হুম। ওঁনার পরিচয় খুঁজতে বেশিক্ষন লাগার কথা নয়।”

পরদিন ১৫ই ডিসেম্বর

সকালে উঠেই দেখি অন্তরা ঘরে নেই। এনার স্কুলের ছুটি। ছুটি সত্ত্বেও বিশেষ কারণে হটাৎ আমায় অফিসের একটা কাজে বের হতে হল। তাই তৈরি হয়ে নিলাম। অন্তরাকে ফোনে পাওয়া গেল না। আমার অফিস বের হবার আগে ফিরলেও আজ বাড়িতে খেয়ে যাওয়া হল না। বুঝতে পারছিলাম যে গতকালের ইনসিডেন্টটা ভাল ভাবে নেয়নি অন্তরা।

“কী ব্যাপার গো এত সকাল কোথায় গিয়েছিলে?”

অন্তরা বলল “একজনের খবর নিতে গিয়েছিলাম পদ্মপুকুর। লোকটির ইতিহাস জোগাড় করে তবে ফিরলাম।”

আজকে দুপুর থেকেই আকাশ মেঘে ঢেকে এল। মেঘের চাদর এতটাই পুরু যে সূর্যের দেখা মিলল না। অফিসে গিয়েও মনের চিন্তা দূর হল না।

সারাদিন এভাবে চিন্তা করেই কাটল। সন্ধ্যায় বৃষ্টি আর ঝড়ের দাপট বেড়ে চলল। রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা সেভাবে চোখে পড়ল না। অকাল বর্ষণে মানুষজন রাস্তায় সেভাবে বের হয়নি, যদিও বা কয়েকজনকে দেখলাম তাঁরাও কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরছিল। এমন বৃষ্টিতে সন্ধ্যার সময় আমি যখন বাড়ি ফিরছিলাম একটা অদ্ভুত ভয় আমায় ঘিরে ধরেছিল। গাড়িটা হটাৎ খারাপ হবার জন্য বাস ধরে এলাম বাড়ির কাছাকাছি। বাস থেকে নেমে বাড়ির পাশের পথ ধরে হাঁটছিলাম। ছাতা সঙ্গে নেই, তাই আমিও ভিজে বাড়ি আসছি। আজকে আবার লোডশেডিং। এমনিতেই ঝড়ের দাপট দেখা গেলেই ইলেকট্রিক অফিস থেকে কারেন্ট বন্ধ করে দেয়। ফলত আজ সারা হাওড়া শহর অন্ধকারে ডুব দিল। যদিও এমন অন্ধকার অনেক সময় বেশ রোমান্টিক করে তোলে। ইদানিং যা সব ঘটছে আমাদের সঙ্গে তাতে মনের রোমান্টিক হবার কোনও সুযোগ নেই। বাড়িটা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, অথচ কেন জানি না আজ আমি কোনও এক টানে জলা জমির একটা দিকে হেঁটে চলেছি। মন আর শরীর দুটোই আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সামনে যেন কেউ জলের মধ্যে হেঁটে চলেছে আর হোগলা বনের মধ্যে একটা শব্দ হচ্ছে। মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে আর আমি এগিয়ে চলেছি, যেন এ আকর্ষণ খুব আন্তরিক ও মায়াবী। বেশ কিছুটা পথ এসে থামলাম। এবার মনে হল সামনে সেই লাল চোখ যুক্ত কেউ ধোঁয়ার আস্তরণ ভেদ করে দু’হাত তুলে ডাকছে আর আমি যেই না পা বাড়াতে গেলাম হটাৎ একটা হেঁচকা টান আর তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে কেউ বলল “কী করছ শুভ! তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? একটু হলেই তলিয়ে যেতে ডোবায়।”

আমার নেশার মতো ভাবটা কেটে যেতে বুঝতে পারলাম আমার পিছনে কোনও মানুষ ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর ঘুরে দেখি এতক্ষন যার টানে আসলাম সে নেই। পরক্ষনেই আলো জ্বলে উঠল আর স্ট্রিট লাইটের আলোয় বুঝতে পারলাম আমার সাথে কথা বলছে অনিমেষদা।

“চল চল শুভ। এখন বাড়ি যাওয়া যাক বরং।”

আমি জানি না কেন ও কিভাবে আমি এই ভয়ঙ্কর ডোবার দিকটায় চলে এলাম।

বাড়ি এসে অন্তরা আমার ভেজা জামাকাপড় দেখে প্রশ্ন করল “কী হয়েছে তোমার? কোথায় গিয়েছিলে?”

আমি কিছু বলার আগেই অনিমেষদা বলল “জানি না অন্তরা শুভর কী হয়েছে! এদিকে আসছিলাম, হটাৎ দেখি একজন বাস থেকে নেমে কেমন উদ্‌ভ্রান্তের মতো তোমাদের বাড়ির পাশের যে বিস্তীর্ণ ফাঁকা জলা আছে সেদিকে চলেছে। আমার মনে হল লোকটা বিপদে। তাই মোবাইল টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গেলাম। সামনে আসতে দেখি ওটা শুভ। দেরি না করে দৌড়ে গিয়ে হাতটা টেনে ধরলাম আর তখনই ওঁর সম্বিত ফিরল।”

অনিমেষদার কথা শেষ হতে অন্তরা বলল “ব্যাপারটা কী বল তো অনিমেষদা?”

অনিমেষদা এবার হাতমুখ ধুয়ে বলল “ব্যাপারটা কী সেটা আমিও ভাবছি, তবে কিছু আন্দাজ করতে পারছি। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না! শোন্ তাহলে একটা গল্প বলি।”

আমি আর অন্তরা মনোযোগ দিয়ে অনিমেষদার কথা শুনতে বসে পড়লাম।

“বছর পাঁচেক আগের কথা। আমি তখন সরকারি চাকরি করলেও পুলিশের কয়েকজন বন্ধুর অনুরোধে বহুদিনের শখের গোয়েন্দাগিরি করতে নেমে পড়েছি। এমনিতেই আমার প্রথম জীবন গোয়েন্দাগিরি নিয়েই কেটেছে। এরপর নানা কাজে সেইসব ছেড়ে চাকরিতে মন দিই। কিন্তু গড়ফা সহ নানা জায়গায় অনৈতিকভাবে যেসব কাজকর্ম চলছে তার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করি। কেউ কেউ বলে গড়ফার এই জায়গাটা অভিশপ্ত। এদিকটা কেউ আসে না। কারও কোনও বাড়ি নেই, শুধু তোমরাই প্রথম এলে।”

আমি বললাম “তাহলে বাড়ি করে কি ভুল করে ফেললাম অনিমেষদা?”

অনিমেষদা বলল “না না তা নয়। সবটাই তো রটনা। সেটা কতটা সত্যি তার জন্যই তো প্রশাসন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। আমি তোমাদের বাড়ি হওয়া থেকে আজ অবধি প্রায় প্রতিদিন এদিকে আসছি আর দেখার চেষ্টা করছি আসলে সত্যিটা কী!

আসলে পুরানো কাগজ ও আশেপাশের লোকজনের থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি এখানে এই জমিজমা নিয়ে একটা খারাপ ইনসিডেন্ট ঘটেছিল। কোনও এক বসন্ত নামের যুবককে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় ওই জলার দিকটায়। গলার নলি কাটা ছিল আর ঘাড় মটকানো। পেটেও ছুরির দাগ ছিল। পুলিশের তদন্তে কিছু উঠে আসেনি। কেসটা ধামাচাপা দেওয়া হয়। কোনও একদল প্রভাবশালীদের সাহায্যে কেসটা আত্মহত্যা বলে চালানো হয়। যদিও বসন্তের মা ও আশেপাশের লোকজন স্বপন নামের একজনের উপর অভিযোগ তোলে। তাঁরা বলেন ‘স্বপন খুন করেছে বসন্তকে।’

যদিও আমি নিজে সমান্তরাল ভাবে তদন্ত করে জানতে পারি বসন্ত ও স্বপনের ভিতরের একটা গল্প।”

অন্তরা বলল “কী সেই গল্প অনিমেষদা?”

