মাঘের শীতে এরকম ঝড় বৃষ্টি বড় একটা দেখা যায় না। ঝরেই চলেছে, থামার কোনো লক্ষণই নেই। আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের ঝলকানি আর বাজের কড়কড় আওয়াজ কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে। বিকেল পাঁচটাতেই নেমে এসেছে মাঝরাতের নিবিড় নিস্তব্ধতা।
পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা জলধারায় প্লাবিত বিপজ্জনক রাস্তায় হেয়ার পিন বাঁক ঘুরে ঘুরে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে একটা গাড়ি। অন্ধকারে মিশে গেছে তার কালো রঙ।
কালো হুডিতে মাথা ঢাকা চালক তার ডান হাত স্টিয়ারিং-এ রেখে বাঁ হাতে ধরে আছে চকচকে একটা রিভলবার।
বিপজ্জনক একটা কাজের ভার নিয়েছে সে। টাকা আসবে কিন্তু… জীবনের ঝুঁকি তো থেকেই যায়। অজানা একটা আশঙ্কা তার শরীরে শিরশিরে কাঁপুনি তুলছে।
স্টার্ট বন্ধ করে দিতেই অন্ধকারে মিশে, গড়িয়ে গড়িয়ে গাড়িটা গিয়ে দাঁড়ালো পাহাড়ের গায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো, আলোহীন একটা বাংলোর পেছন দিকে।
অনেক ধৈর্য ধরে, সুপরিকল্পিত পদক্ষেপে কনওয়ালজিৎ সিং আজ এসে পৌঁছেছে এখানে।
বাংলোর পেছনে বিরাট জমি, নিচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বিশাল বিশাল গাছপালা একে অপরকে জড়াজড়ি করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সেখানে। তাদের গা বেয়ে লকলক করে ওপরে উঠে গেছে রকমারি লতা। অন্ধকারে বোঝা না গেলেও, কালো হুডিতে মাথা ঢাকা অবয়বের বুঝতে অসুবিধে হলো না যে নানারকমের ফল, তরকারির গাছেই ভরে আছে সেই উপবন। রাতের আঁধারেও চকচক করছে পুকুরের জল আর তার পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে মন্দির জাতীয় এক সৌধ।
সামনের দিকেও ছিল বেশ বড় সড় এক সাজানো বাগান, রঙ বিরঙ্গি ফুলে ভরা হয়তো। সবটাই অবশ্য অনুমান, অন্ধকারে দেখা যায়নি কিছুই।
গেটের গায়ে ঝোলানো “কুকুর হইতে সাবধান” সতর্কবাণী নজরে এসেছে আগন্তুকের আর তার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ পড়েছে দরজায় ঝোলানো বড় তালাটাতে। কুকুরে আবার খুব ভয় তার।
কনওয়ালজিৎ সিং ঘাড় ঘুরিয়ে সবকিছু দেখে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। বাংলো বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে ঘন জঙ্গলের মাঝে, পাশেই ভূটান বর্ডার।
বাইরে থেকে বাড়িটাকে বেশ রহস্যময় দেখাচ্ছে। বৃষ্টির দাপট একটু কমে এলেও হাওয়া চলছে জোরদার।
ত্রস্ত পায়ে নিচু পাঁচিল পেরিয়ে বাগানে নামল সে।
গাছের ফাঁকে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ চোখে পড়তেই তার পা দুটো যেন আপনা আপনিই জমে গেল।
“কে! কে ওখানে দাঁড়িয়ে, কাকে চাইছেন আপনি?”
আওয়াজটা কানে আসার পরে পরেই প্রায় ঘাড়ের কাছে আগুনের মতো গরম একটা অনুভূতি হতেই চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল কনওয়ালজিৎ সিং।
“চোরের মতো কেন ঢুকেছেন, বাড়ির পেছন দিক দিয়ে?”
আবছায়া অবয়বের মুখ থেকে বেরনো ফ্যাঁসফ্যাঁসে শব্দগুলো যেন কনওয়ালজিতের শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে কনকনে স্রোতের মতো নেমে গেল, তার গায়ে কাঁটা দিল।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে, উত্তর দিতে ইতস্তত করল অনাহুত, সামলে নিয়ে বার দুয়েক ঢোঁক গিলে সে বলল “না, আসলে সামনের গেটে তালা দেখে…”
“সামনের গেটে তালা অর্থাৎ এটা পরিষ্কার যে বাড়িতে ঢোকা যাবে না আর সেইজন্যে একটা অজানা, অচেনা বাড়ির পেছনের পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়বেন?”
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই রাগত স্বরে বললেন সামনে দাঁড়ানো মহিলা।
“কী দরকার আপনার?”
“এই বাড়ি বিক্রির জন্যে একটা বিজ্ঞাপন ছিল খবরের কাগজে। ঠিকানা মতো ভূটান বর্ডারের এই স্বাস্থ্যকর জায়গায় ভিলেজ ট্যুরিজম শুরু করবার ইচ্ছেতে বাড়িটা দেখতে এসেছিলাম… যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
মৌনতা সম্মতির লক্ষণ মনে করে আবার মুখ খুলল আগন্তুক।
“এই নির্জন জায়গায় কি আপনি একা থাকেন? চারিদিক জঙ্গলে ঘেরা, আপনার ভয় করে না?”
“ভয়…” অদ্ভুত ভাবে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলেন মহিলা। তাঁর মুখে আলো না পড়ায়, চেহারা স্পষ্ট হচ্ছে না।
“আসুন আমার সঙ্গে।”
ঘাসে ঢাকা, নুড়ি বেছানো পায়ে চলা পথ ধরে, বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে তারা গিয়ে ঢুকল মস্ত একটা হল ঘরে। অত্যন্ত পুরনো ধাঁচে বানানো বিরাট বিল্ডিং, কেমন যেন ড্রাকুলার ছবিতে দেখা মহলের মতো। গা ছমছম করে উঠল কনওয়ালজিতের। টাকা উপার্জন করতে এসে বেঘোরে প্রাণ খোয়াবে নাকি কে জানে!
ঘরের আলো জ্বলে উঠতে মহিলাটির মুখ আলোকিত হলো।
কনওয়ালজিতের দম বন্ধ হয়ে এল। এ কাকে দেখছে সে, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন!
রঞ্জাবতী!
-তাহলে কার সন্তানকে অপহরণের দায়িত্বে তাকে পাঠাল আফরোজ শেখ, রঞ্জার সঙ্গে কী সম্পর্ক আফরোজের… এই বাচ্চাটার?
অতীতের স্মৃতি ভিড় করে এল কনওয়ালজিতের মনে। চোখের সামনে ভেসে উঠল ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু অসংলগ্ন দৃশ্য।
কলেজ, লাইব্রেরী, ক্যান্টিন।
বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া ছেলে কণিষ্ক, কীভাবে যে সে জালে জড়িয়ে ফেলে একের পর এক মেয়েকে, কলেজের অন্য ছেলেরা বুঝেই উঠতে পারে না।
কারো সঙ্গেই কিন্তু সম্পর্ক টেকে না কণিষ্ক’র কারণ এক মেয়েতে তার সন্তুষ্টি হয় না। একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক চলাকালীনই চোখ থাকে আরেকজনের ওপরে। তার এই স্বভাবের ব্যাপারে জানার পরেও আগুনের দিকে ছুটে যাওয়া পতঙ্গের মতোই মেয়েরা তার বেছানো প্রেমের জালে ধরা দিতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে।
সেই কণিষ্ক কি না আকুল হলো এক অতি সাধারণ ঘরের মেয়ের মোহে। বড়লোকের মেয়ে ছাড়া চলে না তার কারণ তারাই কণিষ্ক’র প্রেমের জালে ফেঁসে তার সব রকমের নখরা ওঠায়, যাতে কোনো মেয়ের পেছনে তাকে এক পয়সাও খরচ করতে না হয়। তার উশৃংখল স্বভাবের জন্যে কণিষ্ক তার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে অনেকদিন আগেই।
বিরাট বড় ইম্পালা গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসছে একটি মেয়ে, অত্যাধুনিক তার সাজগোজ। কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে কণিষ্ক। মেয়েটি গেট পার হয়ে যাওয়ার পরে বোঝা গেল কণিষ্ক’র নজর রয়েছে সেই গাড়ির পেছনে রিক্সায় বসা এক সালোয়ার কামিজ পরা, বেনী বাঁধা শ্যামলা মেয়ের দিকে।
মেয়েটির চোখ পড়ল গুলতানিরত চ্যাংড়া ছেলের দলের ওপরে।
ক্যান্টিনের সামনের বিরাট বটগাছের নিচে বাঁধানো বেদীর ওপরেই জমেছে আড্ডা। কাপের পর কাপ চা আর প্লেটের পরে প্লেট পকোড়া উড়ে যাচ্ছে। ক্যান্টিনের মাধবদা এসে কড়াচোখে চেয়ে ধমক দিয়ে বলল
“আগের পাওনা টাকা গুলো কে মেটাবে শুনি?”
শুকনো মুখে ছেলেমেয়ে গুলো ইতিউতি চাইছে দেখে দেবদূতের মতো এসে দাঁড়াল কণিষ্ক। পকেটে রাখা মানি ব্যাগ থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করে মাধবদা’র দিকে বাড়িয়ে ধরল সে।
উপেক্ষার দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে সেই মেয়েটা এগিয়ে গিয়ে মিলে গেল কলেজ পোর্টিকোয় জমা হওয়া নবীন ছাত্র ছাত্রীদের দলে।
উদাস মুখে বন্ধুদের ছেড়ে, কলেজ থেকে বেরিয়ে গেল কণিষ্ক।
হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে বছর সতেরোর মেয়েটা হাতে একটা বড় ট্রলি ব্যাগ নিয়ে খুঁজে খুঁজে এসে দাঁড়িয়েছিল সরু গলির ভেতরে গায়ে গায়ে লাগানো কতগুলো জরাজীর্ণ বাড়ির সামনে। বাবা সঙ্গে আসতে পারেননি, রঞ্জা চায়ওনি। এখন থেকে নিজের জীবনটাকে একা একাই চালিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করবে সে। খুব ছোটবেলায় একবারই বোধহয় মেয়েটা এই বাড়িতে এসেছিল মায়ের হাত ধরে, বিশেষ কিছুই মনে নেই। এবারের আসাটা অন্যরকম, সে এসেছে প্রার্থি হয়ে। বুক ভর্তি অস্পষ্ট উচ্চাশা, চোখে নতুন স্বপ্ন। ডাক্তার হতে চায় রঞ্জা। তার জন্মস্থান প্রিয় চন্দনেশ্বরের পাট চুকিয়ে, বাড়ির আরাম ছেড়ে বাগবাজারের এই এঁদো গলির মামার বাড়িতে থাকতে এসেছে রঞ্জাবতী মিত্র। নাতনির স্বপ্নের কথা জানতে পেরে, স্বর্গগতা মেয়ে মধুমতীর একমাত্র সন্তান রঞ্জাবতীকে তার দাদু অনিমেষ বসু ডেকে পাঠিয়েছেন।
ওপরের দিকে তাকিয়ে রঞ্জা দেখল দোতলার বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তার বড়মামা। পাশেই দাঁড়িয়ে ভালোদি, উমা। বড়মাসির মেয়ে, এই বাড়ির আর একজন আশ্রিত। তাকে চিনতে পেরে দিদি হাসল। অজানা আশঙ্কায় একটু যেন কেঁপে উঠল রঞ্জার বুক। কোথায় তাদের চন্দনেশ্বরের সেই খোলা মেলা পরিবেশ আর কোথায় অন্ধগলির এই পলেস্তারা খসে পড়া, ইটের দাঁত বার করে অট্টহাসি হাসা অট্টালিকা। পাশাপাশি দাঁড়ানো গায়ে গায়ে লাগা বাড়িগুলোর মধ্যে কোনো ফাঁক নেই। একতলাটা দিনের বেলাতেও ঘন অন্ধকারে ঢাকা। অনেক আশা নিয়ে সে কলকাতায় এসেছে। জীবনে বড় হতে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।
চাকর এসে দরজা খুলে দিল। তার পেছনে পেছনে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল রঞ্জা। বারান্দার ভেতর দিকে দেওয়াল ঘেঁসে চারখানা চেয়ার আর একটা টেবিল পাতা, সেখানে বসে আছেন বড় মামি, সামনে চায়ের সরঞ্জাম। বড় মামা এসে দাঁড়ালেন। রঞ্জা একটু হাসল তাঁদের দেখে, সে হাসির কোনো প্রত্যুত্তর পাওয়া গেল না। চোখে মুখে কোনো আহ্বান নেই। পায়ের জুতো খুলে, এগিয়ে গিয়ে সে মামা মামিকে প্রণাম করলো।
মামি বললেন “থাক থাক।”
মামা বললেন “আমার চিঠি পাওনি নাকি?”
