পাণ্ডুলিপির পুনরুদ্ধার | বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | অনির্বাণ সরকার| Bengali Detective Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলে এক টুকরো লুচি আলুর দমের সঙ্গে নিয়ে মুখে পুরতে-না পুরতেই ঋষির মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। খাওয়া থামিয়ে ফোনটা ধরে গম্ভীরস্বরে ‘বল’ বলতেই ওপার থেকে নিয়নের কান্নার সুর ভেসে এল, ‘দাদা হঠাৎ করে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কমপ্লিট সেন্সলেস! আমরা ওঁকে ই.ই.ডি.এফ্‌. নিয়ে যাচ্ছি। তুই একবারটি চলে আয় না!’

ঘটনাটা বুঝে উঠতে ঋষির ঠিক দু’সেকেন্ড লাগল, তারপরই উঠে পড়ল সে। চেঁচিয়ে মাকে বলল, ‘মা, নিয়নের ঠাকুরদা অসুস্থ, হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। আমি বের হচ্ছি।’

‘আরে, খেয়ে যা,’ ওর মা রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন, ‘সবে তো খেতে বসেছিলি! অন্ততঃ একটা লুচি গোটা খেয়ে বেরো।’

মায়ের কথায় কোনও লাভ হল না। ঋষি ততক্ষণে বাইরে গিয়ে নিজের পালসারটা স্টার্ট দেওয়ার উপক্রম করছে। বাবা দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গালে শেভিং ফোম মাখছিলেন; ঋষির গলার আওয়াজে তিনি ব্যাপারটা বুঝে আর কিছু বললেন না, শুধু হাত তুলে ছেলেকে ইশারা করে দিলেন।

দশ মিনিটে ঋষি নিয়নদের বাড়ির গেটে পৌঁছে বাইকটা স্ট্যান্ড করল। গেট খোলা, বাগানঘেরা দোতলা বাড়িটার একতলার গাড়ি-বারান্দায় একটি অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে, সদর দরজার ভিতর থেকে গোলমাল-কান্নাকাটি শোনা যাচ্ছে।

সে গেট থেকে গাড়ি-বারান্দা অবধি চওড়া ঢালাই রাস্তাটা দিয়ে প্রায় দৌড়ে বাড়ির একতলার বারান্দায় গিয়ে উঠল। আর ঠিক তক্ষুনি নিয়নের ঠাকুরদা ডঃ দেবশঙ্কর রায়কে স্ট্রেচারে শুইয়ে নিয়ে তোলা হল অ্যাম্বুলেন্সে।

ঋষি দেখল, ভদ্রলোক একেবারে কুঁকড়ে গিয়েছেন, বোধ হয় স্ট্রোক হয়েছে। ওঁকে অচৈতন্য অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় মনে হল যেন তিনি একবারটি তাঁর নাতনির দিকে তাকিয়েই আবার চোখ বুজলেন!

নিয়ন ও তার মা অঝোরে কেঁদে চলেছে, ওর বাবারও দু’চোখ ছলছল, বাড়ির কাজের লোকেরাও দুঃখিত মুখে এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। গ্রীষ্মের দাবদাহে ও দুঃখের উত্তেজনায় সকলেই ঘর্মাক্ত!

ঋষি আর নিয়নের বন্ধুত্বের সূত্রে ওর এই বাড়িতে অহরহ যাতায়াত আছে, সকলের সাথে পরিচিতি আছে, আছে বাড়ির যেকোনও জায়গায় প্রবেশের অবাধ স্বাধীনতা। স্কুল-কলেজের অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু দু’জনে। তার উপর আবার ঋষির প্রতি নিয়নের ঠাকুরদা, বাবা-মা সকলেরই একটা সস্নেহ ভালবাসার অনুভূতি আছে ওর নিজস্ব স্বভাবগুণে, যার মধ্যে ওর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তাও পড়ে।

ঋষিকে দেখে নিয়ন যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল! তার বাবা দেবব্রতবাবু ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্সে উঠে বসেছেন। ডঃ রায়কে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এবং নিয়ন ও তার মা ওদের গাড়িতে চড়ে গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঋষিও তার বাইকে চেপে চলল সবার পিছন পিছন।

ই.ই.ডি.এফ্‌. দক্ষিণ কলকাতার একটি অন্যতম প্রধান ও বিখ্যাত হাসপাতাল। সেখানকার ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করানো হল ডঃ রায়কে। দেবব্রতবাবুর এক বন্ধু এখানকার একজন প্রথিতযশা ডাক্তার, ডঃ অবিনাশ ব্যানার্জী। তিনিই ডঃ রায়কে পরীক্ষা করে বললেন যে, তাঁর অবস্থা সঙ্কটপূর্ণ হলেও মোক্ষম মুহূর্তে চিকিৎসা শুরু হওয়ায় ভয়ের বিশেষ কোনও কারণ নেই।

প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসার পর ডঃ দেবশঙ্কর রায়কে আই.সি.ইউ.-তে নিয়ে যাওয়া হল।

কিছুটা স্বস্তিতে দেখা গেল নিয়নদের, বিশেষতঃ ডঃ ব্যানার্জী ওদেরকে আশ্বস্ত করায় ওরা একটু চিন্তামুক্ত হল।

ঋষি এবার সুযোগ বুঝে নিয়নের সাথে কথা বলল, ‘দাদার কি হঠাৎই এরকমটা হল?’

এতক্ষণ পর নিয়ন নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘কাল সন্ধ্যেয় আমি কলেজ থেকে ফেরার পর থেকেই দাদার মুখটা ভার দেখছি। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেন না। শেষে ডিনারের পর আমায় একটা সীল্‌ড এনভেলপ দিয়ে বললেন, “ঋষির সাথে মিলে খুলে দেখিস।” তারপর গেলেন ঘুমোতে।

আজ সকালে প্রসাদকাকা দোতলায় দাদার ঘরে জলখাবার দিতে গিয়ে দেখে, বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন, কোনও নড়াচড়া নেই, ডাকলেও সাড়া দিচ্ছেন না! সঙ্গে সঙ্গে বাবা অবিনাশ আঙ্কেলকে ফোন করে দিল। উনি সাথে সাথে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার বন্দোবস্ত করে দিলেন। ইতিমধ্যে আমি তোকে কল করলাম।’

ঋষি ওকে অভয় দিয়ে বলল, ‘চিন্তা করিস না, দাদা ভাল হয়ে আবার বাড়ি ফিরবেন।’

হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ ভর্তি-সংক্রান্ত কাজ মিটিয়ে দেবব্রতবাবু ওদের পাশের বেঞ্চে এসে বসতেই ওঁর একটা ফোন এল, যা দেখে তাঁর মুখে চরম বিরক্তি ফুটে উঠল। ঋষি আড়চোখে দেখল তাঁকে – বোঝাই যাচ্ছে, বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছেন ভদ্রলোক। ‘আবার এই লোকটা!’ অতিক্ষীণ কণ্ঠে স্বগতোক্তি করলেন তিনি, তারপর ফোনটা ধরলেন। তাঁর উত্তর শুনে ঋষি ওপারের সাথে তাঁর কথোপকথন মোটামুটি আন্দাজ করে নিল।

ফোনের ওপারের লোকটি প্রথমেই নিয়নের ঠাকুরদার খোঁজ নিল। তিনি যে গুরুতর অসুস্থ, সেটা জানতে পেরে লোকটি দুঃখপ্রকাশ করল। এদিকে দেবব্রতবাবু আরও বিরক্ত হচ্ছেন! তারপর লোকটি বোধ হয় কোনও পুরনো কথার রেশ তুলে কিছু একটার হদিস চাইল, কারণ শেষের কথাটা তিনি বেশ রাগতঃস্বরেই বললেন, ‘ওসবের কোনও ইঙ্গিত বাবা আমাদের দেননি। এই পরিস্থিতিতে দয়া করে আর আমায় বিরক্ত করবেন না!’

ব্যাপারটা নিয়নও লক্ষ্য করেছে। ঋষিকে বাইরে আসতে ইশারা করে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে এল ই.ই.ডি.এফ্‌.-এর ক্যাফেটেরিয়ায়। ঋষির দিকে এক কাপ চা বাড়িয়ে দিয়ে নিজের কাপে চুমুক দিয়ে চারপাশে একটু সাবধানী দৃষ্টি চালিয়ে সে বলল, ‘বাবাকে ফোন করেছিলেন ডঃ তথাগত দেবশর্মা।’

ঋষির কণ্ঠে বিস্ময়, ‘অ্যাম্পিয়ার আই.এন্‌.সি.-র সি.এম্‌.ডি.? সেই ওয়ার্ল্ড ফেমাস ইঞ্জিনীয়ারিং কোম্পানী, যারা ছ’মাস আগে ন্যাশনাল গ্র্যান্ড করিডোর প্রজেক্ট কমিশনিং করল?’

‘হ্যাঁ,’ বলল নিয়ন, ‘দিল্লী-চেন্নাই এবং কলকাতা-মুম্বাই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, অর্থাৎ ফ্লাইওভার-কাম-রেলট্র্যাক।’

প্রসঙ্গে ফিরে জিজ্ঞাসা করল ঋষি, ‘তুই জানলি কী করে ?’