অনিমেষদা বলল “বসন্ত পাল ভালবাসত মাধুরীকে। মাধুরী আবার স্বপন নিয়োগীর একমাত্র মেয়ে। ওঁদের ভালবাসা এতটাই পবিত্র ছিল যে আশেপাশের মানুষও চাইত ওঁদের সম্পর্ক তৈরি হোক। বিবাহ করে সুখে দিন কাটাক। কিন্তু পাশাপাশি একটা ঘটনা কাউকে সুখে থাকতে দিতে চাইল না। গড়ফার এই জঙ্গলে বিভিন্ন প্লট বেআইনি ভাবে বিক্রি করে এখানকার বাস্তুতন্ত্রকে সম্পূর্ণ নষ্ট করার চক্রান্ত করছিল কয়েকজন প্রোমোটার। বসন্ত পাল ছিল পরিবেশপ্রেমী ও বিভিন্ন পরিবেশ সংঘটনের সাথে যুক্ত। সুতরাং আন্দোলন করে গড়ফার এখানে  বেআইনি নির্মাণ করতে বাধা দেয় সে। বহু হুমকি ধেয়ে আসে। তাও সে ছিল একরোখা। এভাবে চলতে চলতে একদিন জানা গেল বসন্ত পাল মারা গেছে। পুলিশ তদন্তের কোনও সুরাহা হল না ঠিকই, কিন্তু কোনও এক অজানা আতঙ্কের জন্য প্রোমোটারি রাজ কমতে লাগল। দুষ্কৃতীরা ভেবেছিল বসন্ত পাল মারা যাবার পর ওঁদের আর কে আটকায়। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন হল না। যতবার জলা বোজাতে ছাই নিয়ে কোনও লরি এসেছে তাকে আর ফিরতে হয়নি সুস্থ হয়ে। কখনও জলায় লরি আটকে গিয়েছে এবং ড্রাইভার নিজে ওই জলায় ডুবতে বসেছে। অনেক কষ্টে হয়তো সে বেঁচে ফিরেছে। একবার এক চালক জলায় কাউকে দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সবটাই কোনও অলৌকিক অস্বাভাবিক ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে। ফলত প্রোমোটারি রাজ কমতে কমতে সকল অনৈতিক লোকজন এলাকা ছেড়ে চলে যায়। প্রায় পাঁচ বছর পর তোমরা এলে আর বাড়ি করলে। জানি না তোমাদের বাড়ি করতে গিয়ে কোনও বাধা আসেনি কেন!”

আমি বললাম “এসেছিল বাধা। তবে সেটা উতরে দিয়েছি আমরা। কিন্তু কয়েকদিন হল নানা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে অনিমেষদা। কী হবে এবার?”

আমার দুশ্চিন্তার ভাবখানা দেখে অনিমেষদা বলল “আপাতত বিশ্রাম নাও।”

অন্তরা জিজ্ঞাসা করল “আচ্ছা অনিমেষদা তুমি বললে না যে বসন্ত পালের মারা যাবার পর মাধুরী কী করেছিল?”

অনিমেষদা বলল “শুনেছি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আর তারপর তাঁকে আর এই অঞ্চলে কেউ দেখেনি। সবটাই নাকি ওঁর দাদা স্বপনবাবুর হাত ছিল।”

“তারপর তুমি কেসটা নিয়ে আর এগোওনি?”

অন্তরার কথা শুনে অনিমেষদা বলল “হ্যাঁ আমি তখন থেকেই এই কেসটা নিয়ে এগিয়ে চলেছি। সমাধান করতে পারিনি এখনও। দেখ মানুষ হলে সমাধান করতে পারা যায়, কিন্তু যদি কোনও অশরীরী আত্মার কাজ হয় তবে বেশ অসুবিধার।”

আমি এবার বললাম “তুমি শেষে আত্মার কথা বলছ অনিমেষদা?”

“না না শুভ আমি বলছি না,এমনটা বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাঁরা বলছেন এই জলার পাশে বসন্তের অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়। বৃষ্টির রাত নেমে এলে কালো কোর্ট পরে পূর্ণিমার আলোয় কিংবা অমাবস্যার অন্ধকারে লাল চোখের কাউকে এদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত, কিন্তু মিথ্যা বলেও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অনিমেষদা বলল “গত মাসে একই কায়দায় জলার পাশে ব্যবসায়ী রতন আগরওয়ালের লাশ মেলে। তদন্তে কিছু উঠে আসেনি। আমিও ব্যাপারটা খোঁজ নিয়ে বিশেষ কিছু উদ্ধার করতে পারিনি। যদিও ওটাও তদন্ত চলছে, খুঁজতে হবে কাজটা মানুষ না অশরীরীর।”

অনিমেষদার শেষ কথাটা শুনে আমার উৎসাহ প্রায় শেষ হয়ে গেল। সেদিন জানলার পাশ দিয়ে রাস্তায় যাকে দেখেছিলাম সে বসন্তের আত্মা নয় তো! আজ সেই লাল চোখ দেখেছি, যেন কোনও এক কারণে আমাকে ডাকছিল। মাথা ঘুরতে লাগল। অনিমেষদা ঘড়িতে আটটা পনেরো দেখে বলল ” আমি উঠলাম। বাকি কথা পরে হবে।”

অনিমেষদা উঠে পড়ল।

পরদিন সকালের কাগজে একটা খবর দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম।

‘পদ্মপুকুর এলাকার এক পুরানো বাড়ির পাশের জলা থেকে মিলিটারি ম্যান প্রশান্ত রায়ের মৃতদেহ উদ্ধার।’

আমি তৎক্ষণাৎ রান্না ঘরে থাকা অন্তরাকে ডেকে বললাম “হ্যাঁ গো কাল তুমি পদ্মপুকুর গিয়েছিলে না?”

অন্তরা জবাব দিল “হ্যাঁ।”

আমি খবরের কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বললাম “এইটা দেখ।”

অন্তরা কাগজটা নিয়ে পড়তে লাগল আর ওঁর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল “ও মাই গড!”

আমি আন্দাজ ঠিকই করেছিলাম যে সেদিনের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে এনাকে ভয় দেখানো ব্যক্তি আর গতকাল পদ্মপুকুরে সকালে অন্তরার হটাৎ বেরিয়ে যাওয়া এই একই ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। সুতরাং সন্দেহ যার উপর ছিল সেই খুন হয়েছেন। অন্তরা বলল “সব যে গুলিয়ে যাচ্ছে গো। আমি ক্রাইম রিপোর্ট লিখতে গিয়ে একেবারে জড়িয়ে গেলাম। যখনই মনে হল সুন্দরলালের খুনিকে বোধহয় হাতের নাগালে পেয়েছি, তখনই সেই সন্দেহভাজনকেই সরিয়ে দিল কেউ! খুব অবাক লাগছে।”

আমি বললাম “ছাড় না এসব। তুমি তো রিপোর্ট লিখবে তার জন্য এত তদন্ত ও তার জন্য প্রাণের ঝুঁকি নেবার কী কোনও কারণ আছে?”

অন্তরা বলল “প্রথমে ছিল না এতটা গুরুত্ব। কিন্তু এনার উপর হামলা করে অপরাধী আমাকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। এখন হয়তো সে মারা গেছে, তাই বলে আমি থেমে যাব না। এর শিকড় বহু দূর অবধি বিস্তৃত।”

অন্তরার জেদ দেখে আমার মনে আশঙ্কার মেঘ জমতে লাগল। গোয়েন্দা হলে তবুও পুলিশের সাহায্য পাওয়া যায়, কিন্তু একজন ক্রাইম রিপোর্টার হয়ে এমন দুঃসাহসিক কাজে কার সাহায্য পাবে? সঙ্গে সঙ্গে অন্তরার ফোনটা বেজে উঠল।

“হ্যালো -“

“হ্যাঁ অনিমেষদা পড়লাম। ব্যাপারটা বড্ড ভাবাচ্ছে!”

“না না। তুমি কী আসছ?”

“আচ্ছা। বেশ বেশ। তাহলে দেখা হচ্ছে।”

ফোন ছাড়তে অন্তরা বলল “তুমি অফিস যেও, আমি একটু অনিমেষদার ওখানে যাচ্ছি।”

দুপুরে অফিসে বসে সর্বদা চিন্তা করতে লাগলাম অনিমেষদার বলা কথাগুলো। সত্যিই কী তবে বসন্ত পাল-এর আত্মা ঘুরে বেড়ায় আমার বাড়ির আশেপাশে! যদি ঘুরেই বেড়ায় তবে সে কী কিছু বলতে চায়? আমার মাথা ভীষণ ধরে এল। হটাৎ ঘরে ঢুকলেন স্বপনদা।

“আরে আসুন আসুন স্বপনদা। তারপর বাড়ির সব ভাল তো?”

স্বপনদা একটু মনমরা হয়ে বললেন “কী আর বলব বল শুভ;তোমার বৌদির শরীর ভাল নেই। যবে থেকে আমার একমাত্র মেয়েটা মারা গেছে তবে থেকেই ওঁর মানসিক সমস্যা শুরু। কত বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েও কিছু সুরাহা হল না। মানুষটা কেমন শেষ হয়ে গেল।”

আমি এবার একটু মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম এই মনে করে মোক্ষম কথাটা বলেই ফেললাম।

“আচ্ছা স্বপনদা আপনি বসন্ত পাল নামের কাউকে চিনতেন?”

কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে আর নিজের কোনও খারাপ অতীতকে চাপা দিতে মনে হল তিনি সংকোচবোধ করছেন। এরপর আবারও বললাম “গড়ফার আশেপাশে পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে যে ছেলেটি ২০১৫ সালে মারা যায় আমি তাঁর কথা বলছি।”

এবার স্বপনদা উত্তেজিত হয়ে বললেন “আমার মেয়েটার সর্বনাশ করেও সে শান্তি পায়নি। তারপর বেআইনি নানা কাজে যুক্ত হয়ে মাফিয়াদের সাথে ঝামেলা করে। এরপর একদিন নিজের সঙ্গীদের টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়ে গা ঢাকা দেয়। এরপর নিজেকে শেষ করে আমাদের ফাঁসিয়ে যায়।”

আমি বললাম “আপনাদের ফাঁসিয়ে মানে?”

স্বপনদা একটু জল খেয়ে বললেন “আমার মেয়েটাকে বিয়ে করে সুখে রাখতে পারেনি, তাই আমি মেয়েকে নিয়ে আসতে চাই। বসন্ত পালের লোকজন বাধা দেয়। আমি হুমকি দিই সবার সামনে। ফলে ওঁর মৃত্যুর পর সকলে খুন ধরে নিয়ে আমার বিরুদ্ধে বলতে থাকে। যদিও পুলিশের বড়বাবু আমার পরিচিত হবার জন্য আমায় বিশেষ বিপদে পড়তে হয়নি।”

আমি বললাম “স্ট্রেঞ্জ! তা আপনার মেয়ে মারা গেল কী করে স্বপনদা?”

“অত্যাচার আর মারধর ক’জন মেয়ে মেনে নেয় শুভ? পালিয়ে আমার অমতে বিয়ে করে ভেবেছিল বসন্ত ওকে ভাল রাখবে। কিন্তু মনে পাপ থাকলে কীভাবে ভাল হবে বলো শুভ?”

আমি বললাম “বসন্ত তাহলে বিয়ের পর আপনার মেয়েকে সুখে রাখেনি?”

স্বপনদা উত্তেজিত হয়ে বললেন “না! একেবারেই না। দিনরাত টাকা আনার জন্য চাপ, এমনকি বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যে গর্ভবতী হয়ে পড়লে সেই সন্তানকে নষ্ট করার মতো ঘৃণ্য কাজ অবধি করেছিল বসন্তের পরিবার। এরপর মেয়েটা মনমরা হয়ে থাকতে গিয়ে একদিন নিজেকে লুকিয়ে নিল। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মেন্টাল অ্যাসাইলামে দিলাম। সেখানেও পাগলের মতো আচরণ করে শেষে গায়ে আগুন দিয়ে মরে গেল। লাশটা এতটাই বিকৃত ছিল যে প্রথমে চিনতে পারিনি। শুধু হাতের একটা কাটা দাগ ও গহনা দেখে সনাক্ত করি। পাঁচটা বছর কিভাবে কেটেছে সেটা আমিই জানি শুভ।”

আমি আর কথা বাড়ালাম না। আজ আমি যা শুনছি সবই যেন কেমন ওলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে। অনিমেষদা যা বলছে আর স্বপনদা যা বলছে সবটাই পরস্পরের বিপরীত। এর মাঝে পড়ে আমি যেন কোণঠাসা হয়ে পড়েছি। মনে হচ্ছে গোয়েন্দাগিরি করতে পারলে হয়তো এই দ্বিধা থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে পারতাম।

অফিস শেষে আমি গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সারাদিন অন্তরার সাথে কথা হল না। অনিমেষদা সেই যে সকালে অন্তরাকে ডেকেছে এরপর একটা ফোন অবধি করেনি।

রাত আটটা নাগাদ বেশ বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরল অন্তরা। আমি জানি এই সময় কিছু জিজ্ঞাসা না করাই শ্রেয়। ফ্রেশ হয়ে অন্তরা একটা কুর্তি পরে আমার সামনে এসে বলল “জান আজ অনেকগুলো তথ্য আমরা জোগাড় করেছি। পড়াশোনা করার সময় একবার কলেজ ফেস্টে আমার সাথে অসভ্যতা করেছিল সেই ছেলেটিকে তোমার মনে পড়ে?”

আমি ভেবে বললাম “হ্যাঁ সেই কোঁকড়ানো চুলের ছেলেটা। হুম অল্প অল্প মনে পড়ে। কিন্তু হটাৎ এ কথা কেন!”

অন্তরা একটা জলের বোতল নিয়ে জল খেতে গিয়ে বলল “আজ যখন অনিমেষদা আর আমি একটা গোপন ডেরায় গিয়েছিলাম, ঠিক তেমনই একজনকে দেখলাম। চেহারার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি, তাই চিনতে অসুবিধা হয়নি। ছেলেটি মনে হল আমার উপর নজর রাখছে।”

আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম “এসব ছেড়ে দাও বরং। অনিমেষদা করলে করুক, তুমি ক্রাইম, রিপোর্ট, গোয়েন্দাগিরি এসব থেকে চলে এস প্লিজ। আমাদের সুখে-দুঃখে কেটে যাবে। আমাদের মেয়ে এনাকে নিয়ে দিব্যি কেটে যাবে।”

অন্তরা আজ যেন অত্যন্ত রেগে বলল “পড়াশোনা করেছি যখন তার সঠিক প্রয়োগ করতেই হবে। কিছু বদমাইশের জন্য ভয়ে পিছিয়ে চলে আসার মতো মেয়ে আমি নই। সুতরাং পিছিয়ে যাবার কথা আগামীদিনে আর বলবে না।”

রাতে ঘুমাতে গিয়ে অন্তরার কাছে ঘেঁষতে পারলাম না। অত্যন্ত রেগে বালিশ নিয়ে সেই যে মুখ ফিরিয়েছে, আর আমার দিকে ঘুরল না।

২০শে ডিসেম্বর শুক্রবার

একসপ্তাহ পরে সকালে অন্তরা তাড়াতাড়ি অফিস বের হচ্ছিল, হটাৎ ফোন এল অনিমেষদার। ফোনটা রিসিভ করেই অন্তরা আমাকে জানাল “আজ ক্যান্টিনে খেয়ে নিও। আমায় তাড়াতাড়ি বের হতে হবে।”

অগত্যা আমি তাই করলাম। ইদানিং দিনের কিংবা রাতের খাবার বাইরেই খেতে হচ্ছে। সংসার যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বলা হয়নি ক’দিন হল অন্তরা যেন নিজের অফিস, কাজ আর দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে আমার থেকে কিছুটা দূরে চলে গেছে। মনে হচ্ছে দাম্পত্য সম্পর্কে কিছুটা চিড় ধরেছে। যদিও সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ধারণা, এই নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনও আলোচনা হয়নি।

দুপুর ২টো

আমার অফিস থেকে আধ ঘন্টার জার্নি করে অন্তরার অফিস যাওয়া যায়। আমি কিছু না জানিয়ে অন্তরার অফিসে পৌঁছালাম। গিয়ে দেখি সবাই কাজে ব্যস্ত, আর অন্তরার দেখা নেই। আমি নিচে রিসেপশনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে গেলাম উপরের সুবিমল আচার্য-এর কেবিনে। কিন্তু দরজার আড়াল থেকে এক নারীর সাথে আরেক পুরুষের কথোপকথন শুনে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হল। বাইরে একজন অল্পবয়সী সুশ্রী মেয়ে আমার অবস্থা দেখে বলল “বসের কাছের লোক হতে অন্তরা ম্যাডাম সবকিছু করতে রাজি। তা আপনি কে হন?”

মেয়েটার কথার কোনও জবাব না দিয়ে আমি হন্তদন্ত হয়ে নেমে ফিরে এলাম। ফেরার পথে অনিমেষদার সাথে দেখা হতে জিজ্ঞাসা করল “আরে শুভ কোথায় চললে? অন্তরার সাথে দেখা হয়নি?”

আমি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম “ওঁর কী দেখা করার অবকাশ আছে অনিমেষদা?”

আমার মনের মধ্যে কী চলছে সেটা একমাত্র আমিই বুঝি। অন্য কাউকে বলেও সে অস্বস্তি কমবে না। সুতরাং মনে জ্বালা নিয়ে অফিস পৌঁচ্ছালাম।

সন্ধ্যায় বাড়ির সামনে একটা বিদেশী গাড়ি থেকে নামল অন্তরা। গাড়ির কালো কাঁচের ভিতর থেকে একজন ব্যক্তি হাত নেড়ে বিদায় জানাতে তবে অন্তরা বাড়িতে ঢুকল। ঘরে ঢুকতেই আমি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বললাম “তোমার প্ৰিয় মানুষটা বুঝি বাড়ি অবধি ড্রপ করে দেন? রাতটা কাটিয়েই আসতে পারতে?”