“না তো, কী ব্যাপারে?”
“জামাইকে লিখেছিলাম, তোকে পাঠাতে বারণ ক’রে। কলকাতায় যখন তখন দাঙ্গা বাধছে, দিন দিন থাকার অযোগ্য হয়ে উঠছে এই শহর।”
“দাদু আসতে বলেছিলেন।” কুন্ঠিত ভাবে বলল রঞ্জাবতী। তার শ্যামল মুখ লাল হয়ে উঠল লজ্জায়, অপমানে।
“ওঁর আর কী যায় আসে, বললেই হলো!” বেশ ক্ষুব্ধ ভাবেই মুখ খুললেন মামি।
“ঝক্কি-ঝামেলা তো সব পোহাতে হয় আমাকে।”
রঞ্জার সমস্ত অস্তিত্বই কেমন যেন তেঁতো হয়ে গেল কিন্তু কী করবে, কী বলবে কিছুই ভেবে পেল না। অভ্যর্থনার বহর দেখে রঞ্জার একবার মনে হলো, যেমন এসেছে তেমনই আবার ধুলো পায়ে বিদায় নেয়, কী দরকার কলকাতায় থেকে পড়ার? বাবারও তো একেবারেই ইচ্ছে ছিল না তাকে কলকাতায় পাঠানোর। তাঁর মতের বিরুদ্ধাচারণ করে, জোর করেই সে এসেছে। নিজের অজ্ঞাতসারে কখন যে তার মধ্যে একটা প্রবল আত্মসম্মান বোধ তৈরি হয়েছে তবে পরমুহূর্তেই তার মনে হলো এটা তো দাদুর বাড়ি, এ’বাড়ির খরচপত্র সবই চলে তাঁর আর্থিক আনুকুল্যে। বড়মামা, ছোটমামা, বড় মাসির স্বর্গবাসের পরে তাঁর তিন সন্তান ভালোদি, দাদাভাই আর ফুলদা এঁরা সকলেই তো দাদুর আশ্রিত, রঞ্জার সঙ্গে তাদের তফাৎ নেই তা অবশ্য বলা যায় না কারণ রঞ্জার বাবা ধনী মানুষ, দাদুর ডাকে এলেও নিখরচায় থাকতে আসেনি সে কিন্তু আশ্রিত তো বটেই আর… একজন আশ্রিতের ক্ষমতা নেই আর একজন শরণাগতকে তাড়িয়ে দেওয়ার। এখানেই থাকবে সে, যতই অবজ্ঞা আর অবহেলা এঁরা করুন না কেন, সহ্য করে নেবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের আলাদা ব্যবস্থা করে নেওয়ার চেষ্টা করবে রঞ্জাবতী ।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে, দাদু ছাড়া আর কারুর তাকে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলার অধিকার নেই। তার তো নিজস্ব আশ্রয় আছে, আছে ফিরে যাওয়ার জায়গা। মামাদের তো নেই কোনো উপার্জন ক্ষমতা, না অন্য কোনো বসবাসের সংস্থান।
ক্লান্তি বোধ করছিল রঞ্জা, স্নান করতে হবে। এখানে কেউ নেই যে একটু স্নেহের পরশ দিয়ে কাছে টেনে নেবে মা’হারা মেয়েটাকে। থাকার কথাও না, এ এক অন্য জগৎ। এতজনের মধ্যে দাঁড়িয়েও বড় একা লাগল রঞ্জার। চোখের সামনে ভেসে উঠল চন্দনেশ্বরের রাস্তাঘাট, বন্ধুবান্ধব নিয়ে তার সেই ছেড়ে আসা ভালবাসার স্থান। জানলা দিয়ে নজরে আসা সমুদ্রের তটরেখা, সারারাত ধরে কানে আসা তার অবিরাম গর্জন। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সে।
সময় নষ্ট করেনি রঞ্জা। কলকাতায় এসেই চটপট কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে ফিজিওলজি পড়তে, ডাক্তারিতে সুযোগ হয়নি তার। আনুষঙ্গিক খরচ খরচার জন্যে একটা টিউশন’ও জুটিয়ে নিয়েছে। বাবা পড়ার খরচ পাঠালেও তাঁর ওপরে পুরোপুরি ভাবে নির্ভর করতে ইচ্ছে করছিল না রঞ্জার। মাসতুতো দাদাও বই টই দিয়ে সাহায্য করছে।
দাদাভাই পড়াশোনায় খুব ভালো, সে ডাক্তারি পড়ে। ফুলদা সাইন্টিস্ট হতে চায়, কেমিস্ট্রী পড়ছে। ভালো’দির পড়াশোনা কবেই বন্ধ হয়ে গেছে, মামির ফাই ফরমাস খাটতেই তার দিন যায়। ছোট বোনের খেয়াল রাখে ভালো’দি, মামিকে লুকিয়ে এটা সেটা, ভালো মন্দ প্রায়ই রঞ্জার হাতে তুলে দেয়। নিতে ইচ্ছে না হলেও দিদির মনে দুঃখ দিতে পারে না রঞ্জা।
রঞ্জাবতীর অপেক্ষায় কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে আছে কণিষ্ক। এই প্রথম তার বুক ধড়ফড় করছে, নাকের পাটা ফুলে উঠছে গরম নিশ্বাসে। কপালে ঘামের বিন্দু দেখা দিয়েছে। এরই নাম কি তবে প্রেম?
ছেঁড়া ফাটা, তালি মারা জিন্স ছেড়ে আজ সে পাটভাঙা পায়জামা পাঞ্জাবি পরে এসেছে। সকলেই ঘুরে ঘুরে দেখছে তার দিকে। এই প্রথমবার লজ্জাবোধ ঘিরে ধরেছে তাকে।
এতদিন ধরে মেয়েরাই এগিয়ে এসেছে প্রেমের প্রস্তাব দিতে, এবারে কণিষ্ক প্রোপোজ করতে চায় রঞ্জাকে। তার বশংবদেরা অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝবার চেষ্টা করে, এতদিন ধরে মেয়েদের খেলিয়ে বেড়ানো এই রোমিও ছোকরা কী দেখল এই সাধারণ মেয়েটার মধ্যে!
রঞ্জাকে কলেজের দিকে আসতে দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল কণিষ্ক। বুকের মধ্যে ধড়ফড় করছে এই প্রথম, কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে। একেই কি ভালবাসা বলে, তাহলে কি কণিষ্ক’র জীবনে প্রেম এল?
“ফার্স্ট ইয়ার ফিজিওলজি?”
থমকাল মেয়েটা।
“হ্যাঁ, আপনি?”
“আমি অ্যান্থ্রোপলজি ফাইনাল।”
হাত মেলাবার জন্যে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল কণিষ্ক। বুকের কাছে হাত জোড়া জড় করে নমস্কার জানাতে ঘাড় ঝোঁকালো রঞ্জা। কণিষ্ককে সম্পূর্ণ ভাবে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেল নিজের সহপাঠীদের জটলার দিকে।
কলেজে যোগ দেওয়ার পরে রঞ্জাবতীর ডাকাবুকো স্বভাব ব্যবহারের পরিচয় প্রায় প্রত্যহই পাচ্ছে তার আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা মানুষেরা।
মনে মনে হাসল রঞ্জাবতী, এই ভেবলুরামটাকে একটু খেলালে মন্দ হয় না।
পুরনো স্মৃতিভারে বিধ্বস্ত দেখায় কণিষ্ককে।
প্রথম পরিচয়ের পরে প্রায় প্রায়ই তাদের দেখা হতে থাকে কলেজ গেটে, বাসস্টপে, রাস্তায় যাওয়া আসার সময়ে। মেয়েটা কী নির্বিকার ভাবে এড়িয়ে যেতে থাকে কণিষ্ককে।
বর্ষা যেতে অনেক দেরি করলেও নীল আকাশে ভেসে চলা মেঘের ভেলা দেখা দিল আর ঝলমলে রোদ’ও উঠল। শিউলির গন্ধ আর কাশের দুলুনি খবর নিয়ে এল মায়ের আগমনের।
মজা হয়েছিল অষ্টমী পুজোর পুষ্পাঞ্জলির সময়ে।
জোরদার মাঞ্জা মেরে কণিষ্ক গিয়েছিল তার মামাবাড়ির পাড়ায়, অঞ্জলি দিতে। প্রতিবারেই যায় সে, দিদা আর মামার সঙ্গে দেখা করতে।
খিলখিল হাসির শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে চোখ পড়ল রঞ্জাবতীর দিকে, চোখাচোখিও হয়ে গেল সেই মুহূর্তেই।
চুলগুলো সেদিন আর বেনীতে বদ্ধ ছিল না সেদিন, পিঠ ঢেকে কোমর পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল। পরনে লাল পাড়ের ঢাকাই জামদানির সঙ্গে কপালে বড় সিঁদুরের ফোঁটা তার রূপকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিল।
অঞ্জলি মন্ত্রের ফাঁকে ফাঁকে চলছিল ফিসফাস, খিলখিল আর ইতি উতি চোরা চাহনি। কথা কানে না এলেও কণিষ্ক বুঝতে পারছিল তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে। কী বলছে মেয়েটা -কণিষ্ক ওর পেছন পেছন ঘুরছে আর রঞ্জা তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না?
এ কী ধরনের চরিত্র বদল, কোন পথে হাঁটছে কণিষ্ক?
প্যান্ডালের বাইরে বেরোতে দেখা দিল সেই চুলবুলি।
“কী, ব্যাপার কী? আমরা কি একদমই অচেনা যে কথা না বলেই চলে যাচ্ছ?”
মুখে কিছু বলল না কণিষ্ক, তার মুখে কথাই যোগায় না এই সুন্দরীর মুখোমুখি হলে।
“শুনলাম তোমার অনেক গার্লফ্রেন্ড, তা আমাকেও কি সেই তালিকাভুক্ত করার ইচ্ছে? খবরদার! ভুলেও সেই চেষ্টা কোরো না।”
“কো-এড কলেজে পড়ি। ছেলে মেয়ে দু’রকম বন্ধুই আছে। মেয়ে বন্ধুরা যদি গার্লফ্রেন্ড হয় তাহলে আছে।”
নিজেকে বশে এনে হাসিমুখে বলল কণিষ্ক।
“তুমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছ আমি কী বলতে চাইছি। তুমি তো প্রতিষ্ঠিত রোড সাইড রোমিও।” চোখ ছোট করল রঞ্জাবতী।
“যাকগে, তোমার বাড়ি কি এখানে?”
“না, এখানে আমার মামার বাড়ি।”
“হায়! মার দিয়া কেল্লা। হোয়াট আ কোয়েন্সিডেন্স। আমারও মামাবাড়ি এখানে, আমি কলকাতার বাইরে থেকে এসেছি তবে মামাবাড়িতে আর বেশিদিন থাকব না আমি, হোস্টেল বা পিজি অ্যাকোমোডেশন পেলেই চলে যাব। আচ্ছা তোমার ফোন নম্বরটা দাও, আমি কল করব।”
কলকল করে উঠল রঞ্জা, যাকে আপাত দৃষ্টিতে শান্ত বলেই মনে হয়েছিল।
এ তো মেঘ না চাইতেই জল! আনন্দিত হলো কণিষ্ক।
“আগামী কাল দেখা হতে পারে? এই প্যান্ডালের পেছনেই একটা জলের কল আছে, ওখানে থাকব সকাল এগারোটায়।” হুশ করে যেন হাওয়ায় মিশে গেল রঞ্জা।
নবমী পুজোর পরে, এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটা অবধি দাঁড়িয়েও রঞ্জার কোনো হদিস পেল না কণিষ্ক। তার পরিচিত কোনো মেয়ে কোনদিনই তাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখেনি, এই ধরনের অবজ্ঞা সহ্য করার অভ্যেসই নেই তার। এই পাড়ায় সকলেই তার পরিচিত, নানারকম প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে উঠল কণিষ্ক।
এগারোটা চল্লিশ নাগাদ দূরে একটি মেয়ের অবয়ব দেখা দিল। রঞ্জা এসে পৌঁছল কিন্তু তার কাছে না এসে এগিয়ে গেল মেন রোডের দিকে। একটু দূরত্ব রেখে ধীর পায়ে তার পিছু নিল কণিষ্ক।
বাস আসতেই উঠে পড়ল রঞ্জা, অনুসরণ করল কণিষ্ক। বাসেও না চেনার ভান করে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বসে রইল মেয়েটা। গাঢ় নীল রঙের সালোয়ার কামিজে কী সুন্দর যে লাগছে তাকে। কণিষ্কের নজর তার থেকে সরছিল না।
কয়েকটা স্টপ পেরতেই নেমে পড়ল রঞ্জা, অন্য দরজা দিয়ে নামল কণিষ্কও।
গ্রাম্য পরিবেশ, টলটলে পুকুরে পদ্ম ভাসছে। একদিকটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে বসে কণিষ্কের চোখে চোখ মিলিয়ে তাকিয়ে রইল রঞ্জা। কণিষ্কের দৃষ্টি নত হলো কিন্তু রঞ্জার নজরে অনুমতি দেখে তার সঙ্গে একটু দূরত্ব রাখলেও একই সিঁড়ির ওপরে বসল কণিষ্ক।
“তোমার সম্বন্ধে অনেক বাজে কথা কানে এলেও তোমার প্রতি আমি কেমন যেন একটা টান অনুভব করছি।”
এ কী শুনছে কণিষ্ক, এর আগে অনেক মেয়েই তাকে প্রেম নিবেদন করেছে কিন্তু যে মেয়েটিকে তার ভালো লেগেছে, যে এতদিন তাকে এড়িয়ে চলেছে অবশেষে সে কি ধরা দিল?