‘আমি জানি। আমাকে দাদা বলেছিলেন ওঁর কথা। বেশ কিছুদিন ধরেই নাকি দেবশর্মা দাদার সাথে যোগাযোগ করে কিছু একটা আদায়ের চেষ্টা করছিলেন, খুব সম্ভবতঃ দাদার কোনও একটা গবেষণাপত্র! দোলপূর্ণিমায় তিনি এসেওছিলেন আমাদের বাড়িতে। সেদিন জানলাম, ভদ্রলোক দাদার আন্ডারে রিসার্চের কাজ করতেন, যখন দাদা ন্যাশনাল টেস্ট হাউজ়ে চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজ়ার ছিলেন।’

ঋষি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘সে তো বছরদশেক আগেকার কথা! যদ্দূর জানি, তোর ঠাকুরদা তার কিছুদিন আগেই সি.পি.ডব্লিউ.ডি.-র চিফ এগজ়িকিউটিভ ইঞ্জিনীয়ার পদে রিটায়ার করেছিলেন।’

‘একদম ঠিক,’ চা শেষ করে কাপটা ওয়েস্টবিনে ফেলে দিয়ে বলল নিয়ন, ‘দাদা ছিলেন আই.ই.এস্‌. অফিসার, শিবপুর বি.ই. কলেজের সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং-এর এক্স-স্টুডেন্ট। বিল্ডিং-স্ট্রাকচারের ফাউন্ডেশন নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেছেন সারাজীবন, তার বেশকিছু ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে পাবলিশও হয়েছে!

তবে ন্যাশনাল টেস্ট হাউজ়ে থাকাকালীন তিনি রাজারহাট-নিউটাউন এলাকার মাটি নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছিলেন, যার সুবাদে ঐ অঞ্চলে হাই-রাইজ় বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন-সংক্রান্ত একটা পেপার লিখেছিলেন ; যদিও তিনি সেটা মূল্যায়নের জন্য কোথাও আর পাঠাতে পারেননি। দাদার কাছেই শুনেছি, ঐ গবেষণাপত্রের মূল পাণ্ডুলিপিটা কোনওভাবে নষ্ট হয়ে যায়!

দেবশর্মা জানতেন দাদার ঐ গবেষণার ব্যাপারটা। আমার মনে হয়, তিনি ঐ কাজেরই বিষয়ে দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। দাদাকে বুঝিয়ে সুবিধে করতে না পেরে বাবাকে ধরেছিলেন। কিন্তু বাবা অফিসের কাজ নিয়ে নিজেই এত ব্যস্ত থাকে যে দেবশর্মা কিছু লাভই করতে পারেননি!’

‘আমি বুঝতে পারছি না, দেবশর্মা তোর ঠাকুরদার গবেষণাপত্র নিয়ে কী করবেন? বিষয়টা যেহেতু তিনি জানেন, চাইলে তো নিজেই গবেষণা করতে পারেন অ্যাম্পিয়ারের নিজস্ব ফেসিলিটিতে, যা কিনা ওয়ার্ল্ডক্লাস!’

‘এ-প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই আমার কাছে,’ মাথা নেড়ে বলল নিয়ন, ‘তবে আছে একটা থিয়োরি – দেবশর্মা নিজেও একজন সিভিল ইঞ্জিনীয়ার; অতএব আমার দাদার গবেষণার খুঁটিনাটি জানতে পারলে তাঁর কাজটা অনেক সহজ হবে। নিজে মাথা খাটিয়ে আবিষ্কার করার চেয়ে অন্যের জিনিস ঝেঁপে টুকে দেওয়া এখনকার ট্র্যাডিশন।’

ওরা ক্যাফেটেরিয়া থেকে ভিজ়িটর্স্‌ লবিতে ফিরে এল।

ডঃ রায়ের অবস্থা এখন স্থিতিশীল। ডঃ ব্যানার্জী নিজেই একফাঁকে এসে সে-খবর দিয়ে গেলেন।

সকালে ব্রেকফাস্ট ঠিকমত হয়নি, তাই নিয়নের মা তাকে ঋষির সঙ্গে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। ওঁরা দু’জন আরেকবার তার ঠাকুরদার খবর নিয়ে দুপুর নাগাদ ফিরবেন।

ওদের বাড়ি ফিরতে দেখেই কাজের লোক সকলে উদ্বিগ্নচিত্তে ছুটে এল ডঃ রায়ের খোঁজ নিতে। নিয়নদের বাড়িতে লোক বলতে তার ঠাকুরদা, বাবা-মা আর সে নিজে। ঠাকুমা গত হয়েছেন বছরতিনেক আগে। এছাড়াও সবসময়ের জন্য থাকে প্রসাদকাকা। আর ঠিকে কাজের লোক হচ্ছে মিনতিমাসি, মালী ভুবনকাকা ও ড্রাইভার পুলকদা; পুলকদা এখন অবিশ্যি রয়েছে নিয়নের বাবা-মার সাথে ই.ই.ডি.এফ্‌.-এই।

জলখাবার তৈরীই ছিল, প্রসাদকাকা পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাবার টেবিলে ওদের জন্য ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে দিল। পরবর্তী দশ মিনিটে কোনও কথা না বলে ওরা খাওয়া সেরে নিল। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে ঋষি নিয়নকে বলল, ‘চল, দোতলায় তোর দাদার ঘরে যাই। ওখানেই সেই সীল্‌ড এনভেলপটা দেখব।’

নিয়নদের এই যোধপুর পার্কের বাড়ির দোতলার একেবারে দক্ষিণ কোণে ডঃ রায়ের ঘর। সামনে একফালি খোলা বারান্দা। এছাড়াও দোতলায় আরও তিনটে বড় বড় ঘর রয়েছে, যেগুলো লাইব্রেরীর মত ব্যবহার হয়, বইয়ে ঠাসা আলমারিতে বোঝাই। দক্ষিণের ঘরের লাগোয়া বারান্দা থেকে এই ঘরগুলোর মধ্যে দিয়েই সিঁড়ি অবধি যাওয়ার রাস্তা।

ওরা দু’জন ডঃ রায়ের ঘরে এসে দাঁড়াল। রুচিশীল অভিজাত উচ্চশিক্ষিত বাঙালীর ঘর, একপাশে তাঁর শোওয়ার পালঙ্ক, উল্টোদিকে পড়ার টেব্‌ল-চেয়ার, আর ঘরের অন্যপাশে পুবের জানলার সামনে তাঁর আরামকেদারা। ঘরের বাকি দেওয়ালগুলো বইয়ের আলমারিতে ভর্তি! এ-ঘর ঋষি বহুবার দেখেছে।

ঠাকুরদার ঘরে আসার সময় নিয়ন তার নিজের ঘরের পড়ার টেব্‌লের ড্রয়ার খুলে সেই সীল্‌ড এনভেলপটা হাতে করে নিয়ে এসেছিল। খামটার উপর বড় বড় হরফে বাংলায় লেখা “স্নেহাশীর্বাদ”, আর তার নীচে লেখা রয়েছে ওদের দুই বন্ধুর নাম – “মণিরত্না রায়” এবং “ঋষিরাজ দত্ত”!

মনে জমে ওঠা কৌতূহল নিয়েই এবার ওরা সেই সাদা এনভেলপটার মুখটা ছিঁড়ে ফেলল। তারপর সেটাকে উল্টো করে ধরতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটি ভাঁজ করা ফুলস্কেপ বন্ড পেপার।

নিয়ন কাগজের ভাঁজটা খুলে সেটা চোখের সামনে মেলে ধরল।

সবার শুরুতে ইংরেজিতে লেখা “আই স্ট্রংলি বিলীভ নান”, অর্থাৎ “আমি কাউকেই দৃঢ়বিশ্বাস করি না”! এই বাক্যে প্রতিটা শব্দের প্রথম অক্ষর বড় হরফে লেখা, আর “নান” শব্দটার পুরোটাই বড় হাতের অক্ষরে লেখা।

তার নীচে ইংরেজিতে একটি তেরো অঙ্কের সংখ্যা লেখা – “৯৭৮৩৫২৩০৩৩১১২”। অদ্ভুত ব্যাপার হল, সংখ্যাটির নীচে দাগ দেওয়া আছে দু’টি পাশাপাশি অঙ্ককে নিয়ে, শেষের তিনটি অঙ্ক নিয়ে একটা দাগ, অর্থাৎ ক্রমটি হল “৯৭”, “৮৩”, “৫২”, “৩০”, “৩৩” এবং “১১২”!

এর নীচে আবার সুন্দর ঝকঝকে হস্তাক্ষরে বাংলায় লেখা একটি কবিতা –

“নেতাজীর পথে আছে

আইনের গাড়ি,

নাক বরাবর পাঁচে

ভূতলের সারি।

বই থেকে বার করা

ছয় ভাই জানে –

গাড়ির দরজা পড়া

‘কী’ যে তার মানে!”

কাগজটা ঋষির হাতে দিয়ে হতাশ গলায় বলল নিয়ন, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না। দেখ, যদি তুই কিছু উদ্ধার করতে পারিস। দাদা তোকে সাথে নিয়েই খামটা খুলতে বলেছিলেন।’

সাদা কাগজে কালো কালি দিয়ে লেখা, কোনওটার সাথে কোনওটার কোনও সম্পর্ক নেই! ঋষি লেখাগুলো খুব মন দিয়ে পড়ল। তারপর কাগজটা নাকের কাছে এনে শুঁকল। সাদা কাগজের সাধারণ গন্ধ। তারপর সেটা ভাঁজ করে খামে পুড়ে নিয়নকে ফেরত দিয়ে দিল।

এরপর সে ডঃ রায়ের টেবিলে রাখা প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। ড্রয়ার খুলে তার ভিতরেও দেখল। সেখানে একতাড়া সাদা কাগজের একেবারে প্রথমটায় হাত বোলাল; এই তাড়াটার উপরে রেখেই লেখা হয়েছে এই কাগজে। শেষে তাঁর বিছানাপত্র ঘেঁটে দেখল, বইয়ের আলমারিগুলোতেও তীক্ষ্ণদৃষ্টি চালাল। কিন্তু কোত্থাও কোনও অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না তার।

নিয়ন দেখল, ঋষির ভুরু কুঁচকে গেছে, মুখ গম্ভীর। ও ঋষিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী রে, কিছু বুঝলি?’