আমার কথায় তীব্র জ্বালার সাথে শ্লেস মেশানো ছিল, তাই খুব রেগে গিয়ে অন্তরা বলল “তুমি পাগল হয়ে গেছ শুভ! নিজের ভাষা ঠিক কর প্লিজ। কাকে কী বলছ?”

আমি বললাম “আমি পাগল হয়ে গেছি! না তুমি? একটা ১১বছরের মেয়ে থাকার পরও তুমি পরপুরুষের প্রতি এভাবে আকৃষ্ট হতে পার যা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। ছিঃ!”

অন্তরা নিজের রাগ সামলে নিয়ে বলল “সত্যিটা সামনে এলে নিজেকেই ছোট লাগবে শুভ। আপাতত এই নিয়ে আমি তোমার সাথে একটাও কথা আলোচনা করব না।”

৩১শে ডিসেম্বর মঙ্গলবার

খবরের কাগজে একটা খবর দেখে চমকে উঠলাম। অন্তরা যে সংবাদপত্রে চাকরি করে সেই অফিস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। আমি কয়েকদিন হল অন্তরার সাথে সেভাবে কথা বলিনি, তাই জানি না যে কী চলছিল ওঁদের অফিসে। রোজই নির্দিষ্ট সময়ে বেরিয়ে গেলেও সে ফেরে রাত করে। অফিসের কোনও সমস্যা ইদানিং আর আমাকে শেয়ার করে না সে। সুতরাং অনেককিছু আর আমার জানা হয় না।

আজ অনিমেষদা আমায় হটাৎ ফোন করে বলল “অন্তরাকে পাচ্ছি না, প্লিজ শুভ একটিবার আমার সাথে ওঁর যোগাযোগ করিয়ে দাও।”

মনের কোন জায়গায় আঘাত লাগলে তবে এতটা দুরুত্ব তৈরি হয়, সেটা বোঝানো সম্ভব নয়। আমি তাও আকার ইঙ্গিতে অন্তরাকে বললাম “বের হবার আগে অনিমেষদাকে একটিবার যোগাযোগ করলে ভাল হত।”

আমার কথা শুনে শুধু ঘাড় নেড়ে অন্তরা বেরিয়ে গেল। কিন্তু আজ অন্তরা অফিস তো যাবে না, তাহলে কোথায় যাবে! যাইহোক আর বিশেষ কিছু বললাম না।

আজ অফিস বেরিয়ে মনটা খুব খারাপ লাগছিল। সন্ধ্যায় ফেরার পথে আজ বাস ধরলাম। বাড়ির একটু কাছে একটা ফাঁকা জায়গায় স্বপনদাকে দেখলাম কয়েকজনের সাথে কথা বলতে। এদিকটা স্বপনদার অফিসের কাছাকাছি নয়, তাও এমন ভরসন্ধ্যায়! আমার মাথায় এসব আসতে কেমন একটা চিন্তা হতে লাগল। যদিও আজ অফিসে গিয়ে কেমন একটা থমথমে ভাব লক্ষ্য করছিলাম। কারণ আজ স্বপনদা আসেনি, অথচ বাড়ির পথে আসতে গিয়ে আমাদের এলাকায় স্বপনদাকে দেখে বেশ অবাক লাগল। আমি অন্ধকারের ওই দিকটায় এগিয়ে গেলেও কাউকে দেখতে পেলাম না। অগত্যা চোখের ভুল মনে করে বাড়ি চলে এলাম।

রাত আটটা নাগাদ স্বপনদাকে ফোন করতে রিং হয়ে কেটে গেল। এরপর আর চেষ্টা করলাম না।

১লা জানুয়ারি বুধবার

হটাৎ একটা কোলাহল শুনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি আমার বাড়ির থেকে খুব কাছাকাছি একটা জায়গায় জটলা। বহুমানুষ ঘিরে আছে আর পুলিশের গাড়ি দূরে দাঁড়িয়ে। হটাৎ অন্তরার ফোন বেজে উঠল। আমি দেখলাম সে বাথরুমে। তাই ফোনটা দেখলাম আর তাতে ভেসে উঠল অনিমেষদার নম্বর।

“হ্যালো অনিমেষদা বল।”

“আরে শুভ, অন্তরা নেই?”

“আছে। ও একটু বাথরুমে ঢুকেছে। তুমি আমায় বলতে পার।”

“শুনেছ একটা খবর?”

“কী খবর?”

“স্বপন নিয়োগীর মৃত্যু হয়েছে। কেউ কাল রাতে জলার ধারে ডুবিয়ে মেরেছে। সম্ভবত খুন।”

“বলেন কী অনিমেষদা! খুন!”

“হ্যাঁ শুভ। একটা জঞ্জাল পরিষ্কার হল।”

“তুমি খবরটা পেলে কী করে অনিমেষদা?”

“সেটা নাহয় পরে বলব। তুমি অন্তরাকে বোলো একটিবার ফোন করতে।”

“বেশ বলব।”

অনিমেষদার ফোন ছাড়তেই একজন ইন্সপেক্টর এদিকে আসছেন দেখলাম। খুব চেনা লাগছে। লোকটি এদিকে আসতে আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম। দেখলাম ইন্সপেক্টর বসাক। আগে একবার একটা ঘটনার জন্য ওঁনার সাথে পরিচয় হয়েছিল।

“শুভবাবু যে, তা কী ব্যাপার?”

“এই তো মিঃ বসাক। তা আপনি আমার বাড়ি এত সকাল!”

“আর বলবেন না। আপনার এলাকার ওই জলার ধারে একটা লোকের লাশ মিলেছে। লোকজন বলছে ওটা স্বপন নিয়োগী। আপনার জমিটা উনিই তো দেখে দিয়েছিলেন না? তাই ভাবলাম যদি এব্যাপারে কিছু জানা যায়, এই আর কি।”

আমি কী বলব ভাবছি, এমন সময় স্নান সেরে তৈরি হয়ে আমাদের সামনে এসে বলল “ইন্সপেক্টর বসাক আপনি ওঁনাকে জিজ্ঞাসা করে বিশেষ কিছু জানতে পারবেন না। বরং আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমরা আপনাকে সবটা জানাচ্ছি। স্বপন নিয়োগীর হত্যার রহস্য আপনি জানতে পারবেন। তবে এটুকু বলতে পারি যে যা হয়েছে বেশ হয়েছে, আর তাঁর মৃত্যুর কারণ আপনাকে সেই মানুষটা বলবে।”

আমি অন্তরার কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না।

৭ই জানুয়ারি

এক সপ্তাহ এভাবে কেটে গেল। আজ হটাৎ ৯টা নাগাদ শুনলাম অন্তরার নিখোঁজ সংবাদ। অনিমেষদা ফোনে জানালে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। অফিস গেলাম না।

ইন্সপেক্টর বসাকের সাহায্য প্রার্থনা করলাম। এরপর ওঁনাদের পরামর্শ অনুযায়ী আমি বের হলাম। একটু পরেই আমি,ইন্সপেক্টর বসাক আর অনিমেষদা কিছু সূত্র ধরে পৌঁছে গেলাম অন্তরার সংবাদপত্রের অফিসে। অফিস বন্ধ কিন্তু পিছনে একটা বড় পুরানো কারখানার ভাঙাচোরা অংশ চোখে পড়ল। এমন পুরানো কারখানার কাছে এলাম কেন, বুঝতে পারলাম না। অনিমেষদা নিজের পিস্তল বের করে বলল “খুব সাবধান। ভিতরে যাঁরা আছে তাঁরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে থাকতে পারে। শুভ তুমি আমার পিছনে থাক।” আমি মাঝে চললাম আর ইন্সপেক্টর বসাক কয়েকজন কনস্টেবল নিয়ে আমার পিছনে চললেন। কিছুটা গিয়ে কয়েকজনের কথাবার্তা শুনতে পেলাম আর তারপর নারী কণ্ঠের চিৎকার আর গুলির শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে থাকা লোকজনকে অতর্কিতে হামলা করে পরাস্ত করলেন পুলিশের লোকজন ও অনিমেষদা। ভিতরে থাকা মহিলা দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। একি অন্তরা! ব্যাপারটা বোঝার আগেই কোঁকড়ানো চুলের লোকটি আর তার সাথে থাকা অনির্বাণ সান্যালকে ধরে পুলিশ নিয়ে গেল। সারাদিন নানা উৎকণ্ঠা আর দুশ্চিন্তায় কাটল।

সন্ধ্যার সময় হাসতে হাসতে বাড়িতে ঢুকল অনিমেষদা ও ইন্সপেক্টর বসাক। এরপর ওঁনারা ডাইনিং টেবিলে বসলেন। অনিমেষদা বলল “বুঝলে শুভ কালকের খবরের কাগজে হেডলাইন হবে ডিটেকটিভ অন্তরা মিত্রের সাহসিকতার কীর্তি!”