নিজের সত্ত্বা ফিরে পেয়ে, আর অপরপক্ষের প্রশ্রয় পাওয়াতে একটু ঘন হয়ে বসে রঞ্জার একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল কণিষ্ক। গ্রামের পুজো মণ্ডপ থেকে ভেসে আসছে শাঁখ ঘন্টা উলুর আওয়াজ।
এই ঘটনার পরেই খোলামেলা ভাবেই শুরু হয়ে গেল তাদের মেলামেশা, ঘোরাফেরা। আর কিছুই লুকনো থাকল না।
শীত পড়তে শুরু করেছে। রঞ্জা এখন তার এক সঙ্গীকে নিয়ে একটা এক ঘরের ফ্ল্যাটে থাকে। জবাবদিহির কোনো ব্যাপার নেই, নেই বাড়ি থেকে বেরনো বা ফেরার কোনরকমের তাড়া।
শহর থেকে একটু দূরে, একটা প্রাচীন মন্দিরের খোঁজ পেয়ে দেখতে উৎসাহিত হলো রঞ্জা আর কণিষ্ক। বেরতে না বেরতেই দুপুরের আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেল।
‘যদি বরষে অঘ্রাণে
হালের গরু বেচে চাষা
গায়ের কাপড় কেনে’
রঞ্জার ‘খনার বচনের আবৃত্তিতে হেসে উঠল দুজনেই।
বৃষ্টি নামার আগেই তারা পৌঁছে গেল মন্দিরের কাছে। সুন্দর টেরাকোটার কাজ দেখতে দেখতে সময় অথবা বাইরে ঘনিয়ে আসা দুর্যোগের ব্যাপারে কোনরকম খেয়ালই থাকল না তাদের।
কিছুক্ষণ পরে বাইরে বেরিয়ে হতচকিত হয়ে গেল দুই বন্ধু। বিকেলেই নেমে এসেছে কালো রাতের আঁধার।
ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাপটে পড়ল প্রচণ্ড ঝড়। নেমে এল অঝোর ধারায় বৃষ্টি, ভিজিয়ে দিল দুটো শরীরকেই।
কাছাকাছি হয়ে দু’জনে একে অপরের দেহের উত্তাপ নিতে নিতেই আবার ঢুকে পড়ল মন্দিরের ভেতরে।
তাদের শরীরে জেগে উঠল এক অদ্ভুত শিহরণ। রঞ্জার চোখে চোখ রেখে তাকে কাছে টেনে নিল কণিষ্ক। কোনরকম আপত্তি না জানিয়ে তার বুকে নিজেকে সমর্পণ করে দিল হঠাৎ করে শান্ত হয়ে যাওয়া দুষ্টু মেয়েটা।
মুখ উঁচু করে কণিষ্ক’র চোখে চোখ রাখল সে, রঞ্জার চোখে আহ্বান দেখে তার মুখটা দুহাতে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে, আকণ্ঠ অমৃত সুধা পান করল কণিষ্ক।
আদিম শরীরি খেলার আনন্দে মেতে উঠল দুটি তরুণের কামোন্মত্ত দেহ। উদ্দাম-অপ্রতিরোদ্ধ উত্তেজনাতে একাত্ম হয়ে ভেসে গেল তারা অজানার উদ্দেশ্যে। সেই কাঁচা বয়সে তারা বুঝে উঠতে পারেনি জীবনের অঙ্ক কিন্তু এতটা সহজ নয়, এইরকম একটানা আনন্দে কাটে না সারা জীবন।
“আপনি আপনার মেয়ের খবরাখবর কিছুই রাখেন না বলেই মনে হয় প্রমথেশ বাবু। কলকাতায় পড়তে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছেন?”
“কেন কী হয়েছে, আমি আমার মেয়েকে চিনি। ও পড়াশোনা করতে গেছে, তাইই করছে।”
“এক বদ ছেলের পাল্লায় পড়েছে রঞ্জাবতী। আমি তাদের অনুসরণ করে অনেক কথা জানতে পেরেছি।”
“কিন্তু মৃন্ময় বাবু, আপনার এত আগ্রহ কেন আমার মেয়ের খোঁজ খবর করাতে? আমি ওর বাবা, আমি বুঝে নেব।”
-আপনি আর কী বুঝবেন প্রথমেশ বাবু? রঞ্জার সেই ছোটবেলা থেকেই ওকে আমি পছন্দ করি, নিজের করে পেতে চাই। অনেকবার তার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেলেও কাজে লাগাতে পারিনি, এমন বদখদ মেয়েটা। একবার তো কিডন্যাপ করার চেষ্টাও করেছি, সফল হতে পারিনি, আমার হাত মুচড়ে দিয়ে পালিয়েছিল। আমি ভুলিনি সেই কথা, কখনো ভুলবো না। বদলা নিতে শুরু করে দিয়েছি অনেকদিন আগে থেকেই। ওকে বেহুঁশ করার ওষুধ খাইয়ে, মুখোশ পরে ওর বাথরুমের সিঁড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকে ওর সুন্দর শরীরটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আনন্দ নিয়েছি আমি। আজ চরম সময় উপস্থিত, যাকে আমি পুরো করে পাইনি আর কাউকেই পেতে দেব না। এই সুবর্ণ সুযোগ কি ছাড়া যায়? মনে মনে এত কথা ভাবলেও মৃন্ময় মুখে বলল “দেখে তো মনে হয় দু’জনে দু’জনের প্রেমে পাগল। আমি জানতে পেরেছি রঞ্জা গর্ভবতী। ছেলেটার কিন্তু কোনরকম সঙ্গতি নেই ওর ভরণপোষণের। কানাঘুষোয় যা শুনলাম শিগগিরই কলকাতা শহর ছেড়ে পালাবার ছক কষছে ওরা।”
প্রমথেশের মাথায় আগে থেকেই আগুন জ্বলছিল রঞ্জার কলকাতায় একা থেকে পড়াশোনা করার ব্যাপারে, মৃন্ময়ের কথাগুলো সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিল। তিনি আগুপিছু চিন্তা না করেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, কলকাতার উদ্দেশ্যে।
রঞ্জার মামার বাড়িতে পৌঁছে তিনি জানতে পারলেন সে আর সেখানে থাকে না, কোন্ সহপাঠীর সঙ্গে নাকি বাড়ি ভাড়া করে থাকে।
প্রমথেশ মনে মনে নিশ্চিত হলেন যে ওই ছেলেটার সঙ্গেই থাকে তাঁর আদরের দুলালী। ঠিকানা জোগাড় করে, খুঁজে খুঁজে সেই ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছলেন রঞ্জার বাবা।
“রঞ্জা!” উঁচু আওয়াজের হুঙ্কারে মুখ তুলল রঞ্জা। বাবাকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে উঠে বসল খাটের ওপরে।
মাটিতে পা দিয়ে বাবার রাগী মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল “বাবা! বাড়ির সব খবর ভালো তো? সরিতা পিসি ঠিক আছে? তুমি এই বাড়ির ঠিকানা পেলে কোথায়?”
“সে তো আমার জিজ্ঞাস্য। মামার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছ একা একা উশৃঙ্খল জীবন যাপন করার জন্যে। আমাকে জানাবার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করনি! এই বাড়ির ভাড়া যোগাচ্ছে কে, ওই স্কাউন্ড্রেলটা, কোথায় সে?”
“আমি জানি না, তুমি কার কাছে এই সব অদ্ভুত খবর পেয়ে এখানে এসেছ! আমি কোনো উশৃঙ্খল জীবন যাপন করছি না, করার ইচ্ছেও নেই। এখানে আমি আমার সহপাঠীর সঙ্গে থাকি। আমরা দু’জনেই টিউশন করে আমাদের অতিরিক্ত খরচ মেটাতে চেষ্টা করি। মামার বাড়িতে বিশেষ জায়গা ছিল না, তাছাড়া যাঁকে দিয়ে তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক সেই মা’ই যখন নেই, তাঁরা আমাকে পালবেনই বা কেন?”
“এক্ষুনি আমার সঙ্গে চল। এখানে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে উঠেছি আমি, তুমিও থাকবে ওখানে। ইউনিভার্সিটি থেকে মাইগ্রেশান সার্টিফিকেট নিতে, সবরকম ফর্ম্যালিটিজ মেটাতে যতটা সময় লাগবে, সব সেরে আমরা ফিরে যাব চন্দনেশ্বরে। ওখানেই পড়বে যে বিষয় পাবে, না পড়তে চাইলে পড়তে হবে না। তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করব আমি।”
“আমি চাইলেই তোমার বিরুদ্ধাচারণ করতে পারি বাবা, নিজের ব্যবস্থা আমি নিজেই করেও নিতে পারি। আমি কিন্তু সাবালিকা তবে আমি লোক হাসাতে চাই না। আমি যাব তোমার সঙ্গে কিন্তু বিয়ে করার জন্যে তুমি জোর করতে পারবে না আমাকে, বিয়ে আমি শুধু একজনকেই করতে পারব।”
“আমি শুনেছি সব, ওই বাস্টার্ডটার নাম আমার সামনে করবে না, আমি কোনদিনও ওকে মেনে নেব না। জেদ করলে হাতে হাতে তার ফল পাবে, ওই আপদটাকে এই দুনিয়া থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দেব আমি। তুমি জান, আমার সেই ক্ষমতা আছে।”
প্রতিবাদের ঝড় তার মনটাকে দুমড়ে মুচড়ে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেও দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাগ, বাক্স গুছিয়ে নিতে থাকল রঞ্জা, তার চোখ ভরে উঠল জলে।
হঠাৎ করেই অদর্শনের পালা শুরু হলো। রঞ্জাকে আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না, কলেজেও তাকে দেখতে পেল না কণিষ্ক। তার মামাবাড়ির কাছে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে সে, ঘুরে বেড়ায় তাদের ভাড়া বাড়ির আশেপাশেও। রঞ্জার দেখা মেলে না, পাওয়া যায় না কোনো খবর। মেয়েটা যেন হঠাৎ করে উবে গেছে।
কলেজের সামনের বাস স্ট্যান্ডে একদিন হঠাৎ করেই কণিষ্ক’র দেখা হয়ে গেল রঞ্জার সঙ্গে। উতল হয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে চাইল কণিষ্ক কিন্তু রঞ্জার দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে দূরে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করতে থাকল সে। এক সুপুরুষ ব্যক্তির সঙ্গে ট্যাক্সি করে চলে গেল তার পাঁজরের হাড়, তার ভালবাসার ধন রঞ্জাবতী।
আর কখনো দেখা হয়নি তাদের।
সবার অলক্ষ্যেই সুন্দর একটা সম্পর্ক মাথা তুলে দাঁড়াবার আগেই ডুবে গেল অগাধ সমুদ্রে। বছরখানেক ধরে ঝড় বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ডালপালার আশ্রয়ে যে নীড়টাকে রক্ষা করে আসছিল বিশাল এক মহীরুহ, আদরে যত্নে ভালবাসায় আগলে রাখার উদ্দেশ্যে বদ্ধপরিকর ছিল, হঠাৎ করেই কোন্ এক অ-কালবোশেখীর ঘূর্ণি ঝড় এসে চুরমার করে দিয়ে গেল সেই মহীরুহকেই। আশ্রয়চ্যুত হলো ডাল-পাতা সমেত সেই নীড়। থেমে গেল পাখির কূজন।
বড়লোক বাপের বখে যাওয়া ছেলেটার শোধরাতে থাকা জীবনটাকে খান খান করে দিয়ে কোথায় চলে গেল তার প্রাণ ভোমরা। অবসাদ গ্রাস করে নিল কণিষ্ককে। ধীরে ধীরে চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে থাকল সে।
আফরোজ শেখ! জীবনের এই কঠিন সময়ে কণিষ্ক’র হাত ধরেছিল এ এস।
আফরোজ শেখের দলে ভিড়ে বম্বে, দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব করে বেড়ানো কণিষ্ক বদলে গেল কনওয়ালজিৎ সিং-এ, তার ঠিকানা আজ অপরাধ জগৎ। মেয়েদের প্রতি প্রবল ঘৃণা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছে নারী পাচার চক্রের সঙ্গে। অপহরণ, মাদক কারবার, অস্ত্র ব্যবসা, খুন-জখম-রাহাজানি… কোনো কিছুই বাদ রাখেনি সে। পুলিশের জালে কখনো ধরা পড়েনি কনওয়ালজিৎ, তার নাম জানা থাকলেও চেহারা চাক্ষুষ করেনি কেউই। ছদ্মবেশ ধারণে বিশেষ রকমের পারদর্শিতা রয়েছে তার।
“সিং, হিয়ার ইজ ইওর নেক্সট টার্গেট।” একটা ছবি এগিয়ে দিয়ে বলল আফরোজ।
ছবিটা দেখল কনওয়ালজিৎ।
“বাট সী… বী ভেরী কেয়ারফুল।”
“কী ব্যাপারে, এ এস?” কৌতুহলী হলো কনওয়ালজিৎ।
দলের খবর সব বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে, কেউ তো বিশ্বাসঘাতকতা করছে। আমি বুঝতে পারছি না কাকে রাখি আর কাকে ফেলি!”