ঋষি উত্তরে ছোট্ট করে ‘উঁহু’ বলে পাশের ঘরে চলে এল, নিয়নও এল তার পিছে এ-ঘর ভর্তি বইয়ের আলমারি, প্রতিটা আলমারি বইয়ে ঠাসা। ডঃ রায়ের সংগ্রহে এত বই যে, তিনি নিজেই একটা ব্যক্তিগত লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করতে পারেন!

ঐ ঘরেও কোনও সূত্রের সন্ধান না পেয়ে ওরা এবার পরের ঘরটায় ঢুকল। এখানেও একই চিত্র, তবে এত বইয়ের মধ্যে একটি আলমারিতে একটা নির্দিষ্ট বইয়ের দিকে ঋষির চোখ আটকে গেল।

ডঃ রায়ের আলমারিগুলি অনেক পুরনো, কাঠের তৈরী, পাল্লায় কাচ বসানো। ফলে আলমারির ভিতরে রাখা বইগুলি দেখা যায়। আলমারির তাকগুলোতে বইগুলো খাড়া করে সাজানো, প্রতিটি বইয়ের নাম ও লেখকের নাম পড়া যায় বাইরে থেকেই। বেশীরভাগ বই-ই অনেক পুরনো, হার্ড বাইন্ডিং-এ বাঁধাই করা। তবে বেশকিছু নতুন বইও আছে, যেগুলো বাঁধানো নয়।

ঋষি যে বইটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, সেটা নিয়মভঙ্গ করে উল্টোভাবে রাখা হয়েছে। বইটির পাতাগুলি দেখা যাচ্ছে, কভারটা পিছন করে আছে, ফলে নামটা দেখা যাচ্ছে না!

আলমারিগুলোতে তালা মারা নেই, কাজেই সে সটান গিয়ে পাল্লা খুলে সেই বইটা বার করে আনল।

একটা গল্পের বই, নাম “নাজেহাল”, লেখক অবিলম্ব ঘটক!

ঋষি আরও গম্ভীর হয়ে গেল, তার ভুরু আরও কুঁচকে গেল, কপালে চিন্তার গভীর ভাঁজ। বইটা উল্টেপাল্টে দেখে সে বলল, ‘নাঃ, এখানেও কিছু পেলাম না।’ তারপর সেই বইটা যথাস্থানে রেখে দিল সে।

নিয়ন কেমন একটা হতভম্ব হয়ে গেছে। অবাক কণ্ঠে বলল সে, ‘দাদা অবিলম্ব ঘটকের লেখা কবে থেকে পড়তে আরম্ভ করলেন? আমি তো জানি উনি মনীষী-সাহিত্যিকদের লেখাই বেশী পড়েন। এছাড়াও অন্যান্য প্রখ্যাত লেখক-লেখিকাদের বইও পড়েন। আর তাছাড়া, ওঁর আসল পড়াশুনা তো সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং নিয়ে!’

তৃতীয় ঘরেও সন্দেহভাজন কিছু না পেয়ে ওরা শেষে একরকম বিফল হয়েই একতলায় নেমে এল।

প্রসাদকাকা বৈঠকখানায় আসবাবপত্র মোছামুছি করছিল। ঋষি নরম সুরে ওকে জিজ্ঞাসা করল, ‘দাদার ঘরে সকালে জলখাবার দিতে গিয়ে কী দেখলে?’

প্রসাদকাকা মুখ ব্যাজার করে দুঃখিত কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘কাকাবাবু সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ-হাত ধুয়ে লেখাপড়া করতে বসেন। আমি অন্যান্য দিনের মতই আজও আটটা নাগাদ গিয়েছিলাম ওঁকে জলখাবার দিতে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি, দরজা ভেজানো, তলার ফাঁক দিয়ে টিউবলাইটের আলো দেখা যাচ্ছে! আমার ব্যাপারটা সুবিধার মনে হল না, এরকমটা আজ পর্যন্ত কখনও হয়নি। শেষে দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি, কাকাবাবু বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন! আমি তক্ষুনি দাদাবাবুকে হাঁক দিই।’

‘দাদাকে কী অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেছিলে মনে আছে?’

প্রসাদকাকা একটু ভেবে বলল, ‘আমি দেখলাম, কাকাবাবুর শরীরটা একদম স্থির, বাঁ হাতটা কনুই থেকে ভাঁজ হয়ে বুকের কাছে চলে গেছে, আর…’

‘আর…? আর কী, বলো প্রসাদকাকা!’

শেষের কথাটা বলল নিয়ন, তার গলায় উদ্বেগের সুর।

‘আর ডানহাতে ধরা ওঁর মোবাইল ফোনটা’, চোখ বড় বড় করে জবাব দিল প্রসাদকাকা।

এটা একটা নতুন তথ্য। ঋষি ধীরকণ্ঠে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘সেই মোবাইলটা কোথায় বলতে পারবে?’

প্রসাদকাকা বলল, ‘আমি তো জানি না! কাকাবাবুকে ঐভাবে পড়ে থাকতে দেখে আমি সঙ্গে সঙ্গে দাদাবাবুকে ডাক দিই।’ একটু থেমে সে আবার বলল, ‘মনে হয়, দাদাবাবুর কাছেই আছে।’

ঋষি নিয়নের দিকে তাকাল। নিয়ন বলল, ‘দেখছি বাবাকে জিজ্ঞেস করে।’

আধঘণ্টা পর দেবব্রতবাবুকে ফোনে ধরা গেল। তিনি ও নিয়নের মা আই.সি.ইউ.-তে ছিলেন, তাই ফোন ধরেননি ওঁরা। ডঃ রায়ের মোবাইল ফোনটা ওঁদের কাছেই আছে। ওঁরা আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বাড়ি ফিরবেন, তখনই নিয়ন তার ঠাকুরদার ফোনটা হাতে পাবে।

ঋষি ইতিমধ্যে বাগানে গিয়ে একটা বড় আমগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। বাগানের অন্যদিকটায় ভুবনকাকা গাছে জল দিচ্ছে। ভারী সুন্দর সাজানো-গোছানো বাগান, দেশী-বিদেশী ফুল-ফলের গাছে ভর্তি! নানারকম পাখিও চোখে পড়ে বাগানের আনাচে-কানাচে। আর গাছের ডালে-ডালে দৌড়ে বেড়ায় কাঠবিড়ালী। মে মাসের এক সকালে এই মনোরম বাগানে গাছের নীচে দাঁড়াতে ওর বেশ লাগছে!

এতক্ষণ ধরে ঋষি ডঃ রায়ের কাগজের লেখাটার মানে উদ্ধার করার চেষ্টা করছিল। বাবার সঙ্গে কথা সেরে নিয়ন বাগানে এসে দাঁড়াতেই সে ওকে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল, ‘মেয়েদের ইনস্টিঙ্কট খুব জোরালো হয় শুনেছি। তুই বল তো, তোর দাদা ঐ কাগজে কী লিখেছেন?’

‘এই মুহূর্তে আমার কোনও ইনস্টিঙ্কটই কাজ করছে না,’ জবাব দিল নিয়ন, ‘তুই-ই বল না!’

‘আমার মনে হয়,’ আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলল ঋষি, ‘লেখাগুলো কিছু একটার সংকেত, একটা ধাঁধা!’

‘বলিস কী! গুপ্তধনের সংকেত?’ ভীষণ উদ্দীপিত হয়ে জিজ্ঞেস করল নিয়ন।

‘সেটা বলা মুশকিল। গুপ্তধন বলতে অনেক কিছু বোঝায়, শুধু টাকা-পয়সা হীরে-জহরত নয়। তোর দাদা কী এমন জিনিস সংকেতের মাধ্যমে লুকিয়ে রাখতে পারেন, সেটা তোরাই ভাল বলতে পারবি।’

‘মানে উদ্ধার করতে পারলি?’ নিয়নের গলায় কৌতূহলের সুর।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিল ঋষি, ‘শুধু ধারণাটাই এসেছে এতক্ষণে, আর কিছুর সূত্রই তো মাথায় আসছে না!’

তারপর সে স্বগতোক্তির মত বলতে থাকল, ‘ডঃ রায় কাউকে বিশ্বাস করেন না কেন? তেরো অঙ্কের সংখ্যাটা কীসের? অঙ্কগুলোর নীচে ওভাবে দাগ দেওয়ারই বা কী মানে? কবিতাটাই বা কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?’

‘তুই কি কোনও রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিস নাকি?’ ঋষির হাবভাব দেখে সন্দিগ্ধকণ্ঠে প্রশ্ন করল নিয়ন।

ঋষি বলল, ‘রহস্য তো রয়েইছে, একটা নয়, অনেকগুলো!’

‘যেমন?’

‘প্রথমতঃ,’ বিজ্ঞের মত বলল ঋষি, ‘তোর ঠাকুরদার এতদিনের পুরনো গবেষণা নিয়ে দেবশর্মা এখন হঠাৎ পড়েছেন কেন, যখন তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তির কোনও অভাব নেই? দ্বিতীয়তঃ, পাণ্ডুলিপি যদি নষ্টই হয়ে গিয়ে থাকে, তা’হলে দেবশর্মা কী আদায় করার চেষ্টা করছেন ওঁর থেকে? তৃতীয়তঃ, ঠাকুরদার লেখা সংকেতগুলো কীসের খোঁজ দেবে? চতুর্থতঃ, সে-জিনিস কেন এত গোপনীয় যে, এমন একটা কঠিন ব্যবস্থা করতে হল সেটা লুকনোর জন্য?’

নিয়ন আর থাকতে না পেরে বলে উঠল, ‘তুই থাম এবার; যা লম্বা রহস্যের লিস্ট বললি, এর কিনারা করতে তো ফেলুদা বা ব্যোমকেশকে লাগবে!’