আমি বললাম “মানে?”

ইন্সপেক্টর বসাক বললেন “বহু দিন ধরে তদন্ত চালিয়েও সুন্দরলাল মৈত্রের খুনি ও তার মোটিভ নিয়ে একটুও এগোতে পারিনি, অথচ মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তোমার স্ত্রী সেই খুনের কিনারা করে দিয়েছেন। একেবারে সিংহের গুহায় ঢুকে শিকার করেছে অন্তরাদেবী। ব্রিলিয়ান্ট ম্যাডাম -“

“আরে না না ইন্সপেক্টর বসাক। আপনি আর অনিমেষদা না থাকলে এ রহস্য সমাধান হত না” বলল অন্তরা।

আমার কৌতূহল ক্রমশ বেড়ে যেতে লাগল। তখন শুরু করল অনিমেষদা।

“আজ থেকে ১০বছর আগে কলকাতার উপকণ্ঠে একটা খুন হয়। যে খুনের মোটিভ জানা যায়নি, এমনকি একটা সূত্রও মেলেনি। ফলে ব্যাপারটা খুন জেনেও অপরাধী ধরা পড়েনি। ‘নিউ পিস লাইফ ইন্সুরেন্স’ কোম্পানির পলিসি এজেন্ট সুন্দরলাল মৈত্রের লাশ পায় পুলিশ। লোকটি যেমন লম্বা তেমনই সুঠাম। উনি পারিবারিক ব্যবসার পাশাপাশি ইন্সুরেন্স কোম্পানির বড় এজেন্ট ছিলেন। অথচ ওঁনার পরিচয় হিসাবে দেওয়া হয় ব্যবসায়ী। বহু বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পী, শিক্ষক, প্রোমোটার ওঁনার পলিসি কিনেছিলেন। মোটা অঙ্কের টাকার পলিসি করে তাঁরাও নিশ্চিন্তে ছিলেন। অসুবিধা কিছু ছিল না। তারপর হটাৎ একদিন সন্ধ্যার পর তাঁর কোনও হদিস মিলছিল না। ওঁনার স্ত্রী রাতে নিখোঁজ ডাইরি করলেও কোনও সূত্র দিতে পারেননি। শুধু জানা যায় সুন্দরলালবাবুকে কোনও পরিচিত ব্যক্তি সন্ধ্যার সময় হাওড়ার কোনও জায়গায় আসতে বলেন। ব্যাস এটুকুই শুধু তথ্য ওঁনার স্ত্রী দেন ইন্সপেক্টর বসাককে। তখনও উনিই ছিলেন হেস্টিংস থানার কর্তব্যরত ইন্সপেক্টর। এরপর কয়েকবছর পর হাওড়ার গড়ফা থানার ইনচার্জ হয়ে চলে আসেন। কিন্তু ইন্সপেক্টর বসাকের সেই খুনের কিনারা না করতে পারার অতৃপ্তি রয়ে যায়। যাইহোক এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। আমি সরকারি দপ্তরের নানা প্রোমোশন না নিয়ে সাধারণ একজন কেরানি হয়েই কাটিয়ে দিয়েছি শুধু শখের গোয়েন্দাগিরিকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য। এতদিন একা ছিলাম, বিয়ে করিনি। ফলত বন্ধু বা পরিচিত কাউকে আশেপাশে পাইনি। কিন্তু কলেজ জীবন থেকে অন্তরার বাবা বিপ্লববাবুর সাথে বেশ ভাল পরিচয় ছিল, তাই একবার অন্তরার সাথে আমার বিয়ের কথা উনি তুললেও তোমার আর অন্তরার প্রেম দেখে আমি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই। তোমাদের সুখের জীবনের জন্য শুধু আশীর্বাদ করে গেছি। বয়সে যদিও অন্তরা আমার থেকে বেশ খানিকটা ছোট। যাইহোক এরপর আসি মূল ঘটনায়। সুন্দরলাল মৈত্র খুন হবার পর ইন্সপেক্টর বসাকের তদন্তে শুধু উঠে আসে কোনও ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত, আর সেটা ওঁনার স্ত্রীর উপরই বর্তায়। নিজের স্ত্রী কেন মারবেন বা হত্যা করাবেন সেটা বুঝতে পারা যায়নি। ফলত সাধারণ কিছু জিজ্ঞাসা আর অবশেষে কোর্টে পেশ করা হয় অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা আর অপরাধী অজানা। কেস প্রায় ধামাচাপা পড়ে যায়। কিন্তু কিছুদিন আগে পদ্মপুকুর এলাকার একটা নির্জন বাড়ির পাশের জলা থেকে যখন মিলিটারি ম্যান প্রশান্ত রায়ের মৃতদেহ মিলল, সেখান থেকে উদ্ধার হয় একটা সূত্র। একটা ফোন নাম্বার যেটা খুনির দেহ পড়ে থাকা জলা থেকে ১০মিটারের মধ্যে একটা পানাবনের ধারে খুঁজে পাওয়া যায়। একটা মোবাইল জলে ভিজে নষ্ট হলেও তার পাশেই কাগজে অদক্ষ হাতের লেখা দশ ডিজিটের ফোন নাম্বার। ওটাই ছিল অগ্নিবাণ। ওখান থেকে যে সূত্র মেলে সেটা উদ্ধার করেছে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট অন্তরা মিত্র। একজন ক্রাইম রিপোর্টার হয়ে যে নিজেকে গোয়েন্দা ও পুলিশের হাতে হাত মিলিয়ে তদন্তে সাথ দিতে পারে যা আমি কখনই ভাবতে পারিনি। আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট খুঁজছিলাম আর তোমার স্ত্রী সেই অপূর্ণ জায়গাটা নিয়ে নিল। ‘ধন্যবাদ অন্তরা।’ তারপর তোমাদের মেয়ে এনার উপর হামলা করার এহেন আচরণ বড্ড ভাবিয়ে তোলে অন্তরাকে। নিজের জীবন দিয়ে সে এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে চায়। ফলে ১৫ই ডিসেম্বর সকাল সকাল আমার সাথে পদ্মপুকুর এলাকার প্রশান্ত রায়ের বাড়ির উপর তৃঘ্ন নজর রাখে। ওঁনার কিছু ফোন কল ট্রেস করতে চেয়েও পারছিলাম না। এমনকি নির্দিষ্ট কোনও কারণে পুলিশও ব্যর্থ হন। এরপর আমি আর অন্তরা ওঁনার গতিবিধির উপর নজর রাখি। সেদিনই সন্ধ্যায় ডালহৌসি চত্বরে একজন কোঁকড়ানো চুলের লোকের এহেন ভোলবদল আমাদের অবাক করে। তিনি যে শুধু নিজের ভোল বদলে ফেলেছেন তাই নয়, বরং সকলকে অবাক করে দিয়েছেন।”

উৎকণ্ঠা চেপে না রেখে জিজ্ঞাসা করলাম “কে উনি?”

অন্তরা উসখুস করছে দেখে অনিমেষদা বললেন “দিনের খবর সংবাদপত্রের সম্পাদক সুবিমল আচার্য।”

আমি অবাক হয়ে বললাম “অন্তরার অফিসের বস সুবিমলবাবু!”

“হ্যাঁ শুভ। সুবিমলবাবু। কিন্তু কী কানেকশন ওঁনার সাথে মিলিটারি ম্যান প্রশান্ত রায়ের? এটাই ভাবিয়ে তোলে আমাদের। এরপর প্ল্যান অনুযায়ী আমাদের গেম শুরু হল। কিন্তু অদৃষ্টে তো আমাদের জন্য কষ্ট লেখা রয়েছে, তাই তীরে এসেও তরী ডুবে গেল। অর্থাৎ পরেরদিন হটাৎই খুন হলেন প্রশান্তবাবু। আমরাও পড়লাম অথৈ সমুদ্রে। কিন্তু যেখানে মনে হয় সব শেষ, আসলে ওটাই কোনও জিনিসের শুরুর পথ দেখায়। আমাদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হল। প্রশান্তবাবু খুন হতে আমি আর অন্তরা আদা-জল খেয়ে নেমে পড়লাম মাঠে। সূত্র পেলাম একটা ভিজে ছেঁড়া কাগজ আর তাতে একটা দশ সংখ্যার ফোন নম্বর। এবার ইন্সপেক্টর বসাকের সাহায্যে ফোন নম্বরটি চালু করা ও তার মালিকের খোঁজ শুরু করলাম। সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম মালিকের নাম। ব্যাস কাজ কমে এল, আর গন্ডি ছোট হতে লাগল। এরপর শুরু অভিনয়, আর তুমি সেই অভিনয় বুঝতে পারনি শুভ।”

অনিমেষদার কথা শুনে বুঝতে পারলাম না কী সেই অভিনয়!