“ডান, এ এস! আমার ওপরে যে দুটো কাজের ভার দিয়েছ তা পুরো করে তবেই মুখ দেখাব।”
সকালে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে শারীরিক কসরতের মাধ্যমে নিজের যত্ন নেওয়া কনওয়ালজিতের দিনচর্যার এক অপরিহার্য অঙ্গ। তার লম্বা, ইস্পাতের মতো টান টান পেটানো চেহারাতে আকর্ষিত হয় না এমন মানুষ কমই আছে শহরে। মেয়ে মহলের হার্ট থ্রব সে তো সেই কলেজে পড়ার দিন থেকেই।
মেয়েদের প্রতি বিশেষ ধরনের আকর্ষণ বোধ করলেও আগে তাদের নিয়ে খেলতেই ভালবাসত সে। তার জীবন পুরোপুরি ভাবে বদলে দিয়েছিল রঞ্জাবতী। রঞ্জা তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে মেয়েদের নিয়ে এক বিধ্বংসী লীলাতে মেতে উঠল কনওয়ালজিৎ সিং। তার হৃদয়ের কোনো এক কোণে লুকিয়ে থাকা কোমল বৃত্তির এক কণাও আর অবশিষ্ট রইল না। থাকতেই দেয়নি রঞ্জা, সমূলে উৎপাটিত করে ফেলে দিয়েছিল। আজ কে এস’এর বুদ্ধিদীপ্ত চোখের ভাষা, ঠোঁটের কোণের হাসির অর্থ পড়ে উঠতে অপারগ আপামর জনসাধারণ।
সমাজে তার পরিচয় প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি হিসেবে। আমদানি রপ্তানির জমজমাট ব্যবসা তার।
কল বেলের শব্দে সিকিউরিটি ক্যামেরায় চোখ রাখল কে সিং।
দরজা খুলে দিয়ে বলল “কী খবর?”
সিং-সাহেবের চোখে অনুমতি দেখে ড্রয়িং রুমে পা রাখল ড্যানি। সোফার ওপরে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে হাঁক ছাড়ল ” ললি মাসিইইই, কফি! জলও আনবে।”
“কফি পরে খাবি, কাজের কথায় আয়।”
বিরক্ত স্বরে বলল কে সিং।
“রায়না খাসনবিশের নামটাই বার বার উঠে আসছে। আর একটু খোঁজ খবর করতে হবে, অগর ঠিক নিকলা তো জান সে হাথ ধো বৈঠেগী ওহ কমিনী।”
ভুরু কুঁচকে খানিক্ষণ ভেবে কনওয়ালজিৎ বলল “আমি চিনি বলে তো মনে হচ্ছে না, নামও শুনিনি ফোটো হ্যায়?”
“মিল জায়েগী।”
“হড়বড়ি করবি না। ধর আগে, পেট থেকে সব কথা বার করে নিতে হবে।”
ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে গরম কফিতে চুমুক দিল ড্যানি।
কে সিং-এর বুকে লেপটে শুয়ে ছিল মদালসা। তার রেশমের মতো কোমল, সুগন্ধী চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল কনওয়ালজিৎ। সিং-এর লোমশ বুকে মুখ রেখে লিসা বলে যাচ্ছিল ইন্সপেক্টর সংকেতকে হাত করার কাহিনী। কীভাবে তাকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ধীরে ধীরে কিছু তথ্য যোগাড় করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে সে। জানতে পেরেছে রায়নাই তাদের দলের খবরাখবর যোগায় পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে। কত কৌশলে সংকেত ঘোড়পাড়ের কাছ থেকে সে হাতিয়ে নিতে পেরেছে প্রয়োজনীয় তথ্য সমৃদ্ধ ফ্ল্যাশ ড্রাইভ। প্রশংসা বাক্য শোনার আশাতে মুখ তুলে কে এস’এর দিকে তাকিয়ে রইল লিসা।
পরিতৃপ্ত কনওয়ালজিৎ লিসার আকর্ষণীয় দেহটা নিজের শরীরের ওপর থেকে সন্তর্পনে নামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। নেক্সট প্ল্যান অফ অ্যাকশন ছকা হয়ে গিয়েছে। কোনো সাক্ষী রাখা যে দস্তুর নয় তাদের এই এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট বিজনেসে।
প্রায় মাঝরাতে বাড়ি ফিরল মদালসা সঙ্গে এসেছে রায়না। তালা খুলে ঘরে ঢুকতেই কেমন যেন অন্যরকম ফীলিং হলো। ঘরের ভেতরের আবছা অন্ধকারেও ঘরের টালমাটাল অবস্থা নজরে আসাতে লিসা অনুমান করে নিল তার অবর্তমানে কেউ বা কারা এই ঘরে ঢুকেছিল। অবস্থা সঙ্গীন আঁচ করতে পেরেই চম্পট দিল রায়না। জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। হাত বাড়িয়ে সুইচটা অন করার আগেই লিসার নাকের ওপরে ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত একটা কিছু চেপে ধরল কেউ। জ্ঞান হারালো মদালসা, আর কিছু মনে নেই তার।
ড্যানির নাম দেখে ফোন কানে নিল কে সিং।
“কে এস, ফ্ল্যাশ ড্রাইভ তো মিলে গেছে কিন্তু প্রবলেম হলো ওহ পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড হ্যায়। যে মেয়েটাকে ধরে আনতে হুকুম দিলে সে তো এখনো বেহোশ। সে’ও জানে কি না তা অবশ্য আমার জানা নেই। ওহ সালী রায়না তো ভাগ গয়ী।”
“আমি আসছি, তোমরা খেয়াল রেখ।”
কে সিং ঘরে ঢোকার পরে পরেই ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরল মদালসার। চোখ খুলে প্রথমেই সবকিছু ঝাপসা দেখল লিসা, কিছুই বুঝতে পারল না কোথায় আছে সে, কোন সময় সেটা দিন না রাত? একটু সম্বিত ফিরতেই দরজা দিয়ে কনওয়ালজিৎকে ঢুকতে দেখে হাঁউমাউ করে কত কী যে বলে যেতে লাগল মদালসা, কেউ কিছুই বুঝতে পারল না। তারপরেই ব্যথা লাগতে লিসার বোধ হলো তার হাতদুটো পেছনে নিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কিছুটা আন্দাজ করে, জড়ানো গলায় বলে উঠলো “আমি কোথায় কনু, আমাকে বেঁধে রেখেছ কেন ডিয়ার?”
“সব জানতে পারবে জানু, জাস্ট ওয়েট।”
সিং-এর কঠিন মুখ দেখে লিসা বুঝতে পারল এরা তাকে সহজে নিস্তার দেবে না কিন্তু সে তো সাহায্যই করেছে, তার দোষ কোথায়? সিং-এর হদিস না পেয়ে, এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখবার চেষ্টা করল লিসা, হাতদুটোকে খোলবার ব্যর্থ চেষ্টা করে, মুখে বলল “আমাকে যেতে দাও।”
লিসা বুঝতে পারল বেশ বড়সড় এক ফাঁদে পড়ে গেছে সে, এখান থেকে বেরনো কি সম্ভব হবে?
পাশের ঘরে পৌঁছে কনওয়ালজিৎ দেখল একটা লোক উল্টো হয়ে মাটিতে পড়ে আছে, হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা।
পা দিয়ে জোরে এক লাথি মারতেই উলটে গিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে রইল শরীরটা।
কে এস বুঝতে পারল তার জ্ঞান নেই।
“এর হোশ ফেরাও, পাসওয়ার্ড বার কর। এক্ষুনি প্রাণে মের না, ওর থেকে অনেক কথা আদায় করতে হবে।”
স্মেলিং সল্ট শুঁকিয়ে, জলের ঝাপটা মারার পরে জ্ঞান ফিরতেই সংকেতকে উঠিয়ে চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে রাখল ড্যানি। অতিরিক্ত মারের চোটে চোখের কোণা ফুলে আছে, সারা শরীরে কালশিটে।
সংকেতের সামনে এসে দাঁড়াল কনওয়ালজিৎ সিং।
“ফ্ল্যাশ ড্রাইভের পাসওয়ার্ড বল।”
অন্যমনস্ক হয়ে গেল ঘোড়পাড়ে। এই আন্ডার ওয়ার্ল্ডের গ্যাংস্টারদের বিরুদ্ধে যত প্রমাণ যোগাড় করতে পেরেছে, সবই ওই ফ্ল্যাশ ড্রাইভে রাখা আছে, সেটা চলে গেছে শত্রুপক্ষের হাতে। নাম শুনে সংকেত ঘোড়পাড়ে বুঝতে পারল এই হলো সেই ঘাগু কে এস। সমাজবিরোধী কাজ কারবারের হোতা আফরোজ শেখের রাইট হ্যান্ড।
এই দলটার হাল হকিকত প্রকাশে আনার জন্যে জমিন আসমান এক করে ফেলেছে সংকেত কিন্তু এদের হাত এতটাই লম্বা, নেটওয়ার্ক এতটাই শক্তিশালী যে সংকেত তাদের খোঁজ পাওয়ার আগে ওরাই তাকে ধরে ফেলেছে। ওর রিস্ট ওয়াচটাতেও মাইক্রোচিপ লাগানো আছে, রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে সব কথাবার্তা কিন্তু এসবের পরিণতি কী? মনে তো হয় না এই বাঘের গুহা থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে সে, তবে যা’ই হয়ে যাক মুখ সে খুলবে না। অবশ্যম্ভাবী অত্যাচার, অনিবার্য মৃত্যুর জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে গেল স্পেশাল ব্রাঞ্চের সবথেকে পারদর্শী এবং সৎ অফিসার সংকেত ঘোড়পাড়ে। সে তার ইনভেস্টিগেশনে কারো হস্তক্ষেপ করা পছন্দ করে না সে সিনিয়রই হোক বা হোমরাচোমরা কেউ। তার অসম্ভব চড়া মেজাজ আর ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্যে তাকে সাসপেন্ডও হতে হয়েছে কয়েকবার কিন্তু বদল আসেনি মানুষটার আচার আচরণে। তার নিজের কাজের প্রতি নিষ্ঠা, জটিল রহস্য সমাধানের উৎকর্ষতাই তাকে আজ পৌঁছে দিয়েছে উচ্চতার এই চূড়াতে। সে যেন পুলিশ বিভাগের এক অরিজিৎ বীর, শত্রু নিধনে পারদর্শী তবে অজাতশত্রু নয়। তার প্রতি ঈর্ষা এবং বিরাগের ফলে আজ তাদেরই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে সংকেত। আজ নয় কাল, মরতে তো একদিন হবেই… দেখাই যাক না। লিসা নামের মেয়েটা যে কীভাবে সংকেতকে তার ফাঁদে জড়িয়ে ফেলল সেই কথা ভাবতে বসলে কূল কিনারা পায় না এই দুঁদে অফিসার। অতি কঠিন কর্মময় দিনগুলোর পরে সাধারণ ভাবে একটু আধটু পান করার অভ্যাস সংকেতের থাকলেও তা সে করে নিজের বাড়িতে বসেই। অ-মিশুক মানুষটার ইয়ার দোস্তেরও দরকার হয় না। অবিবাহিত হলেও নারী লোলুপতাও নেই সংকেতের।
একটা বড় অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হতে স্লাই ফক্স’এ একটা ছোট পার্টীর আয়োজন করেছিল সংকেতের অধস্তন অফিসাররা। বাধা দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত যোগ দিতেই হয়েছিল পার্টীতে আর সেই অবিমৃষ্যকারিতার ফলই আজ হাতে হাতে পাওয়া গেছে। সংকেতকে যদি তারা তাদের পথের কাঁটা মনে করেছিল, সরিয়ে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যেত কিন্তু তা করবে কেন, ঈর্ষার জ্বলন যে মানুষকে কতদূরে নিয়ে যেতে পারে তার বোধ বেশ ভালই আছে সংকেতের। নিজেদের গায়ের জ্বালা মেটাবার জন্যেই এই ফাঁদে ফেলা হয়েছে তাকে। এমন বেওকুফ সে, যে সরল বিশ্বাসে নিজেরই অধস্তনদের পাতা জালে ধরা পড়ে গেছে। পার্টীতে এসেছে আর যা কিছু ঘটবার ওখানেই ঘটেছে। এমন কিছু মিশিয়েছিল তারা তার ড্রিংক-এ যে, যে বীর যোদ্ধা তার কর্মজীবনে কখনও অসফলতা দেখেনি, সেই সত্যের পূজারী আজ ইঁদুরের খাঁচাতে বদ্ধ। সমাজের মাথারাও সংকেতের সিদ্ধান্তের সামনে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছে সময়ে সময়ে, এতটাই নির্ভীক আর কলিজা ওয়ালা ছিল সংকেত ঘোড়পাড়ে।
“ইসকা হোয়্যার অ্যাবাউটস চেক করো… অ্যাসোসিয়েটস ভী!”