‘আমরাই পারব,’ দৃঢ়স্বরে বলল ঋষি, ‘যদি তোর কাছ থেকে কয়েকটা ইনফর্মেশন পেয়ে যাই।’

‘বেশ, কী জানতে চাস, বল।’ মাথার এলোমেলো চুলের গোছা বেঁধে নিয়ে তৈরী হল নিয়ন।

‘ন্যাশনাল টেস্ট হাউজ় থেকে অবসর নেওয়ার পর তোর দাদা কি এ-ক’বছরের মধ্যে তাঁর গবেষণা-সংক্রান্ত ঐ পাণ্ডুলিপিটা সম্পর্কে কখনও কিছু বলেছিলেন?’ জিজ্ঞাসা করল ঋষি।

একটু ভেবে নিয়ন বলল, ‘এ-ক’বছরে দাদার মুখে বেশ কয়েকবার আক্ষেপ শুনেছি ঐ পাণ্ডুলিপিটাকে নিয়ে, বলতেন, “দেবশর্মা আর কিছুদিন সাথে থাকলে ওটা মূল্যায়নের জন্য সি.এস্‌.আই.আর.-এ পাঠানো যেত! ও যে হঠাৎ এমনটা করবে, সেটা ভাবতেও পারিনি।” আসলে ঐ গবেষণাটা ছিল দাদার টানা পাঁচ বছরের অক্লান্ত সাধনা, আর তারই ফল ছিল ঐ পাণ্ডুলিপি।’

ঋষি হাতের সিগারেটে একটা শেষ টান দিয়ে সেটা অবহেলায় বাগানের বাইরে পাঁচিলের ওপারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিয়নকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর দাদা আর দেবশর্মার মধ্যে সমীকরণটা কীরকম ছিল বলতে পারবি?’

উত্তরে নিয়ন বলল, ‘দাদা সি.পি.ডব্লিউ.ডি. থেকে রিটায়ার করার বছরদুয়েক পরে ন্যাশনাল টেস্ট হাউজ় জয়েন করেছিলেন, আম্মা মারা যাওয়ার পর সেখান থেকেও অবসর নেন। দেবশর্মা সেখানে দাদার অধীনে সিনিয়র সায়েনটিস্ট ছিলেন, পাঁচ বছর ওঁরা একসাথে কাজ করেছিলেন। দাদার প্রতিটি গবেষণার সঙ্গী ও অংশীদার ছিলেন তিনি। দাদা নিজের গবেষণার তথ্যাদি ডায়রিতে খসড়া-আকারে লিখে রাখতেন, তারপর দেবশর্মা সেসব তত্ত্ব, তথ্য ও ফলাফল সুসংহতভাবে লিপিবদ্ধ করে তৈরী করতেন প্রধান পাণ্ডুলিপি।

কিন্তু আকস্মিকভাবে দাদার গবেষণা সম্পূর্ণ হওয়ার পরই তিনি ন্যাশনাল টেস্ট হাউজ় ছেড়ে অ্যাম্পিয়ার আই.এন্‌.সি.-তে চিফ ইঞ্জিনীয়ার পদে জয়েন করলেন! দাদা দেবশর্মার এহেন আচরণে মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ ও আহত হয়েছিলেন; তাঁর এই ধারণা হল যে, টাকার লোভে তিনি এত বড় ও জরুরী গবেষণা মাঝপথে ফেলে চলে গেলেন!’

একটু থেমে নিয়ন আবার বলতে আরম্ভ করল, ‘দাদা ন্যাশনাল টেস্ট হাউজ়ে আরও তিন বছর ছিলেন, তারপর ছেড়ে দিলেন। এরপর থেকে তিনি বাড়িতেই নিজের লেখাপড়া নিয়ে থাকতেন।

এ-ক’বছরে দেবশর্মা দাদার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেননি। দাদা কিন্তু ওঁর সম্পর্কে প্রতিটা খবর পড়তেন, যা যা বেরত মিডিয়ায়, সব! ন্যাশনাল গ্র্যান্ড করিডোর তৈরী হল, অ্যাম্পিয়ার আই.এন্‌.সি. হু-হু করে আকাশ ছুঁয়ে ফেলল, সেইসঙ্গে ডঃ তথাগত দেবশর্মা অ্যাম্পিয়ারের চিফ ম্যানেজিং ডিরেক্টর হওয়ার সাথে সাথে প্রত্যেক ভারতবাসীর ঘরের লোক হয়ে গেলেন।’

কথা বলতে বলতেই এবার ওরা হাঁটতে আরম্ভ করল মূল বাড়িটার দিকে। ঋষি জিজ্ঞাসা করল, ‘দেবশর্মা দোলপূর্ণিমায় তোদের বাড়ি এসেছিলেন, বললি না? সেদিন তোর দাদার সাথে ওঁর কী নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, জানিস?’

‘সেদিন সত্যিই অবাক কাণ্ড,’ বলল নিয়ন, ‘হঠাৎ দেবশর্মা এসে হাজির আমাদের বাড়িতে! আমরা তো সকলেই বিস্মিত। তবে তিনি একাই এসেছিলেন, সেদিন তাঁর সাথে গাড়ির কনভয় ছিল না। এসেই দাদার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললেন, “স্যার, আমি আবার আপনার দ্বারস্থ হয়েছি; আপনার আশীর্বাদ পেলে একটা পুরনো কাজ সম্পূর্ণ করতে পারব।” এরপর তিনি অতীতের কথা তুলে দাদার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ পাঁচ বছরের সাহচর্য, রাজারহাট অঞ্চলের মাটি ও হাই-রাইজ় বিল্ডিং-এর ফাউন্ডেশন নিয়ে ওঁদের যৌথ গবেষণা, দাদার পাণ্ডুলিপি – এসব নিয়ে অনেক কথাই বললেন।

শেষমেশ দাদা কঠিন স্বরে দেবশর্মাকে জিজ্ঞেস করলেন তাঁর এতদিন বাদে আসার উদ্দেশ্য। ভদ্রলোক দাদার গবেষণা-সংক্রান্ত অনেক তথ্য জানালেন। শেষে বললেন, তাঁর কোনও অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে তিনি নিজেই সেই গবেষণা নতুনভাবে শুরু করে তা নিজের নামে প্রকাশ করতে পারতেন; আসলে তিনি এসেছেন দাদাকে কনভিন্স্‌ করে তাঁর গবেষণার পাণ্ডুলিপি পুনরুদ্ধার করতে।’

‘তোর দাদা রাজি হলেন?’

‘একেবারেই না! দাদা প্রথমেই বলে দিলেন যে সেই গবেষণার সমস্ত খসড়া ও পাণ্ডুলিপি হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে গেছে। দেবশর্মা বিশ্বাস করলেন না সে-কথা, বললেন, যে ডঃ রায় একটা অতিক্ষুদ্র নগণ্য তথ্যও সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখতেন, যদি কোনওদিন হঠাৎ কাজে এসে যায় – এই ভেবে, তাঁরই গবেষণার কাগজপত্র হারিয়ে গেছে কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে, এ হতে পারে না! কিন্তু দাদা নিজের কথায় অনড় ; তিনি ওঁর সঙ্গে তাঁর গবেষণা-সংক্রান্ত কোনও কথা আলোচনা করতে নারাজ। অবশেষে একরকম বাধ্য হয়েই দেবশর্মাকে হাল ছাড়তে হল।’

ঋষি মন্তব্য করল, ‘ওঁরা ওঁদের গবেষণার সেই পাণ্ডুলিপি নিশ্চয়ই কম্পিউটারে লিখেছিলেন। সে-লেখা আর অন্যান্য ডেটা সেই সফ্‌টকপি থেকেও তো উদ্ধার করা যায়!’

নিয়ন বলল, ‘দাদার সমস্ত গবেষণার ডেটা ওঁর ল্যাবের কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কে স্টোরড ছিল ঠিকই, কিন্তু মূল্যায়ন বা প্রকাশিত হয়নি জন্য সেসব দাদার রিটায়ারমেন্টের পরই ডিলিট করে দেওয়া হয়! দাদা একবার খোঁজও নিয়েছিলেন এ-ব্যাপারে, আর ঐ কাণ্ড জানতে পেরে যার-পর-নাই রুষ্ট হয়েছিলেন।’

একটু থেমে সে আবার বলল, ‘দাদার কথায় একটা জিনিস বুঝেছি, উনি দেবশর্মাকে নিজের ছাত্রের মতই স্নেহ করতেন। আর আমার বিশ্বাস, দেবশর্মাও দাদাকে গুরু হিসেবে শ্রদ্ধা করেন।’

কথার ফাঁকে ওরা বারান্দা পেরিয়ে বৈঠকখানায় এসে ঢুকল। এরপর নিয়ন ঋষিকে তার ঠাকুরদার গবেষণার তত্ত্বটি সংক্ষেপে শোনাল – ডঃ দেবশঙ্কর রায় রাজারহাটের কিছু নির্দিষ্ট এলাকার মাটি নিয়ে গবেষণা করে বুঝেছিলেন, ঐ মাটির হাই-রাইজ় বিল্ডিং বা উঁচু ইমারতের ভিত ধরে রাখার ক্ষমতা নেই। সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং-এর পরিভাষায় বলা যায়, সেই মাটির স্তরের শিয়ার স্ট্রেংথ খুবই কম। এরফলে ঐ মাটিতে উঁচু ইমারত বানালে সামান্য ভূমিকম্পেও তা ধসে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে!

