মা আর স্ত্রী মালিনীকে নিয়ে অনেকদিন পর তোতন বেড়াতে গিয়েছিলো বিষ্ণুপুর। মালিনীকে নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে? ঐযে সার্কাস থেকে উদ্ধার ক’রে এনে যে মেয়েটাকে তোতন বিয়ে করেছিলো। ঐ যে “জিঘাংসা” কাহিনী। মনে আছে তো?
মায়ের অনেকদিনের সাধ কামারপুকুর দেখবেন, জয়রামবাটি দেখবেন। ক’দিন ধ’রে নাকি ওর মা, মানে আমার জ্যেঠিমা, দিনে বা রাতে ঠাকুর রামকৃষ্ণের আর মা সারদা’র স্বপ্ন দেখছিলেন!
ওর মা সাধারণত ছেলেকে তেমন জ্বালান না। ছেলের জীবিকার গুরুত্ব বোঝেন। আর ওর স্ত্রী মালিনী? একেবারে মাটির মেয়ে। যেমন সুন্দর পুতুলের মতো দেখতে, তেমন নিরীহ। কে বলবে, ঐ মেয়ে সার্কাসের ঐসব ডানপিটে খেলা দেখাতো! ও-ও সাধারণত ওর কোনো শখ-স্বাচ্ছন্দের কথা তেমন বলে না। ‘পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য’ কথাটা না জানলেও যেন মনে মনে তা-ই মেনে ব’সে আছে।
একটা অভিজাত হোটেলে উঠেছিল ওরা। হোটেল সারদা। আমাকে বলেনি কিছু। কোনো ফোন না, কোনো হেল্প না। পারতপক্ষে এইসব ব্যাপারে আমাকে তোতন জড়ায়ও না। আমার পদাধিকার ও ব্যবহার করতেও চায় না।
হোটেলে কথা ব’লে ওদের থেকেই একটা ইনোভা গাড়ি পেয়েছে বিষ্ণুপুর ঘুরবার জন্য। এখানে বিশেষ ক’রে তোতনের দেখার মতো অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। আর ওর মা অর্থাৎ আমার জ্যেঠিমা’র শুধু রামকৃষ্ণ আর মা সারদা।
হোটেলে স্নান-টান সেরে মা আর মালিনীকে এতটা জার্নির পরে একটু বিশ্রাম করতে ব’লে তোতন একটু বেরিয়েছে “ভ্রমণসঙ্গী”র নির্দেশ মতো আশেপাশের একটা খবরাখবর নিতে, যাতে ঘুরে বেড়ানোর ছকটা বানিয়ে ফ্যালা যায়।
বিষ্ণুপুর বাঁকুড়া ডিসট্রিকের একটা বড় শহর। মায়ের যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদার প্রতি টান, তেমনি তোতনের টান বিষ্ণুপুরের ইতিহাসে আর ঐতিহ্যে। বরাবরই ও এইসবের প্রতি অবসেজড।
বিষ্ণুপুর ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, জানে তোতন। এর শুধু টেরাকোটা বা পোড়ামাটির শিল্প নয়, মল্লরাজ বংশের একটা ধারার সাথে এই স্থানের মহিমা জড়িত। একেবারে ৬৯৪ অব্দের আদিমল্ল থেকে শুরু ক’রে ১৯৩০ খৃস্টাব্দের কালীপদ সিংহ ঠাকুরের রাজত্ব পর্যন্ত এর গৌরব গাঁথা।
খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্ন পর্যন্ত প্রায় এক সহস্রাব্দ কাল বিষ্ণুপুরের ইতিহাস হিন্দু মল্ল রাজবংশের উত্থান ও পতনের সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িত।
বিষ্ণুপুর রাজাদের উৎস রহস্যাবৃত। বহু শতাব্দীকাল তাদের বাগদি রাজা ব’লে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও বিষ্ণুপুরের রাজারা আর তাদের অনুগামীরা দাবি করে যে, তারা উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভুত। বিষ্ণুপুরের রাজারা মল্লরাজা নামে পরিচিত।
“মল্ল” শব্দের অর্থ মল্লযোদ্ধা। তবে এই শব্দটির সঙ্গে এই অঞ্চলের “মাল” উপজাতির সম্পর্ক থাকাও সম্ভব। এই উপজাতির সঙ্গে বাগদিদের সম্পর্কও বিদ্যমান।
এসব বিষয়ে না মালিনী, না আমার জ্যেঠিমা— কারোরই কোনো আগ্রহ নেই। অবশ্য তোতন একা একাই এইসব এঞ্জয় করে।
হোটেল থেকে নীচে এসেই তোতন দ্যাখে চারদিক পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। ওরা চেকইন করেছে ঘন্টা দুয়েক আগে। তোতন এক পশলা স্নান সেরে বেরিয়েছে। তাই এই ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে কী ঘ’টে গ্যাছে, মালুমই হয়নি।