যাকে কে এস বলে সম্বোধন করছে এরা, তার নাম শুনলেও আগে কখনো তার দেখা পায়নি সংকেত। কনওয়ালজিৎ সিং-এর নির্বিকার আর কঠিন মুখের হিমশীতল চাহনি কাঁপিয়ে দিল প্রবল প্রতাপশালী সংকেতের হৃদয়কেও।
প্রচণ্ড অত্যাচারের পরেও অফিসার ঘোড়পাড়ের মুখ খোলাতে পারা গেল না। তার ঠোঁট জোড়া যেন কেউ সেলাই করে দিয়েছে।
হেডস্ট্রং কে সিং আর সহ্য করতে না পেরে পর পর তিনটে গুলি ছুঁড়ল সংকেতের বুক লক্ষ্য করে। নিজের ওপরে নিজেই অসন্তুষ্ট হলো কে এস। এটা কী করল সে, আসল প্রমাণটাই রাগের বশে হাতছাড়া করে ফেলল?
আরও অনেক মেয়েদের সঙ্গে আরব দেশে পাচার হয়ে গেল মদালসা, ইমানদারীর দাম চোকাল মেয়েটা।
মেয়ে রঞ্জার জোরাজুরিতে অপারগ হয়ে তাকে কলকাতায় পড়তে পাঠিয়েছিলেন প্রমথেশ মিত্র। অল্প বয়েসে মা’কে হারিয়ে জেদী হয়ে উঠেছিল মেয়েটা। মনমরা হয়ে থাকত, স্কুলে যেতে চাইত না, আদ্দেকদিন না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তার বাবা। ডাক্তার বলেছিলেন “ওষুধ দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে। বোর্ডের পরীক্ষা হয়ে যাক, কথা বলব ওর সঙ্গে।”
ব্যাবসার খেয়াল রাখতে গিয়ে মেয়ের প্রতি খানিকটা অমনোযোগীই হয়ে পড়েছিলেন মিত্র বাবু।
সকালের বোর্নভিটা দিতে গিয়ে সরিতা ফিরে এসে জানিয়েছিল “বাবু, রঞ্জুর ঘরের দরজা বন্ধ।”
“এত দেরি করছে কেন উঠতে? ওর তো পরীক্ষা সামনে। বেশি রাত অবধি পড়াশোনা করেছে হয়তো, চল দেখছি আমি।”
দরজা খোলা গেল না, বাইরে থেকে লোক ডেকে এনে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখা গেল জ্ঞানহীন অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে মেয়ে। অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে বোঝা গেল, ঘুমের ওষুধ জাতীয় কিছু খেয়েছে সে, স্টমাক ওয়াশ করতে হবে। আই সি ইউ’তে রাখা হয়েছে, অবস্থার উন্নতি হলে ক্যাবিনে দেওয়া হবে। কীই বা বয়েস ওর, এখনই আত্মহত্যার পথে যেতে হলো! মায়ের অভাব বোধ না বাবার ওপরে রাগ, অভিমান?
প্রথমেশের মনে পড়ে গেল রঞ্জার ছোটবেলার কথা।
স্কুল থেকে ডাক এসেছে। কাজকর্ম সামলে রঞ্জুর স্কুলের প্রিন্সিপালের রুমে পৌঁছে প্রমথেশ দেখলেন ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে মেয়েটা।
“কী হয়েছে, ও কাঁদছে কেন?”
রঞ্জাবতীর ক্লাস টীচর’ও উপস্থিত ছিলেন।
“ক্লাসের কোনো কাজেই যোগ দেয় না রঞ্জা, চুপ করে বসে থাকে আর কান্নাকাটি করে। ওর কোনো বন্ধু নেই। আপনি ওর বাবা, আমি জানি আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ কিন্তু ওকে একটু সময় দেওয়াও তো আপনার কাজের মধ্যেই পড়ে।”
মুখর হলেন রঞ্জাবতীর ক্লাস টীচর নিকিতা নায়েক।
“ওর সঙ্গে কথা বলুন মিস্টার মিত্র, ওর মনে কী চলছে তা তো আমরা জানতে পারব না, আমাদের অসংখ্য বাচ্চাদের নিয়ে চলতে হয়।”
প্রিন্সিপাল মিসেস ব্রেগাঞ্জার স্বরে কোমলতার ছোঁয়া।
“ও কি আপনাদের কিছু বলেছে? অনেক সময়ে সহপাঠীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েও অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে বাচ্চারা। একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন তো ওকে কেউ বিরক্ত করছে কি না।”
“মিস্টার মিত্র, মেয়ে আপনার, আপনি তাকে বড় করে তুলবেন। সমস্যার সম্মুখীন হলে তার সমাধানও আপনাকেই করতে হবে। এই বয়েসে পড়াশোনার জন্যে চাপ সৃষ্টি করতে চাই না আমরা কিন্তু জীবনের পথে চলতে গেলে কিছু না কিছু তো শিখতে হবে। পড়াশোনা ভালো না’ই লাগতে পারে কিন্তু ছবি আঁকা, নাচ গান আবৃত্তি কোনরকম অ্যাক্টিভিটীতেই যে মন নেই ওর তবে আপনি যে সম্ভাবনার প্রশ্ন তুলেছেন সেই ব্যাপারেও নজর দেব আমরা। এইসব ধরনের ঘটনা সাধারণত বোর্ডিং স্কুলেই ঘটে যেখানে বাচ্চারা অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটায়। এখানে সীমিত সময়ে ওরা তো সর্বদাই কারো না কারো দৃষ্টির ঘেরার মধ্যেই থাকে। টিফিন টাইমটাতে খেয়াল রাখব আমরা।”
-মেয়েটা যে কবে স্বাভাবিক হবে, আদৌ হবে কি না কে জানে!
দীর্ঘশ্বাস পড়ল প্রমথেশের। চোখের সামনে ভেসে উঠল মধুমতীর ছিন্নভিন্ন শরীর।
স্ত্রী’র নিরুদ্দেশ রিপোর্ট করিয়ে রেখেছিলেন তিনি স্থানীয় থানাতে।
থানা থেকে ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি রওনা হয়েছিলেন তালসারির পথে। সঙ্গে ছিলেন পুলিশের বড় কর্তা আর তাঁর আর্মড ফোর্স।
তালিসারিতে সুবর্ণরেখা নদী-মোহনার মুখে পাওয়া গিয়েছিল নিবেদিতার নির্বস্ত্র, খোবলানো দেহ। মুখের কিছু অংশ আর এক কানের লতির দুল দেখে শনাক্ত করেছিলেন তাকে। বাড়িতে, সরিতার ভরসায় ছেড়ে গিয়েছিলেন তিন বছরের শিশু কন্যাকে।
সৎকার শেষে বাড়ি ফিরে মেয়ের সামনাসামনি হতে খুব ভয় পেয়েছিলেন প্রমথেশ, কী জবাব দেবেন ওই শিশুর প্রশ্নের?
আশা ছিল সময় ধুয়ে দেবে সবকিছু।
বাড়ির আনাচে কানাচে মাকে খুঁজে বেড়াত রঞ্জাবতী। ক্রমে ক্রমে অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পেতে লাগল ছোট্ট মেয়েটার ব্যবহারে। ধীরে ধীরে নিজেকে শামুকের খোলের মধ্যে গুটিয়ে নিল সে।
ঘন কুয়াশা কেটে প্রমথেশের গাড়ি এগিয়ে চলেছিল। আকাশের রূপোলী চাঁদ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল কালো মেঘের আড়ালে। ঘন হয়ে বসেছিল মধুমতী। হঠাৎই বাধা পেয়েছিল গাড়ির গতি। জোরালো টর্চের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল তাদের। কালো হুডেড জ্যাকেট পরা জনা তিনেক লোক পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে,
কাচ তোলা জানলায় টোকা দিয়ে দরজা খুলে দিতে ইশারা করেছিল।
“খোল বে!”
কন্ঠস্বরের হিংস্রতা বন্ধ গাড়ির কাচ ভেদ করে ভেতরের নীরবতাকে যেন বাড়িয়ে তুলেছিল। প্রমথেশের হাত চেপে ধরে থর থর করে কাঁপছিল মধুমতী। কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায়, স্টীয়রিং-এ হাত রেখে বসেছিলেন প্রমথেশ।
গুলি ছুটে এসে উইন্ডস্ক্রীন চূর্ণ করে দিতেই দরজা খুলে ঊর্ধশ্বাসে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলেন প্রমথেশ।
গাড়ির ভেতরে ঢুকে চুলের মুঠি ধরে মধুমতীকে বার করে নিয়েছিল আততায়ীরা। টেনে নিয়ে গিয়েছিল পথপার্শ্বের গভীর জঙ্গলের দিকে।
জীবনের পথে চলতে কখন যে রঞ্জার হাতটা ছেড়ে গিয়েছিল, দূরে সরে যাচ্ছিল তাঁর আত্মজা, বুঝে উঠতে পারেননি প্রথমেশ।
বিকেলে, ভিজিটিং আওয়ার্সে হাসপাতালের রুমে পৌঁছে প্রমথেশ দেখলেন চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে রঞ্জা, স্যালাইন চলছে। কপালের ওপরে হাত রাখতে চোখ খুলে তাঁর মুখের দিকে দেখল মেয়েটা, তারপরেই ঘাড় ঘুরিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল।
“কী হয়েছে রঞ্জু, আমাকে বলবি না? সেই ছোট থেকে আমিই তো তোর মা আর বাবা দুই’ই।”
নিরুত্তর রঞ্জাবতীর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। কিছুদিন ধরেই মেয়ের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন প্রমথেশ। কথাবার্তা খুব কম বলে, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দহরম মহরম থাকায় পুলিশী ঝামেলা এড়ানো যেতে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে গেলেন প্রমথেশ।
রঞ্জা ঘুমোচ্ছে ভেবে পা টিপে তার ঘরে ঢুকে প্রমথেশ দেখলেন সে বসে আছে তার পড়ার টেবলে। একটা খাতায় কিছু লিখছে মন দিয়ে। মেয়ের চেয়ারের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। খাতার পাতায় কতগুলো মুখোশের ছবি আঁকা। কিছু আন্দাজ করে ঘাড় ঘোরাতেই বাবাকে দেখতে পেয়ে হাসল রঞ্জা, সেই হাসি থেকে ঝরে পড়ল বিষাদ। রোগা হয়ে গেছে রঞ্জা, চোখের তলায় কালি পড়েছে। রঞ্জার সাইকায়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলতে হবে, মেয়েটার চিকিৎসা দরকার।
স্কুলের গেটের কাছে পৌঁছনোর আগেই সেখানে ভিড় দেখে একটু থমকে গেলেন প্রতিমা সামন্ত। আগের বছরে মিসেস ব্রেগাঞ্জা অবসর নেওয়ার পরে এই স্কুলের ভার নিয়েছেন ডক্টর সামন্ত। একটা ছেলেকে ঘিরে রেখেছে বেশ কিছু স্থানীয় মানুষ।
দারোয়ানকে ভেতরে ডেকে নিয়ে ব্যাপারটা জানতে চাইলেন প্রতিমা। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে ডক্টরেট করেও তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে থাকাই শ্রেয় মনে করেছেন।
ক্লাস টেন’এর রঞ্জাবতীর হাত ধরে টানাটানি করছিল ছেলেটা, কথা কাটাকাটিও হয়েছিল।
রঞ্জাবতীকে ডেকে পাঠালেন প্রতিমা।
নিষ্পাপ, কমনীয় একটা মুখ, ছোট করে কাটা চুল, পরনে ইউনিফর্মের স্কার্ট ব্লাউজ। রঞ্জাবতী এসে দাঁড়াল সামনে।
“কী হয়েছিল রঞ্জাবতী, তোমাকে বিরক্ত করছিল কোনো ছেলে? এর আগেও নাকি তোমাদের কথা কাটাকাটি হয়েছে। তুমি আমাকে জানাওনি কেন, তোমার বাবাকে বলেছ?”