সেই সমস্যার চমৎকার এক সমাধান আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। উঁচু ইমারতের ভিতের গড়ন ও গঠন হবে এমন, যা সেই মাটিতে একরকম ভাসমান অবস্থায় থাকবে – জাহাজ যেমন করে জলে ভাসে! ইমারতের প্রত্যেকটা সংযোগস্থল করতে হবে নমনীয় ও নিরপেক্ষ। আবার ভূমিকম্পের সময় ইমারত যাতে স্থানচ্যুত না হয়, তার জন্য উপযুক্ত বাফারের আয়োজন করতে হবে। গ্রীক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের তত্ত্ব এবং উনিশ শতকের মার্কিন স্থপতি জন ওয়েলবর্ন রুটের “ফ্লোটিং ফাউন্ডেশন”-এর ধারণার উপর ভিত্তি করে তাঁর এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী!

সেই গবেষণার তত্ত্ব, তথ্য ও ফলাফল এবং ঐ নতুন ধরনের ভিত তৈরী করার পদ্ধতির বিবরণ একত্র করে ডঃ তথাগত দেবশর্মা তৈরী করেছিলেন একটি মহাকাব্যসম পাণ্ডুলিপি, এবং দু’জনে মিলে সেটার নাম দিয়েছিলেন “থিয়োরি ওয়ান (ও.এন্‌.ই.) – অপটিমাম নিউট্রালাইজ়ড ইক্যুইলিব্রিয়াম অফ্‌ রাজারহাট সয়েল”। পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ হয়েছিল ছয় বছর আগে।

নিয়নের কথা খুব মন দিয়ে শুনল ঋষি, সেইসঙ্গে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ঘেঁটে এ-বিষয়ে যা যা তথ্য আছে, পড়ে নিল; যদিও ইন্টারনেটে “থিয়োরি ওয়ান” বলে ঐ জাতীয় কিছু পাওয়া গেল না।

এইসময় নিয়নের বাবা-মা বাড়ি ফিরলেন। ওঁদের কাছে জানা গেল, ডঃ রায়ের মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছিল, তবে তিনি এখন বিপন্মুক্ত। ই.ই.ডি.এফ্‌.-এ আগামীকাল পর্যন্ত তাঁকে আই.সি.ইউ.-তেই পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তারপর অবস্থার আরও উন্নতি হলে সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে এইচ্‌.ডি.ইউ. এবং জেনারেল ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হবে, শেষে ডিসচার্জ। সবশুদ্ধ দিনপাঁচেকের ব্যাপার।

সবার মনের দুশ্চিন্তা ও আশঙ্কা কেটে গিয়ে একটা খুশী-খুশী ভাব! ডঃ রায়ের বয়স হয়েছে তিয়াত্তর, এ-বয়সে হঠাৎ ওরকম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দেবব্রতবাবু সবকিছুর জন্য দেবশর্মাকেই দায়ী করলেন – ‘লোকটা বাবাকে বড্ড ডিস্টার্ব করেছে। বাবার গবেষণার পাণ্ডুলিপি যে নষ্ট হয়ে গেছে, সে-কথা বিশ্বাসই করতে চায় না! এতবার সেটা জানানো সত্ত্বেও ও সমানে বাবার পিছনে লেগে ছিল ওটা নিয়ে। আমি তো ওর আস্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত!’

ঋষি এতক্ষণ গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল। এবার সে মুখ খুলল, ‘কাকু, দেবশর্মা সম্ভবতঃ ঠিকই বলছেন। দাদা তাঁর সেই গবেষণার অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন।’

‘বলিস কী?’ ভদ্রলোক আশ্চর্য হয়ে গেলেন, ‘তা’হলে বাবা এতদিন যা বলে এসেছেন, সেটা কি সত্যি নয়?’

এরপর তিনি নিয়নের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। নিয়ন বাবাকে গোটা বিষয়টা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিল, সেইসঙ্গে সকাল থেকে ওদের অনুসন্ধানের কাহিনীও তাঁকে জানাল। তারপর ঠাকুরদার দেওয়া সেই সাদা খাম থেকে সংকেতের কাগজটা বের করে দেখাল তাঁকে।

সংকেতগুলো বারংবার পড়েও দেবব্রতবাবু সেগুলোর মানে খুঁজে পেলেন না, তবে একটা মন্তব্য করলেন, যেটা ঋষির মনে খটকার উদ্রেক করে দিল – ‘নিয়ন, বাবা তো তোকে ভীষণ বিশ্বাস করেন বলে জানি!’

নিয়ন সে-কথার কোনও উত্তর না দিয়ে তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তুমি জানো, দাদা কোথায় সেই পাণ্ডুলিপি গুপ্তধনের মত লুকিয়ে রাখতে পারেন?’

খানিক চিন্তা করে দেবব্রতবাবু উত্তর দিলেন, ‘না, সেরকম কোনও জায়গার কথা তো জানা নেই! বাবার পড়ার ঘর বা লাইব্রেরীতে থাকলে তো তুই-ই জানতিস।’

‘একটা কথা কি তুমি জানো, বাবা – দাদা কাল সন্ধ্যে থেকেই খুব গম্ভীর ও চিন্তামগ্ন ছিলেন?’

‘তাই বুঝি,’ দেবব্রতবাবু গম্ভীরমুখে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়েই বললেন, ‘ওঃ, এটার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম।’

নিজের পকেট থেকে নিয়নের ঠাকুরদার মোবাইল ফোনটা বের করে ওদের হাতে দিয়ে উৎফুল্লকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘তোরা যা বলছিস, তা সত্যি হলে বাবার সেই অপ্রকাশিত গবেষণার খোঁজ পাওয়া যাবে। নিঃসন্দেহে সেটা হবে আধুনিক সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং-এর সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার!’

ঋষি ইতিমধ্যে ডঃ রায়ের মোবাইল ফোনটা ঘাঁটতে শুরু করে দিয়েছে।

প্রথমেই সে ফোনের কললিস্ট খুলে দেখল। দেবশর্মা আজ সকাল পৌনে আটটা নাগাদ ডঃ রায়কে ফোন করেছিলেন, কথা হয়েছে এক মিনিট সতের সেকেন্ড। পরবর্তী কল ন’টা চব্বিশে, ওরা তখন ই.ই.ডি.এফ্‌.-এ, এবং এই কলটা দেবব্রতবাবু ধরেছিলেন। আজকের কললিস্টে এছাড়া আর কোনও নাম নেই।

তবে দেখা যাচ্ছে, গতকাল বিকেল পাঁচটা নাগাদ দেবশর্মা ডঃ রায়কে ফোন করেছিলেন, এবং প্রায় ন’মিনিট কথা হয়েছিল।

এরপর সে একে-একে ফোনের মেলবক্স, মেসেজ, হোয়াটস্‌ অ্যাপ খুলল। সবই সাধারণ ই-মেল আর মেসেজ, অধিকাংশই প্রমোশনাল কিংবা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বিষয়ক। হোয়াটস্‌ অ্যাপেও উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া গেল না। এছাড়া ফোনের ক্যামেরায় রয়েছে বাড়ির বাগান ও শহর কলকাতার কিছু ছবি, আর ওঁদের পারিবারিক ছবি।

ঋষি ওদের দু’জনকে ফোনের কললিস্ট দেখিয়ে বলল, ‘দাদার সাথে কাল বিকেলে এবং আজ সকালেও দেবশর্মার কথা হয়েছে। কাল সন্ধ্যে থেকে দাদার মুখ ভার, আর আজ সকালের কথাবার্তার পরেই ওঁর স্ট্রোকটা হয়! সুতরাং, এই দু’বেলায় এত কম সময়ের ব্যবধানে ওঁদের মধ্যে কী কথোপকথন হয়েছিল, সেটা জানা গেলে অনেকটা এগোন যেতে পারে এ-ব্যাপারে।’

নিয়ন বলল, ‘এই মুহূর্তে সেটার তো একটাই উপায়, দেবশর্মাকে সরাসরি ফোন করে জিজ্ঞেস করা।’

‘তিনি কি অত সহজে আদৌ বলবেন সবকিছু?’ ঋষির গলায় সন্দেহের সুর। একটু ভেবে সে আবার বলল, ‘তবে, যদি ভদ্রলোককে এটা বোঝানো যায় যে, পাণ্ডুলিপির একটা সম্ভাব্য ঠিকানা পাওয়া গেছে, তা’হলে হয়ত ওটা পাওয়ার আশায় তিনি তাঁদের ভিতরকার কথাবার্তা জানাতে পারেন।’

দেবব্রতবাবু স্মিতহাস্যমুখে ঋষিকে দেখছিলেন। এবার তিনি তার প্রশংসায় মুখ খুললেন, ‘ঋষি, তোর মধ্যে একজন পাকা গোয়েন্দার লক্ষণগুলো প্রকাশ পাচ্ছে।’ তারপর ওকে বাহবা দিয়ে বলে উঠলেন, ‘গুড আইডিয়া! আর, দেবশর্মাকে ফোন করার দায়িত্বটা নিলাম আমি। বাবাকে বিরক্ত করার শোধ তুলতেই হবে।’

বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে। সূর্য যত মধ্যগগনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, ততই তাপমাত্রা বাড়ছে, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গরমের ভ্যাপসা ভাবটাও বেড়ে চলেছে! বৈঠকখানায় এ.সি. নেই, কাজেই এই অসহ্য গরমে আর থাকতে না পেরে ওরা তিনজন দোতলায় ডঃ রায়ের ঘরে এসে সেখানকার এ.সি. চালিয়ে দিয়ে বসল।

দেবব্রতবাবু নিজের ফোন থেকেই দেবশর্মাকে ফোন করে ফোনটা লাউডস্পিকারে দিলেন।

ফোন রিসিভ করে নম্রভাবে দেবশর্মা বললেন, ‘বলুন, মিস্টার রায়।’

দেবব্রতবাবু বললেন, ‘আপনি বাবার গবেষণার যে পাণ্ডুলিপিটার খোঁজ করছিলেন, সেটার বোধ হয় একটা সন্ধান পেয়েছি।’

‘আগে বলুন, স্যার কেমন আছেন? কী হয়েছে ওঁর?’