অনিমেষদা আমার দুশ্চিন্তা কাটাতে বলল “ডিসেম্বর মাসে একদিন তুমি অন্তরার অফিসে গিয়ে সম্পাদক মহাশয় আর অন্তরার ঘনিষ্ঠ কথোপকথন শুনেছিলে, তাই তো? ওটা ছিল অভিনয়। আসলে প্রশান্তবাবুর লাশের পাশ থেকে পাওয়া ফোন নম্বরটি পত্রিকার এক নিরাপত্তারক্ষী বাদল মন্ডলের নামে নেওয়া। কখনও আধার কার্ডের কপি দিয়ে একটা নাম্বার নেওয়া হয়েছিল এই আর কী! কিন্তু কে এই বাদলবাবু? তুমি বা অন্তরা কেউ তো চেন না। তাহলে এবার আমাদের নজর পড়ল বাদল মন্ডলের উপর। খোঁজ লাগাতে জানতে পারলাম কোনও এক নারীঘটিত কারণে তাঁকে সুবিমলবাবু বরখাস্ত করেন। কিন্তু কোথায় তাঁর বাড়ি আর চিনব কী করে! এটা সম্ভব হয়েছে অন্তরার জন্য। অফিসে সম্পাদক বা বস সুবিমলবাবুর সাথে প্রেমের অভিনয় করে বাদলবাবুর ঠিকানা পাওয়া যায়। যদিও সেটা আরও সহজেই হত, কিন্তু অভিনয় করে একটু দেরিতে পাওয়া গেল। অফিসের স্টাফ শ্রেয়া, যে সেদিন তোমাকে বলেছিল অন্তরা আর সুবিমলবাবুর ঘনিষ্ঠতার কথা, সেই ছিল বাদলবাবুর একমাত্র মেয়ে। ফলত ওঁর পিছু করেই আমরা পাই বাদলবাবুর ঠিকানা, আর ওঁনার কাছে জানতে পারি সুবিমলবাবুর দুস্কর্মের ইতিহাস। শ্রেয়ার সাথে প্রেম, ঘনিষ্ঠতা করে তাঁকে ছেড়ে অন্য কাউকে পাবার আর্তি ওঁনাকে ডোবালো। সামনে ভালমানুষ আর পিছনে শয়তান এটা সহজে কারও নজরে পড়বে না। আমাদেরও পড়েনি। এরপর শ্রেয়ার সাথে দেখা করে ও বাদলবাবুর সাথে যোগাযোগ হতে জানতে পারি একাধিক বেআইনি প্লট বিক্রি করে কিভাবে নিজেকে সফল সাংবাদিক বলে পরিচয় দেন উনি। তোমার মনে হচ্ছে আমি আসলে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছি। আসলে সবটাই একটা সুতোয় বাধা। যাইহোক এরপর অন্তরার অভিনয় আর পুলিশের নজরদারি সবটা চলতে থাকল। সুবিমলবাবু সত্যিই অন্তরার প্রতি মজে যান। এমনকি রাতে বাড়িতে ডেকে নেবার মতো ইচ্ছাও প্রকাশ করেন, যদিও তা সম্ভব হয়নি। মাঝে মাঝে গাড়িতে করে বাড়িতে ড্রপ করেও দিতে লাগলেন। আজকে দুপুরে অন্তরাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেলেও আমাদের দক্ষতার কাছে হার মানলেন সুবিমলবাবু। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সব স্বীকার করেছেন উনি। যাইহোক অন্তরা পাক্কা অভিনয় করে এত বড় ক্রিমিনালকে ধরিয়ে দিল যা আমি ভাবতেই পারিনি। বলা হয়নি উনি ভুল করেন একটা জায়গায় আর সেটা হল অন্তরাকে ক্রাইম রিপোর্ট তৈরি করতে দিয়ে। উনি আর ওঁনার দলের সাগরেদ অনির্বাণ সান্যাল দুজনেই বিরাট চক্রান্তের কান্ডারি। দশ বছর আগে ইন্সুরেন্স এজেন্ট সুন্দরলাল মৈত্র আর পাঁচ বছর আগের বসন্ত পাল দুজনের খুনের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন ওঁনারা দুজন। অজ্ঞ ছিলেন অনির্বাণবাবু। না! বলা ভাল অতিরিক্ত চালাক। মহিলাদের আন্ডার এস্টিমেট যে করতে নেই। মা কালী বা মা চন্ডী যে মহিলারাই হয়েছেন,এই ধারণা ছিল না অনির্বাণবাবুর। তাই পুরানো কাগজ এনে উনি এটা প্রমান করতে চাইছিলেন যে খুনের কিনারা হোক আর ছবি অনুযায়ী ধরা পড়ুক প্রশান্তবাবু। নিজে প্রশান্তবাবুর ছবি দেখিয়ে অন্তরাকে ক্রাইম রিপোর্ট তৈরিতে সব দৃষ্টিটা ওদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু ভুল করলেন তিনি অন্তরাকে সাধারণ মেয়ে ভেবেই। প্রশান্তবাবু ছিলেন সুন্দরলালবাবুর একজন পলিসি হোল্ডার। এমনকি ওঁনারা দুজনেও। সুতরাং এক সময় সুন্দরলালবাবুর কাছ থেকে পরস্পরের পরিচয় পান এঁনারা। যোগাযোগ হলে নিজের ব্যবসার নানা কথা শেয়ার করতে থাকেন। ফলত বন্ধুত্ব হয়ে যায়। মিলিটারি ম্যান প্রশান্তবাবু চাকরি থাকাকালীন একবার এক দুর্ঘটনায় পড়েন, আর অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে চলে যান। ফলে বিবাহ করার মতো অবকাশ পাননি। সুবিমলবাবু শর্ত রাখেন তাঁর বোন আছে যাকে বিয়ে করলে বাকি জীবন সুখে কাটবে। কিন্তু সুবিমলবাবুর তো কোনও বোনই ছিল না! তাহলে এমন শর্তের মানে কী? স্বপন নিয়োগীর মেয়েকে নিজের বোন বলে চালিয়ে সকলকে নিজের কাছাকাছি আনতে চাইলেন। বাদ সাধল বসন্ত, সে তো ভালবাসে মাধুরীকে। কিন্তু প্রশান্তবাবুর নজর পড়ল মাধুরীর উপর। স্বপন নিয়োগী নিজের মেয়ের ভবিষ্যতের থেকে অতিরিক্ত অর্থ, প্রতিপত্তি এসব নিয়ে বেশি ভাবিত ছিলেন। প্রোমোটারি রাজ কায়েম করে ধনী হবার বাসনা ওঁকে চেপে ধরল। প্রশান্তবাবু একবার একটা অন্যায় করেন, আসলে ফাঁকা বাড়িতে মাধুরীর উপর আক্রমণ করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। পরে নিজের ভুল বুঝলেও, সেই ঘটনার প্রমান নিয়ে বছরের পর বছর ব্ল্যাকমেল করতে থাকেন সুবিমলবাবু। অন্তরা ক্রমশ রহস্য সমাধানের পথে এগিয়ে গেছেন,এই বুঝেই ভয় দেখানোর পথ বেছে নিলেন ওঁনারা। এরপর প্রশান্তবাবুর মারফত অন্তরা ও তোমাদের একমাত্র মেয়ে এনাকে কিডন্যাপ করার চক্রান্ত করলেন। সেদিন মাঠে হাজির ছিলেন অনির্বাণবাবু। উনি ব্যর্থ হলেন, তাই ওঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়াই ঠিক হবে এই স্থির করলেন। এই বলে ওঁনারা প্রস্তুতি নিয়ে ফেললেন। আমি আর অন্তরা ওঁনার বাড়ি গিয়ে সবটা নজরে আনতে থাকি। কিন্তু কয়েকটা ভুল ওঁদের সব চক্রান্ত ধরিয়ে দিল। একটা ভুল প্রকাশ্যে দেখা করা আর দুই ওই ফোন নম্বর। আসলে সুবিমলবাবুর পরিচিত গুন্ডারা খুন করলেও বোধহয় কোনও কারণে মালিকের ফোন নম্বর ভুলে গিয়েছিল, তাই সেটা মনে রাখতে ফোনে না সেভ করে বরং কাগজে লিখে রেখেছিল। আগামীতে যোগাযোগ করতে গেলে কিভাবে যোগাযোগ হবে আর সেটা পুলিশের গোচরে এলে ধরা পড়ে যেত। তাই নিজেদের সিম ফেলে দিয়ে সুবিমলবাবুর দেওয়া নম্বর লিখে রেখেছিল। সমস্যা হয় অন্য জায়গায়। যে ফোনটা পাওয়া যায় তাতে ফোন করে সুবিমলবাবুর সাগরেদ অনির্বাণবাবু নির্দেশ দেন যে কাজ শেষে সিম খুলে ফোনটাও জলে ফেলে দিতে। অপরাধীরা ভুল করে সেই কাগজটা জড়িয়ে ফোনটা জলে ফেলে দিতে গিয়ে। সম্ভবত কোনও লোকজন আশেপাশে এসে পড়ায় তাড়াহুড়োয় কাগজটাও জলে ফেলতে পারেননি। সুতরাং ফোনটা পানাবনের পাশে জলে পড়লেও কাগজটা উড়ে ডাঙায় পড়ে। সেই কাগজটাই উদ্ধার করে আমাদের প্ৰিয় অন্তরা। এরপর সেই ফোন নম্বরের সূত্রে আমরা পৌঁছাই বাদলবাবুর কাছে। তখনই জানতে পারি সিমটা বাদলবাবুর নাম করে নেন সুবিমলবাবু। সুতরাং যত অপরাধ ওই ফোন নম্বর দিয়ে করা হোক না কেন,ধরা পড়বেন বাদলবাবু। শ্রেয়া সত্যটা না বললে সুবিমলবাবুর চরিত্র সম্পর্কে সবটা খোলসা হত না। এরপর বাদলবাবু ও তাঁর মেয়ে শ্রেয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা সত্যের কাছে পৌঁছে যাই। আজকে ফাঁদ পাততে ধরা পড়লেন কুখ্যাত অপরাধী ও খুনের আসামী সুবিমল আচার্য ও অনির্বাণ সান্যাল।”