“বাবা! তিনি তাঁর স্ত্রীয়ের জন্যেই কিছু করেননি, আমার পাশে দাঁড়াবেন? আমাকেই উল্টে বকবেন৷ আমার ব্যাপার আমি নিজেই সামলে নেব ম্যাম।”
“সামনে পরীক্ষা রঞ্জা, তুমি তো ভালো মেয়ে, শুনেছি কলকাতায় গিয়ে পড়তে চাও। পড়াশোনায় মন দাও।”
“আমাকে কিছু করতেই দেবে না ওই শয়তান ছেলেটা, সকালে বিকেলে জ্বালিয়ে মারছে। আমার যে ওর প্রতি কোনো রকমের ইন্টরেস্ট নেই ম্যাম সেটা তো ওকে বুঝতে হবে। বড়লোকের স্পয়েল্ট ব্র্যাট, দুনিয়ার রাজা মনে করে নিজেকে। আমি একদিন কিডন্যাপড হয়ে যাব, দেখে নেবেন।”
রঞ্জার চোখে আগুন দেখলেন প্রতিমা সামন্ত।
পরীক্ষা ভালো ভাবে শেষ হয়ে গেল। রঞ্জা জেদ ধরেছে কলকাতার কলেজে পড়বে।
ক’দিন ধরে রাতে রঞ্জার ঘরেই শুচ্ছে সরিতা। মাঝরাতে চিৎকার শুনে উঠে বসে সে দেখল রঞ্জা থরথর করে কাঁপছে, তার চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রুধারা। বুক দিয়ে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে সরিতা বলল “কী হয়েছে মা আমার কাঁদছ কেন, খারাপ স্বপ্ন দেখলে আবার?”
সেই ছোট্টবেলা থেকে বুকে করে বড় করেছে এই পিসি। তাকেই আঁকড়ে ধরে রঞ্জা, বলে “আবার, আবার ওই মুখোশ পরা লোকটা। কী চায় ও আমার কাছে, বার বার কেন আসে?”
কী উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে সরিতা বলে “এস, তুমি আমার সঙ্গে শোও। দেখি তো কোন মুখোশওয়ালা কী করে!”
পিসির বুকের ওমে চট করেই ঘুমিয়ে পড়ে রঞ্জা।
সরিতার কাছে সব শুনে প্রমথেশ ফোনে ধরেন ডাক্তারকে।
“মেয়েটা তো ভালো নেই ডক্টর, কীসব বাজে স্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে ওঠে ঘুমের ঘোরে।”
ডাক্তারের চেম্বারে বসে ছিল রঞ্জা। সাইকোথেরাপীর সাহায্য নিয়ে ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখতে চান ডক্টর কানুনগো।
“তোমার স্বপ্নে বার বার মুখোশ পরা মানুষ আসে। তার সম্বন্ধে আরেকটু বলতে পারবে… তার স্পর্শ পেয়েছ, কোনরকম গন্ধ?”
“চোখ বন্ধ করলেই আমার সামনে এসে দাঁড়ায় এক আবছায়া মূর্তি। আমি তার স্পর্শ পেয়েছি, বিশ্রী ছোঁয়া। সে আমার সারা গায়ে খুব খারাপ ভাবে হাত বোলায়। মুখ ঢাকা থাকে মুখোশে, একটা চেনা চেনা গন্ধ আমাকে সারাদিন ধরে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।”
একটা জোর চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এল সরিতা। আবার ভয় পেল মেয়েটা? সে তো রাতে ওর সঙ্গে থাকতেই চেয়েছিল, রঞ্জাই বলল “না পিসি, তুমি সারাদিন খাটাখাটনি কর, রাতে ভালো করে না ঘুমোতে পারলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে।”
দরজা ভেজানোই ছিল, ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সরিতা দেখল খাটের ওপরে জড়সড় হয়ে বসে আছে রঞ্জা, চোখদুটো ভয়ে বিস্ফারিত।
“কী হলো মা, আবার ভয়ের স্বপ্ন দেখলি?”
“আমি জানি না পিসি, যা দেখি তা স্বপ্ন নাকি সত্যি!”
কৈশোর পেরতেই ত্রিদিব নারায়ণ চৌধুরী বুঝতে পেরেছিলেন, বিপরীত লিঙ্গ নয় তিনি আগ্রহী পুরুষের ভালবাসায়।
ছেলেবেলার সঙ্গী, তার স্কুলের দু’ক্লাস ওপরের আফরোজ ছিল তার ভালবাসার মানুষ। সেই দিনটার কথা মনে পড়ে ত্রিদিবের, নরম সরম লাজুক ছেলেটার স্কুলের প্রথম দিন। ইতস্তত পায়ে স্কুল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে কারো সঙ্গে জোর ধাক্কা লেগেছিল কিন্তু একটা কঠিন হাতের বাঁধনে ধরা পড়ে, আঘাত পাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল ত্রিদিব নারায়ণ চৌধুরী। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল সে কিন্তু যখন বুঝতে পারল পড়ে যায়নি সে, চোখ খুলে দেখল তার কোমর জড়িয়ে ধরে তার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে লম্বা চওড়া দেহের, অসম্ভব সুন্দর মুখের একটা ছেলে।
“লেগেছে?” খুব আদুরে গলায় প্রশ্ন করল ছেলেটা।
অপরিচিত একটা ছেলের আদর আর আহ্লাদের ছোঁয়াতে লাল হয়ে উঠেছিল ত্রিদিবের শ্যামল মুখখানা। ছোট ছিল সে, তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি কিন্তু আফরোজের সঙ্গে সময় কাটাতে খুব ভালো লাগত ত্রিদিবের, কী যেন এক আকর্ষণ বারে বারে তাকে টেনে নিয়ে যেত আফরোজ শেখের কাছে। আফরোজও খুব খুশি হয়ে উঠত ত্রিদিবকে দেখলেই।
টিফিন খাওয়া শেষ করে আনমনে স্কুলের পেছনের জঙ্গুলে জায়গাটায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল ত্রিদিব। হঠাৎ করে পেছন থেকে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরতেই চমকে উঠল ত্রিদিব।
“তুই জঙ্গল ভালবাসিস?”
কী সুন্দর করে হাসল আফরোজ। হাতে হাত রেখে তারা ঘুরে বেড়িয়ে টিফিনের পিরিয়ডটা কাটিয়ে ফিরে গেল নিজেদের ক্লাসে।
“অ্যাই তুই ওই আফরোজের সঙ্গে কী করিস রে, ও তো তোর ক্লাসের নয়।”
স্বভাব লাজুক ত্রিদিব চুপ করে তাকিয়ে রইল তার ক্লাসের দাড়ি গোঁফ বেরনো লম্বা লম্বা ছেলেগুলোর দিকে। এরা সকলে পেছনের বেঞ্চ’এ বসে আর গান গেয়ে, টিপ্পনী কেটে বাকিদের বিরক্ত করে। ক’বছর ফেল করেছে কে জানে!
“কী হলো, কিছু জিজ্ঞেস করছি, উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”
“কিছু না, আমি ওখানে একা একা ঘুরছিলাম আফরোজ দাদা এসে বলল “সাবধান, এখানে সাপ আছে।”
“বাজে কথা! তোরা হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছিলি, আমি দেখেছি। চুমু টুমুও খেয়েছিস নাকি?”
খ্যা খ্যা করে হেসে উঠে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বিশ্রীভাবে চোখ মারল সুজিত।
-এসব কী বলছে সুজিত! আফরোজ দাদাকে তার খুব ভালো লাগে, সেটা কি অন্যায়?
হঠাৎ করেই মাথা গরম হয়ে গেল শান্ত ছেলেটার।
“বাজে বাজে কথা বলছ কেন?”
“তবে রে!”
জোরদার এক চপেটাঘাতে ত্রিদিবকে মাটিতে ফেলে তার ওপরে জুতো সমেত পায়ের লাথি মারতে থাকল সুজিত। হাতের সুখ করতে এগিয়ে এল বাকিরাও।
কোথা থেকে মসীহার মতো উদিত হয়ে আফরোজ অত্যাচারী ছেলেগুলোকে শক্ত হাতে সরিয়ে দিয়ে কোলে তুলে নিল মাটিতে পড়ে থাকা রক্তাক্ত ত্রিদিবকে।
রক্ত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল “লজ্জা করে না তোদের, হাঁটুর বয়সী একটা ছেলেকে এতজন মিলে মারছিস! আমার সঙ্গে লড়ে দেখা সাহস থাকে তো!”
“যা যা তোদের আসনাই চলছে তা জানি আমরা। সারা স্কুলে সব্বাইকে বলে দেব।”
“যা বলে দে। মানুষকে মানুষই ভালবাসে, তা নিয়ে নতুন করে বলার আছেটাই বা কী?”
যত দিন যেতে থাকল, আফরোজ আর ত্রিবিবের একের অপরের প্রতি ভালবাসাটা বেড়েই চলল। বাড়িতেও জানাজানি হওয়াতে স্কুল ছাড়িয়ে ত্রিদিবকে তার পিসির বাড়িতে পাঠিয়ে, নতুন স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। স্কুল শেষ হতেই তার ভালবাসার মানুষ আফরোজের থেকে দূরে করতে জোর করে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো বাংলা ভূটান বর্ডারে চৌধুরীদের বাগানবাড়িতে। বাড়ির ছেলের এই অসম সম্পর্ককে মেনে নিতে পারেননি নারায়ণের বাড়ির প্রাচীন পন্থী মানুষজন।
সব ভুলে যেতে চেষ্টা করে ছোটবেলায় লেখা ‘জীবনের লক্ষ্য’কে রূপ দিতে গিয়ে প্রভূত পরিশ্রমে ডাক্তার হয়ে শহরতলীর দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসায় নিজের জীবন নিয়োগ করে দিলেন ডাক্তার ত্রিদিব নারায়ণ চৌধুরী। আর্ত মানুষের আকুতিভরা প্রার্থনা পূরণে তিনি যেন ভগবানেরই রূপ ধরলেন।
বিশাল জমির ওপরে বাড়ি ডাক্তার বাবুর। সামনে ফুলের বাগান, পেছনের দিকে ছেড়ে রাখা অনেক খানি জমিতে ঘাট বাঁধানো পুকুর, মন্দিরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট সব মহীরুহ।
এতবড় বাড়িতে ডাক্তার ত্রিদিব কিন্তু একদম একাই থাকেন। গ্রাম্য এক মহিলা এসে তাঁর কাজকর্ম করে দিয়ে যায়।
পাগান গ্রামের প্রান্তে গাছের নিচে সাপ্তাহিক মেডিক্যাল ক্যাম্প বসেছে। কে জানে কীভাবে দু’একজন সমাজসেবী বিভিন্ন রোগ-বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের যোগাড় করে ফেলেছেন ডাক্তার ত্রিদিব।
‘যে খায় চিনি যোগান চিন্তামণি’
তাঁদের নিয়ে গ্রামবাসীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন ডাক্তার চৌধুরী।
রোগী দেখা শেষ হয়েছে। তাঁর মোবাইল মেডিক্যাল ভ্যানে জিনিসপত্র তুলে দিয়েছে সাহায্যকারীরা। গাড়িতে উঠতে যাবেন, চোখ পড়ল খানিক দূরে গাছের তলায় শিশু কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের ওপরে।
-কী চায় মেয়েটা, আগে দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না। কে অসুস্থ মা নাকি বাচ্চাটা? তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন “কে তুমি? এই গাঁয়ে তো আগে তোমাকে দেখিনি। কী চাও?”
বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ডাক্তার বাবুর পায়ের কাছে বসে পড়ল মেয়েটা, তার কপাল থেকে রক্ত ঝরছে।
“আমার ছেলেটাকে বাঁচান বাবু। ক’দিনের জ্বরে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। ওষুধ পথ্য কিছুই পড়েনি, অনেক দূর থেকে আসছি আমি।”
“আচ্ছা, গাড়িতে বস, বাড়ি গিয়ে দেখছি।”
সেই যে গৃহ প্রবেশ ঘটল সংযুক্তার আর তাকে বেরতে হয়নি সেই বাড়ি থেকে। দেখাশোনা করার কেউ না থাকায় ডাক্তারবাবুর যত্ন আত্তির ভার নিজের হাতেই তুলে নিয়েছিল সংযুক্তা। ডাক্তারবাবুর চিকিৎসায় বাচ্চাটাও সেরে উঠেছিল।
মেয়েটাকেও শুশ্রূষা করে সারিয়ে তুলেছিলেন তিনি, কোনরকম প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চাননি তাকে। মা আর ছেলে তাঁর আশ্রিত হয়েই থেকে গিয়েছিল, বেড়ে উঠছিল শিশুটা।
সুশ্রী স্বাস্থবতী যুবতী নারী, স্থানীয় বখাটে ছেলেদের নজরে পড়েছিল। রাত বিরেতে হামলা বেড়েই চলেছিল। বাগানের পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকে এসেছিল একদল নারীলোভী। মেয়েটিকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ডাক্তার ত্রিদিবের ওপরেই হামলা চালিয়েছিল। নারায়ণও অবাক হয়েছিলেন, মেয়েটা যেন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল। নিজের প্রাণ বাঁচাতে গিয়েই প্রাণ দিলেন ডাক্তার ত্রিদিব নারায়ণ চৌধুরী। গ্রামের নামকরা ডাক্তার, আর্তের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে দেওয়া মানুষটাকেও রেয়াৎ করল না নারীদেহ লোলুপ শ্বাপদ গুলো। মেয়েটা বা তার ছেলের কোনো খোঁজ পেল না তারা আর তাই তাদের কোনো ক্ষতিও হলো না।
রাতের অন্ধকারে ঘুমিয়ে রয়েছে নিস্তব্ধ পাগান গ্রাম। কোথাও নেই আলোর রেশ, নেই কোনো রকমের মানবিক শব্দ। মাঝে মাঝে এক্কেবারে মানুষের গলায় কেঁদে উঠছে শকুনের বাচ্চারা। শোনা যাচ্ছে শেয়ালের দলবদ্ধ হুক্কাহুয়া।
গ্রামের শেষ প্রান্তের বিরাট বাগানে ঘেরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল এক নারী শরীর। মেঘে ঢাকা আধখানা চাঁদের হাল্কা আলো এসে পড়ল তার মুখে। সেই নারীর চোখ ধরেছে গাঢ় লাল রঙ। অমোঘ এক আকর্ষণের বশবর্তী হয়ে অবয়বটি এগিয়ে চলল গ্রামের কবরস্থান আর শ্মশান, পাশাপাশি স্থিত জায়গা দুটির উদ্দেশ্যে।
নারীমূর্তি এসে দাঁড়াল গ্রামের পূব কোণে, জঙ্গলের ধারে, এদিকে জনবসতি নেই।
বেশ কিছুদিন ধরেই রহস্যময় ঘটনার জেরে বিধ্বস্ত রয়েছে পাগানের গ্রামবাসীরা। বিভিন্ন প্রান্তে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে ঘাড় মোচড়ানো, খুবলে খাওয়া দেহ। একবিন্দু রক্তও অবশিষ্ট থাকে না সেই দেহগুলোতে। সেই বীভৎস দৃশ্য সহ্য করা যায় না। ঘরবন্দী হয়ে বসে থাকাও তো সম্ভব নয়, কাজে বেরতেই হবে নাহলে পেট চলবে কীভাবে? গোটা গ্রামের ওপরে নেমে এসেছে বিভীষিকার ছায়া।
এমনিতেই ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে গ্রামের মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরছে, তার সঙ্গে ঘটে চলেছে এইসব অদ্ভুত ঘটনা। যে ছেলেগুলোর দৌরাত্মে স্থানীয় মেয়েদের চলাফেরা বেঁচে থাকা দুঃসহ হয়ে উঠেছিল, পথে ঘাটে বেরনো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাদেরই মৃতদেহ পাওয়া যেতে লাগল এখানে ওখানে। অপরাধী সনাক্তকরণের ব্যাপারে কিছুই করে উঠতে পারেনি পুলিশ, কোনো রকম কূল কিনারাই পায়নি তারা।
ডাক্তার বাবুর মৃত্যুর পরে সেই বাড়ির আশেপাশে যেতে ভয় পেত লোকে। রাত বিরেতে সাদা জ্যোৎস্নায় মোড়া এক অবয়বকে ঘোরা ফেরা করতে দেখা যেত বাড়ির বাগানে, তার সঙ্গে সব সময়ে থাকত হিংস্র নেকড়ের মতো বীভৎস এক কুকুর।
কার্ত্তিকের মাঝামাঝি, বাতাসে লেগেছে একটা শিরশিরে ভাব। ঘাসে পাতায় হীরের কুচির মতো জ্বলছে শিশির বিন্দু। শহুরে ইট কাঠের জঙ্গলের হাওয়ায় তখনো লাগেনি এই শীতের পরশ।
পীর বাবার দরজায় গিয়ে দাঁড়াল আফরোজ শেখ। দরজার বাইরেই বিরাট কালীমূর্তি দেখে অবাক হলো সে।
অনেকদিন হয়ে গেল, তার প্রিয় বন্ধু নারায়ণের বিরহ আর সহ্য করতে পারছিল না আফরোজ। অনেকের কাছে এই সিদ্ধ পুরুষ পীর বাবার হদিস পেয়ে তার মনের সংশয় দূর করার আশাতে গভীর জঙ্গলের মাঝে তাঁর কুটিরের দ্বারে এসে পৌঁছেছে আফরোজ।
কার্ত্তিক মাসের এই হিমেল রাতে হঠাৎ করেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো শুরু হয়ে গেল বিপুল ঝড় তুফান। বিদ্যুতের ঝলকানিতে পীরবাবার কুটিরটাকে কেমন যেন শাপগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছিল।
জঙ্গলের মধ্যে নেই কোনো জনবসতি, ঘন ঝোপ ঝাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে একটি মাত্র কুঁড়ে ঘর। তারই বেরিয়ে থাকা চালার নিচে আশ্রয় নিল আফরোজ। একটা খুপরি জানলা দিয়ে উঁকি মেরে সে দেখল ঘরের ভেতরে প্রদীপ জ্বলছে। পীরের ডেরার কাছাকাছি পৌঁছতেই শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ বোধ করেছিল আফরোজ। সে ছিল চন্দ্র গ্রহণের রাত। আফরোজ শুনেছিল গ্রহণের রাতে জঙ্গলের কাছের শ্মশানে যান পীর বাবা, ডাকিনী সাধনায় বসতে। ঝড়বৃষ্টি একটু কম হতেই, আন্দাজে আন্দাজে ধীরপায়ে শ্মশানের দিকে এগিয়ে গেল আফরোজ।
খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আফরোজ দেখল, শ্মশান ভূমির বেশ কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে গোবর জল দিয়ে নিকোনো হয়েছে। একটা কালো কাপড়ের ওপরে বসে পীর বাবা। দূর থেকেই যেটুকু দেখা গেল, তাঁর চেহারাটা অস্বাভাবিক। ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে মনে ভক্তির ভাবও জাগিয়ে তোলে। কালো কাপড় লুঙ্গির মতো করে পরা, গায়ের কামিজের রঙও কালো। মাথার জটা পাকিয়ে পাকিয়ে নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত। মুখের সাদা দাড়ি নাভি ছুঁয়েছে। কপালে সিঁদুরের তিলক কাটা। সামনে থেকে তাঁর চেহারাটা দেখার ইচ্ছেতে কাছাকাছি হতেই মুখ তুলে আগন্তুকের দিকে তাকালেন তিনি। চোখে চোখ পড়তেই তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আফরোজের হাড় হিম করে দিল, কী বীভৎস সেই চাহনি। সামনে মাটির পাত্রে রাখা কোনো পশুর কলিজা ও রক্ত।
শান্ত ভাবে অপেক্ষা করল শেখ।
আরাধনা শেষে পীর তাঁর আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই সজাগ হলো আফরোজ। তাঁকে অনুসরণ করে ফিরে এল তাঁর কুটিরের কাছে। পীর বাবার অনুমতি পেতে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসল আফরোজ।
হাঁড়ির মধ্যে থেকে যেন ভেসে এল বাজ পড়ার মতো আওয়াজ।
“কী দিককৎ বাচ্চা?”
“আমার প্রিয় মানুষটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন বাবা।”
প্রণাম করার জন্যে মাথা ঝোঁকাতে, আফরোজের মাথাটা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন পীর বাবা। তাঁর শরীর আর কাপড়চোপড় থেকে ওঠা উৎকট তেলচিটে গন্ধে আফরোজের নাড়ি ভুঁড়ি উল্টে এল। কত জন্ম স্নান করেননি কে জানে। মনের জোরে পীর বাবার বুকের সঙ্গে লেগে রইল সে।
“না রা য় ণ… তোর প্রিয় মানুষ? তাকে তোর থেকে আলাদা করে তোর সঙ্গে মিলতে না দেওয়ার জন্যে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারও প্রাণ যে কাঁদছে তোর জন্যে।”
“কীভাবে ফিরে পাব আমি আমার প্রিয় মানুষটাকে, কিছু উপায় করুন বাবা।”
“পিশাচ সাধন! পারবি তো? একটু এদিক ওদিক হলেই সর্বনাশ।”
“আপনি তো ইসলাম ধর্মের অনুসারী, শ্মশানে বসে তন্ত্র সাধনা করছিলেন দেখলাম?” জিজ্ঞাসু হলো আফরোজ।
“ধরম কে উপর ভী বহুত কুছ হ্যায় বেটা। পাঁচ বছর বয়েস থেকে তন্ত্র সাধনা করছি আমি। কুর্বানি! আল্লাহর নামে কুর্বানি দিতে হবে তোকে। তোর প্রিয় মানুষের কাছে এক বাচ্চা আছে, ওকে এনে দে, সব গড়বড়ি খতম হবে। অগলী অমাবসের রাতের দু’দিন পরেই বলির ব্যবস্থা করতে হবে। তবে, পয়সা বহুত লাগবে রে বাচ্চা।”
“পয়সার ফিক্র করবেন না বাবা, আপকী আদেশ সর আঁখোঁ পর। আমাকে কী করতে হবে বলে দিন।”
একটা বিশ্রী গন্ধ এসে আফরোজের নাক জ্বলিয়ে দিল, তার সঙ্গেই ভেসে এল মহিলা কন্ঠের হাড় হিম করা হাসির আওয়াজ। কেঁপে উঠল আফরোজ। যেমন এসেছিল, তেমনই ধীর পায়ে, সন্তর্পণে পীর বাবার কুটির ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল সে। বাড়ি ফিরে অনেক কাজ করতে হবে। জীবনে অনেক রকমের খারাপ কাজই করেছে সে তাই বলে একটা শিশু হত্যা! কিছু করার নেই, বাবার আদেশ।
পীর বাবার নির্দেশ অনুযায়ী, বিশ্বস্ত কনওয়ালজিৎ সিং-কে কাজে লাগাল আফরোজ।
আফরোজের কাছে টাকা পয়সা পেয়ে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বসলেন পীর সাহেব।
কয়েকদিন সময় চেয়ে নিল আফরোজ, নারায়ণের বাড়ি থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে আসার জন্যে। কনওয়ালজিতের ওপরে অটুট বিশ্বাস তার, সিং তার কাজে কখনো অসফল হয় না।
পীর বাবা বলেছেন “অমাবস্যার দু’দিনের মাথায়, দ্বিতীয়ার কাস্তের মতো সরু চাঁদ যখন পশ্চিম আকাশের গায়ে পৌঁছবে তখনই কোপ দিতে হবে বাচ্চার গলায় আর সেই রক্তের ফিনকি পান করে পিশাচিনী তৃপ্ত হওয়ার পরেই নারায়ণ পুরোপুরি ভাবে তোর বশে আসবে। চিন্তা করিস না বাচ্চা, আগ দোনো তরফ সে হী বরাবর কে লগী হ্যায়। সে’ও তোকে দেখার, তোর ছোঁয়া পাওয়ার আশাতে বেচয়েন হয়ে আছে।”
অতিপ্রাকৃত এবং অশুভ শক্তিদের প্রত্যক্ষ করবার ক্ষমতা থাকলেও পীর বাবা বুঝতে অসমর্থ হলেন যে নারায়ণ আর এই পৃথিবীতে নেই।