‘বাবা এখন ভালই আছেন, তবে কাল অবধি আই.সি.ইউ.-তেই অবজ়ারভেশনে রাখা হবে ওঁকে। তারপর শারীরিক অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাইল্ড স্ট্রোক হলেও, এই বয়সে তার ধকল অনেকটাই পড়ে শরীরের উপর।’

‘তা ঠিক,’ ফোনের ওপার থেকে বললেন দেবশর্মা, ‘স্যার যে এখন বিপদের বাইরে, এই ভাল খবরটা শুনে শান্তি পেলাম।’

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ‘স্যারকে আজ সকালে ফোন করেছিলাম এটা জানানোর জন্য যে, আমি কাল ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব। আজ সন্ধ্যের ফ্লাইটেই দিল্লী থেকে কলকাতা ফিরছি আমি। কিন্তু হঠাৎ এরকমটা হবে ভাবতেই পারিনি! ভিজ়িটিং আওয়ার্সে আগামীকাল আমি যাব ওঁকে দেখতে। আপনারাও সাবধানে থাকবেন, দুশ্চিন্তা করবেন না। আর, কোনওকিছুর প্রয়োজন হলে জানাতে দ্বিধা করবেন না।’

ঋষির মুখে চিন্তার ছাপ, চোখদু’টো সরু, ভাব-ভঙ্গিতে উৎকণ্ঠা।

আবার একটা বিরতি নিয়ে বললেন দেবশর্মা, ‘স্যারের সঙ্গে গতকাল বিকেলে যখন আমার ফোনে কথা হয়, তখনই তিনি আমাকে একটা আভাস দিয়েছিলেন, “থিয়োরি ওয়ান”-এর পাণ্ডুলিপিটা এখনও ওঁর কাছে আছে! আমি তো নিশ্চিত ছিলাম, ওটা ওঁর কাছে থাকবেই। এত যত্নশীল মানুষের কাছে কোনও জিনিস হারায় নাকি?’

দেবব্রতবাবু বোকার মত মুখ করে ঋষি-নিয়নের দিকে তাকালেন। ওরা দু’জনও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। যেগুলো জানার জন্য এত বুদ্ধি খাটিয়ে এই ফোন-কল, দেবশর্মা নিজে থেকেই সেসব বলে দিলেন!

‘বাবা আপনাকে কী আভাস দিয়েছিলেন?’ অবাককণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন দেবব্রতবাবু।

ফোনের ওপারে অখণ্ড নৈঃশব্দ্য। বোঝাই যাচ্ছে, দেবশর্মা সাউন্ড-প্রুফ ঘরে বসে আছেন। এদিকে ওঁর জবাব শোনার জন্য এপারে ওরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

মিনিটখানেক পর নীরবতা ভাঙলেন তিনি, ‘আমি গবেষণা অসম্পূর্ণ রেখে যাওয়ার জন্য স্যারের কাছে এতদিন পর মার্জনা-ভিক্ষা চাইলাম। তিনি আমাকে ক্ষমাও করে দিলেন! ছ’বছরের অভিমান ভাঙল এতদিনে। পাণ্ডুলিপির কথা বলাতে উনি এবার আর রেগে যাননি, বরং শান্তস্বরেই বললেন, “তোমায় ক্ষমা করলেও এখন আর আমি তোমায় বিশ্বাস করি না। তবে ঐ পাণ্ডুলিপিটার পিছনে তোমার পরিশ্রমের কথা বিবেচনা করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” এর বেশী আর কিছু তিনি বলেননি আমায়। আমারও আর সাহস হয়নি জিজ্ঞেস করার।’

নিয়ন উৎফুল্ল হয়ে উঠে চাপাগলায় বলল, ‘ইউরেকা! দাদার পাণ্ডুলিপি এখনও আছে।’

ফোনের ওপার থেকে আবার দেবশর্মার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘এনিওয়ে, আগে স্যার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠুন, তারপর ওসব নিয়ে ভাবা যাবে।’

দেবব্রতবাবু ইতি টানলেন, ‘ও.কে. ডঃ দেবশর্মা, কাল আসুন ই.ই.ডি.এফ্‌.-এ, সেখানেই বাকি কথা হবে।’

ফোনটা কেটে গেল।

‘তা’হলে জানা গেল,’ বলল ঋষি, ‘দাদার ছ’বছর পুরনো গবেষণাপত্র “থিয়োরি ওয়ান”-এর পাণ্ডুলিপিই হল সেই গুপ্তধন, যা এই সংকেতের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছেন তিনি। এছাড়াও আরও যা যা জানা গেল, সেগুলো একটা কাগজে লিখে নেওয়া যাক।’

ডঃ রায়ের টেবিলের ড্রয়ারের সেই সাদা কাগজের তাড়াটা থেকে একটা পৃষ্ঠা নিয়ে সেটায় সমস্ত তথ্যগুলো লিখে নিল ঋষি। ওঁর সংকেতের কাগজটার একটা ছবি সে আগেই তুলে নিয়েছে তার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায়। এবার সে দ্রুত তার জায়গা ছেড়ে উঠে রায়বাড়ি থেকে বিদায় নিল।

নিয়নদের বাড়ি থেকে ঋষিদের যাদবপুরের বাড়ি আসতে ওর সময় লাগল ঠিক পনের মিনিট। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। ঘরে ঢুকতেই মা ওকে স্নান-খাওয়া সেরে নিতে বললেন। বাবা অফিস গেছেন, ফিরবেন রাত আটটায়।

সিটি কলেজের বি.এস্‌.সি. ফিজ়িক্স সেকেন্ড ইয়ারের সেকেন্ড সেমেস্টার শেষে এখন ওর হাতে অঢেল সময়। সারাদিন বই পড়েই কেটে যায়। সবধরনের বই পড়ে ঋষি – প্রেমের উপন্যাস থেকে ভূগোল-ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে কল্পবিজ্ঞান, রামায়ণ-মহাভারত থেকে রান্নার বই – কোনওকিছু বাদ দেয় না! ফলে মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই সে হয়ে উঠেছে অফুরন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার। নিয়ন তাকে বলে, এত পড়াশুনা যদি সে নিজের বিষয়ে করত, তা’হলে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির গোল্ড মেডেল কেউ আটকাতে পারত না!

আর তর সইছিল না ঋষির। তড়িঘড়ি স্নান-খাওয়া সেরে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে মোবাইল ফোন সাইলেন্ট মোডে দিয়ে নিয়নদের বাড়ি থেকে আনা কাগজটা নিয়ে বসল সে। কাগজে লেখা প্রতিটা কথা বার বার মন দিয়ে পড়ল। তারপর ঐ কাগজেরই উল্টো পৃষ্ঠায় ঘটনাগুলো পর পর সাজাল, সংক্ষেপে সেগুলোর ব্যাখ্যা লিখল, একটার সাথে অন্যটার যোগসূত্র বানাল। সবশেষে নিয়নের ঠাকুরদার লেখা সংকেতগুলি সমাধান করার চেষ্টা করল, এবং তারজন্য মাঝে মাঝে ইন্টারনেট ঘেঁটে নিজের মনে জেগে ওঠা প্রশ্নের উত্তর খুঁজল। এইভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে, এবং সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নেমে এল।

রাত সাড়ে আটটা নাগাদ নিয়নের ফোন এল, ‘কীরে, কিছু উদ্ধার করতে পারলি? বাবা-মা তো চোখ বন্ধ করে তোর উপর ভরসা রেখে যেন বাজি ধরেছে, দাদার পাণ্ডুলিপি তুই-ই খুঁজে বের করতে পারবি!’

‘একদম,’ বলল ঋষি, ‘সংকেতের সমাধান হয়ে গেছে, কেবলমাত্র ছোট্ট কয়েকটা ক্লু বাকি।’

‘তাই নাকি,’ নিয়নের গলায় আনন্দের সুর, ‘সমাধানটা বলবি না?’

‘ধৈর্য, বন্ধু, ধৈর্য,’ মজার সুরে বলল ঋষি, ‘কাল সকালে তোদের ওখানে আসছি ন’টায়। ব্রেকফাস্ট করে আরও একবার তোর দাদার লাইব্রেরীতে ঢুঁ মারব। আশা করি ব্যর্থ হব না। তারপর ই.ই.ডি.এফ্‌.-এ তোর দাদাকে দেখে তোকে সাথে নিয়ে যাব সি.এস্‌.ডি.-তে।’

নিয়ন অবাককণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘সি.এস্‌.ডি.-টা আবার কী?’

‘সেটা কালই জানতে পারবি। গুড নাইট।’ ফোনটা কেটে দিল ঋষি।

* * *

পরদিন সকাল ন’টায় কথামত ঋষি গিয়ে উপস্থিত হল নিয়নদের বাড়িতে। নিয়ন তৈরী হয়েই ছিল। দু’জনে ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে গেল তাড়াতাড়ি।

খেতে খেতেই নিয়ন বলল, ‘এবার বল সব, আর সাসপেন্স্‌ বাড়াস না!’

এগ-টোস্টে একটা পেল্লায় কামড় বসিয়ে চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করল ঋষি, ‘তার আগে তুই বল, “নান” মানে কী?’

‘“নান” মানে “কাউকে নয়”, “নোবডি”,’ বিরক্তির সঙ্গে উত্তর দিল নিয়ন।

‘উঁহু, হল না,’ বলল ঋষি, ‘“নান” মানে তুই, “নিয়ন”– এন্‌.ই.ও.এন্‌.; এন্‌.ও.এন্‌.ই.-কে সাজিয়ে লিখলে দাঁড়ায় সেটা। ‘

ডাইনিং হলে এইসময় নিয়নের বাবা-মা এসে দাঁড়িয়েছেন। ওঁরাও সাগ্রহে ওদের কথায় যোগ দিলেন।

‘আমি কিছুই বুঝলাম না,’ ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে নিয়নের, ‘দাদার সংকেতের সমাধান কী করেছিস, সেটা না বলে হাবিজাবি বলতে লেগেছিস!’