ইন্সপেক্টর বসাক বললেন “আচ্ছা অনিমেষবাবু আপনি বলুন কী বিশেষ কারণে খুন হলেন ইন্সুরেন্স এজেন্ট সুন্দরলাল মৈত্র?”

অনিমেষদা বলল “ওটাও একটা ষড়যন্ত্রের অংশ বলতে পারেন। নিজে ব্যবসা করলেও ইন্সুরেন্স এজেন্ট হবার জন্য নিজের জন্য একটা পলিসি করেন। সেটা ছিল অদ্ভুত একটা স্কিম। উনি মারা গেলে, ওঁনার মৃত্যুর লাইফ ইন্সুরেন্স এর টাকা পাবেন নমিনি যাকে করেছেন। টাকার অঙ্কটা তিন কোটি টাকা। স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় উনি বিশ্বাস করে নমিনি করেন সুবিমলবাবুকে। ফলে ওঁনার স্ত্রীকে না জানিয়ে ষড়যন্ত্র রচেন সুবিমলবাবু ও অনির্বাণবাবু। রাত্রে ডেকে খুন করেন দুজনে। তারপর পুলিশ ও বড় রাজনৈতিক নেতাদের সৌজন্যে খুনটা এক্সিডেন্ট কেস বলে চালিয়ে ইন্সুরেন্স পলিসির তিন কোটি হাতিয়ে নেন। কিছু কিছু ভাগ কয়েকজনকে দেন, কিন্তু বেশিরভাগটাই পান দুজনে। ওঁনাদের যাবতীয় দহরম মহরম ওই টাকার জন্যই। সুতরাং খুন করার মোটিভ নিয়ে আশা করি বুঝতে অসুবিধা নেই আপনাদের।”

আমি বললাম “এগুলো তুমি কী করে জানলে?”

অনিমেষদা হাসতে হাসতে বলল “বছর দশেক ইন্সুরেন্স কোম্পানির দ্বারে ঘুরে আর পরে সুন্দরলালবাবুর স্ত্রীকে জেরা করেই বাকিটা জানতে পারি। এরপর তো আমাদের দুই অতিথি মিঃ সুবিমল আচার্য ও অনির্বাণ সান্যাল নিজ মুখে সবটা স্বীকার করেছেন।”

একটা কৌতূহল রয়েই গেল তাই আমি জিজ্ঞাসা করলাম “কিন্তু স্বপন নিয়োগী ও তাঁর মেয়ে মাধুরীর কী হল?”

অন্তরা বলল “আজ রাতে এর উত্তর আমরা সবাই পাব আশা করছি।”

এই হেঁয়ালির অর্থ আমার মাথায় ঢুকল না। তাও অন্তরার কথায় আমি ভরসা করলাম। বিগত কয়েকদিন আমার এমন সাহসী স্ত্রীকে সন্দেহ করে যে অন্যায় করেছি, জানি না তার প্রায়শ্চিত্ত করব কী করে! যাইহোক আপাতত রাতে কী ঘটে তা দেখতে তৈরি হলাম। ইন্সপেক্টর বসাক চলে গেলেন।

ঠিক রাত দশটা বাজতে আমি, অনিমেষদা আর অন্তরা তিনজনে জলার একটা বিশেষ জায়গায় গেলাম, যেখানে এক সপ্তাহ আগে স্বপনদার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। নিম্নচাপের ভ্রূকুটি ছিল, তবে আজ মাঝরাত থেকে তা কার্যকর হবার কথা। কেন জানি না প্রচন্ড এক বজ্রপাত পড়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। হটাৎ এই অসময়ের বৃষ্টি যেন পরিবেশটাকে বেশ রোমাঞ্চিত করে তুলেছে। বৈকাল থেকে দমকা হাওয়ার পর এই মাঝ রাতে টিপটিপ বৃষ্টি শীতের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলল। জানুয়ারি মাসের ঠান্ডা এমনিতেই বেশ কনকনে হয়, তার উপর এবছরের ঠান্ডা শুরুতে বেশি থাকলেও দুদিন হল বেশ কমে গিয়েছিল। ফলে এই নিম্নচাপের আগমন। আজ যেন দমকা হাওয়ায় মনটা কেমন ছন্নছাড়া। বৃষ্টি দেখে আমি একটা ছাতা সঙ্গে রেখেছিলাম। এরই মধ্যে মাঝে মাঝে একটা শীতল হাওয়া আর তার পাশ দিয়ে সো সো শব্দ শরীরটাকে বড্ড শিহরিত করে তুলছিল। আজ যেন এদিকটা আরও বেশি অন্ধকার লাগছে, সেটা অমাবস্যার জন্যই বোধহয়। এটাও সত্যি যে আকাশে নিম্নচাপের মেঘ ঘোরাফেরা করছে, ফলে অন্ধকারটা আরও নিকষ কালো। জলার কাছে একটা গন্ধ নাকে এল আর একটু পরেই একজনকে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম জলার সেই আধ বোজানো জায়গাটায়। পিছন করে দাঁড়িয়ে। তবে এমন অন্ধকারে যে এরকম জায়গায় কেউ থাকতে পারে ধারণা ছিল না। আমাদের ঠিক পূর্ব দিক থেকে আরও একটা ছায়ামূর্তি ক্রমশ প্রকট হতে শুরু করল। সে মানুষ না অশরীরী ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দু’হাত বাড়িয়ে কান্না ভেজা গলায় ডাকল “বসন্ত তুমি এসেছ!”

সেই পিছন ঘুরে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি এবার সামনে ঘুরে তাকাল, যার চোখ দুটো জ্বলছিল। এরপর টকটকে লাল চোখ, যা আমার খুব চেনা। এরপর সেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। পাশের মহিলাটি আবার বলল “কাঁদছ তুমি? তুমি তো প্রতিশোধ নিয়েছ! এবার নিজেকে মুক্ত কর আর এই জায়গাকে ছেড়ে চিরতরে বিলীন হয়ে যাও। আমরা আবার মিলিত হব খুব শিগগিরই।”

মেয়েটির কথায় বোধহয় জাদু আছে। সামনে দাঁড়ানো লোকটি ধোঁয়ার আস্তরণ ভেদ করে এরপর মিশে গেল। এরপর আর তার কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না। ইন্সপেক্টর বসাকের কণ্ঠে শুনলাম “মাধুরীদেবী এবার আপনি আসুন প্লিজ।”