রাত দুটো’র সময়ে কুর্বানির ব্যবস্থা করেছেন পীর বাবা। দু’দিন ধরেই কনওয়ালজিৎকে ফোনে ধরবার চেষ্টা করে চলেছে আফরোজ। ফোন হয় আউট অফ রীচ বা বেজেই যাচ্ছে, তুলছেই না কেউ। কী হলো, কী হতে পারে সেই চিন্তায় অধীর হয়ে বাবার আস্তানার পাশের জঙ্গলে পায়চারি করছিল আফরোজ।
দ্বিতীয়ার কাস্তে চাঁদ যখন পশ্চিম আকাশের গায়ে দেখা দিল তখন পীর বাবার দরগার বাইরেই আফরোজের শরীরটাকে মাটিতে পেড়ে ফেলল অদমনীয় দুটো হাতের চাপ। এক অজানা অশরীরী শক্তির কবলিত হলো আফরোজ। কাউকে প্রত্যক্ষ না করলেও সে অনুভব করতে পারল তার গায়ের ওপরে ভারি কোনো অদৃশ্য নারী শরীর চেপে বসে তার দম বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে, অশরীরীর তপ্ত নি:শ্বাসে পুড়ে যাচ্ছে আফরোজের দেহ। সেই নারী-অবয়বের ঘন কালো, আজানুলম্বিত কেশদাম যেন পাকে পাকে পেঁচিয়ে ধরল আফরোজের দেহটাকে। নারীশক্তির মুখ থেকে বেরচ্ছে এক চাপা, হাড় হিম করে দেওয়া গর্জন। আফরোজ শেখের লম্বা চওড়া শরীরটাকে শূন্যে তুলে ধরে অবলীলাক্রমে বনের ধারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, অসীম উন্মাদনাতে খিল খিল করে হেসে উঠল সেই পিশাচিনী।
কুর্বানির যোগাড় যন্ত্র করে চাঁদ দর্শনের আশায় বসেছিলেন পীর বাবা।
আফরোজের দেখা নেই, বাচ্চাটাকে নিয়ে সন্ধ্যের মধ্যেই তার পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। ছটফট করছিলেন বাবা। চেলা চামুণ্ডাদের পাঠালেন আফরোজের খোঁজে।
আফরোজের ঘাড় মোচড়ানো, রক্তশূন্য দেহটাকে বনের ধারে পড়ে থাকতে দেখে ভয়ে বিবর্ণ মানুষ গুলো ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে এসে সেই খবর জানাল পীর বাবাকে।
“থেকে থেকেই ঘটনাটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।”
কণিষ্ক’র সঙ্গে কথা বলছিল রঞ্জাবতী। তার গলার আওয়াজটা প্রথম দিনের মতই ফ্যাঁসফ্যাঁসে। চোখ জোড়াও অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল। কেমন যেন এক অ-জাগতিক অনুভূতিতে ভরে উঠছিল কণিষ্ক’র মন।
“একটা গাড়ি তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার খাদে। কয়েক দিনের বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে বাবার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম আমি।
মন্দিরের সেই ঝড় বৃষ্টির দিনের পরেই আমার শরীরে তোমার অস্তিত্ব টের পেয়েছিলাম কণিষ্ক।”
কার কাছে সব খবর পেয়ে রঞ্জাকে কলকাতা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিলেন প্রমথেশ তা আজ আর অজানা নেই রঞ্জা ওরফে সংযুক্তার। আজ সে জেনে গেছে সেই মুখোশধারী শয়তানটাই কৌশল করে রঞ্জার ঘরে ঢুকে তাকে ভয় দেখাত। সরিতা পিসির চোখ এড়িয়ে কীভাবে যে সে রঞ্জার খাবারে ওষুধ মিশিয়ে তাকে এক ঘোরের মধ্যে থাকতে বাধ্য করত তা তো অজানাই রয়ে গেছে। ইচ্ছে মতো নিজের লিপ্সা চরিতার্থ করতে চেষ্টা করলেও রঞ্জার চেঁচামেচিতে বিশেষ কিছুই করে উঠতে কখনো সক্ষম হয়নি সে। ছোটবেলা থেকেই ওই লোকটা, বাবার বায়সী মৃন্ময় রঞ্জার সঙ্গে অভব্য আচরণ করার সুযোগ খুঁজতে থাকত। মা হারা শিশুটা কিছুই বুঝতে পারত না তবে সরিতা পিসি তাকে এমন ভাবে আগলে রাখত, সীমা লঙ্ঘন করতে পারেনি সেই পিডোফিল।
তার মানী বাবা মেনে নিতে পারেননি রঞ্জার জারজ সন্তানের ব্যাপারটা। বার বার তাকে বলেছিলেন সেই অনাগত, অবাঞ্ছিত সন্তানটাকে ভ্রূণেই শেষ করে দিতে। মেনে নিতে পারেনি রঞ্জা, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল সে তার ভালবাসার ফসলকে পৃথিবীর আলো দেখাতে। বাবার অমতে এবং তাঁর কোনরকম সাহায্য ছাড়াই শিশুটার জন্ম দিতে সমর্থ হয়েছিল রঞ্জাবতী। কচি মুখটা তার হৃদয়কে অপার সুখানুভূতিতে ভরিয়ে তুলেছিল। অসীম মমতায় সে তার আত্মজকে আঁকড়ে ধরেছিল নিজের বুকের সঙ্গে, প্রতিজ্ঞা করেছিল তাকে রক্ষা করার।
তার পরে পরেই ঘটেছিল সেই দুর্ঘটনা। কী হয়েছিল এখন তা ভালভাবেই স্পষ্ট তার কাছে। পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার নামে ট্রেনে আলিপুরদুয়ারে পৌঁছে ব্রেক ভেঙে রাখা গাড়িতে রঞ্জাকে চড়িয়েছিলেন তার বাবা।
-তুই বস, আমি একটু কাজ সেরে আসছি।
কী যেন কিনতে গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিলেন তিনি।
-একসঙ্গেই বেড়াতে যাব আমরা তোর আর তোর মায়ের প্রিয় পাহাড়ে।
মেয়ে আর নাতিকে মেরে ফেলার ছক কষতে দু’বার ভাবেননি প্রমথেশ মিত্র, বুক কাঁপেনি তাঁর।
বাবার ফেরার অপেক্ষা না করেই গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিল ড্রাইভার। বাধা দিয়েছিল রঞ্জা। ভাঙা ব্রেক সামলাতে অসুবিধে হচ্ছিল ড্রাইভারের কিন্তু সে সজাগ থাকায়, পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িটা বেসামাল হতেই লাফ দিয়ে নেমে গিয়েছিল। পাক খেতে খেতে খাদের অতলে তলিয়ে গিয়েছিল গাড়িটা। চলন্ত গাড়ি থেকে বাইরে ছিটকে গিয়েও অভাবনীয় ভাবে বেঁচে গিয়েছিল শিশুটা। রাখে হরি মারে কে?
রঞ্জার কথা মতো তার পরেই সেই ছানাকে বুকে করে, হাঁটতে হাঁটতে রঞ্জাবতী পৌঁছেছিল ভূটান বর্ডারের এক পাহাড়ি গ্রাম পাগানে। সাহায্যের জন্যে সেখানে সেবাপরায়ণ ডাক্তার নারায়ণের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সংযুক্তা নাম নিয়ে। আশ্রয় দিয়েছিলেন সহৃদয় ডাক্তার ত্রিদিব নারায়ণ চৌধুরী।
খাবারের খোঁজে তাকে বেরতে হতো রাতে, শুরু হয়েছিল জন্তু জানোয়ারের রক্ত পান দিয়ে। ধীরে ধীরে মানুষের দিকে হাত বাড়িয়েছিল সংযুক্তা, খাদ্য আহরণ ছাড়াও পাপের শাস্তি দেওয়াই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।
রঞ্জা ছাড়েনি মৃন্ময়কে। তাকে দেখা দিয়ে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সমুদ্রের ধারে, শয়তানটাকে ডুবিয়ে মারলেও তার ঘাড় মোচড়ানো রক্তহীন অশুচি দেহটা পাওয়া গিয়েছিল তালসারির সমুদ্র সৈকতে।
রঞ্জা রেহাই দেয়নি তার জন্মদাতা পিতাকেও, তাঁর অপরাধের শাস্তি পেয়েছিলেন তিনি। প্রমথেশের দেহ পাওয়া গিয়েছিল সেই দুর্ঘটনা গ্রস্ত খাদের ধারে একইভাবে, ঘাড় মোচড়ানো আর রক্তহীন অবস্থায়।
কনওয়ালজিৎ ওরফে কণিষ্ক’র চোখের পলক পড়েনি। মন দিয়ে রঞ্জাবতীর কথাগুলো শুনতে শুনতে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। তাহলে কি রঞ্জার প্রেতাত্মা দাঁড়িয়ে তার সামনে!
“অনেক রাত হয়েছে, আজ তুমি শুয়ে পড়। তোমাকে অনেক কথা বলার আছে, কাল শুনো।
রাতে ভালো ঘুম হলো না কণিষ্ক’র। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে বার বারই কালো পোশাক পরা এক ফকিরের দেখা পেল সে। তার চোখদুটো রক্তবর্ণ হলেও ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস ছিল। জটাজুটধারী সেই ফকির বলেছিল -সাবধান! খুব সাবধান, বংশের বাতিকে নিভতে দিও না।
ফকিরের কথার জবাব দেওয়ার আগেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেতে থম মেরে অনেক্ষণ বসেছিল কণিষ্ক। স্বপ্নের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি। বিছানা ছেড়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে নজরে এসেছিল বাড়ির পেছনের সেই বিশাল জমির বাগান। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে গলে আসা মৃদু চাঁদের আলো সেই রহস্যাবৃত জঙ্গুলে বাগানটাকে আরো বেশি রোমাঞ্চকর করে তুলেছিল। বাগানের বড় বড় বৃক্ষগুলোর গাঢ় সবুজ রঙ ছেড়ে তাদের কালো কালো ছায়াগুলো বেরিয়ে এসে যেন বিভিন্ন অবয়ব ধারণ করে বাগানময় ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
ভোরের আলো ফুটতেই কণিষ্ক’র ঘরের দরজাতে এসে দাঁড়াল রঞ্জাবতী। জানলা দিয়ে আসা সূর্যের লালিমা এসে পড়েছে তার মুখে। রঞ্জার এই রূপ আগে কখনো দেখেনি কণিষ্ক। তার কোমর ছাপিয়ে যাওয়া চুলের রাশ যেন সাপের মতো কিলবিলিয়ে নেমে এসেছে তার রহস্যে আবৃত মুখের বেশিরভাগটাকেই ঢেকে দিয়ে। একটা টকটকে লাল রঙের শাড়ি তার ছিপছিপে শরীরটাকে আঁটে সাঁটে জড়িয়ে রেখেছে। তার চোখের দৃষ্টি কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত। বহুদিনের পরিচিত সেই প্রিয় রমণীর সামনে দাঁড়িয়ে কণিষ্ক’র শরীরটা শিউরে উঠল। কাছে এগিয়ে এল রঞ্জা। তার দেহ থেকে যেন আগুনের হল্কা বেরচ্ছে, কণিষ্ক’র শরীরেও সংক্রামিত হলো সেই তাপের আঁচ।
“আমি জানতাম তুমি আসবে, আসতে তোমাকে হতই। তোমার অপেক্ষাতেই এতদিন ধরে বসে আছি আমি তোমার আমানতকে সামলে, সে যে আমার কাছেই রয়ে গেছে। তার ভার নিয়ে তুমি আমাকে মুক্ত কর।”
ছোট একটা ছেলে এসে রঞ্জার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল কণিষ্ক। তার নিজের ছোটবেলাটা যেন এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে।
“আমার কথা তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে, সত্যকাম তোমার সন্তান। তোমার সব খবরই রাখতাম আমি। ওইসব পথ ছেড়ে দাও, এই বাড়িতে থেকে নতুন ভাবে নিজের জীবিকা শুরু কর। ছেলেটাকে মানুষ কর, পারলে ডাক্তারি পড়িও। আমার আশ্রয়দাতার প্রতি সেই হবে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।”
রঞ্জাবতীর রক্ত মাংসের শরীরটা ধীরে ধীরে বদলে গেল এক জ্যোৎস্না মাখা অবয়বে, কণিষ্ক’র চোখের সামনেই মিলিয়ে গেল সেই অগ্নিশিখার শেষ ছায়াটুকু।
সত্যকামকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার মস্তক চুম্বন করে নিজের রক্তের ঘ্রাণ নিল কণিষ্ক।
বিষয় মৌলিকত্ব | |
ভাষা সাবলীলতা | |
কৌতূহল উদ্দীপক ঘটনা প্রবাহ | |
শক্তিশালী চরিত্র চিত্রণ | |
অডিও/ভিডিও রূপান্তর যোগ্য | |
Average
|
|
![]() |