দেবব্রতবাবু তাঁর মেয়েকে বললেন, ‘ও বাবার লেখা সংকেতেরই সমাধান বলছে!’

ঋষি মুচকি হাসল, তারপর আরম্ভ করল, ‘দাদা সংকেতের কাগজের একদম শুরুতেই ইংরেজিতে লিখেছেন : “আই স্ট্রংলি বিলীভ নান”। দেখা যাচ্ছে, এখানে “আই”-এর সাথে সাথে প্রতিটা শব্দের প্রথম অক্ষর ক্যাপিটাল, আর “নান” শব্দটার পুরোটাই ক্যাপিটালে লেখা। এই সেনটেন্সের মাধ্যমে দাদা দু’টো কথা বলেছেন – এক, তিনি নিয়নকে দৃঢ়বিশ্বাস করেন। সেজন্য ঐ এনভেলপটা তিনি ওর হাতেই দিয়েছিলেন, অন্য কারও হাতে নয়। আর দুই, এই পুরো বাক্যটাই একটা সংকেত।’

‘কীসের সংকেত?’ প্রশ্ন করল নিয়ন।

ঋষি খাওয়া শেষ করে টেব্‌ল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ক্যাপিটাল লেটারে লেখা প্রথম অক্ষরগুলোকে পাশাপাশি সাজালে পাওয়া যাচ্ছে একটা কোড – আই.এস্‌.বি.এন্‌., যার ফুল ফর্ম হচ্ছে “ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড বুক নম্বর”। প্রতিটি বইয়ের ব্যাক-কভারের নীচের দিকে তেরো অঙ্কের একটা বার-কোড থাকে, যেখানে সেই বইটির আই.এস্‌.বি.এন্‌. ছাপা থাকে। কিন্তু কোডটা কই?

এরপরই আমার চোখ যায় পরবর্তী সংকেতের দিকে, যা ইংরেজিতে লেখা তেরো অঙ্কের একটি সংখ্যা – ৯৭৮৩৫২৩০৩৩১১২। নিশ্চিত হলাম, এই সংখ্যাটাই কোনও বইয়ের আই.এস্‌.বি.এন্‌.। কোন বই?

এক্ষেত্রে আমায় সাহায্য করলেন গুগ্‌লবাবা! ইন্টারনেটে সার্চ করে মুহূর্তের মধ্যে পেয়ে গেলাম সেই বইটির নাম ; শুনলে তুইও আমার মত অবাক হয়ে যাবি।’

নিয়ন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, উত্তেজনায় তার হাত-পা কাঁপছে।

দু’চোখে দুষ্টুমি-মেশানো কৌতূক নিয়ে ঋষি বলল, ‘অবিলম্ব ঘটকের “নাজেহাল”!’

বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে গেল নিয়নের। সংকেতের সমাধানে “নাজেহাল”! তার যে বিশ্বাসই হচ্ছে না! দেবব্রতবাবুও হতবাক, আর নিয়নের মা হতভম্ব।

ওদের সবার কৌতূহল নিবারণ করতে ঋষি এবার সকলকে দোতলায় ডঃ রায়ের দ্বিতীয় লাইব্রেরীতে আসতে অনুরোধ করল। সেখানে পৌঁছে ও সরাসরি গিয়ে বইটা আলমারি থেকে টেনে বার করে আনল। বইয়ের ব্যাক-কভারের নীচের দিকে ছাপা আছে ওটার আই.এস্‌.বি.এন্‌., ডঃ রায়ের লেখা সেই তেরো অঙ্কের সংখ্যাট!

ঋষি বলল, ‘এই বইটাকে উল্টোভাবে রেখে দাদা প্রথম থেকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। এই বইতেই রয়েছে ওঁর সেই গুপ্তধনের সন্ধান!’

ওর কথা বলার ভঙ্গিমায় নিয়নরা সকলে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে রহস্য-উন্মোচনের জন্য।

‘এই অবধি তো এলাম,’ বলে চলেছে ঋষি, ‘কিন্তু এই সংখ্যাটার নীচে এভাবে জোড়ায় জোড়ায় দাগ দেওয়া কেন? শেষের তিনটি অঙ্কের নীচেই বা দাগ কেন?

সেটা জানার জন্য গতরাতে এই বইটার কিন্ড্‌ল এডিশনটা আমায় চারবার খুঁটিয়ে পড়তে হয়েছে! তাতে বোঝা গেছে, সংখ্যাগুলির তলায় ঐ দাগগুলো কেটে বইটির কয়েকটি পেজ নম্বরের দিকে ইঙ্গিত করেছেন দাদা।’

এবার সে নিয়নের হাতে বইটি তুলে দিয়ে বলল, ‘ঐ পেজ নম্বরগুলো অনুযায়ী পৃষ্ঠাগুলো খুলে দেখ তো, কিছু পাস কিনা!’

বাধ্য ছাত্রীর মত নিয়ন বইয়ের সেই পৃষ্ঠাগুলো একে একে খুলে দেখল। নাঃ, রহস্যময় কিছুই চোখে পড়ল না তার, শুধু লেখা আর লেখা! তার বাবা-মাও দেখলেন একই জিনিস।

‘কিছু পাওয়া গেল না তো?’ বইটা ফেরত নিয়ে একটা পৃষ্ঠা খুলে ঋষি সেটার একটা বিশেষ জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘এবার ভাল করে দেখ। ৯৭ নম্বর পৃষ্ঠার এই সেনটেন্স্‌টা পড়। কী লেখা আছে?’

নিয়ন মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ল, ‘আমার বাড়ি থেকে মণির বাড়ির দূরত্ব ফোর কিলোমিটার।’

‘এবার এই সেনটেন্স্‌টা পড়,’ ঋষি আবার তাকে ৮৩ নম্বর পৃষ্ঠার একটি জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখাল।

নিয়ন একইরকমভাবে পড়ল, ‘ওয়ান পারসেন্ট সুযোগ থাকলেও আমি মণিকে বাঁচাব।’

এরপর ঋষি যথাক্রমে ৫২, ৩০, ৩৩ এবং সবশেষে ১১২ নম্বর পৃষ্ঠারও এক-একটি নির্দিষ্ট বাক্য পড়তে বলল নিয়নকে। পড়া শেষ হলে সে বলল, ‘এই সেনটেন্স্‌গুলোর মধ্যে কতকগুলো কমন ব্যাপার আছে। এগুলো সবই কাহিনীর নায়কের সংলাপ। প্রতিটিতে কোনও একটা বিশেষ সংখ্যা ইংরেজি এককে লেখা, অথচ পৃষ্ঠার অন্য কোথাও আর কোনও সংখ্যা ইংরেজিতে লেখা নেই! যেমন–’ ঋষি এবার নিয়নের হাত থেকে বইটা নিয়ে ঐ পৃষ্ঠাগুলোরই অন্য কয়েকটি বাক্যে আঙুল চালিয়ে দেখাল, ‘এখানে “দু’কেজি”, “ছয় লিটার” কিংবা “এক ব্যাগ” কথাগুলিতে সংখ্যাটা বাংলাতেই লেখা। সেইসঙ্গে এই বাক্যগুলিতে “মণি” নামক চরিত্রটির উল্লেখ রয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য জায়গায় চরিত্রটিকে “প্রিয়মণি” নামে ডাকা হয়েছে। বুঝলি মণিরত্না?’

শেষের কথাটা নিয়নের উদ্দেশে ছুঁড়ে দিয়ে ঘরে পায়চারি করতে লাগল সে, বলল, ‘আমিও এত বড় কাকতালীয় ব্যাপার আশা করিনি, যেখানে এই কমন জিনিসগুলি বইয়ের আই.এস্‌.বি.এন্‌.-এর সাথে পেজ নম্বরের এমন মিল খুঁজে দিতে সাহায্য করবে! সত্যি বলতে, পুরো ব্যাপারটার কৃতিত্ব দিতে হয় দাদাকে, যিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ দিয়ে এ-জিনিসের হদিস দিয়েছেন।’

নিয়নের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ঠাকুরদার জন্যে গর্ববোধ হচ্ছে তার।

‘তা’হলে আমরা কী পেলাম?’ ঋষির স্বরে আবিষ্কারের উত্তেজনা, ‘দাদার সংকেতের সমাধান করে পাওয়া গেল একটা ছয় অঙ্কের সংখ্যা – ফোর-ওয়ান-জ়িরো-সেভেন-থ্রী-সিক্স!’

অবিলম্ব ঘটকের “নাজেহাল” বইটি আলমারিতে রেখে দিয়ে ফের বলতে শুরু করল ঋষি, ‘এবারে আসা যাক দাদার কবিতাটায়। বলা হয়েছে, “নেতাজীর পথে আছে আইনের গাড়ি”। আমি প্রথমে “নেতাজীর পথ” মানে ভেবেছিলাম তাঁর জীবনাদর্শের কথা। তারপর তাঁর এলগিন রোডের বাড়ি থেকে অন্তর্ধানের ঘটনা মনে পড়তেই মাথায় এল তাঁর নামে নামাঙ্কিত কলকাতার দু’টি রাস্তার কথা – লালদিঘির পশ্চিমে এন্‌.এস্‌. রোড আর টালীগঞ্জে এন্‌.এস্‌.সি. বোস রোড। এ-দু’টোর মধ্যে কোনটা আমাদের ধাঁধার “নেতাজীর পথ”?

স্থির করতে না পেরে গেলাম পরের পংক্তিতে। সেখানেও গেলাম আটকে! “আইনের গাড়ি” বলতে কী বোঝানো হয়েছে?