আমাদের পাশে এতক্ষন দাঁড়িয়ে মহিলা যে মাধুরীদেবী সেটা এরপর বুঝতে পারলাম। স্ট্রিট লাইটের হালকা আলোয় সকলকে ঠিক স্পষ্ট চেনা যাচ্ছিল না। আমার কৌতূহল দূর করতে অন্তরা বলল “স্বপন নিয়োগীর একমাত্র মেয়ে মাধুরী এতদিন মারা যায়নি, সে এতদিন ছিল হাসপাতালে। নিজের বাবার অপকর্মের জন্য লুকিয়ে ছিল সে। আজকে সে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বহুদিন আগে মেন্টাল হাসপাতালে একজন পুড়ে যায়, সেই সময় নিজের হাতের একটা গহনা তাঁর হাতে পরিয়ে দিয়ে প্রমান করে যে সে মৃত। এরপর আড়ালে থেকে সবটা লক্ষ্য করত। নিজের শারীরিক ও মানসিক জোর না থাকায় অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারেনি। কিন্তু বসন্ত মারা গিয়েও শান্তি পায়নি। তাঁর অতৃপ্ত আত্মা এই গড়ফা চত্বরে ঘুরে বেড়াতে থাকে বছরের পর বছর। কোনও বেআইনি নির্মাণ সে করতে দেয়নি। যাকেই এখানে দেখেছে, তাঁকেই ভয় দেখিয়ে এলাকা ছাড়া করে। কোনও মিথ্যা কথা নয়, গল্পের মতোই অতৃপ্ত শরীর প্রতিশোধ না নিতে পেরে এই স্থান পরিত্যাগ করেনি। তুমি সেদিন রাতে বসন্তের অতৃপ্ত আত্মাকেই দেখেছিলে। বসন্ত কোনোদিনও মাধুরীকে কষ্ট দেয়নি। ওঁদের প্রথম সন্তানকে মেরে মাধুরীকে মানসিক রুগী সাজাতে একটুও বাঁধেনি স্বপনবাবুর। সুবিমলবাবুর সাহায্যে ও নেতাদের দৌলতে বসন্তকে হুমকি দেওয়া ও পরে নৃশংসভাবে মেরে জলার ওই জায়গায় পুঁতে দেন স্বপনবাবু নিজে। এলাকার লোকজনের কাছে রটিয়ে দেন বসন্ত আত্মহত্যা করেছে। কারণ হিসাবে দেখান যে মাধুরীর উপর অত্যাচার করে, শেষে ধরা পড়ার ভয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। পাশাপাশি নিজের মেয়েকে ভুল বুঝিয়ে গর্ভপাত ঘটিয়ে মেন্টাল হাসপাতালে দিয়ে আসেন। এরপর একটা দুর্ঘটনা ঘটলে নিজের মেয়ের মুখ না দেখেই শুধু হাতের কাটা দাগ ও একটা হাতের গহনা দেখে সনাক্ত করেন ওটা মাধুরী। কিন্তু ঈশ্বর যে তাঁর জন্য অন্য কিছু রেখেছেন। নিজের হাতে বসন্তকে যেভাবে খুন করেন, ঠিক একই ভাবে বসন্তের আত্মা স্বপন নিয়োগীর হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়েছে।”

অন্তরার কথা শেষ হতে আমি বললাম “এত কিছু ঘটনা ঘটে গেছে অথচ আমি অন্ধকারেই ছিলাম।”

এবার আবছা আলোয় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মাধুরীদেবী আমাদের সকলের উদ্দেশ্যে বললেন “আমার জীবনের যাবতীয় ঘটনা এই ডাইরিতে আমি লিখে রেখেছি। শেষ পাতার লেখাটা পড়ে নেবেন। যদি কিছু বাকি আছে মনে হয় তবে আপনারা বরং লিখে নেবেন।” ডাইরিটা আমার হাতে ধরিয়ে সকলকে নমস্কার জানিয়ে আস্তে আস্তে উনি আবছা আলো থেকে অন্ধকার রাস্তার দিকে এগিয়ে চললেন। ইন্সপেক্টর বসাক চিৎকার করে বললেন “দাঁড়ান মাধুরীদেবী দাঁড়ান… আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।” কথাটা যেন মাধুরীদেবী শুনতেই পেলেন না।

“তাহলে আমিও আসি কী বলেন অনিমেষবাবু?”

“ও সিওর মিঃ বসাক” বলল অনিমেষদা। আমাকে আর অন্তরাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইন্সপেক্টর বসাক হেঁটে এগিয়ে গেলেন। পুলিশের জিপ গাড়ির শব্দ ক্রমশ মিলিয়ে যেতে লাগল আর আমরাও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। হেঁটে তিনজনে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। বাড়িতে ঢুকতে ঘড়িতে এগারোটার ঘন্টা পড়ল। এনা আজ দাদুর কাছে গেছে। আমাদের কয়েকদিনের মন কষাকষি দেখে অন্তরা ওকে দিয়ে এসেছে। সামান্য কিছুসময় থেকে অনিমেষদা বলল “তাহলে উঠলাম শুভ, আসি অন্তরা।” অনিমেষদাকে আর কিছু বলার ছিল না।

অনিমেষদা বেরিয়ে যেতে আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। ডাইরিটা সঙ্গে নিয়ে নিলাম। হটাৎ মনে পড়ল একটা বিশেষ কথা। এত ঘটনার মধ্যে আর সেই কথাটা জিজ্ঞাসা করা হয়নি যে রতন আগরওয়ালকে কী বসন্তের অতৃপ্ত আত্মা মেরেছিল! ডাইরির পাতাটা উল্টে ওই নভেম্বর মাসের সময়টা খুলতে তাজ্জব হয়ে গেলাম। ওখানে লেখা আছে ‘রতন আগরওয়াল একজন ব্যবসায়ী হলেও স্বপন নিয়োগী অর্থাৎ আমার বাবার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। জমি ব্যবসার পাশাপাশি যাবতীয় প্রয়োজনে বাবাকে  সাহায্য করতেন। কিন্তু সে যে অনেক পাপ করেছে, আমি তাঁকে শাস্তি দেব। আমার শরীরটাকে ছিঁড়ে খেয়েছিল পাপী ওই রতন। সেদিন বৃষ্টির সন্ধ্যায় জলার ধারে রূপের মোহ দেখিয়ে ডেকে এনে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করে তবে আমি শান্তি পেলাম। পুলিশ ঘাড় মটকানো অবস্থায় রতনকে দেখে ভাবল এটা অশরীরী বসন্তের কাজ। আসলে ওটা করেছি আমি। আমার এই শরীরটা ভোগ করার জঘন্য কাজের শাস্তি আমি নিজে হাতে দিয়েছি।’ আমি শিউরে উঠলাম। কী মনে করে আমি শেষ পাতাটা ওল্টাতে লাগলাম আর সেখানে একটা লেখা দেখে মাথা ঘুরে গেল। ‘আমার এতদিন বেঁচে থাকার কারণ ছিল অত্যাচারী আমার বাবা স্বপন নিয়োগীর উপর প্রতিশোধ নেওয়া। নিজে হাতে রতনকে মারলেও স্বপন নিয়োগীকে মারতে পারিনি। বসন্ত সেটা করেছে। আর আমার বাঁচার কোনও কারণ নেই। গতকাল আমার এই দেহ মুক্তি পেয়েছে। পারলে জলার পূর্ব দিকে যেখানটা বসন্তের লাশ পেয়েছিল পুলিশ, সেখানে আমার দেহটাও পাবেন।’ আমার গলা শুকিয়ে গেল। তাহলে মাধুরী গতকাল মারা গেছে! একটু আগে যে কথা বলল সে কে? সবটাই কী অশরীরীদের খেলা? অন্তরা, অনিমেষদা কিংবা ইন্সপেক্টর বসাক তাঁরাও কী খবরটা জানে? ভাবনা গুলো কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। আমি চুপ হয়ে গেলাম।

রাতের খাবার কোনওরকমে খেয়ে উপরে শুতে গেলাম। অন্তরা ডিনার শেষে ওয়াশরুমে ঢুকল। আমি জানলার পাশটায় দাঁড়িয়ে জলার দিকটা তাকিয়ে রইলাম। দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টির ঝাপটা লাগতে জানলাটা বন্ধ করে দিলাম।

অন্তরা সুমধুর পারফিউম মেখে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আজ যেন অন্তরাকে আরও বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। যাইহোক আমি নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী সেটা বলবার চেষ্টা করতে যাব এমন মুহূর্তে অন্তরা আমার মুখে হাত দিয়ে বলল “নিজেকে এতটা ছোট ভাবার কিছু নেই। তোমার জায়গায় যে কেউ থাকলেই এমনটা করত। সুতরাং আজকে রাতে আর কোনও কথা নয় -“

অন্তরার কথা শেষ হতেই আমি তাঁকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার উপলব্ধি হল প্রেমের সম্পর্ক সর্বদা অনুভূতিতে বিরাজমান, সেই সম্পর্কের কোনও নাম থাক বা না থাক ভালবাসা থাকে আজীবন।

অন্ধকার রাত্রি যেন আমাদের সেই ভালবাসার রূপকথা লিখতে শুরু করল।

~সমাপ্ত~

বিষয় মৌলিকত্ব
0
ভাষা সাবলীলতা
0
কৌতূহল উদ্দীপক ঘটনা প্রবাহ
0
শক্তিশালী চরিত্র চিত্রণ
0
অডিও/ভিডিও রূপান্তর যোগ্য
0
Average
 yasr-loader

About Post Author

9F10 DA

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post Bhuter Golpo
Next post আলোর নিচে অন্ধকার | পলক ফেলা নিষেধ 2023 | সুদীপ মুখার্জী | Bengali Detective Story | 9F10