শেষে ফিরে এলাম সেই ছয় অঙ্কের সংখ্যাটাতে। এটা কীসের কোড? আবার গুগল ‌বাবা, সিক্স-ডিজিট কোড। যথারীতি মাথা গুলিয়ে দেওয়া অজস্র উত্তরে ভরে গেল ফোনের স্ক্রীনটা। কিন্তু সেই উত্তরগুলোর মধ্যেই পাওয়া গেল কাঙ্ক্ষিত শব্দটি, আর সেটা এতটাই সাধারণ ও সাবলীলভাবে লেখা রয়েছে কবিতায়, যার জন্য চট করে বোঝা যায়নি!’

নিয়ন উত্তেজনাভরে প্রশ্ন করল, ‘কী শব্দ?’

‘লকার,’ বলল ঋষি, ‘“আইন” হচ্ছে “ল”, আর “গাড়ি” হল “কার”। সুতরাং “আইনের গাড়ি” বলতে কোনও লকারের কথাই বলা হয়েছে, এবং ঐ ছয় অঙ্কের কোডই হল সেই লকার খোলার চাবি!’

দেবব্রতবাবু বললেন, ‘কিন্তু ঋষি, বাবার তো কোনও ব্যাঙ্কে লকার নেওয়া নেই!’

‘আমি তো ব্যাঙ্কের লকারের কথা বলিনি, কাকু!’ সকলকে চমকে দিয়ে বলল সে, ‘ব্যাঙ্কের লকার চাবি দিয়ে খুলতে হয়। এখনও সেখানে ডিজিটালাইজ়েশন হয়নি! দাদার লকার সেই ছয় অঙ্কের কোড দিয়ে খুলতে হয়, পুরোপুরি ডিজিটালাইজ়ড।’

খানিক বিরতি নিয়ে সে পুনরায় সংকেতের বাকি অংশের সমাধানের দিকে এগোল, ‘দাদার সেই লকার রয়েছে নেতাজীর নামাঙ্কিত রাস্তায়। কলকাতাতে ব্যাঙ্ক বা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়, এরকম একটিই সংস্থা আছে, যারা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন লকার ভাড়া দেয় – ক্যালকাটা সেফ ডিপোজ়িট কোম্পানী লিমিটেড। এই সি.এস্‌.ডি. এন্‌.এস্‌. রোডে অবস্থিত, আর.বি.আই.-এর কিছু পরেই। মজার বিষয় হল, সি.এস্‌.ডি.-র সমস্ত লকার সিক্স-ডিজিটের কোড দিয়েই খুলতে হয়! অতএব দু’য়ে-দু’য়ে চার।

এর পরের পংক্তিগুলোর মানে বোঝা খুবই সহজ। “নাক বরাবর পাঁচে ভূতলের সারি” – সি.এস্‌.ডি.-র গ্রাউন্ড ফ্লোরের স্ট্রংরুমে ঢুকেই সোজা পাঁচ নম্বর লকার। তারপর “বই থেকে বার করা ছয় ভাই জানে”, মানে “নাজেহাল” থেকে খুঁজে পাওয়া ঐ ছ’অঙ্কের কোড, আর সবশেষে “গাড়ির দরজা পড়া” এবং “‘কী’ যে তার মানে” বোঝাচ্ছে যে সেই কোডই হল লকার খোলার ‘কী’ বা চাবিকাঠি!’

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ঋষি থামল এবার। তার চোখে-মুখে অমন একটা জটিল সংকেতের মানে উদ্ধার করার আনন্দ ফুটে বেরচ্ছে!

* * *

আজ ডঃ দেবশঙ্কর রায় অনেকখানি সুস্থ। খুব দ্রুত তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাঁকে ভিজ়িটিং আওয়ার শুরু হওয়ার আগেই ই.ই.ডি.এফ্‌.-এর এইচ্‌.ডি.ইউ.-তে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।

ভিজ়িটিং আওয়ারে ওঁকে দেখতে এসেছিলেন ডঃ তথাগত দেবশর্মা। ঐ অবস্থাতেও ওঁদের দু’জনের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ দেখে মনে হচ্ছিল যেন বহুদিনের বিরাগের পরে গুরু-শিষ্যের মিলন হল!

ভিজ়িটর্স্‌ লবিতে কথায় কথায় জানা গেল, দেবশর্মা তাঁর ব্যক্তিগত কারণে অ্যাম্পিয়ারে জয়েন করেছিলেন – ‘আমি ভাবতাম, স্যারের আবিষ্কৃত থিয়োরি, তাঁরই গবেষণা, আমি তো শুধুমাত্র পেপারটা লেখার কাজই করেছি! অতএব ও-কাজে আমার কৃতিত্ব আমি দাবি করি কীভাবে? সেজন্যই তো পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ করেই চাকরিটা ছেড়ে দিই।’

এরপর চরম বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন তিনি, ‘অথচ, স্যার আমার ওটুকু অবদানের কথা মাথায় রেখে অত মূল্যবান একটি গবেষণা প্রকাশই করলেন না! ওঁর ইচ্ছে ছিল, গবেষণাপত্রে আমাদের দু’জনেরই নাম থাকুক, “থিয়োরি ওয়ান”-এর কৃতিত্বের শিরোপা আমাদের দু’জনের মাথাতেই উঠুক।’

পরিশেষে আক্ষেপের সুরে তিনি বললেন, ‘এ-ক’টা বছর আমি স্যারকে ভুল বুঝেছি! অহঙ্কারে আমি এতটা মূর্খ বনে গেছিলাম?’

ভদ্রলোকের দু’চোখ ছলছল করে উঠল।

দেবব্রতবাবু দেবশর্মাকে ওঁদের “থিয়োরি ওয়ান”-এর পাণ্ডুলিপির সন্ধান জানিয়ে দিলেন, সাথে এও বললেন যে ঋষি ও নিয়ন মিলে সেটা খুঁজে বের করেছে।

ঋষির সমাধান করা ডঃ রায়ের সংকেতের সূত্র ধরে নির্ভুলভাবেই এন্‌.এস্‌. রোডে ক্যালকাটা সেফ ডিপোজ়িট কোম্পানী লিমিটেডের গ্রাউন্ড ফ্লোরের স্ট্রংরুমের পাঁচ নম্বর লকার খুলে উদ্ধার হল কয়েকশো পাতার বিশাল মোটা একখানা কাগজের পুঁথির মত “থিয়োরি ওয়ান”-এর পাণ্ডুলিপি।

* * *

ডঃ দেবশঙ্কর রায় এবং ডঃ তথাগত দেবশর্মার যৌথ গবেষণার পাণ্ডুলিপির পুনরুদ্ধারের প্রায় বছরতিনেক বাদে নানাস্তরের মূল্যায়ন ও পরীক্ষণে উত্তীর্ণ হওয়ার পর “থিয়োরি ওয়ান” গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল। তার একটি সংস্করণ ও এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে দেবশর্মা নিয়নদের বাড়ির বৈঠকখানায় প্রবেশ করলেন। সেখানে ডঃ রায় ও তাঁর পরিবারের সকলে উপস্থিত, আর ঋষিকে উনি নিজেই ফোন করে সেখানে আসতে বলেছিলেন।

দেবশর্মা এবারও ডঃ রায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে “থিয়োরি ওয়ান”-এর গ্রন্থ-সংস্করণটি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘স্যার, আপনার জন্যেই আমি এত বড় একটা গবেষণার ভাগীদার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। এই নিন আপনার সম্পদ – আধুনিক সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং-এর মহামূল্যবান গবেষণাপত্র “থিয়োরি ওয়ান”।’

ডঃ রায় দেবশর্মার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘এই সম্পদ আমার একার নয়, তোমারও। আমি তো তোমার উপর অভিমান করে সেই পাণ্ডুলিপি অতলেই তলিয়ে দিয়েছিলাম! তুমিই আবার সেটা উদ্ধার করার কাজে প্রধান অনুঘটকের কাজ করেছ।’

দেবশর্মা লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলেন।

ঋষি-নিয়ন একে-অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে মিটিমিটি হাসল। এক আন্তর্জাতিক স্তরে সুবিখ্যাত সংস্থার সর্বপ্রধানও সুবোধ ছাত্রের মত তাঁর গুরুর সামনে গুটিসুটি হয়ে যান!

দেবশর্মা ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে এবার মাথা সোজা করে বলে উঠলেন, ‘স্যার, আপনার পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করার পুরো ক্রেডিটটা আসলে ঋষিরাজ আর মণিরত্নারই প্রাপ্য! ওদেরই যৌথ উদ্যোগে আপনার দেওয়া সংকেতের সমাধান করা সম্ভব হয়েছিল।’

‘অবশ্যই,’ বললেন ডঃ রায়, ‘অবিলম্ব ঘটকের বই থেকে কোডটা খুঁজে বের করতে হলে কতটা বুদ্ধি ধরতে হয় আর কতখানি নাজেহাল হতে হয়, সেটা ওদের চেয়ে ভাল আর কে জানে!’ একটু থেমে তিনি ওদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমাদের দুই ক্ষুদে গোয়েন্দা এই কেস থেকে কী পেলেন?’

ঋষি ও নিয়ন তিন বছর পুরনো সেই সমাধানের কাগজটা সবার চোখের সামনে তুলে ধরে সমস্বরে বলে উঠল, ‘এই কাগজটা আমাদের গোয়েন্দাগিরির প্রথম পাণ্ডুলিপি! এটা আমরা সারাজীবন সযত্নে রেখে দেব।’

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post জলে জঙ্গলে | বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | চিরঞ্জিৎ সাহা| Bengali Detective Story
Next post উত্তরাধিকারী কে? | বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | শতরূপা ভট্টাচার্য্য | Bengali Detective Story